ট্রাফালগারের অবস্থান
কাদিজের দক্ষিণে, আটলান্টিকের পাড় ঘেঁষে ট্রাফালগার অন্তরীপ (Trafalgar)। জিব্রাল্টারের উত্তর-পশ্চিম দিকে এর অবস্থান। ভিল্যেনুভ চলছিলেন ট্রাফালগারকে একপাশে রেখে দক্ষিণ-পূর্ব দিক ধরে জিব্রাল্টার বরাবর। তাকে ধরতে নেলসন উত্তর-পূর্বে মোড় নেন। ২১ অক্টোবর ট্রাফালগারের ২১ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ভোর ৫:৪৫ মিনিটে মাত্র দশ মাইল ব্যবধানে দুই বহর একে অপরের দেখা পায়। বাতাস ছিল নেলসনের অনুকূলে, ফলে প্রথমেই যুদ্ধের একটি বড় সুবিধা ব্রিটিশরা পেয়ে যায়।
সংঘাত আসন্ন বুঝে ভিল্যেনুভ সমরবিন্যাসের পতাকা তোলেন। বিশৃঙ্খল ফরাসি-স্প্যানিশ নৌবহরের জাহাজগুলো এক সারিতে আসতে গিয়ে একে অপরের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে দেয়। অবশেষে তারা অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে নিজেদের লাইন তৈরি করতে সক্ষম হয়। গ্র্যাভিনা স্প্যানিশদের নিয়ে জায়গা নেন লাইনের একপ্রান্তে। ভিল্যেনুভের সহকারী ল্যু পেলিকে রণক্ষেত্র থেকে একটু দূরে পাঠিয়ে দেয়া হয় রিজার্ভ হিসেবে।
নেলসনের বহর দুই সারিতে ভাগ হলো। প্রথম সারিতে ১৪টি জাহাজের নেতৃত্বে অ্যাডমিরালের পতাকাবাহী জাহাজ ভিক্টরি। দ্বিতীয় সারিতে কলিংউড রয়্যাল সভারেইনকে নিয়ে ১৩টি জাহাজের কমান্ডে আছেন। সকাল এগারটার সময় তারা শত্রুদের তিন মাইলের ভেতর চলে আসলেন। এই সময় নেলসন নিজের কেবিনে ফিরে গিয়ে প্রার্থনা সেরে নেন। এরপর কাগজ-কলম নিয়ে নিজের উইলের জন্য একটি সংযুক্তি তৈরি করেন তিনি। এতে লড়াইয়ে তার মৃত্যু হলে এমা হ্যামিল্টনের দায়িত্ব নিতে স্বয়ং রাজার কাছে আবেদন রেখে যান।
কাজ শেষে কেবিন থেকে বেরিয়ে নেলসন জাহাজের ডেকে ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক নাবিককে উৎসাহ দিতে থাকেন। অন্য জাহাজের ক্যাপ্টেনরাও অনুরূপভাবে নাবিকদের উদ্দীপ্ত করছিলেন। ফলে পুরো বহরে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। নাবিকেরা সবাই মুখিয়ে ওঠে লড়াইয়ের জন্য। বেলেরফোন জাহাজের কামানে লিখে দেয়া হয় “জয় অথবা মৃত্যু”।
ভিল্যেনুভের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তার নাবিকদের মনোবল, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা কিছুই নেই। তারা হারার আগেই হেরে বসে আছে। ভিল্যেনুভ ধারণা করছিলেন, নেলসন তার রিয়ার বা পশ্চাৎ অংশেই আক্রমণ করবেন। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে অ্যাডমিরালের ইশারার দিকে না তাকিয়ে থেকে প্রত্যেক ক্যাপ্টেনকে তার বিচারবুদ্ধি অনুসারে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে দেন তিনি।
ওদিকে এইচএমএস ভিক্টরির ডেকে দাঁড়িয়ে জাহাজের চিকিৎসক উইলিয়াম বেটি উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নেলসনের দিকে। শত্রুদের তোয়াক্কা না করে খোলা ডেকে দাঁড়িয়ে নেলসন টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে ভিল্যেনুভের লাইন পর্যবেক্ষণ করছেন। তার পোশাকে চকচক করছে অ্যাডমিরালের পদবীচিহ্ন, যা যেকোনো শত্রুসেনার জন্য তাকে লোভনীয় টার্গেটে পরিণত করেছে। আর থাকতে না পেরে বেটি নেলসনের ব্যক্তিগত সহকারী অ্যালেক্সান্ডার স্কটকে ফিসফিস করে বললেন কমান্ডারকে বলতে যাতে অন্তত পদবীচিহ্ন তিনি ঢেকে ফেলেন। এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন স্কট, “আমি পারব না ডাক্তার। তাকে এই কথা বলার সাহস আমার নেই”।
সকাল ১১:৪৫।
ভিল্যেনুভের সাথে সংঘর্ষ আসন্ন বুঝে নেলসন তার সিগন্যাল অফিসার পাস্কোকে আদেশ করলেন বহরের নাবিকদের কাছে একটি বার্তা পাঠাতে। নেলসনের ইতিহাস বিখ্যাত সেই মেসেজ তুলে ধরা হলো ভিক্টরি থেকে, “ইংল্যান্ড আশা করে প্রত্যেকে তার কর্তব্য পালন করবে।” নেলসন আর কলিংউড নিজ নিজ সারি নিয়ে শত্রুদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় আঘাতের জন্য আলাদা হয়ে গেলেন।
শত্রুবহরের রিয়ারে স্প্যানিশ জাহাজ স্যান জুয়ান নেপোমুসেনো থেকে অসহায় চোখে পরিস্থিতি দেখছিলেন কমোডোর চুরুকা। নিজের সহকারীর কাছে তিনি খেদোক্তি করলেন যে নেলসন ভিল্যেনুভের লাইনকে দুই টুকরো করে ভ্যানকে বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। এরপর তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন রিয়ার বা পশ্চাৎ অংশে। ফলে বহরের প্রায় অর্ধেক জাহাজ নিষ্ক্রিয়ভাবে দেখতে বাধ্য হবে তাদের সঙ্গীরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আফসোস, ফরাসি অ্যাডমিরাল বুঝতে পারছেন না বা বুঝতে চাইছেন না। তিনি যদি ভ্যানে থাকা স্প্যানিশদের নির্দেশ দেন ঘুরে রিয়ারের জাহাজগুলোর পেছনে অবস্থান নিতে তাহলেই কিন্তু শত্রুর পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। ব্রিটিশরা তখন দুই পাশ থেকেই কামানের মুখে পড়বে। কিন্তু ভিল্যেনুভের সেই উদ্যম কোথায়। হতাশ চুরুকা স্প্যানিশে বলে উঠেছিলেন, “সব শেষ! সব শেষ! সব শেষ!”
যুদ্ধ হলো শুরু
সূর্য তখন মধ্যগগনে।
কলিংউডের ১২০ কামান সমৃদ্ধ রয়্যাল সভারেইন ভিল্যেনুভের লাইনের রিয়ার বা পশ্চাৎ অংশে এগিয়ে আসতে থাকলে শত্রু জাহাজ ফুগু গোলা ছোড়ে। তবে তখনও দুই জাহাজের দূরত্ব বেশি থাকায় তা কলিংউডকে স্পর্শ করতে পারল না। তবে নিরাপত্তার খাতিরে কলিংউড নাবিকদের মাথা নিচু রাখতে আদেশ দিলেন।
অন্যান্য জাহাজ থেকে সভারেইন অনেকটা এগিয়ে ছিল। বেলা ১২:২০ মিনিটে সভারেইন ফুগু’কে তীব্রভাবে ধাক্কা দিলে মড়মড় করে ফুগুর কাঠামোর অনেক অংশ ভেঙে গেল। ফুগু আর স্প্যানিশ জাহাজ সান্টা অ্যানার ফাঁক গলে ঢুকে পড়ল সভারেইন। ব্রিটিশ জাহাজের কামানের মুহুর্মুহু গর্জনে কেঁপে উঠল স্যান্টা অ্যানা, মুহূর্তেই হতাহত হলো প্রায় কয়েকশ নাবিক। নিজেকে সামলে স্প্যানিশ ক্যাপ্টেন পাল্টা জবাব দিলেন। ফুগু আর স্যান লিয়েন্দ্রো জাহাজ এসে ধাক্কা লাগালো সভারেইনকে বেসামাল করে দিতে।
শত্রুবহরের ইন্ডম্পটেবল আর স্যান জুস্টো জাহাজও স্যান্টা অ্যানার সাথে মিলে তুমুল গোলাবর্ষণ শুরু করল ব্রিটিশদের উপর। প্রায় ১৫ মিনিট একাই লড়ে গেল সভারেইন। এরপর বহরের অন্যান্য জাহাজ তার সাথে এসে যোগ দেয়। স্যান্টা অ্যানা আর সভারেইনের দ্বৈরথ চলেছিল প্রায় দু’ঘণ্টা, তবে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ নাবিকদের দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা তাদেরকে সুবিধা পাইয়ে দেয়। পুরো সময়টাই কলিংউড ডেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চারপাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া গোলাগুলির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আপেল চিবুচ্ছিলেন।
এদিকে সভারেইনের পিছু পিছু ১৫ মিনিট পর ক্যাপ্টেন হারগুডের বেলেইল ৮-১০টি শত্রুজাহাজের গোলাবর্ষণ উপেক্ষা করে ভিল্যেনুভের লাইনে আঘাত করল। স্যান্টা অ্যানা আর ইন্ডম্পটেবলের মাঝ দিয়ে ঢুকে পড়লেন হারগুড। স্যান্টা অ্যানার পেছন দিকে কামান ছুড়ে সজোরে ধাক্কা দিলেন ইন্ডম্পটেবলকে। সঙ্গীদের সাহায্যে এগিয়ে এলো ফুগু আর নেপোমুসেনো। ধাক্কাধাক্কিতে ফুগু আর বেলেইল আটকে গেল একে অপরের সাথে। এর মধ্যে ফরাসি জাহাজ এইশিল এসে বেলেইলকে আঘাত করে। এইগেল, স্যান জুস্ট্রো, স্যান লিয়েন্ড্রো আর এস্টুরিয়াস হারগুডের উপর চারদিক থেকে কামান ছুড়লে ব্রিটিশ জাহাজের অবস্থা সঙিন হয়ে পড়ে। মাস্তুল ভেঙে পড়ে যায় ডেকের উপর, পাল ছিড়ে নাবিকদের দৃষ্টিসীমায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এর মাঝেও সৈনিকেরা কামান তাক করে শত্রুজাহাজ দেখামাত্রই গোলা দেগে যাচ্ছিল।
কলিংউডের অন্যান্য জাহাজ লাইন ভাঙ্গার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ব্রিটিশ মার্স আর টনেন্ট জাহাজ পড়ল শত্রুদের মনার্কা জাহাজের গোলার মুখে। মার্সের স্কটিশ ক্যাপ্টেন ডাফ নিহত হন, তার মরদেহ সেখানেই ব্রিটিশ পতাকা দিয়ে ঢেকে দিয়ে সহযোগীরা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। টনেন্টের ক্যাপ্টেন চার্লস টাইলার মুখোমুখি হলেন নেপোমুসেনো আর আলজেসিরাসের।
আলজেসিরাসের ক্যাপ্টেন ম্যাগন সৈনিকদের নিয়ে ডেকে জড়ো হয়েছিলেন ব্রিটিশ জাহাজে লাফিয়ে পড়বার জন্য। কিন্তু টাইলার আলজেসিরাসকে প্রচন্ড ধাক্কা দেন। জাহাজের মাস্তুলে রাইফেল হাতে বসে থাকা সেনাদের নিখুঁত নিশানার শিকার হয় বহু ফরাসি, যার মধ্যে ম্যাগনও ছিলেন। আলজেসিরাসের তিনটি মাস্তুলই ভেঙে গেলে অসহায়ভাবে সাগরে ভাসতে থাকে সে। তুমুল উৎসাহে এবার টনেন্টের নাবিকেরা উল্টো আলজেসিরাসে নেমে পড়ে। নেতারা সবাই নিহত হওয়ায় আলজেসিরাস আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তার পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়, তখনকার দিনে এর মানে ছিল শত্রুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে।
এদিকে নেপোমুসেনোতে চুরুকা গুরুতর আহত হয়েও লড়াই চালিয়ে যাবার নির্দেশ জারি রাখেন। চারদিক থেকে গোলার আঘাতে জাহাজের অবস্থা যায় যায়, কিন্তু চুরুকার এককথা, তিনি বেঁচে থাকতে নেপোমুসেনো শত্রুদের হস্তগত হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় ছিল যে তিনি মারা যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নাবিকেরা জাহাজ সমর্পণ করে দেয়।
এদিকে বেলেরফন জাহাজ নিয়ে ক্যাপ্টেন জন কুক হামলে পড়েছেন মনার্কার উপরে। কিন্তু ১২:৩৫ মিনিটে এইগেল, বাহামা আর তখন অবধি টিকে থাকা নেপোমুসেনো তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। দুটি মাস্তুল ভেঙে পড়ল, পালে আগুন ধরে যায়। এইগেল থেকে ছুড়ে মারা গ্রেনেডে ডেকে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। এর মাঝেই পড়ে যাওয়া পতাকা তুলে ধরতে এক নাবিক এগিয়ে যায়। শত্রু জাহাজে বসে থাকা বন্দুকধারীরা সহজ নিশানা পেয়েও সম্ভবত তার সাহসিকতা দেখে গুলি ছুড়ল না। তবে কুক তাদের গুলিতে নিহত হন। এরপর দুবার এইগেল থেকে বেলেরফনে নাবিকেরা লাফিয়ে পড়বার চেষ্টা করলেও তাদের ব্যর্থ করে দেয়া হলো। এরই মধ্যে ব্রিটিশ জাহাজ রিভেঞ্জ এগিয়ে আসে বেলেরফনের সহায়তায়। তাদের সাথে লড়াই শুরু হয় একসাথে কয়েকটি জাহাজের। এত গোলমালের মধ্যে বিধ্বস্ত বেলেরফন মনার্কা জাহাজে সৈনিক নামিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
বেলা ১ টার দিকে ক্যাপ্টেন জেমস মরিস তার কলোসাস জাহাজ নিয়ে ঢুকে পড়লেন রণক্ষেত্রে। তুমুল আক্রমণে অচল করে দিলেন ফরাসি সুইফটশুর জাহাজ আর স্প্যনিশ বাহামাকে। বাহামা আত্মসমর্পণ করল। ব্রিটিশ জাহাজ ওরিয়ন এসে কলোসাসের সাথে মিলিত হলে সুইফটশুরও পতাকা নামিয়ে নেয়। কলোসাসের ৪০ জন নিহত আর ১৬০ জন আহত হয়, ব্রিটিশ জাহাজগুলোর মধ্যে এটাই ছিল সর্বোচ্চ ক্ষতি।
লড়াই শুরু হবার মাত্র দুই ঘণ্টার ভেতর ভিল্যেনুভের লাইনের রিয়ার নিষ্ক্রিয় করে দিলেন কলিংউড। ঘড়িতে মাত্র তখন দুপুর দুটো বাজে। এখন বাকিটা নির্ভর করছে নেলসনের উপর।