আসলে, ব্যাপারটা এমন না যে দিনে-রাতে বনে-জঙ্গলে কাটিয়েছি। বরং বনের মাঝ দিয়ে ছুটা চলা নদীর শাখা-প্রশাখা ধরে জাহাজে করে কাটানো দিনরাত্রির গল্প এটা। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে বনে-বাদাড়ে ঘুরেছি বৈকি, তা না হলে তো আর বন দেখা সম্ভব নয়, তাই না? তবে শুরুতেই বলে রাখছি, বাঘের দেখা কিন্তু পাইনি! দুঃখজনক হলেও সত্যি। কিন্তু সুন্দরবন যে শুধু বাঘেরই বাসস্থান নয়, বরং প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাখেলার আধার! এই কারণেই সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতার আড়ালে বাঘ মামার দেখা না পাওয়ার কষ্টটা খুব একটা ভারী মনে হয় না।
একদিকে কাজের প্রচণ্ড চাপ, আর অন্যদিকে মাত্র লকডাউন থেকে সাময়িক মুক্তি। ঠিক এই সময়ে যখন একটু বড় রকমের অবকাশের কথা ভাবছিলাম, তখনই এক বন্ধু প্রস্তাব করল খুলনা থেকে সুন্দরবন যাচ্ছে একটি দল, তাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য। সাথে সাথেই সেই দলের ঢাকার প্রতিনিধির সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে বুকিং করে নিই। আমার বন্ধু সরাসরি খুলনা থেকেই যোগ দেয়। আর আমার যাত্রা শুরু হয় ২০২০ সালের নভেম্বরের ৫ তারিখে রাত ৯টার বাসে। ৬ তারিখে ভোর ৬টার কিছু পরে খুলনা পৌঁছে উক্ত দলের আরেক প্রতিনিধিকে ফোন করে জাহাজ (এম.ভি. বা মিডিয়াম ভেসেল- প্রকৃতপক্ষে বেশ বড় আকারের লঞ্চ, তবে এই অঞ্চলে জাহাজ হিসেবেই পরিচিত) ছাড়ার সঠিক সময়টা জেনে নিই।
হাতে ঘন্টাখানেকের বেশি সময় ছিল বলে সামনের রেস্তোরাঁতেই আয়েশ করে সকালের নাস্তা সেরে নিই। বাস সকাল সকাল রয়্যাল মোড়ে নামিয়ে দেয়। পরিচিতজনদের থেকে আগেই জেনে নিয়েছিলাম, এই এলাকায় বেশ ভাল চা পাওয়া যায়। আর সকাল সকাল এক কাপ জুতসই চা না হলে, ভ্রমণটা আমার জন্য ঠিকভাবে শুরুই হয় না। তাই গরুর ঝাল ঝাল ভুনা, পরোটা আর সুজির হালুয়া দিয়ে নাস্তা সারার আগে এক কাপ এবং পরে এক কাপ চা খেয়েই চলে যাই জেলখানা ঘাটের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকেই আমাদের জাহাজ ছাড়বে সকাল ৯ টায়। যাওয়ার পথে বিখ্যাত মিষ্টির দোকান ‘ইন্দ্রমোহন সুইটস’-এর খোঁজে ব্যর্থ হলেও, ফেরার পথে সেখানেও একবার ঢুঁ মারার সুযোগ হয়েছিল। তবে সেই গল্প এখানে নয়।
ঘাট থেকে নৌকায় করে জাহাজ পর্যন্ত যাওয়ার স্বল্পদৈর্ঘ্যের পথে আমার সঙ্গী হয় ঢাকা ও অন্যান্য স্থান থেকে একই সফরে যোগ দেওয়া আরও বেশ ক’জন। এদের মধ্যে সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক দলটি ছিল ২৩ জনের- আত্মীয়, সহকর্মী, বাড়িওয়ালা ও বন্ধুবান্ধব মিলে এক অসাধারণ প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সব বয়সীদের এই দল, এই যাত্রার পুরো সময়টা জুড়েই আমাদের মাতিয়ে রেখেছিল। আমি ও আমার বন্ধু একটি কেবিন নিয়ে পরবর্তী দুই রাতের জন্য নিজেদের বাসস্থান গুছিয়ে নিই। ঠিক ঠিক ৯ টায় জাহাজ ছুটতে শুরু করে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। মনের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনার পারদ এই পর্যায়ে চুড়ান্তে পৌঁছায়।
ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে সুন্দরবন সম্পর্কে জানার পর থেকে বরাবরই আগ্রহ ছিল অন্তত একটিবারের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার-এর বাসস্থান দর্শন করার। জীবনের এতগুলো বছর পার করার পর যখন শেষ পর্যন্ত সেই সুযোগ এলো, তখন পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে কিছুটা তো বেগ পেতেই হয়। সেই সাথে ছিল প্যান্ডেমিক ও লকডাউন- যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছিল। এসবের মাঝে আবারও যে ভ্রমণ সম্ভব হবে তা-ই যথেষ্ট অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই যাত্রার আয়োজক ও কর্তৃপক্ষ এবং প্রত্যেক যাত্রী যথার্থ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সব সময়ই সচেতন ছিল।
প্রায় আট মাস লকডাউনের পরে আবারও পর্যটন শুরু হওয়ার পর এই দিনেই ছিল সুন্দরবনে মানুষের প্রথম যাত্রা। আর এই কারণেই বাঘের দেখা পাওয়ার আশাটা আমাদের সকলের মাঝেই বেশ জোরালো ছিল। আমাদের ধারণা ছিল, যেহেতু বেশ লম্বা সময় পর্যটকদের আনাগোনা বন্ধ ছিল, প্রাণীরাও হয়তো কিছুটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু আর সবাই বেপরোয়া হলেও বাঘ মামা সদা সচেতন ছিলেন। কুমির, হরিণের প্রাচুর্য চোখে ধরা পড়লেও বাঘের পায়ের চিহ্নটাও আমাদের দেখা হয়নি। এখানে বলে রাখি, বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত এসব সাধারণ যাত্রায় বাঘের দেখা পাওয়াটা বিরল, তবে কোনো কোনো আয়োজক প্রায় ১৭ মাইল দীর্ঘ হাইকিংয়ের ব্যবস্থা রাখে, যেখানে বাঘের দেখা বা অন্তত পায়ের ছাপের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
সুন্দরবন ভ্রমণের বেশ কিছু আকর্ষণীয় দিকের একটি হলো- খাবার। এই যাত্রার প্রায় প্রতি বেলাতেই ভারী খাবার দাবারের ব্যবস্থা থাকে। যেখানে থাকে বিভিন্ন ফলমূল, নদী থেকে ধরা ছোট বড় মাছ, স্থানীয় শাক-সবজি, মুরগির মাংসের তরকারি আর সাথে ভাত, পোলাও, খিচুড়ি। এমনকি এক বেলাতে দেশীয় স্বাদে চাইনিজ খাবার, এক বেলা বার-বি-কিউ আর শেষ দিনের দুপুরের খাবারে থাকে বিয়েবাড়ির জম্পেশ খানাদানা, সাথে দই-মিষ্টি। তিনটি সকালেই ভোর থেকে শুরু করে দুপুরের খাবারের মাঝের সময়ে দুবার নাস্তার ব্যবস্থা থাকে। আরও থাকে সন্ধ্যার নাস্তা। সারাদিনে ইচ্ছামতো চা-কফির ব্যবস্থাও থাকে।
নভেম্বরের ৬ তারিখ বেলা দেড়টার দিকে আমাদের জাহাজ সুন্দরবনে প্রবেশ করলে যাত্রীদের সকলেই উল্লাসে ফেটে পড়ে। ছেলে-বুড়ো সকলের মাঝেই এই বনে প্রবেশের যে উত্তেজনা ছিল তা বয়সের পার্থক্যকে অনায়াসেই অতিক্রম করে যায়। বেলা আড়াইটা নাগাদ দুপুরের খাওয়া শেষ করে তিনটার দিকে আমরা পৌঁছে যাই হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে। জাহাজ থেকে নৌকার মাধ্যমে এখানে যাতায়াত করা হয়। উল্লেখ্য, এরকম সংকীর্ণ নদীপথে চলাচলের জন্য এসকল জাহাজের সাথে সব সময়ই একটি নৌকা বাধা থাকে। নৌকার মাঝিও আমাদের সাথেই গাইড হিসেবে সর্বক্ষণ ছিলেন। সুন্দরবনের মাঝি হিসেবে তার অভিজ্ঞতা ১০ বছরেরও বেশি সময়ের। গল্প করে জানতে পারি, এই লম্বা সময়ে তিনি একবারও বাঘের দেখা পাননি। তবে বিচিত্র বেশ কিছু অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল যে গল্প সব জায়গায় করার মতো নয়।
একটি ওয়াচ টাওয়ার সম্বলিত এই এলাকা কাছ থেকে বন্যপ্রাণী দেখার জন্য পর্যটকদের উদ্দ্যেশ্যে নির্মিত একটি সুরক্ষিত এলাকা। তবে ভাগ্যে থাকলে বাঘের দেখা এখানেও মিলতে পারে- যদিও সেটা সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য তা জানার সুযোগ আমাদের হয়নি। এখানে অনায়াসে বেশ কয়েকটি বানরের পরিবার, হরিণ এবং কুমিরের দেখা মিলে। সেই সাথে ওয়াচ টাওয়ারের চূড়া থেকে পুরো সুন্দরবনের একটি অংশ পাখির চোখে দেখার মতো করে দেখা যায়। আমাদের সাথে সব সময়ই দুজন সশস্ত্র গার্ড ছিলেন। তারা একইসাথে গাইডের ভূমিকাও পালন করেন। দুজনেরই অভিজ্ঞতা প্রায় দুই দশকের। তাদের একজন মাত্র একবার বাঘের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
তবে বনের ভেতরে কাঠের তৈরি সাঁকোর মতো রাস্তা দিয়ে নিরন্তর হেঁটে চলাই আমার জন্য বেশি আনন্দদায়ক ছিল। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই হাঁটার ক্ষেত্রে সামনে থাকার প্রতিযোগিতায় নামা নিতান্ত বোকামি। বরং পেছনে থেকে আস্তে ধীরে এগোলে যেমন বনের সৌন্দর্য্য পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায়, তেমনি মাঝে মাঝেই বিভিন্ন পাখিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর দেখাও পাওয়া যায়। আর পায়ের ওপরও অত্যাচার কম হয়। আগেই বলেছি যে এই যাত্রায় ভোজনপর্বে কোনো কমতি থাকে না, ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, যে পরিমাণে হাঁটানো হয়, খাওয়াটা আসলে সেই কারণেই এমন রাজকীয় হয়ে থাকে!
হাড়বাড়িয়ার ভেতর দিয়ে বয়ে চলা খালে বেশ কিছু গুইসাপের দেখাও পেয়েছিলাম। বানরের কোনো কমতি তো ছিলই না! একটি হরিণ খুব কাছে এসে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছিল আমাদের সাথে। কিন্তু ঠিক সূর্যাস্তের সময় যখন জাহাজে ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া দেওয়া হচ্ছিল, ঠিক তখন গভীর বনের ভেতর থেকে নদীর ধারে বেশ কয়েকটি হরিণ বাচ্চাসহ সামনে এসে মানবদর্শন করে যায়। আর এই ঘটনায় আমাদের উত্সাহ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ব্যাপারটা এমন ছিল যে সেই সময়ে একই স্থানে একটি কুমিরও পানি থেকে বাইরে তীরে এসে আমাদের দর্শন দিয়ে যায়। কুমিরের আগমনে অবশ্য আমাদের মাঝে জাহাজে ফিরে যাওয়া নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি হয়। আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে কুমিরের জন্য জাহাজে ওঠা সহজ হবে, না কি নৌকায়?
প্রথম রাতেই একটু তাড়াতাড়ি ঘুমানোর জন্যই আমাদের পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ পরদিন সূর্য ওঠারও আগে আমাদের যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। এবারের গন্তব্য ছিল জামতলা সমুদ্র সৈকত। ভোরের আকাশে তখনও চাঁদ-তারা বিদ্যমান- এরকম সময়ে তৈরি হয়ে, হাড় হিম করা শীতে কাঁপতে কাঁপতে, গরম গরম চা আর বিস্কুট দিয়ে প্রথম পর্বের নাস্তা সেরে ভোরের লালচে আভা আকাশ ছোঁয়ার সাথে সাথেই নৌকায় করে আমাদের যাত্রা শুরু হয়।
ভোরের হালকা আলোয়, ঠাণ্ডা বাতাসে চলতে থাকা এই যাত্রাটি এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে আরও ঘন্টাখানেক চললেও মন ভরতো না। তবে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাই। যাত্রাপথে আরও কিছু হরিণের দেখা মেলে। সেখানে আমাদের সাথে সাথে আরও কয়েকটি দল ছিল। কিন্তু বাঘ দেখার ভাগ্য সকলেরই একই রকম ছিল।
এই যাত্রায় মন ভরানোর জন্য প্রকৃতির একাধিক আয়োজন আমাদের অপেক্ষায় ছিল। প্রথমেই সূর্যোদয়ের অবিশ্বাস্যরকম সুন্দর দৃশ্যে মনে হয়েছিল যেন আমরা বাংলাদেশের সুন্দরবনে নই, বরং টিভিতে দেখা আফ্রিকার কোনো এক জঙ্গল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এবারে কাঠের তৈরি কোনো সাঁকো দিয়ে নয়, আমরা যাচ্ছিলাম মাটির রাস্তা দিয়েই, বনের গভীর দিয়েই। যখন সমুদ্র তীরে পৌঁছলাম, তখন সূর্য পুরোপুরি আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু বালুচরে সূর্য রশ্মি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে যাতে মনে হচ্ছিল আমারা সকাল বেলায় নয়, বরং পূর্ণিমার কোনো রাতে সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম।
সেই সাথে সেখানে ছিল ঘূর্ণিঝড় সিডরের ধ্বংস লীলার চিহ্ন- উপড়ে পড়া গাছের গুড়ি ও শাখা-প্রশাখা। পুরো সমুদ্র তীর জুড়েই এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যেটা বনের অন্যান্য অংশের সাথে বেশ বেমানান ছিল। কিন্তু সৌন্দর্য যেন কোনোভাবেই কম হবার নয়! এই পথে যাওয়া-আসার সময় অসংখ্য হরিণ আমাদের নজর কাড়ে। একেকবারে তো দলবেধে অসংখ্য হরিণ, আমাদের যাতায়াতের রাস্তাটি দিয়ে, আমাদের সামনেই দৌড়ে যাচ্ছিল। এক স্থানে একটি কুলগাছ নজরে পড়ে যেখানে কুল তো সবেমাত্র ফুল থেকে বাড়তে শুরু করছিল, কিন্তু ‘ ক্রিমসন রোজ‘ নামের একটি বিশেষ ধরনের প্রজাপতির ঝাঁক আমাদের সকলকে বেশ কয়েক মিনিটের জন্য সেখানে যেন বেধে ফেলে। প্রায় কয়েকশত প্রজাপতি সেই গাছটিতে ঝাঁক বেধেছিল।
জামতলা সমুদ্র সৈকত থেকে ফিরে গরম গরম খিচুড়ি দিয়ে নাস্তা সেরে নিয়ে দুটি দলে ভাগ হয়ে কটকা সমুদ্র সৈকত ও নিকটবর্তী পর্যটন এলাকায় হরিণের দর্শনে বেরিয়ে পড়ি। এখানে একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক হরিণ সপরিবারে মানুষের দেওয়া ঘাস-লতাপাতা খাওয়ার জন্য মানুষের বেশ কাছাকাছি চলে আসে। এখানে চাইলে হরিণের খুব কাছে গিয়ে ছবিও তোলা যায়। তবে বেশি কাছে না যাওয়া বা ছবি না তোলাই উচিত। কটকা থেকে ফিরে অত্যন্ত ক্লান্ত শরীরে একে একে সকলেই গোসল সেরে দুপুরের খাবারের জন্য তৈরি হয়ে যাই।
এই সময়ে বেশ কড়া রোদের মাঝেই আমাদের জাহাজ ছুটে চলে দেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের দিকে, খুলনা অঞ্চল ছেড়ে আমরা পাড়ি জমাই বাগেরহাটের সীমানার সুন্দরবন অংশে। দুপুরের খাবারের পরে শরণখোলা ফরেস্ট রেঞ্জে কিছুটা সময় অতিক্রম করে এবং আরও বেশ কিছু বন্য হরিণকে স্বপরিবারে বিচরণ করতে দেখার পরে আমরা চলে যাই ডিমের চরে। ডিমের চর মূলত মোহনার নিকটবর্তী একটি স্থানে জেগে ওঠা ডিম্বাকৃতির একটি চর। এখানে যে যার ইচ্ছামত নেমে ঘুরে বেড়ায়, কেউ কেউ বা পানিতে নেমে দাপাদাপিও করে। আবার কেউ কেউ আমার মতো নদীর তীরে নৌকায় বসে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে থাকে।
এই দ্বিতীয় ও শেষ রাতটি ছিল বার-বি-কিউ উত্সবের জন্য নির্ধারিত। এই সময়ে আমি, একজন একজন করে জাহাজের বিভিন্ন কর্মীর সাথে সুন্দরবনে তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শোনার জন্য কথা বলতে থাকি। নির্ধারিত সময়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে যার যার কেবিনে ঘুমাতে গিয়ে আমাদের দ্বিতীয় দিনের সুন্দরবন অভিযানের সমাপ্তি ঘটে। পরদিন সকালটা যেন সবার জন্যই বিচ্ছেদের বার্তা বয়ে এনেছিল। সবারই মনে নির্মল, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ ছেড়ে শহুরে ব্যস্ত জীবনে ফিরে যাওয়ার অনিচ্ছা জেঁকে বসেছিল।
এই কারণেই বোধহয় সুন্দরবনে আমাদের শেষ গন্তব্য করমজলে কাটানো সময়টা সবার কাছে বেশ খানিকটা মলিন মনে হয়েছিল। করমজল কুমির প্রজননের জন্য প্রসিদ্ধ। একইসাথে এখানে খুব কাছ থেকে হরিণের সান্নিধ্য লাভেরও সুযোগ রয়েছে। চাইলে হরিণকে বন্য লতাপাতা নিজের হাতে খাওয়ানোরও ব্যবস্থা আছে। তবে এই অংশে মানুষের বিচরণ বন্য প্রাণীর চেয়ে কিছুটা বেশি। পর্যটকদের জন্য এখানে ছোট আকারে বাজারের আয়োজন হয় যেখানে স্থানীয়রা বিভিন্ন ধরনের খাবার ও দ্রব্যাদি বেচাকেনা করে থাকে। সেই সাথে অসংখ্য বানরকেও এখানে সপরিবারে ছুটোছুটি করে বেড়াতে দেখা যায়, এরা মাঝে মাঝে মানুষের হাত থেকে খাবারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
বেলা প্রায় সাড়ে এগারটা-বারোটা নাগাদ করমজল থেকে সকলে জাহাজে ফিরে এলে খুলনার উদ্দেশ্যে আমাদের ফিরতি যাত্রা শুরু হয়। আজকের দুপুরের খাবারের আয়োজন ছিল বিয়ে বাড়ির মতোই। সেই সাথে শেষ পাতে দই-মিষ্টি। এই যাত্রায় একই জাহাজে দুই রাত ও তিন দিন কাটানোর পরে অনেক অপরিচিত মানুষও বেশ কাছের বন্ধু হয়ে ওঠে। এখানে নৌকায় করে স্থানীয়দের আর্থিক সাহায্য চাইতেও দেখেছি। দুপুরের খাবারের পরে জাহাজের ছাদে, বয়সে বেশ ছোট কয়েকজন সহযাত্রীর সাথে লুডু খেলায় মেতে উঠি আমি। সেই খেলা শেষ হওয়ার আগেই ঠিক সূর্যাস্তের সময়ে আমাদের জাহাজ জেলখানা গেটের কাছে পৌঁছে যায়।
তারপর আগের মতোই নৌকা করে ঘাটে ফিরে, রাতের বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। তবে এই বাসযাত্রার পূর্বে খুলনা শহরে বেশ খানিকটা সময় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়, সেই সাথে বহুল আকাঙ্ক্ষিত ইন্দ্রমোহন সুইটস- এর সন্ধানও মেলে।