একটি দালানের কাজ আসলে কী?
যদি প্রশ্ন করা হয়, একটি দালান মূলত কেন বানানো হয়, এর উত্তর ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হবে, এমনকি পেশাভেদেও ভিন্ন উত্তর পাওয়া যেতে পারে। যেমন একজন সাধারণ মানুষ দালানকে শুধুমাত্র তার বাসস্থান হিসেবেই হয়তো দেখে। তবে একজন স্থপতি বা পুরকৌশলীর কাছে দালান মানে শুধুমাত্র বাসস্থান নয়। দালান নির্মাণের সময় একজন স্থপতিকে চিন্তা করতে হয়, এখানে যারা থাকবেন তাদের মনোজগতের উপরও দালানের নির্মাণশৈলীর একটি বড় প্রভাব থাকতে পারে।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরী প্রদেশের সেন্ট লুইস শহরে Pruitt-Igoe নামে একটি নগর গৃহায়ণ প্রকল্প শুরু করা হয়। পুরো প্রকল্পটিতে মোট ৩৩টি দালান ছিল। দালানগুলোর নকশা প্রণয়ন করেছিলেন একজন জাপানিজ-আমেরিকান স্থপতি মিনোরু ইয়ামাসাকি যিনি বিখ্যাত বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র (World Trade Centre) এরও স্থপতি ছিলেন। ১৯৫৬ সালে নির্মাণকাজ শেষ হবার পর থেকেই আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, দালানগুলোতে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রার মান কমতে শুরু করেছে। দালানগুলোর ভেতরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অনেক বেশি হতে দেখা গেল। মানুষ এই প্রকল্পের দালানগুলোতে থাকতে ইচ্ছুক ছিল না, প্রচুর ফ্ল্যাট খালি পড়ে থাকতো। বসবাসের উপযোগী কোনো পরিবেশই ছিল না সেখানে।
অনেকেই ধারণা করে থাকেন যে এর পেছনে দায়ী ছিল ভবনগুলোর স্থাপত্য নকশা। প্রতিটি ব্লকের মধ্যে আধুনিক স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে বিশাল বিশাল ফাঁকা স্থান রাখা হয়েছিল যা ভবনের বাসিন্দাদের মধ্যে হৃদ্যতা নষ্ট করে। তারা নিজেদেরকে সামষ্টিকভাবে একটি কমিউনিটি বা গোষ্ঠী হিসেবে চিন্তা করতে পারতো না। বসবাসের উপযোগীতা নষ্ট হওয়ায় ১৯৭২ সালে ভবনগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়।
তবে ২০১১ সালে এই পুরো ঘটনাটির উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়, The Prutt-Igoe Myth নামে। সেখানে দাবি করা হয় পুরো ঘটনাটির পেছনে আসলে একক কোনো কারণকে দায়ী করা উচিত নয়, বরং এটা ছিল পুরো শহর হিসেবে সেন্ট লুইসের অধঃপতনের একটি ফলাফল। অর্থাৎ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি কিংবা গোষ্ঠীগত ভেদাভেদ তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা শুধুমাত্র যে ঐ ৩৩টি দালানের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, বরং তা পুরো শহরজুড়ে বিস্তৃত ছিল।
দালানের সাথে মানুষের মনোজগত যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা আরেকটি উদাহরণের মাধ্যমে পরিষ্কার করা যাক। আধুনিককালে দালানের নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে Visual Attention Modelling বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। একজন দর্শক যখন একটি দালানের দিকে তাকায় তখন পুরো দালানের সবকটি অংশের দিকে তার মনোযোগ কখনোই যায় না, মনোযোগ যায় দালানের বিশেষ কিছু অংশের উপর। প্রশ্ন হচ্ছে, দালানের নির্দিষ্ট একটি অংশের উপর কেন ঐ দর্শক তার দৃষ্টি ফেললেন? অন্য অংশগুলোর উপর কেন তিনি তাকালেন না বা ঐ অংশটিতে এমন কী আছে যা অন্য অংশগুলোতে নেই?
এর উত্তর হয়তো সাধারণ মানুষের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু দালানের নকশা প্রণয়নের সাথে জড়িত যে কারো জন্য এটি অনেক গুরুত্ব বহন করে। যেমন যদি এটা আগে থেকেই একজন নকশা প্রণয়নকারী জানতে পারেন যে একজন দর্শক দালানের একটি সুনির্দিষ্ট জায়গায় তাকাবেন কিনা তা কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে, তাহলে তার জন্য নকশা প্রণয়নের সময় সেসব দিক খেয়াল রাখা সহজ হয়। তিনি ঐ অংশগুলো অধিক মনোযোগ দিয়ে নকশা করতে পারেন এবং দালানটি তখন দর্শনার্থীদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
হয়তোবা এটি ঐ অংশের রং বা গঠনের উপর নির্ভর করে, কিংবা এটি তার অবস্থানের উপর নির্ভর করে। যেটাই হোক, আগেভাগে তা জেনে নিলে নকশা করার সময় সেসব দিক খেয়াল রাখা অনেক সহজ হয়। তবে একজন নকশা প্রণয়নকারীর জন্য এ ব্যাপারগুলো আগে থেকে জেনে নেয়া খুবই দুরূহ, কারণ দালানের এ রকম অনেক বিষয়াদি থাকতে পারে যার উপর একজন দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যাপারটি জড়িত থাকে।
মানুষের জন্য এ কাজটি সহজ করে দেয় Visual Attention Software (VAS)। এটি নকশা প্রণয়নের পূর্বেই গাণিতিকভাবে হিসেব করে বলে দিতে পারে একটি দালানের কোন জায়গায় একজন দর্শকের দৃষ্টি নিক্ষেপের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি এবং তা কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে থাকে। এ ধরনের প্রযুক্তি শুধু দালানের ক্ষেত্রেই নয়, আরো অনেক ক্ষেত্র যেখানে একজন দর্শক একটি নির্দিষ্ট জায়গার উপর কতক্ষণ দৃষ্টিপাত করছেন তা একটি ভয়ংকর রকমের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক সেখানে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যেমন- চিত্রকলা, কোনো প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের ফ্রন্ট পেজ, ঘরের অভ্যন্তরীণ নকশা, প্রভৃতি।
এবার আসা যাক বিশেষত একজন পুরকৌশলীর কাছে দালান নির্মাণের উদ্দেশ্য কী হতে পারে এ ব্যাপারটিতে। একটি দালানে বিভিন্ন ধরনের ‘ভার’ (Load) আসে। একজন পুরকৌশলীর কাছে মূল চিন্তার বিষয় হচ্ছে অবকাঠামো হিসেবে পুরো দালানটি, এর উপর আসা সব ধরনের ভার বহন করতে পারবে কিনা। অর্থাৎ তার কাছে একটি দালানের মূল উদ্দেশ্য হলো এর উপর আসা সকল ভার সঠিকভাবে বহন করা এবং তা ঠিকভাবে মাটিতে চালান করে দিয়ে পুরো ব্যবস্থাটিকে ঠিক রাখা। ভার বহনের সময় দালানের কোনো অংশে (যেমনঃ কলাম, বিম প্রভৃতি) যদি ভাঙন দেখা দেয় বা অন্য কোনো ধরনের অসামঞ্জস্যতা দেখা যায় তাহলেই দালানটি ভার বহনে ব্যর্থ হিসেবে পরিগণিত হবে।
অপরদিকে একজন স্থপতির (Architect) কাছে দালানের অবকাঠামোগত শক্তির চেয়ে মুখ্য বিষয় হলো দালানটি স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে কতটুকু যুতসই হলো তা দেখা। আবার এখানে যে বাসিন্দারা থাকবেন তারা সব মিলিয়ে ভালোভাবে আরাম করে, সর্বোপরি স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবেন কিনা এটাও দেখার বিষয়।
এছাড়াও আরো অনেক বিষয় একজন স্থপতিকে দেখতে হয় যেটা হয়তো দালানের অবকাঠামোগত শক্তির সাথে সরাসরিভাবে সম্পর্কিত নয়। একটি সাধারণ উদাহরণ দিলে আশা করি বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ধরি একজন পুরকৌশলীর গাণিতিক নকশা মতে দালানের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কলাম বসালে সেটা দালানকে অধিক শক্তিশালী করে তুলবে। এক্ষেত্রে পুরকৌশলীর ভাবনার দিকে তাকালে দেখা যাবে তিনি হয়তো শুধুমাত্রই দালানটিকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় সে ব্যাপারটি নিয়ে ভাবছেন। দালানের স্থাপত্যশৈলী, সহজ কথায় দালানটিকে বাইরে থেকে দেখতে কেমন লাগবে, এখানে কলামটি বসানো হলে দালানের ভিতর যারা থাকবেন তাদের মনোজগতে এর কোনো প্রভাব পড়বে কিনা কিংবা এটি দালানের অভ্যন্তরীণ কারুকার্যে কোনো ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করবে কিনা এ ব্যাপারগুলো নিয়ে হয়তো তিনি তেমন একটা চিন্তিত নন। তার চিন্তার মুখ্য বিষয় হলো এখানে কলামটি বসালে সেটি দালানটিকে শক্তিশালী করবে, ব্যস এতটুকুই।
অন্যদিকে কলামটিকে একজন স্থপতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাক। তিনি চিন্তা করবেন ঠিক এই জায়গায় কলামটি বসালে সেটি কি ভেতরে থাকা মানুষদের জন্য কোনো বাঁধা (Obstruction) হিসেবে কাজ করবে? এটি কি ভেতরের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যকে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত করবে? স্থাপত্যশৈলীকে কি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে? যদি করে তাহলে হয়তো তিনি এটিকে অন্য কোথাও সরিয়ে বসানো যায় কিনা এ ব্যাপারে পুরকৌশলীর সাথে আলাপ করবেন। আবার পুরকৌশলী ভাববেন দালানের সামগ্রিক স্থিতিশীলতার কথা। এভাবে উভয়ে মিলে আলোচনা করে কলামটি বসানোর জন্য এমন একটি স্থান নির্বাচন করবেন যেখানে বসালে কলামটি একইসাথে দালানের স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে এবং স্থাপত্যশৈলীতেও কোনো প্রকার বাঁধা সৃষ্টি করবে না।
এভাবে একেক পেশার মানুষের কাছে দালানের উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।
একজন সাধারণ মানুষের কাছে দালানের অর্থ
একজন প্রকৌশলী এবং একজন সাধারণ মানুষ উভয়েই যখন একটি দালানের দিকে তাকান, স্বাভাবিকভাবেই তারা দুজন একই জিনিস দেখেন না, ভিন্ন কিছু দেখেন। একজন প্রকৌশলীর কাছে যেমন দালানের স্থিতিশীলতা, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে টিকে থাকার ক্ষমতা, কীরকম মাটির উপর স্থাপনাটি নির্মিত হলো তা যাচাই করা, এসব বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাধারণ মানুষ কিন্তু এসব নিয়ে তত একটা চিন্তিত নন।
হ্যাঁ অবশ্যই তর্কের খাতিরে মানা যায়, সবারই জীবনের মায়া আছে এবং সবাই চায় একটি নিরাপদ দালানে তার পরিবারের সাথে বসবাস করতে। সবাই চায় যদি কোনো অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে তার দালানটি যেন এ ধরনের দুর্যোগ প্রতিরোধে সক্ষম হয়। কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের গড়পড়তা একজন সাধারণ মানুষ যখন তার সারাজীবনের পুঁজি খরচ করে একটি দালান নির্মাণ করেন তার ও তার পরবর্তী প্রজন্মের বসবাসের জন্য, দালানের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর তিনি প্রকৌশলীকে গিয়ে কখনো এটা জিজ্ঞেস করেন না যে “আমার দালানটা কতটা মজবুত হলো, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব? কলামটা ঠিকমতো বসিয়েছেন তো? কলামের ভেতর যতগুলো রড দেয়া দরকার ছিল তা ঠিকমতো দেয়া হয়েছে তো?” এসব বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষের জিজ্ঞেস করার কথা নয়, বরং তিনি জিজ্ঞেস করবেন, আমার ড্রয়িং রুমটা দেখতে সুন্দর হলো কিনা। বাথরুমে যে টাইলস বসানো হলো সেটা কতটা দামি হলো? মানুষ দেখে ভালো বলবে তো? বেডরুম ডাইনিং এর আলোকসজ্জা যেমনটা চেয়েছিলাম তেমনটা পেয়েছি তো?
(নোটঃ এগুলো সবই লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা ও অন্যদের থেকে শোনা অভিজ্ঞতার আলোকে বলা। অভিজ্ঞতা ব্যাপারটি ব্যাক্তিভেদে আপেক্ষিক। একই বিষয় সম্পর্কে একেকজনের অভিজ্ঞতা একেকরকম হতে পারে। পাঠকদের কারো যদি এ ব্যাপারে ভিন্নমত/ভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে থাকে, তাহলে তা অভিজ্ঞতার আপেক্ষিকতা বিবেচনায় রেখে চিন্তা করার জন্য অনুরোধ রইলো।)
এখানে বলে রাখা ভালো, একটি দালানের নির্মাণকাজে দুই ধরনের অংশ থাকে- ১. অবকাঠামোগত অংশ (Structural Components) এবং অনবকাঠামোগত অংশ (Non-Structural Components)। অবকাঠামোগত অংশ মানে হলো যেসব অংশ ছাড়া দালানটি দাঁড়াতেই পারতো না, কাঁত হয়ে যেতো বা দালানে ভাঙ্গন ধরতে পারতো। এ ধরনের অংশের মধ্যে আছে দালানের কলাম, বিম, স্ল্যাব প্রভৃতি। এগুলো ছাড়া একটি দালানকে দালান হিসেবে চিন্তা করাই মুশকিল। পরবর্তী পর্বে দালানের প্রতিটি অংশ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
অনবকাঠামোগত অংশের মধ্যে আছে দালানের ফ্লোর ফিনিশিং (যেমনঃ টাইলস, সিমেন্টের আস্তরণ প্রভৃতি), রঙের কাজ, পুরো দালানের অভ্যন্তরীণ আলোকসজ্জা, পার্টিশান ওয়াল, প্রভৃতি। এগুলো ছাড়া দালান সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু এগুলো না হলেও কোনো ধরনের কারিগরি ত্রুটি ছাড়াই একটি দালান দাঁড়িয়ে যাবে। এ কারণেই টাইলস ছাড়া সিড়ি আমরা ঢাকা শহরে অনেকেই দেখতে পাই, অনেক বাথরুমেই সুন্দর আলোকসজ্জা খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিন্তু কলাম ছাড়া একটি দালান, শহর বা গ্রামের কোথাও কেউ দেখাতে পারবে না। অবকাঠামোগত অংশগুলো দালানের জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ। জানালায় কাঁচ ছাড়া একটি গাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব যা রাস্তায় চালাতে তত একটা অসুবিধা হবে না, তবে ইঞ্জিন ছাড়া গাড়িটিকে এভাবে কল্পনা করাই দুঃসাধ্য। দালানের সাথে তুলনা করলে এক্ষেত্রে ইঞ্জিনটি হলো গাড়ির অবকাঠামোগত অংশ এবং গাড়ির জানালার কাঁচ হলো তার অনবকাঠামোগত অংশ।
মনস্তাত্ত্বিকভাবেই একজন সাধারণ মানুষ দালানের অবকাঠামোগত ও অনবকাঠামোগত অংশের মধ্যে বৈষম্য করে ফেলেন। এই যেমন একজন বাড়ির মালিক তার দালানের কলামকে ততটা গুরুত্বের চোখে দেখছেন না যতটা তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন তার বাথরুমের টাইলসকে। অর্থাৎ দালানের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশটিই একজন সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে কম গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের দেশে ছাদ ঢালাই শেষে দালান মালিকরা খুব ঘটা করে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করে থাকেন। অথচ গুরুত্বের কথা চিন্তা করলে ছাদ ঢালাইয়ের আগে প্রতিটি কলাম ঢালাইয়ের সাথে একবার করে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা উচিত ছিল। অন্যভাবে চিন্তা করলে, দালানের বিভিন্ন অংশের ঢালাইয়ের গুরুত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মানের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করলে এভাবে আয়োজন করা যেতে পারেঃ
কলাম ঢালাইয়ের পর – বিরিয়ানি*
বিম ঢালাইয়ের পর – ভাত-মাছ*
ছাদ ঢালাইয়ের পর – সাধারণ মিষ্টিভোজন*
(নোটঃ খাবারের এই তালিকা লেখকের সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত পছন্দের আলোকে দেয়া হয়েছে। চাইলে ব্যাক্তিভেদে যে কেউ এই তালিকা পরিবর্তন করে আয়োজন সারতে পারেন।)
তবে একজন সাধারণ মানুষের স্থাপনা সম্পর্কিত জ্ঞান বা বোধকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। ফুটপাত ধরে হেটে যাওয়া একজন ব্যাক্তি খুব সহজেই স্থাপনার গঠন দেখে বলে দিতে পারবেন কোনটা মসজিদ আর কোনটা জেলখানা। এটার জন্য তাকে কোনো সাইনবোর্ড টানিয়ে বাংলা অক্ষরে বুঝিয়ে দিতে হয় না যে কোথায় ধর্মপ্রাণ মানুষেরা যায় আর কোথায় অপরাধীরা। বাইরে থেকে দেখলে গম্বুজ, মিনার, মুসলিম স্থাপত্যশৈলীসমৃদ্ধ স্থাপনাকে দেখে সহজেই যে কেউ আঁচ করতে পারবেন যে এটা মসজিদ। আবার উঁচু দেয়াল, কাঁটাতারের বেষ্টনী দেখেই বলে দেয়া যায় এটি একটি জেলখানা।
একজন মানুষ যেমন দালানের দিকে তাকিয়ে পুরো স্থাপনার সৌন্দর্যকে উপভোগ বা অনুধাবন করেন, দালানও তার নিজস্ব মাধ্যমে সেই মানুষটার সাথে যোগাযোগ করে। তাকে নিজের গঠনের মাধ্যমে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। এ থেকেই বোধ হয় একবার শুনেছিলাম, এক বাড়িওয়ালা তার দালানের স্থাপত্য নকশায় বাড়ির সামনের দিকে বেশ বড় একটি কংক্রিটের চোখ বসিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন, পথিক যেমন দালানকে দু’চোখ মেলে দেখে, দালানও তেমনি পথিককে চোখ মেলে দেখে। এর প্রতীকী উপস্থাপনা বোঝাতেই এ নকশা।
এখন প্রশ্ন হলো, এই যে একজন সাধারণ মানুষ দালানের অবকাঠামো ও অনবকাঠামোগত অংশের মধ্যে বৈষম্য করছেন, একটিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, অন্যটিকে কম দিচ্ছেন, এটা তিনি কেন করছেন? এর পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে সে ব্যাপারটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, দালানের অবকাঠামোগত অংশগুলো সাধারণত থাকে লোকচক্ষুর আড়ালে। এগুলো ঠিকভাবে বসানো হলো কি হলো না তা দিয়ে বাড়িওয়ালার কোনো প্রশংসা করা হয় না। প্রকৌশলী ও বাড়ির মালিক নিজে বাদে একজন তৃতীয় ব্যক্তি এসে কখনো নতুন একটি দালানের কলাম বা বিমের দিকে নজর দেন না, নজর দেন দালানটি ভেতর ও বাইরে থেকে দেখতে কতটা সুন্দর হলো তার উপর।
একটি কলামের ভেতর যতই পর্যাপ্ত পরিমাণে লোহার রড দেয়া হোক না কেন, থাকবে সেগুলো কনক্রিটের আস্তরণের ভেতরেই। নিজেদের জনপ্রিয়তা বিসর্জন দিয়ে তারা যেন চুপিসারে লোকচক্ষুর আড়ালে পুরো দালানের ভার একসাথে বহন করে চলবে যুগ যুগ ধরে। স্বভাবতই একজন বাড়িওয়ালা তৃতীয় পক্ষের লোকদের কাছ থেকে প্রশংসাসূচক বাণী তখনই শুনবেন যখন তিনি দালানের অনবকাঠামোগত অংশগুলোতে বেশি টাকা ঢালবেন। যখন ঘরের ভেতরের আলোয় মেঝের টাইলসগুলো চকমক করে উঠবে, যখন ঘরের দেয়ালে বসানো মার্বেল পাথর বা সুদৃশ্য ঝালর থেকে আভিজাত্যের নিদর্শন ঠিকরে বের হবে, কেবল তখনই মানুষ ঐ দালান নির্মাণের সার্থকতা খুঁজে পাবে। সাধারণ সেই বাড়িওয়ালা যে দালানের অনবকাঠামোগত অংশকে এতো গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন, এ যেন পুরো সমাজ একটি দালানকে যে ভুল কষ্টি পাথরে যাচাই করে দেখে, তারই প্রতিবিম্ব।
তবে সময়ের সাথে সাথে মানুষের ধ্যান ধারণায় পরিবর্তন আসছে। এর পেছনেও দায়ী ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ। উপর্যুপরি আঘাত হানা কয়েকটি ভূমিকম্প আমাদের শিখিয়েছে দালানের ভিত্তি মজবুত না করলে এবং দালানের কাঠামোগত অংশকে গুরুত্ব দিয়ে না দেখলে যেকোনো সময় আমার তিন বছরের কষ্টের এই দালান তিন সেকেন্ডে গুড়িয়ে যেতে পারে। ভূমিকম্প সহনীয়তা প্রমাণ করা যে এখন বাংলাদেশের রড কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের অন্যতম একটি মনোযোগের জায়গা, তা সম্ভব হয়েছে সাধারণ মানুষের ভূমিকম্প সম্বন্ধে পূর্বের তুলনায় বর্ধিত সাবধানতা অবলম্বনের ফলস্বরূপ। আজ যদি বাংলাদেশে কোনো ভূমিকম্প না হতো বা দূর্যোগ হিসেবে ভূমিকম্প ততটা জনপ্রিয় না হতো, তাহলে মানুষ দালানে রডের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারতো না, বিজ্ঞাপনে ‘ভূমিকম্প সহনীয় স্টিল’ শব্দগুলোকে ট্যাগলাইন হিসেবে কেউ হয়তো ব্যবহার করতো না। সময়ের সাথে সাথে একেকটি বিপদ এসে সাধারণ মানুষ ও বিজ্ঞানের মাঝে দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে যায়।
২৪শে এপ্রিল, ২০১৩ সাল। সাভারের রানা প্লাজা ধ্বস আমাদের শিখিয়েছে দালানকে যত্ন নিয়ে তৈরি করা কতটুকু জরুরি। নয়তো কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও একটি দালান ধুলোয় মিশে যেতে পারে। পুরান ঢাকায় ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনা উপর্যুপরি প্রমাণ করছে একটি অপরিকল্পিত আবাসনের পরিণতি কী হতে পারে।
যে বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ, এ দুর্ঘটনাগুলো থেকে একজন সাধারণ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে প্রকৌশলের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি তখন আর একজন সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে দালানকে দেখেন না, দেখেন একজন প্রকৌশলীর চোখ দিয়ে। এতে করে সুবিধে যেটা হয়, দালানের অবকাঠামোগত অংশের গুরুত্ব তার কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। তিনি বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারেন, কলাম বা বিমের ভেতরের ওই রডগুলো ঠিকভাবে না দিলে তা তার নিজের জন্যই বিপদ বয়ে নিয়ে আসবে। যে কয়তলা ভিত্তির জন্য দালানটি নকশা করে দেয়া হয়েছে তার থেকে এক তলাও বেশি বাড়ানো মানে হলো নিজের হাতে পুরো দালানের মানুষদেরকে ঝুঁকির মুখে ফেলা।
তিনি বোঝেন দালানের ছাদে অনুমোদন ছাড়া ভারী টাওয়ার স্থাপন করলে হয়তো ক্ষণিকের জন্য টাওয়ার নির্মাতাদের কাছ থেকে কিছু অতিরিক্ত অর্থ পাওয়া যাবে ঠিকই কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ভারী টাওয়ারের ভার সইতে সইতে একসময় দালানের সামগ্রিক গঠনে সমস্যা তৈরি হতে পারে। এভাবে যতই দিন এগুতে থাকবে, দালানকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন প্রকৌশলী ও একজন সাধারণ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক দূরত্ব ততই ঘুচে যেতে থাকবে। আমজনতা যদি নিজের দালানের যত্ন নিজেই নিতে শিখে, এর চেয়ে বড় চাওয়া একজন প্রকৌশলীর জন্য আর কী হতে পারে?
(এরপর দেখুন ৩য় পর্বে)
বাসস্থান কেন আমাদের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি? (পুরকৌশলের প্রাথমিক ধারণা || পর্ব ১)