Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্যযুগের নিদর্শন

বাংলা সাহিত্যের একেবারে গোড়ার দিকের নিদর্শন হচ্ছে চর্যাপদ। বেশিরভাগ পন্ডিতের মতে, চর্যাপদের রচনাকাল ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তুর্কি আক্রমণের ফলে বাংলা সাহিত্যে এক বড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এ সময়কে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ। এর ব্যাপ্তিকাল হিসেবে ধরা হয় ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ।

এবার আসা যাক শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে। চর্যাপদের আধো বিকশিত বাংলা ভাষার পরিস্ফুট রূপটি আমরা দেখতে পাই পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মাধ্যমে, যেটির রচনাকাল হিসেবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পরবর্তী সময়কে ধরা হয়। প্রথমেই একটু কাব্যের গল্পটা জেনে নেওয়া যাক।

পুঁথি – শ্রীকৃষ্ণকীর্তন; Image Source: banglapedia.org

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য মোট ১৩টি খণ্ডে রচিত। যদিও শেষ খণ্ডটা নিয়ে একটু বিতর্ক রয়েছে, খণ্ডের নামে ‘খণ্ড’ শব্দটি নেই বলে।

১. জন্ম খণ্ড: রাধা এবং কৃষ্ণ দুজনই ঈশ্বরের ইচ্ছায় মর্তে মানব রূপে জন্ম নেয়। কৃষ্ণ কংস রাজাকে বধ করার উদ্দেশ্যে দেবকী ও বাসুদেবের ঘরে সন্তান হিসেবে জন্ম নেয়। কংস রাজা কৃষ্ণকে হত্যা করতে পারে এই ভয়ে জন্মের সাথে সাথেই বাসুদেব কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে রেখে আসে। রাধাও সেই বৃন্দাবনেই এক গোয়ালার ঘরে জন্মগ্রহণ করে। দৈবইচ্ছায় বালিকা বয়সেই রাধার বিয়ে হয়ে যায় এবং বৃদ্ধা পিসি বড়ায়ি রাধার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে থাকে।

২. তাম্বুল খণ্ড: বড়ায়ি এবং সাথীদের সঙ্গে করে মথুরাতে দুধ বিক্রি করতে যায় রাধা। পথে বৃদ্ধা বড়ায়ি রাধাকে হারিয়ে ফেলে এবং কৃষ্ণের কাছে রাধার রূপের বর্ণনা করে জিজ্ঞেস করে সে রাধাকে দেখেছে কি না। রূপের বর্ণনা শুনে কৃষ্ণ রাধার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং কৌশলে রাধার কাছে প্রেম নিবেদন করে। কিন্তু বিবাহিতা রাধা তা প্রত্যাখ্যান করে।

৩. দান খণ্ড: মথুরাগামী রাধা এবং তার সঙ্গীদের পথরোধ করে কৃষ্ণ। নদী পারাপার করিয়ে দেবার বিনিময়ে কৃষ্ণ রাধার সঙ্গ প্রত্যাশা করে। কিন্তু রাধা কৃষ্ণের প্রস্তাব প্রত্যাখান করার চেষ্টা করে।

৪. নৌকা খণ্ড: এরপর থেকে রাধা কৃষ্ণকে এড়িয়ে চলে। একদিন কৃষ্ণ নৌকার মাঝি সেজে রাধাকে নৌকায় তুলে মাঝ নদীতে নিয়ে নৌকা ডুবিয়ে দেয় এবং রাধার সঙ্গ লাভে সমর্থ হয়। নদী তীরে ওঠার পর রাধা লোকলজ্জার ভয়ে সবাইকে এটা বলে যে মাঝ নদীতে নৌকা ডুবে গিয়েছিল। কৃষ্ণই তাকে নদী থেকে তুলে বাঁচিয়েছে।

৫. ভার খণ্ড: এরপর থেকে রাধা ঘরের বাইরে বেরোয় না। কিন্তু রাধা দর্শনের জন্য কৃষ্ণ কাতর। সে বড়ায়িকে দিয়ে রাধার শাশুড়িকে রাজি করিয়ে রাধাকে আবার দুধ বিক্রির জন্য ঘর থেকে বের করায়। এবার কৃষ্ণ ছদ্মবেশে মজুর হিসেবে রাধার কাছে আসে এবং ভার বহনের মজুরি হিসেবে রাধার আলিঙ্গন প্রার্থনা করে। রাধাও কাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কৃষ্ণকে মথুরা পর্যন্ত ভার বহন করায়।
৬. ছত্র খণ্ড: মথুরা থেকে ফেরার পথে কৃষ্ণ তার আলিঙ্গন দাবি করে। কিন্তু রাধা চালাকি করে সূর্যের তাপের কথা বলে তাকে ছাতা নিয়ে বৃন্দাবন পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে। আলিঙ্গনের আশায় আশায় কৃষ্ণ বৃন্দাবন পর্যন্ত রাধাকে পৌঁছে দেবার পরও রাধা তার কথা রাখেনি।

রাধা কৃষ্ণ; Image Source: eisamay.indiatimes.com

৭. বৃন্দাবন খণ্ড: কৃষ্ণের প্রতি এরূপ ঔদাসীন্য দেখে কৃষ্ণ এবার নতুন পথ খোঁজে। সে বৃন্দাবনকে অপূর্ব শোভায় সাজিয়ে তুলল। এই সৌন্দর্য দেখে রাধা তার প্রতি অনুরক্ত হয়।

৮. কালীয়দমন খণ্ড: এবার কালীয়নাগকে তাড়াতে কৃষ্ণ যমুনা নদীতে ঝাঁপ দেয়। কালীয়নাগের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় কৃষ্ণের প্রতি রাধার কাতরতা প্রকাশ পায়।

৯. যমুনা খণ্ড: রাধা ও তার সঙ্গীরা যমুনা নদীতে জল আনতে যায়। কৃষ্ণ হঠাৎ নদীতে ডুব দেয়। রাধা ভাবে কৃষ্ণ হয়তো ডুবে গেছে। তাই রাধা ও তার সঙ্গীরা কৃষ্ণকে খুঁজতে শুরু করে। এদিকে কৃষ্ণ জল থেকে লুকিয়ে উঠে যায় এবং নদীতীরে রাখা রাধার গলার হার চুরি করে কদম গাছে উঠে বসে থাকে।

১০. হার খণ্ড: রাধা কৃষ্ণের চালাকি বুঝতে পেরে কৃষ্ণের পালিত মায়ের কাছে নালিশ জানায়। কিন্তু কৃষ্ণ হার চুরির কথা অস্বীকার করে। এদিকে বড়ায়ি সব কিছু বুঝতে পেরে রাধার স্বামী যাতে হার চুরির বিষয় জানতে না পারে সেজন্য বলে যে রাধার হার হারিয়ে গিয়েছে।

১১. বাণ খণ্ড: হার চুরি এবং নালিশ এই ঘটনাদ্বয়ের পরিপ্রেক্ষিতে রাধা এবং কৃষ্ণের মাঝে মনোমালিন্য দেখা দেয়। বড়ায়ি এবার কৃষ্ণকে বুদ্ধি দেয় যাতে কৃষ্ণ রাধাকে প্রেমবাণে বশীভূত করে। তাই সে পুষ্পধনু নিয়ে কদম তলায় বসে এবং রাধা কৃষ্ণের প্রেমবাণে পতিত, মূর্ছিত এবং অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

১২. বংশী খণ্ড: কৃষ্ণের বাঁশির সুরে রাধার মন স্থির থাকে না, সে কোনো কাজ ঠিকভাবে করতে পারে না। তাই বড়ায়ি এবার রাধাকে বুদ্ধি দেয় যাতে সে কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করে এই সমস্যা থেকে সমাধান পায়।

১৩. রাধাবিরহ: রাধা যখন সর্বত্যাগী হয়ে নিজেকে কৃষ্ণের কাছে সমর্পণ করতে প্রস্তুত তখন কৃষ্ণ রাধার প্রতি উদাসীনতা দেখায়। এরপর হঠাৎ করেই থেমে যায় রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী, কারণ এর পরবর্তী পাতাসমূহ আর পাওয়া যায় না। সেজন্য রাধা এবং কৃষ্ণের সর্বশেষ পরিণতি কী হলো তা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সাহায্যে বলা যাচ্ছে না।

আবিষ্কারের গল্প

এবার সংক্ষেপে একটু আবিষ্কারের গল্প শোনা যাক, না হলে যাদের কল্যাণে বাংলা ভাষার মধ্যযুগের সূচনার খোঁজ পাওয়া গেল তাদের প্রতি ঋণখেলাপি হয়ে যায়। ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাকিল্য গ্রামের এক বাড়ির গোয়াল ঘর থেকে এটি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ সালে তারই সম্পাদনায় গ্রন্থটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। পুথিটির প্রথম এবং শেষের দিকের কিছু পাতা পাওয়া যায়নি বলে এর নামধাম, কবির পরিচয়, রচনাকাল ইত্যাদি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না।

বসন্তরঞ্জন রায় কর্তৃক সম্পাদিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন; Image Source: wikimedia.org

নামকরণ

সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় কাব্যের বিষয়বস্তু দেখে এর নাম রাখেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। তবে এই নাম নিয়ে পরবর্তীতে অনেক জলঘোলা হয়েছে। যারা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণের বিরোধী তাদের মতে, প্রথমত, এটি একটি আদিরসাত্মক কাব্য. এতে কৃষ্ণের শ্রী বা কীর্তন কোনোটিই উপস্থিত নেই। বরঞ্চ কৃষ্ণের দেবতারূপ উপেক্ষিত হয়ে তার লৌকিক রূপ বর্ণিত হয়েছে এ কাব্যে। দ্বিতীয়ত, পুথির সঙ্গে একটি চিরকুট পাওয়া যায় এবং সেখানে ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব’ বলে একটি কথা পাওয়া যায়। এ কারণে অনেকে মনে করেন গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’।

শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ; Image Source: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম
বর্তমান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ; source: jiyobangla.com

কাব্যের লেখক

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আবিষ্কৃত হওয়ার পর বাংলা সাহিত্যে এক সমস্যা দেখা দেয়, যার নাম চন্ডীদাস সমস্যা। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যে চন্ডীদাস নামের একাধিক কবির উপস্থিতি এই সমস্যা সৃষ্টি করে। তবে সে নাহয় আরেকদিন হবে। আজকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কবি বড়ু চন্ডীদাসেই সীমাবদ্ধ থাকা যাক।

তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। এমনকি পরবর্তী সময়কালে তার রচিত কোনো গ্রন্থের উল্লেখ এবং সন্ধান কিছুই পাওয়া যায় না। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে যতটুকু জানা যায় তা হলো- কাব্যে তার তিনটি ভণিতার দেখা মেলে: বড়ু চন্ডীদাস, চন্ডীদাস ও আনন্ত বড়ুচন্ডীদাস। এছাড়া আরো জানা যায়, তিনি বাসুলী দেবীর উপাসক ছিলেন। এই বাসুলী দেবী প্রকৃতপক্ষে চন্ডী বা মনসার অপর নাম। তাছাড়া তার জীবনকাল সম্পর্কে প্রায় সকল পন্ডিতের মত- তিনি চৈতন্যপূর্ববর্তী সময়ের মানুষ।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কিছু পাঠ; Image Source: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম

তাৎপর্য

এবার একটু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর তাৎপর্য নিয়ে কথা বলা যাক। প্রথমত, এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য। এই কাব্য আবিষ্কৃত না হলে হয়তো প্রাচীন বাংলা সাহিত্য এবং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মধ্যে যে অন্ধকার যুগটা রয়েছে সেটা আরো প্রলম্বিত হতো। সেই সাথে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম রূপের সঙ্গে মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার যে সেতুবন্ধন হয়েছে এই আদি মধ্যযুগের কাব্যের মাধ্যমে সেটা হয়তো সম্ভব হতো না।

এ তো গেল ঐতিহাসিক তাৎপর্য। এছাড়াও এর সাহিত্যিক তাৎপর্যও কম নয়। কাব্যের গল্প পাঠে আমরা দেখতে পাই, এখানে কৃষ্ণকে দেবতা হিসেবে না দেখিয়ে গ্রামের চঞ্চল যুবক হিসেবে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ দেবতার মানবায়ন ঘটেছে সেখানে। যদিও পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সমাদর পায়নি বলা যায় এ কারণে যে পরবর্তীতে বৈষ্ণব পদাবলীর সাহায্যে শ্রীকৃষ্ণের উপস্থাপনের আঙ্গিক সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। তৎকালীন বৈষ্ণব পদাবলীর পদকর্তাগণ, গুরুজন, তারা কৃষ্ণের মানবায়নকে খুব একটা পছন্দ করেননি। এ কারণেই ধারণা করা হয় যে এই ‘কৃষ্ণকীর্তন’কে লুকিয়ে ফেলা বা সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে দেবতাদের দেবত্বের যে শৃঙ্খল, সেই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার প্রথম প্রয়াস এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।

অনলাইনে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বইটি কিনতে চাইলে ক্লিক করুন নিচের লিংকে-

https://rb.gy/0tf7sg 
https://rb.gy/trtblu 

This is a bengali article describing the history of literary work 'Shreekrishnakritan'.

Reference:

১. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস; অধ্যাপক মাহবুবুল আলম; প্রকাশক: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি; ষোড়শ সংস্করণ
২. কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী; হুমায়ুন আজাদ; আগামী প্রকাশনী; দ্বিতীয় সংস্করণ
৩. বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি; একাদশ শ্রেণি; পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ
৪. প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য (দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী); Directorate of Distance Education, Tripura University

Related Articles