ওয়েস্টার্ন সন্দেহাতীতভাবে হলিউডের সেরা জনরাগুলোর একটি। এই জনরাকে আমেরিকান সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদের প্রতিভূ বলে বিবেচনা করা হয়। তবে বর্তমানে হলিউডে ওয়েস্টার্নের আগের সেই জৌলুশ নেই। জনপ্রিয়তায়ও পড়েছে ভাটা। খুব বেশি সিনেমা নির্মিতও হয় না এই জনরায়। যেগুলো হয় সেগুলোর ভেতর হাতে গোনা কয়েকটি হয়তো দর্শকদের মনে জায়গা করে নেয়। তাও আবার সেটা কালেভদ্রে।
সম্প্রতি এশীয় সিনেমার জয়জয়কার চলছে। এসব সিনেমার ব্যাপারে পশ্চিমারাও আগ্রহী হচ্ছে। তারা শিল্পী ও কলাকুশলীদের সমাদরও করছে। নিকট অতীতের চলচ্চিত্র উৎসব এবং পুরষ্কারের দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়। ওয়েস্টার্নের সাথে মূলত হলিউড আর ইতালির নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকলেও, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাদেশে যত সিনেমা নির্মিত হয়; তাতে কিছু ওয়েস্টার্ন জনরার সিনেমা থাকাটাই স্বাভাবিক।
পাদপ্রদীপের আলোয় না থাকলেও এই জনরা নিয়ে এশিয়াতেও কাজ হয়েছে। কিছু দেশ তাদের নিজস্ব উপকরণ যুক্ত করে এই ধারার কাজ করেছে। বিশেষ করে চীনের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলের পটভূমিতে কোরিয়া ও জাপান উভয় দেশই কিছু ওয়েস্টার্ন নির্মাণ করেছে। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার পটভূমিতেও এই জনরা নিয়ে কাজ হয়েছে। তালিকায় আছে ভারত আর থাইল্যান্ডের নামও। সর্বকালের সেরা এশিয়ান ওয়েস্টার্ন সিনেমার তালিকায় ইয়োজিম্বো (১৯৬১), দ্যা ড্র্যাফটিং অ্যাভেঞ্জার (১৯৬৮), ব্রেক আপ দ্যা চেইন (১৯৭১), সাংহাই এক্সপ্রেস (১৯৮৬) ইত্যাদির নাম অগ্রগণ্য। আজকের আলোচ্য সিনেমা দ্যা গুড, দ্যা ব্যাড, দ্যা উইয়ার্ডও একটি এশিয়ান ওয়েস্টার্ন।
নাম দেখে চলচ্চিত্র-প্রেমীরা হয়তো বুঝে ফেলেছেন, সিনেমাটি কিংবদন্তি ওয়েস্টার্ন পরিচালক সার্জিও লিওনির ১৯৬৬ সালের ক্লাসিক দ্যা গুড, দ্যা ব্যাড অ্যান্ড দ্যা আগলি থেকে অনুপ্রাণিত। আমেরিকান চলচ্চিত্রের ইতিহাসের আইকনিক এই সিনেমাটির শ্যুটিং হয়েছিল স্পেনে আর পরিচালক ছিলেন ইতালিয়ান। দক্ষিণ কোরীয় পরিচালক কিম জি-উনের দ্যা গুড, দ্যা ব্যাড, দ্যা উইয়ার্ড দেখতে গিয়ে দর্শকের মনে হবে যেন লিওনির চরিত্রদের কোরিয়ান সংস্করণ দেখা যাচ্ছে পর্দায়।
দ্যা গুড, দ্যা ব্যাড অ্যান্ড দ্যা আগলি ছাড়াও লিওনি নির্মিত অন্যান্য স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্নের প্রভাবও দৃশ্যমান এখানে। সাথে কিম যুক্ত করেছেন কুয়েন্টিন টারেন্টিনোর সিগনেচার পোস্ট-মর্ডানিজম। ফলে তার এই অ্যাকশন এবং হঠাৎ করে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো চরিত্র সম্বলিত মহাকাব্যিক চলচ্চিত্রটিতে হোমাজ আর নতুনত্বের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়েছে।
লিওনি আর টারেন্টিনোর মতো কিমও ক্লাসিক বলে বিবেচিত বিভিন্ন সিনেমা থেকে বিভিন্ন উপকরণ নিয়েছেন। সাথে যুক্ত করেছেন নিজস্ব স্বকীয়তা। তাই লিওনির ক্লাসিকের অনুকরণ এবং এই ধারার সিনেমার মডেলকে অতিক্রম করতে না পারলেও; কিছুতেই এটিকে অমৌলিক বলে মনে হয় না। আর কিম যে বিভিন্ন মহান পরিচালকদের থেকে নানা উপকরণ টুকে নিচ্ছেন, সেটি দর্শকের মন থেকে একেবারে উবে যায় সিনেমার অসাধারণ প্রারম্ভিক দৃশ্যেই। এক্ষেত্রে তার অস্বাভাবিক দ্রুতিতে গল্প বলার ধরন এবং বিরামহীন কমিক রিলিফের সংযুক্তিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
কিমের লঘু চালের এই হোমাজের প্রেক্ষাপট ১৯৩০ এর দশকের মাঞ্চুরিয়া। মারামারি এবং হানাহানিতে সিদ্ধহস্ত তিন কোরিয়ান তাদের জাপানি দখলদারিত্বে জর্জরিত মাতৃভূমি থেকে পালিয়ে এখানে আড্ডা গেড়েছে। জাপানিরাও চলে এসেছে এখানে। তারা খোঁজ করছে একটি ম্যাপের। কিংবদন্তি অনুযায়ী এই ম্যাপ প্রাচীন কিং রাজাদের গুপ্তধনের সন্ধান বাতলে দেবে। গল্পে এই ম্যাপ ম্যাকগাফিনের ভূমিকা পালন করেছে। ম্যাকগাফিন বলতে সাধারণত এমন একটি বস্তুকে বোঝায় যেটি গল্পের প্রবাহকে একটি নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত করে।
যে তিন অ্যান্টি-হিরোকে আমরা সিনেমায় দেখব, তাদের মধ্যে একজন হলো গুড। গুলি চালনায় এই বাউন্টি হান্টারের জুড়ি মেলা ভার। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাং উ-সাং, যাকে কোরিয়ান সিনেমার ভক্তরা রোমান্টিক সিনেমায় প্রায়শই দেখে থাকেন। এখানে তার লুক সুদর্শন রমণীমোহন অভিনেতার মতো।
দয়ামায়াহীন গ্যাং লিডার ব্যাডের চরিত্রে দেখা গেছে লী বিউং-হিউনকে। প্রথম দেখায় সে ছেলে নাকি মেয়ে এটা বোঝা যায় না, গ্ল্যাম-পপস্টারদের মতো অসমান করে কাটা তার চুল। দেখতে বোকাসোকা কিন্তু কর্মকাণ্ডের দিক থেকে মারাত্মক ডাকু উইয়ার্ডের চরিত্রে অভিনয় করেছেন গোলাকৃতির মুখের মালিক সং কাং-হো। যিনি মেমরিস অফ মার্ডার, প্যারাসাইট কিংবা দ্যা হোস্ট-এর মতো সিনেমায় অভিনয় করে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়েছেন।
জাপানিদের সাথে আঁতাত করে এক কোরিয়ান ধনদর্পী ব্যাডকে ভাড়া করে। উদ্দেশ্য, ইম্পেরিয়াল আর্মির জন্য গুপ্তধনের ম্যাপ হাসিল করা। কিন্তু ব্যাডের কাজে বাধ সাধে উইয়ার্ড। অজ্ঞানতাবশতই দর্শনীয়ভাবে মঞ্চস্থ একটি ট্রেন ডাকাতির সময় সে সাথে করে নিয়ে যায় পুরাতন, মোচড়ানো ও জীর্ণ একটি কাগজ। পরে দেখা এটির সাথে ঐ গুপ্তধনের ম্যাপের যোগসূত্র রয়েছে। ট্রেন ডাকাতির সময় গুডকেও দেখা যায়।
সিনেমার একপর্যায়ে বাউন্টি হান্টার ব্যাড বলে, “জীবনে হয় কাউকে ভাগাতে হবে, নয়তো নিজে ভাগতে হবে।” এই ভাগানো আর ভাগার ভূমিকায় আমরা অনেককেই অবতীর্ণ হতে দেখি। আর এই ভূমিকা বদল নির্ভর করে সর্বশেষ কার কাছে গুপ্তধনের ম্যাপ আছে তার উপর।
ক্রমশ পরিবর্তনশীল ভূমিকার ভিত্তিতেই একটি আফিমের আড্ডায় বিপদসংকুল অ্যাকশন সিকোয়েন্সে অবতীর্ণ হতে দেখা যায় এখানকার চরিত্রদের। যাতে জিতে গেলে মিলতে পারে অমূল্য সম্পদ আর হারলে হারাতে হবে মাতাপিতা প্রদত্ত প্রাণটাই। আফিমের আড্ডা ছাড়াও চীনা গোস্ট মার্কেট বা নাইট মার্কেট এবং দোতলা অলিন্দ বিশিষ্ট সরাইখানায়ও কিছু বিপদজনক দৃশ্যের অবতারণা হতে দেখা গেছে। এসব অ্যাকশন সিকোয়েন্স ধারণের জন্য শ্যুটিং সেটকে বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে।
দ্যা গুড, দ্যা ব্যাড, দ্যা উইয়ার্ড-এর চরিত্ররা মরুভূমিতেও অনেক সময় কাটিয়েছে। এ সময় মরুভূমি অ্যাডভেঞ্চারের জন্য বিস্তীর্ণ এলাকার যোগান দিয়েছে। শেষ দিকে রয়েছে এখানে ধারণকৃত বিশাল এক চেইস সিকোয়েন্স। যা চলতে থাকে তো চলতেই থাকে, মনে হয় এই দৃশ্য কখনোই শেষ হবে না।
দৃশ্য ধারণের ক্ষেত্রে ওয়াইড স্ক্রিন ফরম্যাট আর সর্বদা চলমান ক্যামেরার ব্যবহার করেছেন পরিচালক কিম। যা দর্শকের ইন্দ্রিয়কে বৃহত্তর স্থান এবং দ্রুতগতির অনুভূতিতে পূর্ণ করে দিতে সক্ষম। আর এভাবেই পর্দায় লিওনির ম্যাজিক পুনরায় তৈরির চেষ্টা করেছেন তিনি। স্প্যানিশ ঘরানার একটি ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরও জুড়ে দিয়েছেন।
স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্নের স্টাইলকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করেছেন কিম। এক্ষেত্রে তিনি হংকংয়ের মায়েস্ত্রো জন উ এবং সুই হার্কের মতো করে এডিটিং এবং ক্যামেরা টেকনিক ব্যবহার করেছেন। ফলে হলিউড এবং এশিয়ান টেকনিকের সংবন্ধনে একধরনের স্বতন্ত্র আবহের সৃষ্টি হয়েছে।
সিনেমাটি অনেকাংশে অ্যাকশন সিকোয়েন্সের উপর নির্ভরশীল। এই সিকোয়েন্সগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী পন্থা। অভিনেতারাই তাদের স্টান্টগুলোতে অংশ নিয়েছেন, প্রযুক্তির সাহায্যে নির্মিত কোনো দৃশ্য ব্যবহৃত হয়নি। বাস্তবিকতার সাথে যার হাজার মাইলের তফাৎ। তবে এখানকার ভিজ্যুয়াল রিয়ালিজম খুব ভালোভাবেই অবাস্তব দৃশ্যাবলীকে ন্যায্যতা প্রদান করেছে। এই ভিজ্যুয়াল রিয়ালিজমে কিছু স্ল্যাপস্টিক ভায়োলেন্সের সংযোজনও ঘটেছে, যা আবার কারো কারো কাছে হাস্যরসাত্মকের বদলে ক্রুর বলে মনে হতে পারে।
এটি এমন একটি সময়কালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যখন ঘোড়সওয়ার সহজেই চলমান ট্রেন বা মোটর সাইকেলকে ধরে ফেলতে পারতো। একজন তলোয়ারবাজ লড়াইয়ের একপর্যায়ে মুখোমুখি হতো কোনো মেশিনগানারের। এ ধরনের বৈপরীত্যের ফলে এখানে উদ্ভব ঘটেছে একটি কৌতুকাবহের। যা এই সিনেমা দেখার সামগ্রিক অভিজ্ঞতার মতোই, খুব একটা গুরু নয় কিন্তু গভীরভাবে পরিতৃপ্তিকর। ২০১৭ সালে নিজ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিনেমা বানাতে গিয়ে, ইতিহাসের সঠিকতা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাননি কিম। বরং জোর দিয়েছেন দর্শকদের আনন্দ দেবার উপর।
সময় করে আপনিও তিন অ্যান্টি-হিরোর সাথে চলে যেতে পারেন তাদের গুপ্তধনের ম্যাপ অনুসন্ধানের মিশনে। আর প্রাণ খুলে উপভোগ করতে পারেন তাদের একইসাথে নিষ্ঠুর এবং হাস্যরসাত্মক কর্মকাণ্ডে।