এমন যদি হতো, পৃথিবীর সব মানুষেরই খাদ্যের চাহিদা মিটে গেছে কিংবা কেউ চাইলেই যেকোনো পুষ্টি-গুণসম্পন্ন খাবার পেয়ে যাচ্ছে হাতের কাছে? যদিও শুনতে অস্বাভাবিক লাগতে পারে, এমন অনেক উদ্ভিদবিজ্ঞানী আছেন যারা কাজ করছেন বিজ্ঞানের এমন একটা দিক নিয়ে যেখানে কোনো গাছের সামান্য জেনেটিক কোড পরিবর্তনের মাধ্যমেই ঘটে যেতে পারে খাদ্যের বড় বিপ্লব। আমাদের নিত্যদিনের সহজলভ্য ভাত কিংবা রুটিতেই থাকবে ভিটামিন এ, বি, সি কিংবা থাকবে আরও অনেক পুষ্টিগুণ। আর সেসব ধান আর গমের উৎপাদনও হবে বর্তমানের চেয়ে বহুগুণ। বিজ্ঞানের এই শাখাটিই হলো প্লান্ট ব্রিডিং, যেখানে প্রতিনিয়তই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদ। যার ফলেই হয়তো সত্যি হবে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন।
প্লান্ট ব্রিডাররা অনেকদিন ধরেই উন্নত ফসল উৎপাদনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এর ফলশ্রুতিতে কিছু কিছু ফসলের প্রায় ৫০ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফসল উদ্ভিদের উন্নয়ন বলতে আসলে এর গুণাগুণ, ফলন, সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জৈব ও অজৈব পীড়নের বিরুদ্ধে সহনশীলতা বৃদ্ধিকে বোঝায়। গেল কয়েক দশকে প্লান্ট ব্রিডিংয়ের খাবারে স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন উদ্ভিদের আঞ্চলিক জাত উদ্ভাবনের দিকে গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফলন বৃদ্ধি
পৃথিবীতে জনসংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সেই সাথে কমে যাচ্ছে ফসলি জমির পরিমাণ। তাই এখন বিজ্ঞানীদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ অল্প জমিতে বেশি ফসল উৎপাদন। এক্ষেত্রে ফসলের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা যেমন, রোগবালাই, লবণাক্ততা, খরা, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি সহনশীল জাত উদ্ভাবন করার কোনো বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি জেনেটিক উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল জাতও উদ্ভাবন করা গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই সহনশীল জাত উদ্ভাবন বর্তমানে কৃষিক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখতে পারছে। প্লান্ট ব্রিডিং ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাহায্যে কোনো ফসলের ডিএনএতে প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জিন স্থাপন করে এমন সব ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে, যারা নিজেরাই বিভিন্ন ধরনের পোকা মাকড়ের আক্রমণ ও রোগ বালাই থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জিন থেকে একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরি হচ্ছে, যেটি সেই ফসলের পোকার জন্য বিষাক্ত কিন্তু মানুষের জন্য বিষাক্ত নয়। তাই মানুষের খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিটি বেগুনের কথা। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাহায্যে গবেষকরা ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস ব্যাকটেরিয়া থেকে ক্রিস্টাল প্রোটিন বেগুনে প্রবেশ করিয়ে বর্তমানে এর সবচেয়ে বড় শত্রু বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ অনেক গুন হ্রাস করতে পেরেছে।
লবণাক্ততা সহনশীল জাত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। খাদ্য হিসেবে ধানের ক্ষেত্রে কোনো একটি জাতের ফলন বৃদ্ধিই সবচেয়ে বড় সূচক হিসেবে কাজ করে। লবণাক্ততা সহনশীল ধানের যে জাত বর্তমানে উদ্ভাবিত হয়েছে তারা ০.৩% লবণাক্ত জমিতেও প্রতি হেক্টরে ৪৫০০ কেজির বেশি ফলন দিয়ে থাকে। বহু বছরের চেষ্টায় বর্তমানে ব্রিডাররা অনেক লবণাক্ততা সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন ও সংরক্ষণ করতে পেরেছেন। লবণাক্ততার জন্য উদ্ভিদে যে সকল আয়নিক পীড়ন এবং আস্রবণশীল পীড়নের সৃষ্টি হয় তার বিপক্ষে উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য এবং ফলন বাড়ানোর জন্যই মূলত সহনশীল জাত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বব্যাপী পানির স্বল্পতা এবং কৃষিক্ষেত্রে খরার কারণে অনেক ফসলের ফলনই কমে গিয়েছে। তাই বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে জল সাশ্রয়ী এবং খরা সহনশীল ফসলের নতুন ব্রিড নিয়ে আসার গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। উদ্ভিদের মূলের গঠনের ক্ষেত্রেই নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য আনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে খরা সহনশীল কোনো নতুন জাত তৈরি করার ক্ষেত্রে।
পানির স্বল্পতা উদ্ভিদের পাতার আকার হ্রাস করে, কাণ্ডের বৃদ্ধিতেও প্রভাব ফেলে এবং প্রচুর পরিমাণে ফলন কমিয়ে দেয়। তাই খরা সহনশীল জাত উদ্ভাবন করার জরুরি। বিজ্ঞানীরা ফসলের উন্নতিকল্পে একই প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে সাধারণ মেন্ডেলিয়ান বিভাজনের মাধ্যমেই নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভিদ তৈরি করতে পারছেন।
এর পাশাপাশি জলাবদ্ধ পরিবেশেও যেন ফসলের ফলন বাড়ানো যায় তার জন্যেও গবেষকরা তৈরি করে যাচ্ছে নতুন নতুন জাত। এর ফলে বাংলাদেশের নিচু ভূমিতে যেখানে বছরের বড় একটা সময় পানি জমে থাকে সেখানেও উদ্ভিদ জন্মানো সম্ভব হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী পুষ্টির চাহিদা পূরণ
পৃথিবীতে প্রায় ৮৪০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বর্তমানে তাদের শক্তির চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। এছাড়াও প্রায় ৩ বিলিয়ন মানুষ নানা ধরনের মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাবে ভুগছে। ভালো শাক সবজি, ফলমূল কিংবা মাছ মাংস ইত্যাদি তাদের ক্রয় ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। সাব-সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা ক্যারিবিয়ান এলাকার নারী ও শিশুরা বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট যেমন, আয়রন, ভিটামিন এ, আয়োডিন ও জিংকের অভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগ এবং অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এ সকল সমস্যা সমাধানের বড় একটা মাধ্যম হতে পারে এ সকল পুষ্টি আমাদের জন্য সহজলভ্য খাবারগুলোতেই পাওয়া গেলে।
প্লান্ট ব্রিডিংয়ের ক্ষেত্রে কমলা মিষ্টি আলুর উৎপাদন হতে পারে পুষ্টির চাহিদা পূরণে একটি সফল গল্প। দেখা গেছে কমলা মিষ্টি আলুতে বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে বৃদ্ধি করা প্রোভিটামিন এ, এই উদ্ভিদের ভিটামিন এ উত্তোলন বৃদ্ধি করে এবং আফ্রিকার সাধারণ সাদা মিষ্টি আলুর প্রজাতির তুলনায় অনেক বেশি ভিটামিন বহন করে। এটা সত্যিই একটি উৎসাহজনক খবর যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার আফ্রিকান শিশু ভিটামিন এ-র অভাবে অন্ধ হয়ে যায়।
ধানের পরেই গম এশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্যশস্য। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জন্য যেখানে জিংক-যুক্ত খাবার অপ্রতুল সেখানে বায়োফর্টিফাইড গমে থাকা অতিরিক্ত জিংক এ সকল মানুষের জন্য জিংকের চাহিদা পূরণে কাজ করবে।
এছাড়াও ভিটামিন এ-র চাহিদা পূরণে গোল্ডেন রাইসের উৎপাদন একটি বড় অর্জন। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যেখানে মানুষের সারাদিনের অর্ধেক ক্যালোরির চাহিদা মিটে থাকে ভাত খাওয়ার মাধ্যমে সেখানে গোল্ডেন রাইস ভিটামিন এ-র চাহিদা নিরসনে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। গোল্ডেন রাইসের ক্ষেত্রে ভাতের গুণগত মান বৃদ্ধি করবে বিটা ক্যারোটিন যা ভিটামিন এ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখবে। সাধারণ ধান গাছের পাতা কিংবা কাণ্ডে বিটা ক্যারোটিন থাকলেও বিজ্ঞানীরা গোল্ডেন রাইসকে এমনভাবে মডিফাই করেছেন যাতে মানুষের খাওয়ার অংশ ভাতেও বিটা ক্যারোটিন থাকে।
হাইব্রিড ও জিএমও খাদ্য
হাইব্রিড খাদ্য বলতে সে ধরনের খাবারকে বোঝায় যারা স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয় না বরং নির্বাচিত ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত উন্নত জাতের উদ্ভিদ থেকে সংগ্রহ করা হয়। ক্রসিং প্রক্রিয়ায় মানুষের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদের তৈরি করাই হলো হাইব্রিডাইজেশন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বড় সব কৃষি অর্থনীতির উৎসই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন ধরনের উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ফল, সবজি কিংবা ফসলের চাষ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বীজহীন তরমুজ, বীজহীন সাইট্রাস ফল কিংবা উন্নত জাতের বাঁধাকপি, আলু ইত্যাদি।
জিএমও উদ্ভিদ মূলত তৈরি করা হয় অন্য কোনো জীব হতে প্রাপ্ত কোনো একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জিনকে উক্ত উদ্ভিদের ডিএনএ-তে স্থানান্তরের মাধ্যমে। একটি জিনের প্রবেশই কোনো একটা জীবের বৈশিষ্ট্য বদলে দিতে পারে। মূলত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বারা আমাদের প্রয়োজনীয় উদ্ভিদের ডিএনএ-কে কিছুটা পরিবর্তন করার মাধ্যমেই জেনেটিকালি মোডিফাইড অর্গানিজম বা জিএমও উদ্ভিদ তৈরি করা হয়। এ সকল হাইব্রিড ও জিএমও খাদ্যই আমাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষের জন্য পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে যাবে এবং মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।