পিংক ট্যাক্স। নামের মাঝেই ট্যাক্স শব্দটির অস্তিত্ব থাকলেও আক্ষরিক অর্থে এটি কোনো ট্যাক্স নয়। হুবহু একই কিংবা প্রায় কাছাকাছি ধরনের পণ্যে নারীরা পুরুষদের তুলনায় যে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে থাকেন (জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে) সেটাই পিংক ট্যাক্স নামে পরিচিত।
নিউ ইয়র্ক ডিপার্টমেন্ট অভ কনজ্যুমার অ্যাফেয়ার্স কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নারীরা প্রসাধন সামগ্রীতে পুরুষদের চেয়ে গড়ে ১৩% বেশি মূল্য পরিশোধ করেন। প্রসাধন সামগ্রী কিংবা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সম্পর্কিত এসব পণ্যের উপাদানগত পার্থক্য আহামরি না হলেও নারীদেরকে এই অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হয় স্রেফ তারা নারী বিধায়। লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে এই বৈষম্য প্রচলিত বলে কখনো কখনো একে অর্থনৈতিক লিঙ্গ বৈষম্যও বলা হয়।
২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি অভ সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণাতেও একই ধরনের তথ্য-প্রমাণ মেলে। ডিওডোরেন্ট স্প্রের প্রতি বোতলে নারীরা পুরুষদের চেয়ে গড়ে ৩০ সেন্ট বেশি খরচ করে থাকেন। বাজারজাত করার সময় নারীদের বেলায় সাধারণত গোলাপী রঙ এবং পুরুষদের লক্ষ্য করে ছাড়া পণ্যের ক্ষেত্রে নীল রঙের আধিক্য ছাড়া মৌলিক তেমন কোনো তারতম্যই চোখে পড়ে না। ফোর্বসের সূত্রমতে, পিংক ট্যাক্সের কারণে নারীরা বছর প্রতি তাদের কেনাকাটার পেছনে ১,৪০০ মার্কিন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করেন।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে একজন পুরুষ যদি একটি রেজর কিনতে যান, তাহলে তাকে খরচ করতে হয় গড়পড়তা ৮০ রুপির কাছাকাছি। সেই একই প্রতিষ্ঠানের, একই মানের একটি রেজর, যা সুনির্দিষ্টভাবে বাজারজাত করা হয় মহিলাদের জন্য, কিনতে গেলে খরচ পড়বে ২৫০ রুপির কাছাকাছি। অ্যাক্টিভিস্টদের অসামান্য পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রতিবাদের মুখে ২০১৮ সালে দেশটির সরকার নারীদের মাসিকের সময় ব্যবহৃত সকল পণ্যে ১২% জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স) হ্রাসে বাধ্য হয়।
এখানে একটি চমৎকার শুভঙ্করের ফাঁকি আছে! দেশের প্রত্যেক নারীই মাসিক সম্পর্কিত পণ্য ব্যবহার করেন না। যারা করেন সংখ্যার হিসেবে তারা মূলত সমাজের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। অন্যদিকে নারীদের ব্যবহৃত এমন কোনো পণ্য নেই যা সম্ভবত পিংক ট্যাক্সের আওতায় পড়ে না। মেয়ে শিশুদের খেলনা, পুতুল, পোশাক থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কাদের রেজর, প্রসাধনী সবকিছুতেই নারীদেরকে পুরুষদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ এখান থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট- যে আন্দোলন বিশেষভাবে নারীদের মাসিকের সময় ব্যবহৃত পণ্যসমূহের ওপর আরোপিত অত্যধিক ট্যাক্স হ্রাস করতে সফলতার মুখ দেখেছে, সেই একই আন্দোলন দিয়ে পিংক ট্যাক্স রহিত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
পুঁজিবাদ কীভাবে বাহ্যিক সৌন্দর্যের একটি প্রতারণামূলক ধারণা তৈরি করে রেখেছে তার একটি সরাসরি উদাহরণ হলো পিংক ট্যাক্সের অস্তিত্ব। পৃথিবীজুড়ে চলমান বাণিজ্য ব্যবস্থা নারীদের একটি দুর্বলতাকে (insecurity) পুঁজি করে প্রতিনিয়ত বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের ব্যবসাকে জিইয়ে রেখেছে। নারীদের মাঝে খুব নগণ্য সংখ্যক আছেন যারা এই দুর্বলতা অতিক্রম করতে সমর্থ হন। বাকিরা হয় বোঝেনই না যে তারা মূলত পুঁজিবাদের একটি চক্করে আবদ্ধ, আর না হয় বুঝেও তারা এই শোষণের সাথে নিজেদের একটি আপোষমূলক অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন।
ভেবে দেখুন যে একটি রেজরের মূল কাজ কী? পুরুষের ক্ষেত্রে একটি রেজরের যা ভূমিকা একজন মহিলার ক্ষেত্রে কি সেটি বদলে যায়? তবুও নীলের বদলে গোপালি রঙের মোড়কে কিছুটা ফুলেল নকশায় (তথাকথিত নারীসুলভ) যদি সেটি নারীদের উদ্দেশ্য করেই বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে দাম হাঁকা হবে মাত্রাতিরিক্ত বেশি।
ভারতে এই বৈষম্যমূলক আচরণে (অন্য দেশগুলোতেও মোটামুটি একই চিত্র) ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো ভূমিকা রাখছে নারী-পুরুষের আয়ের বৈষম্য। আয়ের এমন একটি ক্ষেত্র নেই যেখানে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দেশটিতে একই পরিমাণ শ্রম দেওয়ার পরও নারীরা পুরুষদের তুলনায় ১৯% কম টাকা আয় করে থাকেন। পরিতাপের বিষয় হলো, কৃষিভিত্তিক সমাজে এই অবস্থা আরও করুণ হয়ে ওঠে। কৃষিকাজে পুরুষদের তুলনায় নারীদের অবদান সীমাহীনভাবে বেশি হওয়া সত্ত্বেও তারা রোজগার করেন কম। তাহলে মোটের ওপর অবস্থাটা আঁচ করা যাচ্ছে কিছুটা? একজন নারী আয়ের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকবেন আবার ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তাকেই বেশি খরচ করতে হবে।
নিউ ইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অভ কনজ্যুমার অ্যাফেয়ার্সের হিসেব মতে, শুধু পিংক ট্যাক্স বাবদ একজন নারী তার জীবনের প্রথম ৩০ বছরে ৪০,০০০ ডলার খরচ করতে বাধ্য হন। যতদিনে তিনি ৬০-এর কোঠায় পদার্পণ করেন ততদিনে খরচের অংকও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে- পিংক ট্যাক্স এত বহাল তবিয়তে আছে তার কারণ কী? বাজার ব্যবস্থায় যখন কোনো পণ্য উৎপাদন, বিপণন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করা হয় তখন নকশার ওপর জোর দেওয়া হয়। কিছু স্টেরিওটাইপকে ভিত্তি করে পণ্যের বর্ণনা কিংবা পণ্যের মোড়ক এমনভাবে করা হয় যাতে ক্রেতারা (এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে নারীরা) ওই পণ্যটি কিনতেই উৎসাহী হন। পুরুষদের জন্য যে রেজর সেটির হাতল সোজা করে বানানো হলে নারীদের জন্য কখনো কখনো হাতলে কিছুটা বাঁক (curvy) থাকে। পুরুষদের বডি স্প্রেতে যে গন্ধ থাকে সেটির তুলনায় কিছুটা অন্যরকম ঘ্রাণ যোগ করা হয় নারীদের স্প্রেতে। এরকম নানা খুঁটিনাটি বিষয় মাথায় রেখে নারীদের জন্য একই পণ্যকে বিশেষায়িত বলে চালিয়ে দেওয়া হয় মাত্রাতিরিক্ত দামে।
আরেকটি বিষয় কাজ করে এখানে- প্রাইস ইলাস্টিসিটি বা দামের স্থিতিস্থাপকতা। কোনো ব্যক্তি যদি পণ্যের দামকে বিবেচনা না করে পণ্যটির মান, নকশা, দীর্ঘস্থায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়কে সবসময় নজর দেন এবং এসব বৈশিষ্ট্যের সাথে উল্লেখিত দাম সত্যিই কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সেটি বিচার না করেন তাহলে তাকে একজন প্রাইস ইলাস্টিক ব্যক্তি বলা হয়। অর্থাৎ পণ্যের দাম যা-ই হোক না কেন তিনি সেটি কিনবেনই। প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ গবেষণামতে নারীরা পুরুষদের তুলনায় অধিক প্রাইস ইলাস্টিক হয়ে থাকেন।
প্রশ্ন হচ্ছে- পিংক ট্যাক্সের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে কীভাবে? সমতার লড়াই কীভাবে করা যেতে পারে সেই বিষয়ে চমৎকার সূত্রের সন্ধান দিচ্ছে রাইস ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা। এই গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, কোনো দেশের প্রশাসনিক পর্যায়ে কিংবা সরকার গঠনের ক্ষেত্রে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বেশি হলে সেই দেশে পিংক ট্যাক্সজনিত সমস্যার প্রকোপ হ্রাস পায়। সমস্যা হচ্ছে সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী পুরুষের স্বেচ্ছা অংশগ্রহণ এতটাই বৈষম্যমূলক যে চট করে প্রতিটি দেশের রাজনীতিতে নারীরা পদার্পণ করবে এটা আশা করা বর্তমান বাস্তবতায় কিছুটা বাড়াবাড়ি। সেজন্য কিছু বিকল্প পন্থা বেছে নেওয়া যেতে পারে।
সবচেয়ে সোজাসাপ্টা উপায় হচ্ছে কিছুটা চালাক হওয়া। নারীরা চাইলে কিছুটা হিসেবনিকেশ করে দেখতে পারেন যে তারা যে পণ্য কিনবেন বলে মনস্থির করেছেন সেই একই পণ্য পুরুষদের জন্য বাজারে আছে কি না? চাইলে তারা সেটি কিনতে পারেন। আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত যারা বাবা মা হবেন কিংবা সদ্য সন্তানের মুখ দেখেছেন তাদের জন্য। আপনার সন্তানকে (ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে) লিঙ্গ নিরপেক্ষ খেলনা সামগ্রী কিনে দিন। সবশেষে সবচেয়ে দরকারি বিষয়। পিংক ট্যাক্স কী জানুন, বুঝুন এবং এরপর এর যৌক্তিকতা নিয়ে উচ্চকণ্ঠে কথা বলুন- প্রকাশ্যে এবং অন্দরমহলে সর্বক্ষেত্রে।