‘রক মিউজিক’; বর্তমান সময়ে সঙ্গীতজগতে বিলুপ্তপ্রায় এক ধারা। কিন্তু রক সঙ্গীতের এই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতেও কিছু কিছু দর্শক প্রতিনিয়ত উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন এ সঙ্গীত দ্বারা। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো রক-ব্যান্ডগুলোর। একটা সময় ছিল, যখন প্রত্যেক দশকেই রক সঙ্গীতে নতুন কোনো ধারার আবির্ভাব হতো। মূলত ব্লুজ মিউজিক থেকে উঠে আসা রক এন রোল জনরাটি পঞ্চাশের দশকে এসে তার অবস্থান শক্ত করে তোলে। পরে ষাট এবং সত্তর দশকে গিটারে ডিস্টোরশনের ব্যাবহার বেড়ে গেলে জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে ‘হার্ড রক’ মিউজিক।
এরই ধারাবাহিকতায় আশির দশকে যখন হেভি মেটাল জনরা পুরো সঙ্গীতজগতে নিজের ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল, ঠিক সেই সময় রক মিউজিক আবিষ্কার করে নতুন একধরনের সাউন্ড। আর এই সাউন্ডটিই পরবর্তী সময়ে নিজের পরিচিতি লাভ করে গ্রাঞ্জ-রক হিসেবে। নির্ভানার ‘স্মেলস লাইক টিন স্পিরিট’ গানটি এ ধারাকে পৌঁছে দিয়েছিল অনন্য এক উচ্চতায়। এ ধারার পেছনে স্থপতি বা ‘আর্কিটেক্ট’ হিসেবে যার অবদান সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল, তিনিই ক্রিস কোরনেল।
২০১৭ সালে পুরো সঙ্গীতজগত স্তম্ভিত হয়ে যায়, জনপ্রিয় ব্যান্ডদল লিংকিন পার্কের ভোকালিস্ট চেস্টার বেনিংটনের আত্মহত্যার খবরে। সেই দিনটি ছিল ২০ জুলাই, ক্রিস কোরনেলের জন্মদিন। আর এ ঘটনার ঠিক দু’মাস আগেই চেস্টারের মতো কোরনেলও আত্মহত্যা করেন। মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে ভক্তরা হারায় দু’জন অসাধারণ প্রতিভাবান গায়ককে।
সঙ্গীতের ভুবনে অসংখ্য অবদান রেখে চলা ক্রিস কোরনেল একাধারে ছিলেন গায়ক, গীতিকার, গিটারবাদক এবং বিখ্যাত গ্রাঞ্জ ব্যান্ড সাউন্ডগার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৪ সালের ২০ জুলাই, ওয়াশিংটনের সিয়াটল শহরে তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। তার বাবা ছিলেন একজন ফার্মাসিস্ট এবং মা হিসাবরক্ষক। জন্মের পর তার নাম রাখা হয়েছিল ক্রিস্টোফার জন বয়েল। কিন্তু কিশোর বয়সেই হঠাৎ তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ক্রিস এবং তার ভাইবোনেরা তাদের মায়ের নাম অনুযায়ী নিজেদের নামের শেষে ‘কোরনেল’ রাখেন।
বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ প্রভাব ফেলতে শুরু করে ক্রিসের উপর। মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পরেন তিনি। ১৫ বছর বয়সে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। আর এখান থেকেই শুরু তার একাকিত্বের জীবন। এ অবস্থায় তিনি ভীষণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং পুরোটা সময় বাসায় থাকা শুরু করেন। তেমন কোনো বন্ধুবান্ধবও ছিল না। ধীরে ধীরে তিনি আশপাশের মানুষজন থেকে নিজেকে পুরোপুরি আড়াল করে ফেলেন।
এভাবেই একাকিত্বের এই সময়ে নিজেকে তিনি ফিরে পান রক সঙ্গীতের মাধ্যমে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিস গানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। ছোট থেকেই তিনি পিয়ানো এবং গিটারে অনুশীলন করতেন। সেখান থেকেই তার প্রতিভা ফুটে ওঠে। একবার এক প্রতিবেশীর বেসমেন্টে তিনি বিটলসের অ্যালবাম কালেকশন ফেলে রাখা অবস্থায় খুঁজে পান। সেই কালেকশনের গানগুলো শুনেই নিজের ছোটবেলা পার করেছিলেন ক্রিস কোরনেল।
সঙ্গীতশিল্পী হওয়ার আগে আয়-রোজগারের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম কাজ করতে হয়েছিল ক্রিসের। কিছু সময় তিনি ছিলেন একটি রেস্তোরাঁয়। সেখানে তার কাজ ছিল টেবিল পরিষ্কার করা ও থালাবাসন আনা-নেওয়া করা। আবার কখনো তিনি কাজ করেছেন সিফুড পাইকারের দোকানে মাছ বিক্রেতা হিসেবে। এছাড়াও সিয়াটলের ‘রে’স বোটহাউস’ নামক একটি রেস্তোরাঁয় বাবুর্চি হিসেবেও কাজ করেছেন পরবর্তী সময়ের এই রকস্টার।
এর পরই আশির দশকের শুরুতে ক্রিসের দেখা হয় সাউন্ডগার্ডেনের গিটারবাদক কিম থাইলের সাথে। কিম ও তার বন্ধু ব্রুস পাভিট ওয়াশিংটনে এসেছিলেন কলেজে পড়াশোনার জন্য। সিয়াটেলে ক্রিস ছিলেন কিমের রুমমেট। আর এভাবেই একজন আরেকজনের সাথে পরিচিত হওয়ার পর ক্রিস, তার সাথী হিরো এবং কিম মিলে ১৯৮৪ সালে গঠন করেন ব্যান্ডদল ‘সাউন্ডগার্ডেন’।
‘সাউন্ডগার্ডেন’ নামটি তারা রেখেছিলেন সিয়াটলের একটি বায়ু চ্যানেলিং পাইপ ভাস্কর্যের নামের উপর ভিত্তি করে। সাউন্ডগার্ডেনে থাকা অবস্থায় পরবর্তী সময়ে গিটার বাজালেও ক্রিস ব্যান্ড শুরু করেছিলেন একজন ড্রামার হিসেবে। তাদের বন্ধু ব্রুস ব্যান্ডে যোগদান না করলেও, সেই সময় গঠন করেন ‘সাব পপ’ রেকর্ড লেবেল। আর এই রেকর্ড লেবেলের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো সঙ্গীতাঙ্গনে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করে সাউন্ডগার্ডেন, মাডহানি এবং নির্ভানার মতো ব্যান্ডগুলো। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ক্রিস এবং তার সহযোগীরা জানান দেন, সঙ্গীতজগতে তারা নতুন পরিবর্তন করতে এসেছেন। যে পরিবর্তন কিছু সময় পর রূপ নেয় গ্রাঞ্জ-রক হিসেবে।
সাউন্ডগার্ডেন ছিল সিয়াটল শহর থেকে উঠে আসা প্রথম সারির ব্যান্ডগুলোর একটি। এই বিষয়ে ২০১৪ সালে গিটার সেন্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্রিস বলেন,
“যদি আপনি সিয়াটলে বেড়ে ওঠেন, তাহলে আপনি কখনোই নিজেকে একজন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে দেখার আশা রাখবেন না। কারণ, আমরা আমাদের আশেপাশে কাউকে সঙ্গীত নিয়ে কিছু করতে দেখিনি। এ ধরনের শিল্প নিয়েও যে কাজ করা যায়, এটা আমি প্রথম বুঝতে পারি, যখন আমি আমার প্রথম ব্যান্ডে যোগদান করি। তখন আমার মনে হয়েছিল, কাজটা আমার জন্যই।”
১৯৮৮ সালে সাউন্ডগার্ডেন তাদের প্রথম স্টুডিও অ্যালবামের কাজ শুরু করে। প্রথম অ্যালবামের জন্য কিছু বড় রেকর্ড কোম্পানি সাউন্ডগার্ডেনকে প্রস্তাব জানায়, কিন্তু সাউন্ডগার্ডেন তাদের সাথে চুক্তি না করে একটি স্বতন্ত্র রেকর্ড কোম্পানির সাথে অ্যালবাম মুক্তির চুক্তি করে এবং ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে তারা প্রকাশ করে তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘আলট্রামেগা ওকে’। সাউন্ডগার্ডেন একটি গ্রাঞ্জভিত্তিক ব্যান্ড হলেও, শুরুর দিকে তাদের গানের কথাগুলো ছিল গম্ভীর ধরনের এবং সাউন্ড ছিল হেভি-মেটালের সাথে কিছুটা সাইকেডেলিক রকের মতো।
নিজের সঙ্গীতজীবনের প্রথম অ্যালবামেই ক্রিস কোরনেল তার গায়কীর প্রতিভা তুলে ধরেন। অ্যালবামে ‘বিয়ন্ড দ্য হুইল’ শিরোনামের একটি গানে তিনি নিজের কণ্ঠস্বরকে বারবার পরিবর্তন করছিলেন এবং কোরাস গাওয়ার সময় নিজের কণ্ঠ পরিসীমাকে তিন থেকে চার অক্টেভ রেঞ্জের মধ্যে রেখেছিলেন। এ সকল বিষয় সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে, ১৯৯০ সালের গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডসে মেটাল বিভাগে মনোনয়ন দেওয়া হয় সাউন্ডগার্ডেনকে।
পরের বছরগুলোতে সাউন্ডগার্ডেন যথাক্রমে মুক্তি দেয় তাদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অ্যালবাম। অ্যালবামগুলোর ফলে সাউন্ডগার্ডেনের একটা ভক্তকূল তৈরি হয়। কিন্তু সেই সময় মেটালিকা এবং গান্স এন রোজেজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যাচ্ছিল, ফলে সাউন্ডগার্ডেন খুব বেশি পরিচিতি অর্জন করতে পারেনি। এরই মধ্যে সাউন্ডগার্ডেনের তৃতীয় অ্যালবাম মুক্তির সময় একই দিনে নির্ভানা রিলিজ করে তাদের বিখ্যাত অ্যালবাম ‘নেভারমাইন্ড’। ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়ায় নির্ভানা চলে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে এবং গ্রাঞ্জ ব্যান্ডগুলো চোখে পড়ে সকলের।
তৃতীয় অ্যালবামের প্রায় তিন বছর পর সাউন্ডগার্ডেন মুক্তি দেয় তাদের যুগান্তকারী চতুর্থ অ্যালবাম ‘সুপার আননোউন’। আর এই অ্যালবামটির মাধ্যমেই সাউন্ডগার্ডেন দেখা পায় তাদের কাঙ্ক্ষিত সফলতার। ‘সুপার আননোউন’ এখন পর্যন্ত সাউন্ডগার্ডেনের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া অ্যালবাম। অ্যালবামটি বিলবোর্ড টপচার্টে শীর্ষস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং শুধুমাত্র প্রথম সপ্তাহেই তিন লাখেরও বেশি কপি বিক্রি করে।
১৬টি গানে সাজানো বিশাল এই অ্যালবামের অধিকাংশ গানই ক্রিস কোরনেলের লেখা ছিল। এমনকি অ্যালবামের বিখ্যাত গান ‘ব্ল্যাক হোল সান’ ক্রিস লিখেছিলেন মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে। এছাড়াও অ্যালবামটিতে ক্রিস গানের ধারা অনুযায়ী তার কণ্ঠের বৈচিত্র্যময় রূপ প্রকাশ করেন। কখনো তিনি গানের মধ্যে সুরের সাথে খুব ভারি গলায় গান গাচ্ছিলেন, আবার কখনো মৃদু কণ্ঠে গানের মধ্যে একধরনের হতাশা প্রকাশ করছিলেন। অ্যালবামটি বেস্ট রক অ্যালবামের গ্র্যামি মনোনয়নসহ তুলে নেয় দুটি জয়। এরপর সাউন্ডগার্ডেনের সদস্যরা নিজেরাই তাদের পঞ্চম অ্যালবাম প্রযোজনা করেন।
অবশেষে ১৯৯৬ সালে মুক্তি দেওয়া হয় অ্যালবামটি। আগের অ্যালবামের মতো এই অ্যালবামেও ছিল ১৬টি গান। আর এখান থেকেই ব্যান্ডের সদস্যদের মধ্যে সমস্যা দেখা দেয়। কনসার্টের অতিরিক্ত চাপ এবং মতামতে মিল না হওয়ায় ১৯৯৭ সালে ব্যান্ডের সদস্যরা বিরতিতে চলে যায়। ক্রিস শুরু করেন তার সোলো ক্যারিয়ার এবং পরে যোগ দেন ব্যান্ডদল ‘অডিওস্লেভ’-এর সাথে।
২০০০ সালে ‘রেজ এগেইনস্ট দ্য মেশিন’ ব্যান্ডদল থেকে তাদের ভোকালিস্ট ব্যান্ড ছেড়ে দেয়। তখন গিটারবাদক টম মরেলো এবং ব্যান্ডের অন্য সদস্যরা একজন নতুন ভোকালিস্টের খোঁজ করছিলেন, ঠিক সেই সময় তাদের বন্ধু সঙ্গীত প্রযোজক রিক রুবিন তাদেরকে ক্রিস কোরনেলের কথা বলেন। টম এবং রিক সিদ্ধান্ত নেন, তারা ক্রিসের সাথে এ বিষয়ে দেখা করবেন। ক্রিস তাদের সাথে পরে যোগ দেন এবং মাত্র ১৯ দিনের অনুশীলনে ক্রিস ২১টি নতুন গান লিখে ফেলেন। কিন্তু হঠাৎ ১৩টি গানের মিক্সিং রেকর্ড লিক হয়ে যায়, সেখান থেকে সামাল দিয়ে ২০০২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে তারা প্রকাশ করে তাদের প্রথম মিউজিক ভিডিও।
‘কোচিস’ নামক গানের মিউজিক ভিডিওটি শুরু হয় ‘রেজ এগেইনস্ট দ্য মেশিন’ ব্যান্ডের সদস্যদের নিয়ে। তবে তাদের সাথে কোনো ভোকালিস্ট ছিল না। ব্যান্ডের সদস্যদের দেখা যায় একটি নির্মাণাধীন কাজের স্থানে, গায়কবিহীন একটি ব্যান্ড হিসেবে। আর ক্রিস সেখানে মাইক হাতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন একজন ব্যান্ডবিহীন গায়ক হিসেবে। সকলে যখন একসাথে গান করা শুরু করেন, তখন পেছনে আতশবাজি ফোটা শুরু হয়। মিউজিক ভিডিওটি শেষ হয় সকলের একসাথে আলিঙ্গন করার মাধ্যমে। বুঝিয়ে দেওয়া হয়, গঠিত হলো নতুন ব্যান্ডদল ‘অডিওস্লেভ’।
ভিডিওটি আশেপাশে সাড়া ফেলা শুরু করে এবং একই বছর নভেম্বর মাসে তারা প্রকাশ করে তাদের প্রথম অ্যালবাম। আর নিজেদের প্রথম অ্যালবাম দিয়েই দর্শকদের জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় অডিওস্লেভ। ‘আই অ্যাম দ্য হাইওয়ে’, ‘শো মি হাউ টু লিভ’, ‘লাইক অ্যা স্টোন’ এর মতো বিখ্যাত গান দিয়ে এখন পর্যন্ত অ্যালবামটি শুধুমাত্র আমেরিকাতেই বিক্রি করে তিন মিলিয়নেরও বেশি কপি। এর পরবর্তী সময়ে পাঁচ বছরে তারা প্রকাশ করে আরও দুটি অ্যালবাম। অডিওস্লেভের সাউন্ড এবং টিম মরেলোর গিটার বাজানোর ধরন, সাথে ক্রিস কোরনেলের গান দর্শকরা বেশ ভালোভাবে উপভোগ করতে পেরেছিল। তবে ২০০৭ সালে ক্রিস ঘোষণা দেন, তিনি স্থায়ীভাবে অডিওস্লেভ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। এর পেছনে মূল কারণ ছিল সদস্যদের মধ্যে গান নিয়ে পছন্দের পার্থক্য। তাই নিজ থেকেই ক্রিস বের হয়ে আসেন অডিওস্লেভ থেকে।
অডিওস্লেভ ছাড়ার পর তিনি আবার মনোযোগ দেন তার একক অ্যালবামগুলোতে, ২০০৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ক্যারি অন’। একই বছর তিনি যোগ দেন লিংকিন পার্কের সাথে তাদের অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের কনসার্ট ট্যুরে। পরবর্তী বছর, ২০০৮ সালে লিংকিন পার্কের ‘প্রজেক্ট রেভল্যুশন’ নামক কনসার্টেও দেখা মেলে ক্রিস কোরনেলের। কনসার্টে লিংকিন পার্কের জনপ্রিয় গান ‘ক্রলিং’-এ চেস্টার বেনিংটনের সঙ্গে একসাথে গলা মেলান ক্রিস। কনসার্টে তা অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে। সঙ্গীতজগতে লিংকিন পার্কের সাথে কোনো কাজ না করলেও, লিংকিন পার্কের সদস্যরা, বিশেষ করে চেস্টার ছিলেন ক্রিসের ভালো বন্ধু।
এছাড়াও নব্বইয়ের দশকের আরেক জনপ্রিয় গ্রাঞ্জ ব্যান্ড ‘পার্ল জ্যাম‘-এর সাথেও ছিল ক্রিস এবং তার ব্যান্ড সাউন্ডগার্ডেনের ভালো সম্পর্ক। আশির দশকের শেষের দিকে একজন উঠতি ব্যান্ডতারকা ছিলেন এন্ড্রু উড। একসময় এন্ড্রু উডের রুমমেট ছিলেন ক্রিস। গ্রাঞ্জ রকের উৎপত্তি নিজেদের চোখের সামনেই গড়ে উঠতে দেখছিলেন দুজনেই। কিন্তু মাদকাসক্ত হয়ে ১৯৯০ সালে হঠাৎ মারা যান এন্ড্রু। শুরুর দিকে মানসিকভাবে আঘাত পেলেও, একটা সময় ক্রিস স্থির করেন, এন্ড্রু উডকে সম্মান জানিয়ে একটা অ্যালবাম প্রকাশ করবেন।
এভাবেই সাউন্ডগার্ডেনের ড্রামার ম্যাট ক্যামেরন এবং পার্ল জ্যাম ব্যান্ডের সদস্যদের নিয়ে গঠন করেন ব্যান্ডদল ‘টেম্পল অভ দ্য ডগ’। এসময় তার দেখা হয় পার্ল জ্যামের ভোকালিস্ট এডি ভেডারের সাথে। অ্যালবামে ‘হাঙ্গার স্ট্রাইক’ নামক একটি গানে একসাথে দুজন ভোকালও দিয়েছিলেন। মাত্র ১৫ দিনে তারা রেকর্ড করেন অ্যালবামটি। অ্যালবামটি সে সময় বেশ সাড়াও ফেলেছিল।
সঙ্গীতজগতের পাশাপাশি ক্রিস সিনেমার জন্য বেশ কিছু সাউন্ডট্র্যাক নিয়েও কাজ করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০০ সালের ‘মিশন ইম্পসিবল-২‘ সিনেমার ‘মিশন ২০০০’ শিরোনামের গানটি। এছাড়াও ২০০৬ সালে অডিওস্লেভ ব্যান্ডে থাকাকালে সনি পিকচারসের সঙ্গীত বিভাগ থেকে ক্রিস কোরনেলকে প্রস্তাব জানানো হয় একটি গান বানানোর জন্য, যে গানটি তারা মেইন থিমসং হিসেবে ব্যবহার করবে, তাদের নতুন জেমস বন্ড মুভি ‘ক্যাসিনো রয়াল‘-এ।
কোরনেল শুরুতে মনে করেন এটি একটি অদ্ভুত প্রস্তাব। কারণ তিনি ভেবেছিলেন জেমস বন্ডের মতো একটা সিনেমায় তিনি হয়তো সেকেন্ডারি বিভাগের গান করবেন, যা সিনেমার ভেতরে কোনো অংশে ব্যাবহার করা হবে। কিন্তু সনি কোম্পানি জানায় তারা এই মুভির জন্য একজন দৃঢ় কণ্ঠস্বরের পুরুষ গায়ককে খুঁজছিলেন এবং ক্রিস জানতে পারেন ড্যানিয়েল ক্রেইগ হবেন নতুন বন্ড। ফলে ক্রিস সিনেমার কম্পোজার ডেভিড আর্নল্ডকে সাথে নিয়ে সিনেমার জন্য গান লেখা শুরু করেন। অবশেষে লন্ডনের একটি স্টুডিওতে ক্রিস এবং ডেভিড রেকর্ড করেন ‘ইউ নো মাই নেম’ শিরোনামের গানটি।
অর্কেস্ট্রা এবং রকের মিশ্রণের এই গানটি ছিল কোনো আমেরিকান পুরুষের গাওয়া প্রথম জেমস বন্ড সিনেমার জন্য গান। পরবর্তী সময়ে অডিওস্লেভ ব্যান্ডদল ভেঙে যাওয়ার বছরখানেক পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে ক্রিস কোরনেল টুইটারে ঘোষণা দেন, সাউন্ডগার্ডেন ব্যান্ড তাদের প্রত্যাবর্তন করতে চলেছে এবং ব্যান্ডের সদস্যরা আবার কনসার্টে ফিরছেন।
সাউন্ডগার্ডেনের সদস্যদের পুনরায় একত্র হওয়া নিয়ে অনেকেই ভেবেছিলেন, তারা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে তারা মুক্তি দেয় ‘টেলিফ্যান্টাসম’ নামক একটি সংকলিত অ্যালবাম। যেখানে ব্যান্ডের ২৩ বছরের জনপ্রিয় গানগুলোর সাথে যোগ করা হয় ‘ব্ল্যাক রেইন’ নামক নতুন একটি গান। আর এরপরই ২০১১ সালে সাউন্ডগার্ডেন থেকে জানানো হয়, তারা নতুন একটি অ্যালবামে কাজ শুরু করেছে।
পাশাপাশি ২০১২ সালে, দীর্ঘ ১৫ বছর পর সাউন্ডগার্ডেন প্রকাশ করে তাদের নতুন একক গান ‘লিভ টু রাইজ’। গানটি তৈরি করা হয়েছিল মারভেলের ‘দ্য অ্যাভেঞ্জারস‘ মুভির জন্য। একই বছর অবশেষে তারা মুক্তি দেয় তাদের ষষ্ঠ এবং শেষ অ্যালবাম ‘কিং অ্যানিমেল’। নিজেদের শেষ অ্যালবামে সাউন্ডগার্ডেন যেন আবার শুরু থেকে শুরু করে। সাউন্ডগার্ডেন শুরুতে যেমন মেটাল, গ্রাঞ্জ এবং সাইকেডেলিক রক সাউন্ড নিয়ে গান করত, ঠিক সে ধরনের সাউন্ড তাদের শেষ অ্যালবামে শোনা যাচ্ছিল।
ষষ্ঠ অ্যালবামের পর সাউন্ডগার্ডেনের আরও একটি অ্যালবামের কাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছিল। এমনকি ২০১৬ সালে ড্রামার ম্যাট এবং বেসিস্ট বেন জানান, তারা নতুন অ্যালবামের জন্য ছ’টি নতুন গানের সুর তৈরি করেছেন। কিন্তু নতুন অ্যালবাম বানানো আর সম্ভব হয়নি। ২০১৭ সালের মে মাসে সাউন্ডগার্ডেনের সাথে একটি কনসার্ট শেষ করার পর আত্মহত্যা করেন ক্রিস। সঙ্গীতজগত হারায় অনন্য এক প্রতিভাশালী গায়ককে। সঙ্গীতজগত ছাড়াও হলিউডেও নেমে আসে শোকের ছায়া।
লেড জেপলিনের বিখ্যাত গিটারবাদক জিমি পেজ, অ্যাল্টন জন, অ্যালেন ডিজেনেরেস, ক্রিস ইভেন্স, মাইকেল কিটনসহ আরও অনেকেই তাদের প্রতিক্রিয়া জানান সামাজিক মাধ্যমে। মেগাডেথ, গান্স এন রোজেজ এবং লিংকিন পার্কসহ অন্যান্য ব্যান্ড তাদের কনসার্টে সম্মাননা জানান ক্রিস কোরনেলকে। ২০১৯ সালে ক্রিস কোরনেলের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তার গানের নামের উপর ভিত্তি করে আয়োজন করা হয় ‘আই অ্যাম দ্য হাইওয়ে’ কনসার্টটি। মেটালিকা, ফু ফাইটারস আর অডিওস্লেভের সদস্যদের সাথে প্রথমবারের মতো ক্রিস কোরনেলকে ছাড়া মঞ্চে ওঠে সাউন্ডগার্ডেন। এটাই ছিল গ্রাঞ্জ-ব্যান্ড সাউন্ডগার্ডেনের শেষবারের মতো কনসার্টে বাজানো।
সঙ্গীতজগতের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলা ক্রিস কোরনেল ছিলেন ফ্রেডি মার্কারির মতোই চারটি অক্টেভে গান গাওয়ার অধিকারী। ছোটবেলা থেকেই বিষণ্ণতায় বেড়ে ওঠা ক্রিস কখনো সাউন্ডগার্ডেনের ‘ফেল অন ব্ল্যাক ডেইজ’ গানটির মাধ্যমে প্রকাশ করতেন নিজের মনে জমতে থাকা অজানা ভয়কে, আবার কখনো অডিওস্লেভের ‘বি ইওরসেল্ফ’-এর মতো গান দিয়ে চেষ্টা করতেন দর্শকদের উৎসাহিত করার।
নিজের সঙ্গীতজীবনে ব্যান্ডের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন সময় মতের অমিল দেখা দিলেও, তাদের কখনো মন থেকে ভুলে যাননি ক্রিস। আর সে কারণেই হয়তো নিজের জীবনের শেষ বছরগুলোতে ‘সাউন্ডগার্ডেন’, ‘অডিওস্লেভ’, ‘টেম্পল অভ দ্য ডগ’ ব্যান্ডের সকলের সাথে আবার আগের মতো একত্রিত হয়েছিলেন। এমনকি সমাজসেবক হিসেবেও ক্রিসের একটি ছোট পরিচিতি ছিল। ক্রিশ্চিয়ান বেলের ‘দ্য প্রমিস’ নামক সিনেমায় নিজের গাওয়া একটি গান থেকে যত অর্থ আয় করেছিলেন, তা ব্যয় করেন শরণার্থীদের সাহায্যে।
আশির দশকে একটা সময় যখন হেয়ার মেটাল নামক ধারাটি সঙ্গীতজগতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করে, ঠিক সেই সময় ক্রিস কোরনেল গ্রাঞ্জ ধারার মাধ্যমে সঙ্গীতজগতকে নতুন পথ দেখান। যেখানে সঙ্গীতের মৌলিক টাইম সিগনেচার হলো ৪/৪, সেখানে সাউন্ডগার্ডেনের সাথে ক্রিস গান করতেন ১৫/৮, ৬/৪, ৭/৮ টাইম সিগনেচারে। ফলে, গানের মধ্যে এ ধরনের বিকল্প সুরের ব্যবহার অন্যান্য ব্যান্ড থেকে সাউন্ডগার্ডেনকে আলাদা করে তোলে।
এছাড়াও অডিওস্লেভ ব্যান্ডের মাধ্যমে ষাট এবং সত্তর দশকের হার্ডরক ধারা যেন পুনরায় জীবিত হয়ে ওঠে, বর্তমান সময়ের পপ এবং ইলেকট্রনিক সঙ্গীতের মাঝে। নিজের জীবনে হতাশা এবং উদাসীনতা থাকলেও গানের মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন সেগুলোকে মুছে ফেলতে। তাই হয়তো একটি গানের মধ্যে বলেছিলেন,
“Life ain’t nothing if it ain’t hard
It’ll show you who you truly are
Knock you down when you get too tall
Till you spun around in a free fall….. ”
ক্রিস হয়তো এখন আর বেঁচে নেই, কিন্তু তার গান সবসময় অনুপ্রাণিত করবে রক সঙ্গীতের প্রতিটি ক্ষেত্রকে।