Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লুই পাস্তুর: একজন নিরহংকার, দেশপ্রেমী বিজ্ঞান-তপস্বী

দৃশ্যপটের একদিকে এক ব্যক্তি টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে আপন মনে কাজ করে চলেছেন, অন্যদিকে ফ্রান্সের প্যারিসের একটি চার্চে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। কনেপক্ষের প্রায় সকলে কনেকে নিয়ে অনেক আগেই উপস্থিত। পাত্রপক্ষের অনেকেই ইতিমধ্যে উপস্থিত। কিন্তু সকলের সময় কাটছে অধীর উৎকণ্ঠায়। কারণ বর এখনও উপস্থিত হননি। 

চার্চের পাদ্রীও অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। কিন্তু বরের কোনো দেখা নেই। কনের বাবা মঁসিয়ে লরেস্টের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কিছুটা দুর্ভাবনায় নিমগ্ন ও অধীর উৎকণ্ঠায় কনের বাবা বরের এক বন্ধুকে জরুরি তলব করলেন, কী ব্যাপার, এখনও তো তোমার বন্ধু এলো না? পথে কোনো বিপদ হয়নি তো? বিয়ের আসরে বরের খোঁজ নেই! 

শুরু হলো বরের খোঁজ। দু-চার জায়গায় খোঁজ করেও বরের কোনো খোঁজ খবর মিলল না। বিয়ের আসরে না এসে বন্ধু কোথায় যেতে পারে; এমন চিন্তায় নিমগ্ন বন্ধুটির হঠাৎ মনে পড়ে, বন্ধু তো তার দারুণ কাজপাগল! তাই একবার ল্যাবরেটরিতে গিয়ে খোঁজ করি, ওখানে থাকলেও তো থাকতে পারে। ঠিক যেমন ভাবা, তেমন কাজ। এবার তার আন্দাজ মোটেই ভুল নয়, সঠিক। 

ল্যাবরেটরিতে একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছে বর, বিয়ের কথা তো ভুলেই গেছে। নিজের কাজ ব্যতীত নিজের বাহ্যিক পরিবেশের প্রতি এতই বেখেয়ালি যে, তার বন্ধুর পায়ের শব্দও তার শ্রবণযন্ত্রে কোনো সারা জাগায় না, ভাঙে না তার তন্ময়তা। বন্ধুটি আর সহ্য করতে না পেরে প্রচন্ড রাগে চেঁচিয়ে ওঠে, আজ না তোর বিয়ে, সবাই অপেক্ষা করছে আর তুই এখানে আপনমনে কাজ করে যাচ্ছিস! প্রত্যুত্তরে বরের জবাব, বিয়ের কথা আমি ঠিক ভুলে যাইনি, তবে কাজটা শেষ না করে কী করে বিয়ের আসরে যাই! 

বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগী এবং কাজ পাগল এই ব্যক্তি লুই পাস্তুর। আমাদের নিকট যিনি পরিচিত জীবাণুবিদ্যার জনক হিসেবে, যার সম্বন্ধে তৃতীয় নেপোলিয়ন অকপটে বলেছেন, ফ্রান্সের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান।

বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর; Image Source: Wikipedia

১৮২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ক্রিসমাস পর্বের দুদিন পর ফ্রান্সের জুরা প্রদেশের দোল শহরের এক দরিদ্র ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লুই পাস্তুর। তবে তিনি বেড়ে উঠেন আরবোয়া শহরের পরিবেশে। তিনি জিন-জোসেফ পাস্তুর এবং জ্যানি-এটিয়েনেট রোকি দম্পত্তির তৃতীয় সন্তান। 

লুইয়ের বাবা প্রথম জীবনে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর সেন্যাধ্যক্ষ ছিলেন। এই বিষয়টি সম্ভবত শিশু পাস্তুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছিল। কারণ তিনি তার বাবার মতোই দেশপ্রেমিক ছিলেন। 

পরবর্তীতে বাবা নিজের গ্রামে ফিরে এসে একটি ছোট ট্যানারি কারখানা গড়ে তোলেন। ট্যানারি কারখানায় কাজ করতে করতে তিনি প্রায় সময় ভাবতেন, যদি তিনি পড়াশোনা করার সুযোগ পেতেন, তাহলে হয়তো তাকে দুর্গন্ধযুক্ত মরা জীব-জন্তুর চামড়া পরিষ্কার করে দিন অতিবাহিত করতে হতো না। অন্যদিকে তার মা এটিয়েনেট পেশায় ছিলেন বাগানের মালিনী। 

যখন লুইয়ের বাবা যোসেফ জানতে পারলেন তার ঘরে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে, তখন তিনি খুব আনন্দিত ছিলেন এই ভেবে যে, তিনি পড়াশোনা করতে না পারলেও তার পুত্রকে উপযুক্ত শিক্ষালাভের সকল সুযোগ করে দেবেন। 

 

শিক্ষা ও কর্মজীবন

১৮৩১ সালে পাস্তুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডিতে প্রবেশ করেন। এই সময় তিনি বিদ্যালয়ের গৎবাধা পড়াশোনার প্রতি তেমন মনোযোগী ছিলেন না। বরং পড়াশোনার বদলে এ সময় তার বিশেষ আগ্রহের জায়গা ছিল মাছ ধরা এবং স্কেচিং করা। তার পরিবার ইতিমধ্যে নিজগ্রাম পরিত্যাগ করে করে বেসানকনের কাছে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে পাস্তুর বেসানকনের একটি স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বেশ কয়েক বছর স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পর ১৮৩৮ সালের অক্টোবরে পেনশন বারবেটে ভর্তির উদ্দেশ্যে প্যারিসে চলে যান। 

কিন্তু মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা পাস্তুরকে পারিস শহরের একঘেয়ে জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে বেশ কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। যার কারণে শহরের বন্ধ পরিবেশে মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। স্মৃতিচারণ করে তিনি একবার এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “যদি আবার বুক ভরে চামড়ার গন্ধ নিতে পারতাম, কয়েক দিনেই আমি সুস্থ হয়ে উঠতাম।”

পাস্তুর প্যারিসের নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি। যার কারণে নভেম্বরেই প্যারিস ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসেন। ফিরে এসে ১৮৩৯ সালে উচ্চতর ডিগ্রী লাভের উদ্দেশ্যে রয়্যাল কলেজে ভর্তি হন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৮৪০ সালে দর্শনশাস্ত্রে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রী অর্জন করেন। নিজের কলেজেই তিনি একদিকে গণিতে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন, অন্যদিকে বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জনের জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এর ঠিক দুই বছর পর ১৮৪২ সালে রসায়নশাস্ত্রে ব্যাচেলর অব সাইন্স ডিগ্রী অর্জন করেন। 

১৮৪২ সালে ইকোল নরমলে সুপারভাইয়ার প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। তিনি প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তবে তার র‌্যাঙ্কিং কম ছিল। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন পরবর্তী বছর আবার পরীক্ষা দেবার। যে প্যারিস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, সেই প্যারিসে তার পুনরাগমন ঘটে। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য তিনি পেনশন বারবেটে ফিরে যান। ১৮৪৩ সালে ভাল ফলাফল নিয়েই পাস করেন এবং ইকোল নরমলে সুপারভাইয়ারে প্রবেশ করেন। ১৮৪৫ সালে তিনি বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। 

১৮৪৬ সালে টর্নন কলেজ (Collège de Tournon)-এ পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে পাস্তুরের অন্যতম প্রিয় একটি বিষয় ছিল রসায়ন। তিনি এই সময় পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৮৪৭ সালের মধ্যে তিনি তার দুটি থিসিস জমা দেন, একটি ছিল রসায়নে এবং অন্যটি পদার্থবিদ্যায়। কিছুদিন ডিজন লাইসিতে (Dijon Lycée) পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনা করার পরে ১৮৪৮ সালে স্ট্র্যাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনা করার ডাক পান। এই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেন পাস্তুর। তার সুপ্ত প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে একবার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তিনি একজন কৃতী শিক্ষক হবেন, আর হয়েছিলও তা-ই।

ইকোল নরমলে সুপারভাইয়ার স্কুলে লুই পাস্তুর পরীক্ষাগার; Image Source: himetop.wikidot.com

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর মঁসিয়ে লরেস্টের গৃহে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ১৮৪৯ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেন মঁসিয়ে লরেস্টের ২৩ বছর বয়সী ছোট মেয়ে মেরি লরেন্তেকে। তিনি শুধু তার স্ত্রী হিসেবেই যোগ্য ছিলেন না, ছিলেন একজন যোগ্য সহচরী। বিজ্ঞান-তপস্বী স্বামীর সাধনায় নিজেকেও যুক্ত করেছিলেন মেরি। পাস্তুর তার নিজ স্ত্রী সম্পর্কে গর্ব করে বলতেন, একজন স্ত্রী হবার জন্য যত গুণাবলী দরকার তার সবই আমি তার মধ্যে খুঁজে পাই। এই দম্পত্তির ঘর আলো করে জন্ম নেয় পাঁচ সন্তান, এদের মধ্যে তিনজন শৈশবে টাইফয়েডের কারণে মারা যায়। ব্যক্তিগতভাবে নির্মম এ ঘটনায় হতোদ্যম না হয়ে বরং এর প্রতিকারে মনোনিবেশ করেন তিনি। 

পরিবারের সাথে লুই পাস্তুর; Image Source : connexionfrance.com

মানবকল্যাণে বিজ্ঞান-তপস্বী পাস্তুরের কৃতিত্ব 

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের গবেষণায় নিজেকে উৎসর্গ করা বিজ্ঞানীদের মধ্যে লুই পাস্তুর অন্যতম। সেকালে দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের (ফ্রান্স ও জার্মানি) রাষ্ট্রপ্রধানরা যখন পরস্পরকে শত্রু বিবেচনা করে একে অন্যের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ, ঠিক তখন এই বিজ্ঞানী দিন রাত এক করে, সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে নিজেকে গবেষণায় মগ্ন রেখেছিলেন। তার আবিষ্কার কখনও বাঁচিয়ে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ জীবন, কখনো বা পুনরুদ্ধার করেছে প্রায় ডুবতে বসা ব্যবসা, কারও জীবনে এনে দিয়েছে স্বস্তির নিঃশ্বাস। চলুন, জেনে নেওয়া যাক লুই পাস্তুরের যুগান্তকারী এমনই কিছু আবিষ্কার সম্বন্ধে, যা ধীরে ধীরে আমাদের জীবনযাপনের ধারাকে বদলে দিয়েছে। 

মদ শিল্প 

মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে লিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগের ডিন এবং প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন লুই পাস্তুর। তখন ছিল দামী মদ তৈরিতে ফ্রান্সের বিশ্বব্যাপী বেশ খ্যাতি ছিল। আর সেই সুবাদে লিলের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য মদ তৈরির কারখানা। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে মদ টকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এতে শুধুমাত্র মদ ব্যবসায়ীরাই নয়, সরকারও প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। কারণ, সরকার মদ থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব পেত। 

মদ নষ্ট হবার কারণ অনুসন্ধানের দায়িত্ব এসে বর্তায় লুই পাস্তুরের উপর। তিনিও কাউকে নিরাশ করেননি। কঠোর পরিশ্রম করে গেলেন এবং অবশেষে সফল হলেন।

মদ নষ্ট হবার জন্য দায়ী ছিল একধরনের ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া। শুধু মদ নষ্ট হবার কারণ অনুসন্ধান করেই হননি, এই সমস্যা হতে পরিত্রাণের উপায়ও বের করে ফেললেন। তিনি মদকে ১২০° ফারেনহাইট তাপমাত্রায় গরম করার পরামর্শ দিলেন। এতে ক্ষতিকর জীবাণু নষ্ট হয়ে যাবে। তার এই আবিষ্কারের কারণে ফ্রান্সের লক্ষ লক্ষ টাকার মদের ব্যবসা রক্ষা পায়। তার এই আবিষ্কার আজ পৃথিবী জুড়ে পাস্তুরাইজেশন (Pasteurization) নামে সমাদৃত। তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কার পরবর্তীতে বহুজন চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য কাজে লাগিয়েছেন।

পাস্তুরাইজেশন পরীক্ষাটি ছিল রোগের জীবাণুতত্ত্বের ধারণাকে সমর্থনকারী প্রমাণের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ; Image Source: Wikipedia

রেশম শিল্প পুনরুদ্ধার

সেকালে ফ্রান্সের অন্যতম প্রধান একটি শিল্প ছিল রেশম শিল্প। কিন্তু কোনো এক অজানা রোগে হাজার হাজার গুটিপোকা নষ্ট হচ্ছিল। এই নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। তবে কেউ এর কারণ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেননি। ১৮৬৫ সালে ফরাসি সরকারের শেষ ভরসার জায়গা পেলেন পাস্তুর।

দিনে টানা আঠারো ঘণ্টা কাজ করে গেলেন, খুব স্বল্পই বিশ্রাম নিতেন। টানা তিন বছর নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে এই রোগের কারণ ও সমাধান দুই-ই আবিষ্কার করে ফেললেন। পাস্তুর লক্ষ্য করেন, রেশম পোকার এই সমস্যাটি বংশগত অর্থাৎ মায়ের থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সংক্রামিত হয়। তাই তিনি কেবলমাত্র রোগমুক্ত গুটি বাছাই করার প্রস্তাব করেন। 

তার এই সিদ্ধান্তে ঠাট্টা-বিদ্রূপ আসলেও তিনি ছিলেন তার সিদ্ধান্তে অটল। যার সুফল সেই বছর রেশম চাষীরা পেয়েছিল। এই অমানুষিক পরিশ্রমের বিনিময়ে যৎসামান্য পারিশ্রমিক লাভ করলেও তার এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না, দুর্দিনে দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছিলেন এতেই তার আত্মতৃপ্তি। 

গুটি পোকা বা রেশম পোকা; Image Source : hobbyfarms.com

জীবাণু তত্ত্ব

১৮৬৭ সালে পাস্তুর সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এসময় তিনি জীবাণু তত্ত্ব (Bacteriology) নিয়ে তার গবেষণা শুরু করেন। তার তত্ত্বে দেখান, অণুজীব দ্বারা কিছু রোগ সংঘটিত হতে পারে এবং সেগুলো পানি ও বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পরতে পারে। তার এই তত্ত্বের মূল কথা ছিল, অনুজীব কোনো বৃহদাকার জীবের শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম।

পোল্ট্রি শিল্প

ফ্রান্সে মুরগির মধ্যে ব্যাপক আকারে কলেরার প্রভাব দেখা দিত। খুব স্বল্প সময়ে তা মহামারি আকারে পার্শ্ববর্তী ফার্মে ছড়িয়ে পড়ছিল। এতে পোলট্রি ব্যবসা বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। তিনি এই বিষয় নিয়ে বিচলিত না হয়ে অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে দেন। 

গবেষণা করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন অ্যানথ্রাক্স ব্যাসিলি নামক একটি জীবাণু এই মহামারির জন্য দায়ী এবং এই জীবাণু অ্যানথ্রাক্স (Anthrox) রোগের কারণ। যার কারণে চারদিকে গবাদি পশুর মৃত্যু অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তিনি এই রোগের প্রতিষেধকও আবিষ্কার করে ফেললেন। এক্ষেত্রে তিনি কিছু নিষ্ক্রিয় জীবাণু ভেড়ায় মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে দেখেন এগুলো পরবর্তীতে আর রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম জীবাণু দিয়ে সংক্রমিত হয় না। আর এভাবেই বেঁচে যায় ফ্রান্সের পোল্ট্রি শিল্প। 

হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্ক

অ্যানথ্রাক্সের প্রতিষেধক আবিষ্কারের পরে পাস্তুর হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্ক নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। তার জীবনে করা শ্রেষ্ঠ গবেষণা ছিল এটি। হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্ক ছিল সে যুগের এক আতঙ্কের নাম। কোনো মানুষকে পাগলা কুকুর কামড়ালে অধিকাংশ সময়েই সেই ক্ষত কিছুদিনেই মধ্যেই শুকিয়ে যেত। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরেই প্রকাশ পেত হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্কের লক্ষণ। অনেকেই এই রোগ নিয়ে গবেষণা করছিলেন, কিন্তু কেউ তখন পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। 

জলাতঙ্ক নিয়ে গবেষণারত পাস্তুর: Image Source: angelfire.com

তিনি আবিষ্কার করেন জলাতঙ্ক আক্রান্ত কোনো পশু স্পাইনাল কর্ডের নির্যাসের মাধ্যমে অপর কোনো প্রাণীকে জলাতঙ্কে আক্রান্ত করতে সক্ষম। তিনি প্রাণীদেহে রোগ তৈরিতে অক্ষম এমন কিছু জলাতঙ্ক ভাইরাস উৎপাদন করে তা পশুর দেহে প্রয়োগ করেন এবং অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেন।

এবার মানুষের শরীরে এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা বাকি ছিল। পাস্তুর সেই সুযোগটাও পেয়ে যান। একজন ছেলেকে তার মা পাস্তুরের গবেষণাগারে নিয়ে আসে। ছেলেটিকে জলাতঙ্ক আক্রান্ত একটি কুকুর কামড়িয়েছিল, পাস্তুর বুঝলেন ছেলেটি আর বেশিদিন বাঁচবে না। অবশেষে পাস্তুর তাকে টিকা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে ছেলেটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে পাস্তুরের এই অবিস্মরণীয় আবিষ্কারের কথা।

দেশপ্রেমিক পাস্তুর 

দেশের প্রতি লুই পাস্তুরের মনে ছিল গভীর ভালোবাসা। জার্মান বাহিনী ফ্রান্স আক্রমণ করলে তিনি ফ্রান্সের সেনাদলে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু অমানবিক শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের কারণে তিনি ফ্রান্স সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি। যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারলেও জার্মান বাহিনীর আগ্রাসন কিছুতেই মুখ বুজে সহ্য করতে পারেননি তিনি। 

জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব মেডিসিন উপাধি প্রদান করেছিল। কিন্তু ফ্রান্সে জার্মান বাহিনীর আগ্রাসনের নিন্দাস্বরূপ তাকে দেওয়া উপাধি গ্রহণে অসম্মতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেন।

 তিনি মানবকল্যাণে নিয়মিত কাজ করে পরিশ্রম করে গেছেন, বিনিময়ে খুব স্বল্পই নিয়েছেন। কিন্তু লোকমুখে এমনও কথা প্রচলিত আছে যে, এক জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধের কারণে ফ্রান্সের যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল, শুধুমাত্র লুই পাস্তুরের অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রতিষেধক ফ্রান্সকে তার থেকে বেশি অর্থ এনে দিয়েছিল। অথচ লুই শুধু নিজ দেশের দুর্দিনে কিছু করতে পেরেছিলেন- এটাই ভেবে সন্তুষ্ট ছিলেন। 

তৃতীয় নেপোলিয়নের দরবারে সম্রাট পাস্তুরের কাছে তার পারিশ্রমিক সম্পর্কে জানতে চান। তার উত্তরে সম্রাট আশ্চর্য হয়ে এত বেশি পরিশ্রম করে, এত কম পারিশ্রমিক নেওয়ার কারণ জানতে চান। সম্রাটের প্রশ্নের উত্তরে তার জবাব ছিল অনেকটা এমন, “একজন বিজ্ঞানী কখনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কাজ করে না।”

নিজের ল্যাবরেটরিতে গবেষণারত লুই পাস্তুর; Image Source: Wikipedia

আমাদের জন্য খুব পরিতাপের বিষয় মানব কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা এই বিজ্ঞানী সম্পর্কে আমরা খুব সামান্যই জানি। ফ্রান্সের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানের সত্তরতম জন্মদিনে ফ্রান্স সরকার জাতীয় ছুটি ঘোষণা করে। দেশ-বিদেশ থেকে আগত সকলের উদ্দেশ্যে সরবনের সেই আনন্দ অনুষ্ঠানে নিরহংকার, সরল, সাদাসিধে মনের লুই পাস্তুরের ভাষ্য ছিল,

আমি সমস্ত জীবন ধরে বিশ্বাস করেছি, একমাত্র বিজ্ঞান আর শান্তির চেতনাই পারে সমস্ত অজ্ঞতা আর যুদ্ধের বিভীষিকাকে দূর করতে। বিশ্বাস করুন, একদিন সমস্ত দেশই সম্মিলিত হবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তি-সহযোগিতার পক্ষে থাকবে; আর সেই ভবিষ্যৎ হবে বর্বরদের নয়, শান্তিপ্রিয় মানবজাতির।

পদক ও সম্মাননা 

পাস্তুর রেসমিক অ্যাসিড সংশ্লেষণের জন্য ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটি কর্তৃক ১৮৫৩ সালে ১,৫০০ ফ্রাঙ্ক অর্জন করেন। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি তাকে ১৮৫৬ সালে রেসমিক অ্যাসিডের প্রকৃতি এবং আলোর পোলারাইজেশনের সাথে এর সম্পর্ক আবিষ্কারের জন্য রামফোর্ড পদক এবং ১৮৭৪ সালে রাসায়নিক গাঁজন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণার কারণে তাকে কোপালি পদকে ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির (ফরমেমআরএস) বিদেশি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

ফ্রেঞ্চ একাডেমি অফ সায়েন্সেস ১৮৬০ সালে পরীক্ষামূলক শারীরবৃত্তির জন্য পাস্তরকে মন্টিওন পুরস্কার, ১৮৬১ সালে জ্যাকার পুরষ্কার এবং ১৮৬২ সালে আলহম্বার্ট পুরষ্কারে ভূষিত করে। তিনি ফ্রেঞ্চ একাডেমি অফ সায়েন্সেসের সদস্যপদের জন্য ১৮৫৭ এবং ১৮৬১ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হলেও ১৮৬২ সালের নির্বাচনে মিনেরালজি বিভাগে সদস্যপদে জয়লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ভৌত বিজ্ঞান বিভাগের স্থায়ী সচিব নির্বাচিত হন এবং ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। 

১৮৮৬ সালের ৮ জুন অটোমান সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ পাস্তুরকে মেডিজিডির অর্ডার (প্রথম শ্রেণী) এ ভূষিত করেন এবং ১০,০০০ অটোম্যান লিরা পুরস্কার দেন। পাস্তুর ১৮৫৩ সালে লিজিয়ন অফ অনারের শেভালিয়ার হন এবং তার বুদ্ধিমত্তার কারণে ক্রমেই পদোন্নতি লাভ করেন। ১৮৬৩ সালে অফিসার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। এর পাঁচ বছর পর ১৮৭৮ সালে গ্র্যান্ড অফিসার এবং ১৮৮১ সালে লিজিয়ন অফ অনার গ্র্যান্ড ক্রস পদে আসীন হন। ১৮৮৭ সালে তার সম্মানে গড়ে তোলা হয় পাস্তুর ইন্সটিটিউট।

এছাড়াও পাস্তুর নিজ জীবদ্দশায় ক্যামেরন পুরস্কার, লিউভেনহোক মেডেলসহ আরো অসংখ্য সামরিক ও বেসামরিক পদক, উপাধি, সম্মাননা ও পুরষ্কারে ভূষিত হন। 

পাস্তুর ইনস্টিটিউট; Image Source: Wikipedia

এত এত অর্জন, নাম-ডাক ও আবিষ্কারের কারণে কিছু মানুষের মনে তিনি বিষফোড়া হয়ে উঠেছিলেন। তারা কারণে-অকারণে পাস্তুরের নানা দোষ কীর্তন করতেন। কিন্তু নিজের কাজ ফেলে নিন্দা হোক কিংবা প্রশংসা উভয় ক্ষেত্রেই এই বিজ্ঞানী ছিলেন সমানতালে উদাসীন। 

কোনো এক সভায় তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। কিন্তু গুরিয়েন ডুয়েল নামের এক চিকিৎসকের কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না যে, কীভাবে একজন রসায়নবিদ চিকিৎসাবিদ্যার উপদেশ দিতে পারেন! নানা প্রশ্ন জালে জর্জরিত করতে লাগলেন পাস্তুরকে। কিন্তু পাস্তুর মোটেই রাগন্বিত হলেন না। এতে আরো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল সেই চিকিৎসক। তাকে সেই সভা থেকে বের করে দেওয়া হলো। 

পরবর্তী দিন তিনি পাস্তুরকে লড়ার জন্য আহ্বান জানালেন। কিন্তু তার সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়ে পাস্তুর সোজা-সাপ্টা জানিয়ে দিলেন, “আমার কাজ জীবন দান করা, হত্যা করা নয়।”

শারীরিক অসুস্থতাও যাকে পারেনি থামাতে

১৮৬৮ সালে পাস্তুর এক গুরুতর স্ট্রোকের শিকার হন। তিনি প্রাণে বেঁচে যান বটে, তবে তার দেহের বাম দিক পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়। এই দফায় ভাগ্য সহায় থাকায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। 

১৮৯৪ সালের দিকে আবার একটি স্ট্রোক বা ইউরেমিয়ার কারণে পাস্তুরের স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তাররাও তার জীবনের আশা ত্যাগ করেছিল। নিষ্ঠার সাথে কর্মমগ্ন থাকা মানুষটির শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছিল। কিন্তু শত শারীরিক অসুস্থতাও তাকে কাজ থেকে দূরে রাখতে পারেনি।

রোগ থেকে পুরোপুরি সেরে উঠতে ব্যর্থ বিজ্ঞানীর একসময় ভবলীলা সাঙ্গ হয়। পাস্তুর ইনস্টিটিউটের পরিচালক থাকাকালে ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্যারিসের নিকটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নটরডেম ক্যাথেড্রালে চির নিদ্রায় শায়িত হন বিজ্ঞান-তপসী লুই পাস্তুর। তার দেহাবশেষ প্যারিসের পাস্তুর ইনস্টিটিউটে স্থানান্তরিত করা হয়।

তার সম্পর্কে আরো জানতে পড়তে পারেন বই। অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন এই লিংকে- লুই পাস্তুর

Related Articles