ধরুন, হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি কিংবা মেঘলা আকাশ। এর মাঝে ফোন কিংবা টেক্সট দিতে ইচ্ছে হলো দূরে থাকা প্রিয়জনকে। কী করবেন তখন? প্রযুক্তির আশীর্বাদে মুহূর্তেই সন্দেশ পৌঁছে দেবেন প্রিয়জনের কাছে। কিন্তু, বার্তা পৌঁছানোর কোনো মাধ্যমই যদি না থাকত, তাহলে কেমন হতো?
বর্ষার বৃষ্টিস্নাত দিনগুলো প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের মনেও যোগ করে নতুন মাত্রা। তাই বর্ষাকে ঘিরে দেশ-বিদেশ জুড়ে কবি সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন দারুণ সব গান, কবিতা আর উপন্যাস। বহু বছর আগে আষাঢ়ের এমনই এক দিনে প্রেয়সীর কাছে সন্দেশ পাঠানোর আকুলতাকে ঘিরে কবি কালিদাস রচনা করেছেন বর্ষাকাব্য ‘মেঘদূত’, যা সংস্কৃত সাহিত্যের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বহু ভাষা, সাহিত্য ও মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। আর মেঘদূতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে বর্ষায় মানবমনের আকুল আবেদন।
বিরহ, অপেক্ষা আর প্রেয়সীর কাছে সন্দেশ পাঠানোর আকাঙ্ক্ষাকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে অনবদ্য এই কাব্য।
কাহিনীসংক্ষেপ
কশ্চিৎ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ
শাপেনাস্তংগমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেন ভর্তুঃ।
যক্ষশ্চক্রে জনকতনয়াস্নানপুণ্যোদকেষু
স্নিগ্ধচ্ছায়াতরুষু বসতিং রামগির্যাশ্রমেষু॥
‘মেঘদূত’ কাব্যের মূল চরিত্রে আছে যক্ষ এবং তার পত্নী। তাদের নিবাস অলকানগরীতে। যক্ষ ছিল কুবেরের সেবায় নিয়োজিত এক সেবক এবং ধনপতি কুবেরের বাগান দেখাশোনা করত। কিন্তু একদিন হাতির পাল সেই বাগানে ঢুকে বাগান নষ্ট করে দেয়। আর এ কারণে যক্ষ তার প্রভু কুবেরের শাপপ্রাপ্ত হয়ে নির্বাসিত হয় রামগিরিতে।
তস্মিন্নদ্রৌ কতিচিতবলাবিপ্রযুক্তঃ স কামী
নীত্বা মাসান্ কনকবলয়ভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ।
আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ॥
প্রিয়ার বিরহে যক্ষের নির্বাসিত সময় কাটতে থাকে রামগিরিতে। ঋতু পাল্টে আসে আষাঢ় মাস। আষাঢ়ের প্রথম দিবসে মেঘের আগমনে প্রকৃতির নিয়মেই যক্ষের মন আকুল হয়ে ওঠে তার প্রিয়ার জন্য। বিরহী যক্ষ তখন মেঘের কাছে অনুনয় জানায়, তার সন্দেশ অলকানগরীতে তার প্রিয়ার কাছে পৌঁছে দেবার। আর যক্ষপ্রিয়ার কাছে মেঘকে দূত করে সন্দেশ পাঠানোর কাহিনীকে উপজীব্য রচিত হয়েছে সংস্কৃত সাহিত্যের বহুল সমাদৃত কাব্য মেঘদূত।
১১৮টি শ্লোক বিশিষ্ট কবি কালিদাস মেঘদূত কাব্য রচনা করেছেন এবং দু’টি খণ্ডে ভাগ করেছেন; উত্তরমেঘ ও পূর্বমেঘ।
পূর্বমেঘ
পূর্বমেঘের প্রথম অংশে মেঘদূত কাব্যের ঘটনাপ্রবাহের আরম্ভ, এ অংশেই দেখা মিলবে মেঘদূত কাব্যের নায়ক যক্ষের সাথে। এরপর পর্যায়ক্রমে এসেছে তার প্রেয়সী এবং অলকানগরীর কথা। সদ্য বিবাহিত যক্ষ আর তার পত্নীর নিবাস অলকানগরীতে। এরপর কাহিনীর মোড় নিতে আগমন হয়েছে যক্ষের প্রভু ধনদেবতা কুবেরের। ঘটনাপ্রবাহে যক্ষ নির্বাসিত হয় রামগিরিতে। আর এখান থেকেই গল্পের মূল অংশ। নির্বাসিত যক্ষ রামগিরি থেকে অলকানগরীতে তার প্রিয়ার কাছে বার্তা পাঠানোর জন্য মেঘের কাছে জানায় আকুল আবেদন।
এই ঘটনার প্রবাহের বিপরীতে পূর্বমেঘের মূল আকর্ষণ হচ্ছে রামগিরি থেকে অলকানগরীর মেঘের যাত্রাপথের বর্ণনা। মেঘ যখন যক্ষের বার্তা নিয়ে অলকানগরীর দিকে যাবে, সে যাত্রাপথের সৌন্দর্য বর্ণিত হয়েছে শ্লোক ১৬ থেকে ৬৪ পর্যন্ত।
পাণ্ডুচ্ছায়োপবনবৃতয়ঃ কেতকৈঃ সুচিভিন্নৈঃ-
নীড়ারম্ভৈর্গৃহবলিভুজামাকুল্গ্রামচৈত্যাঃ।
পূর্বমেঘের এ অংশে কবি অলকানগরীর যাত্রাপথের সৌন্দর্য বর্ণনা দিতে কবি ব্যবহার করেছেন অনিন্দ্যসুন্দর সব উপমা আর ফুটিয়ে তুলেছেন রামগিরি থেকে অলকানগরী পর্যন্ত অখণ্ড ভারতের রূপ।
পূর্বমেঘ পড়তে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠবে অলকানগরীর যাত্রাপথে উজ্জয়নী, অবন্তি অথবা বিদিশা নগরীর দৃশ্য। কিংবা কানে বেজে উঠবে রেবা, শিপ্রা ও বেত্রবতী নদীর বহমান জলধারার কলকল ধ্বনি ও ভেসে আসবে নদীর ধারের ভুঁইচাপার সুবাস।
আবার ‘পূর্বমেঘ’ পড়তে পড়তে সন্ধ্যা নামতে পারে বিন্ধ্য, কৈলাস কিংবা দেবগিরি পাহাড়চূড়ায়। আবার কখনও হারিয়ে যাবার সাধ জাগে মেঘের যাত্রাপথের কেতকী বনে। পথিমধ্যে দেখা মিলবে মেঘের ছাঁট পেয়ে আনন্দিত চাতকের দলের সাথে। আর বইয়ের পরতে পরতে মুগ্ধতা ছড়াবে বর্ষার স্নিগ্ধ সতেজ কদমগুচ্ছ।
এভাবেই বহু নগর, পাহাড়, নদী আর বন পেরিয়ে মেঘ পৌঁছায় অলকানগরীতে। তারপর আসে ‘উত্তরমেঘ’-এর পালা।
উত্তরমেঘ
বহু দূর-দূরান্ত পেরিয়ে মেঘ পৌঁছে যায় সেই অলকানগরীতে। পূর্বমেঘ জুড়ে অলকানগরীর যাত্রাপথের বর্ণনার পর দেখা মেলে যক্ষপ্রিয়ার বাড়ির। যার বর্ণনায় পাঠকের মানসপটেও সেই বাড়িটি ভেসে উঠবে অবিকলভাবে।
বাসশ্চিত্রং মধু নয়নয়োর্বিভ্রমাদেশদক্ষং
পুষ্পোদ্ভেদং সহ কিসলয়ৈর্ভূষণানাং বিকল্পান্
লাক্ষারাগং চরণকমলন্যাসযোগ্যঞ্চ ষস্যা-
মেকঃ সূতে সকলমবলামণ্ডনং কল্পবৃক্ষঃ।।
মেঘ যখন কুবেরের বাড়ি পৌঁছবে, তখন দেখা মিলবে বাড়ির পাশের উঠোনে থাকা মন্দার গাছটির। আর কিছুদূর পাশেই আসছে পান্নাশোভিত একটি হৃদ, যেখানে তখন ভেসে বেড়াবে হাঁসের দল আর নীলকান্তমনি শোভিত পদ্মের কাণ্ডে ছেয়ে থাকবে পুরো হ্রদ।
এভাবেই অলকাপুরী আর যক্ষের বাসগৃহের বর্ণনার পর দেখা মিলবে যক্ষপ্রিয়ার। যক্ষপ্রিয়ার রূপের বর্ণনায় বিখ্যাত একটি শ্লোক,
তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী…
হালকা গড়নের ঈষৎ শ্যামলা বর্ণ- এমনভাবেই তার রূপের বর্ণনা শুরু হয়েছে। এরপর বহু উপমা আর রূপে রঞ্জিত হয়েছে যক্ষপ্রিয়া। বিখ্যাত এই শ্লোকটির সৌন্দর্য সংস্কৃত সাহিত্যের সীমানা ছাড়িয়ে স্থান করে নিয়েছে অন্য বহু ভাষার সাহিত্যকর্মে। শুধু সৌন্দর্যের বর্ণনাই নয়, যক্ষের বিরহে বিনিদ্র রজনী পার করে যক্ষপ্রিয়ার মলিন দশাও বর্ণিত হয়েছে দারুণ ভঙ্গিমায়।
এরপর মেঘ পৌঁছে যায় যক্ষপ্রিয়ার কাছে এবং তাকে পৌঁছে দেয় বহু প্রতীক্ষিত যক্ষের বার্তা। এভাবেই প্রেয়সীর কাছে যক্ষের বার্তা পৌঁছানোর মধ্য দিয়েই ‘মেঘদূত’ কাব্যটি এর নামের সার্থকতা পায়।
মেঘদূত আনুমানিক ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত একটি কাব্য। এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত হওয়ার কারণে অনেকের কাছেই এর পাঠ কিছুটা দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। তাই অসাধারণ এ সাহিত্যকর্মের অর্থ বিশ্লেষণ নিয়ে বিভ্রাট এড়াতে পড়তে পারেন বিভিন্ন সাহিত্যিকের অনুবাদ গ্রন্থসমূহ। বুদ্ধদেব বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বহু গুণী কবিসাহিত্যিক গুণ বহুরূপে মেঘদূতকে অনুবাদ করেছেন এবং প্রতিটি অনুবাদের রয়েছে নিজস্ব আবেদন। যে ভাষায়ই হোক না কেন, প্রাচীন সাহিত্যের কালজয়ী এই রচনাটি পাঠকদের কাছে বেশ সুখপাঠ্য হবে।