মিনিমালিজম। হাল জমানার সাড়া জাগানো এক ট্রেন্ড। নিত্যপ্রয়োজনীয় যেকোনো দ্রব্য, ঘরবাড়ি গোছানো, আসবাবপত্র, পণ্যের নকশা, জীবনযাপনের ধরন, সবকিছুতে ‘কমই শ্রেয়’ দর্শনের অনুসারী হওয়াকেই বৃহৎ অর্থে সকলে মিনিমালিজম বলছে। সত্যিই কি তা মিনিমালিজম? মিনিমালিজম বলতে কি শুধুই জিনিসপত্র বেচে দেওয়াকে বোঝায়? কিংবা শুধু নগণ্য সংখ্যক আসবাবপত্র রাখতে পারলেই কি মিনিমালিস্ট হওয়া যায়?
শিল্পে বা চিত্রকলায় মিনিমালিজমের চর্চা শুরু হয়েছিল মূলত বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। ১৯৬০ এর দিকে নিউ ইয়র্কের চিত্রশিল্পীরা সে আমলের চিত্রকলাকে প্রত্যাখ্যান করা শুরু করলেন। শিল্প বা চিত্রকলার নামে যা হচ্ছে, সেগুলো মূলত পুরোটাই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার জন্য এবং অনেকটাই বাসি হয়ে গেছে- এমনটাই ছিল তাদের বক্তব্য। পুরনো হয়ে যাওয়া, ঘুণে ধরা এবং আবেদন হারানো শিল্পের জগতে তারা আনতে চাইলেন নতুনের আবাহন। শিল্পের প্রচলিত বিভিন্ন মাধ্যমগুলোতে অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের বাড়াবাড়িকে তারা বললেন বিরক্তিকর। শিল্পের সবকিছুতেই নানান কিছু দিয়ে বিমূর্ত এক বা একাধিক ভাবনাকে প্রকাশের চর্চাকে তাদের কাছে মনে হলো বাহুল্য।
এরই ধারাবাহিকতায় তরুণ শিল্পীরা তাদের নিজ নিজ কাজের জগতে প্রতীক, রূপক, বিমূর্ত ধারণা এবং স্থূল উপাদানের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হওয়া শুরু করলেন এবং তুলনামূলকভাবে সূক্ষ্ম কাজের প্রতি তারা মনোযোগ দিতে লাগলেন। যতটা সম্ভব কম উপাদান, কম টেকনিক ব্যবহার করে শিল্প বিনির্মাণের এ চর্চা আলোড়ন সৃষ্টি করে ১৯৭০ এর শেষ দিকে। শিল্পীদের কাজকর্মের সাথে জাদুঘর কিউরেটর, ক্রেতা-বিক্রেতা, নিবন্ধ প্রকাশনা সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহের অনুদানে অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের শিল্প জগৎ এক অভাবনীর সাফল্যের দেখা পেল মিনিমালিজম চর্চায়।
প্রারম্ভিকে মিনিমালিজম যেমন ছিল:
- মিনিমালিজমের চর্চা যারা শুরু করেছিলেন, তারা সম্পূর্ণ অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্টদের চেয়ে ভিন্ন ঘরানার শিল্পী ছিলেন। তাদের শৈল্পিক দর্শনই ছিল ভিন্ন রকম। শিল্পে রূপক, উপমা ইত্যাদির ব্যবহারের পুরোপুরি বিরোধী ছিলেন তারা। তারা বরং রত থাকতেন সূক্ষ্ম, অতি সাধারণ, নিতান্ত তুচ্ছ কিছুতেই কীভাবে নন্দনতত্ত্বের দ্যোতনার সন্ধান পাওয়া যায়, সে সাধনায়। এক অর্থে তারা কিছুটা হলেও অ্যান্টাগনিস্ট ছিলেন।
- কোনো সুনির্দিষ্ট ধারাবিবরণী (ন্যারেটিভ) কিংবা কোনো শিল্পীর বাঁধাধরা বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে তারা নিজেদের মতো কাজ শুরু করেছিলেন। শিল্প মাত্রই কোনো পূর্ব নির্ধারিত বার্তা বহন করতে হবে- এমন ধারণার বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছিলেন।
- শিল্পের ঘরানা হিসেবে মিনিমালিজম সন্দেহাতীতভাবে উদারপন্থী চেতনায় বিশ্বাসী। মিনিমালিজমের আবির্ভাবের পূর্বে চিত্রশিল্পী এবং ভাস্করের মাঝে সুস্পষ্ট বিভাজনরেখায় আস্থা রাখতেন শিল্পীরা। অন্যদিকে মিনিমালিজম যাদের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে, তারা তুলনামূলকভাবে অধিক গণতান্ত্রিক ছিলেন। অর্থাৎ, শিল্পীর সবচেয়ে বড় পরিচয় এই যে, তিনি শিল্পের সমঝদার, ভক্ত, অনুরাগী। এ ঔদার্যের কারণেই শিল্পের ধারা হলেও পরবর্তীতে সাহিত্যে মিনিমালিজমের বলিষ্ঠ অনুপ্রবেশ ঘটে।
শুরু করেছিলাম প্রাত্যহিক জীবনে মিনিমালিজমের চর্চা ঠিক কী রকম, তা নিয়ে। শিল্প, সাহিত্যের কথা এল মিনিমালিজনের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা করার পরিপ্রেক্ষিতে। মিনিমালিজমের গোড়ার দিকের কথা এর অন্তর্নিহিত ভাবধারা বোঝার জন্য দরকারি। এবারে আসা যাক যাপনের দৈনন্দিনতায় মিনিমালিজমের অনুসরণ ঠিক কী, সে বিষয়ে।
মিনিমালিজমের স্ফুরণের কৃতিত্ব সর্বতোভাবে শিল্পের হলেও আধুনিক জীবনব্যবস্থায় এর জোয়ার শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। তবে ইতিহাসের দলিলপত্র ঘাঁটলে কিছুটা আশ্চর্য হতে হয়। স্মরণ করতে হয় মিনিমালিজমের গুরু গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিসকে। সে হিসেবে মিনিমালিজমের আদি উৎস আজ থেকে কমপক্ষে ২,৫০০ বছর আগে। বর্তমান প্রজন্ম মিনিমালিজমের যে উত্থানকে হাল আমলের উদ্ভাবন বলে উদযাপন করছে, সেটির জন্ম মূলত গ্রিক চিন্তাবিদ ডায়োজিনিসের মস্তিষ্কে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ডায়োজিনিস সিনিসিজম বা সিনিক দর্শনের পিতা হিসেবেও সুপরিচিত। মিনিমালিজমের আদি পিতার এ দর্শনের ছোট্ট একটি নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে তার বাসস্থান। কোনো কুঁড়েঘর তো দূরেই থাক, তিনি বাস করতেন বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য যে ব্যারেল ব্যবহার করা হতো, সেরকম ফেলে দেওয়া একটি ব্যারেলে।
যাযাবর বলতে যা বোঝায়, তিনি ঠিক তাই ছিলেন। পৈতৃক নিবাস সিনোপ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তিনি চলে আসেন এথেন্সে। এথেন্সের অধিবাসীরা তাকে ডাকতেন ‘কুকুর’ নামে। গ্রিক ভাষায় কুকুরের সমার্থক শব্দ হচ্ছে ‘সিনিক’। এখান থেকেই দর্শনের আরেক বিখ্যাত শাখার জন্ম- সিনিসিজম। গৃহহীন এই জীবনযাপনের ধরনই তার মাঝে মিনিমালিজমের বীজ বপন করে দেয়। প্রথম জীবনে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া আর পরবর্তী সময়ে মানুষের মুখে মুখে ‘কুকুর’ ডাক শুনে তার মাঝে এক অবিস্মরণীয় বোধ জাগ্রত হয়, মূলত জীবনে সুখী হতে চাইলে মানুষের উচিত প্রকৃতির অনুগামী হওয়া। প্রথানুবর্তী হয়ে লোকাচারের সাথে নিজের সাযুজ্যের সন্ধানে রত থেকে বিশাল অট্টালিকায় বাস করলেই যে সত্যিকার শান্তির দেখা মেলে না- এই বোধটিই তাকে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে।
দশ খণ্ডের লিভস অভ দ্য ফিলোসফার্স বইতে ডায়োজিনিস সম্পর্কে একটি গল্পের উল্লেখ আছে। তার একটি পাত্র ছিল, যেটি খাওয়া এবং পানি পানের সময় তিনি ব্যবহার করতেন। একদিন তিনি একজন কিশোরকে দু’ হাত একত্র করে পানি পান করতে দেখলেন এবং তিনি সাথে সাথেই তার পাত্রটি ছুঁড়ে ফেলে দেন। আর এভাবেই জন্ম হয় মিনিমালিজমের।
একটি বিষয় সম্পর্কে সজাগ থাকা আবশ্যক, যদি কেউ মিনিমালিজমের ভক্ত হয়ে থাকেন। ব্যক্তি হিসেবে জীবন যাপনের এ পন্থায় বিশ্বাসী হলে আপনাকে আগে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। মিনিমালিজম কখনই স্রেফ ‘বেচে দাও’ নীতিতে বিশ্বাসী হওয়ার সমার্থক নয়। মিনিমালিজম কখনই উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরে বেড়াতে বলে না। যাযাবার হওয়াই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য- এমন কথাও মিনিমালিজম শেখায় না। আসবাবপত্রহীন জীবনযাপন করতে পারাটাই সামগ্রিকভাবে মিনিমালিজম নয়।
মিনিমালিজমের উদ্দেশ্য আপনাকে জীবনের মূল্য সম্পর্কে দ্বিধান্বিত হতে শেখানো। যা করছেন, সেটি কি আপনার জন্য সত্যিই দরকারি? যেভাবে যাপন করছেন আপনার প্রতিদিনকার জীবন, তা ঠিক কতটা সঙ্গত? যেসব বস্তু আপনার মালিকানাধীন, সেসবের কতটা প্রয়োজন আছে আপনার দৈনন্দিন জীবনে? কতজন মানুষের সাথে আপনার অর্থবহ ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে আপনার? আপনার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে কতটা সচেতন আপনি? আপনি যা অর্জন করতে চান জীবনে, তার সাথে কি আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মের মেলবন্ধন আছে, এবং থাকলে কতটা? প্রতিদিন যে কাজগুলো করেন, সেগুলোর কয়টি অর্থবহ আর কয়টি অর্থহীন? মিনিমালিস্ট হতে চাইলে এই প্রশ্নগুলোর সুস্পষ্ট জবাব থাকাটা প্রথম দায়িত্ব।
এই প্রশ্নের উত্তরগুলো যদি সন্তোষজনক হয়, তাহলে আপনাকে অভিনন্দন; আপনি ইতোমধ্যেই একজন মিনিমালিস্ট। অন্যদিকে আপনার উত্তরে যদি নিজেই তৃপ্ত হতে না পারেন, তাহলে আপনার বিশ্বাস আর চর্চায় ফারাক আছে। সেই শূন্যস্থানটুকু পূরণ করার জন্য মিনিমালিজমের চর্চা আপনাকে সাহায্য করতে পারে।
প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে দর্শন হিসেবে মিনিমালিজম যা বলে, তার সাথে নামের মিল কতটা? বিষয়টা হচ্ছে বাহ্যিক জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে নিজের ভেতরে তৃপ্তি, শান্তির উন্মীলন ঘটানো। মিনিমালিজম জীবনের প্রতি ধাপে বিক্ষেপকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসার বাণী শোনায়। প্রতি মুহূর্তের জীবনে বিক্ষেপ যত হ্রাস করতে পারবেন, মূল জায়গায় দৃষ্টি দেওয়া তত বেশি সহজ হবে আপনার জন্য।
অভ্যন্তরীণ সন্তুষ্টির জন্য আপনার বাহ্যিক জগতটাকেও নিয়মের মাঝে আনতে হবে। প্রতিটি কাজ, পদক্ষেপ, আশা, প্রাপ্তি যখন উদ্দেশ্য পরিচালিত হবে, তখন আপনি ধীরে ধীরে মিনিমালিজমের সুফল ভোগ করতে শুরু করবেন। শিল্পে মিনিমালিজমের চর্চাটাও কিন্তু একই সুরে কথা বলত। নির্বিশেষত্বের মাঝেও যে অর্থপূর্ণ পরিতোষ খুঁজে পাওয়া সম্ভব- মিনিমালিজমের সারকথা এটিই।