প্রাচীন গ্রীসের অন্যতম বিখ্যাত শহর থিবস। বর্তমানে মধ্য গ্রীসের থিভা শহর গড়ে উঠেছে পুরাতন থিবসের ধ্বংসাবশেষের কাছেই। এথেন্সের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত থিবস বিখ্যাত ছিল বহু উষ্ণ প্রস্রবণের জন্যে, যার সবচেয়ে পরিচিতটির নাম ছিল দির্স (Dirce)।
গ্রীক পুরাণে বেশ ঘটা করেই থিবসের পত্তনের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। হাজার বছরের পরিক্রমায় সেই কাহিনীর বেশ কয়েকটি সংস্করণ পাওয়া যায়। তবে ছোটখাট বিষয়গুলো বাদ দিলে মূল গল্প অবিকৃত থেকে যায়।
জিউস ও ইউরোপা
থিবসের গল্প শুরু হয়েছে রাজকন্যা ইউরোপার থেকে। ইউরোপার বাবা হিসেবে দুজনের নাম এসেছে। একজন থেসালির রাজা অ্যামিন্টরের সন্তান ফিনিক্স, আরেকজন এশিয়া মাইনরের রাজ্য টাইরের ফিনিশিয়ান বংশদ্ভুত রাজা এগেনর (Agenor)। অধিকাংশ বর্ণনায় অবশ্য এগেনরকেই ইউরোপার পিতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সেই হিসেবে ইউরোপার মা ছিলেন রানী টেলিফ্যাসা।
অনিন্দ্যসুন্দরী ইউরোপাকে দেখে কামনা জেগে উঠল দেবরাজ জিউসের মনে। স্ত্রী হেরাকে ফাঁকি দিয়ে ইউরোপার কাছে যাওয়ার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন তিনি। একদিন ইউরোপা সখীদের নিয়ে ফুল তুলতে গেলে সাদা একটি ষাঁড়ের রূপ ধরলেন জিউস। ইউরোপা অসাধারণ এই জন্তুকে দেখে বিমোহিত হয়ে পড়ল।
জিউস বুঝতে পারলেন তার ফন্দি কাজ করছে। তিনি রাজকন্যার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। ইউরোপা তার পিঠে উঠে বসতেই উঠে দাঁড়িয়ে ষাঁড় দিল ছুট। রাজকন্যা কিছু বোঝার আগেই সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেবরাজ। তার জন্য সাগরের অশান্ত ঢেউ শান্ত করে দিলেন ভাই পসাইডন, সাগরদেবীরা গাইতে লাগলেন প্রশস্তির গান। এসব দেখে ইউরোপা বুঝে গেলেন সাধারণ কোনো ষাঁড় তাকে অপহরণ করেনি। এ বড় কোনো দেবতার কাজ।
জিউস ক্রিট দ্বীপে এসে দম ফেললেন। এখানে ইউরোপার সাথে মিলনে তিনটি সন্তানের জন্ম হয়। মিনোস, যিনি পরে হন ক্রিটের রাজা। র্যাডামেন্থেস, সাইক্লাডেস দ্বীপপুঞ্জের শাসক, এবং সার্পেডন, লাইসিয়ার অধিকর্তা। এশিয়ার কন্যার সম্মানে জিউসে এই সমস্ত যে মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত তার নাম দিলেন ইউরোপ।
ইউরোপা পরবর্তীতে ক্রিটের রাজা অ্যাস্টেরিয়াসকে বিয়ে করেছিলেন। ক্রিটের রানী হিসেবে তাকে পূজা করত লোকেরা। তাকে ক্রিটবাসী ডাকত হেলোটিস নামে, তার সম্মানে আয়োজিত হতো হেলোশিয়া নামে এক উৎসব।
ইউরোপার সন্ধানে
জিউস মনের আনন্দে থাকলেও এগেনরের চোখে ঘুম নেই। প্রিয় কন্যা ইউরোপার চিন্তায় তিনি অস্থির। মেয়ে কোথায় আছে, কী খাচ্ছে- রাজার কিচ্ছু জানা নেই। তিনি ডেকে পাঠালেন ছেলেদের: ক্যাডমাস, সিলিক্স, থ্যাসাস, এবং কোনো কোনো মতে ফিনিক্স। নির্দেশ দিলেন বোনকে খুঁজে বের করতে। ইউরোপার খবর না নিয়ে কেউ যেন রাজ্যে ফিরে না আসে।
রাজপুত্ররা বেরিয়ে পড়লেন। তাদের সঙ্গী মা টেলিফ্যাসাও। চতুর্দিকে খুঁজেও কোনো কূলকিনারা করা গেল না। দেশে ফেরা যাবে না বোনকে ছাড়া। সুতরাং সিলিক্স এশিয়া মাইনরে এক শহরকে সিলিসিয়া আর থ্যাসাস ইজিয়ান সাগরের এক দ্বীপকে থ্যাসোস নাম দিয়ে শাসন করতে থাকেন। ফিনিক্স নামে এগেনরের ছেলের কথা যেসব বর্ণনায় আছে, সেখানে বলা হয় তিনি এমন এক স্থানে বসতি স্থাপন করেন যা পরে ফিনিশিয়া বলে পরিচিতি পায়।
অদম্য ক্যাডমাস
ভাইয়েরা যে যার জীবন গুছিয়ে নিলেও ক্যাডমাস থামলেন না। মাকে সাথে নিয়ে পৃথিবীর আনাচেকানাচে তালাশ করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি এসে পৌঁছলেন থ্রেসে। এখানে টেলিফ্যাসা এতদিনেও মেয়েকে ফিরে না পাবার দুঃখে প্রাণত্যাগ করলে ক্যাডমাস অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েন।
মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার পর সঙ্গিসাথী নিয়ে ক্যাডমাস ডেলফির মন্দিরে তীর্থযাত্রায় চললেন। উদ্দেশ্য ওরাকলের সাথে দেখা করা। ওরাকল হয়তো বলতে পারবে কোথায় আছে বোন।
ওরাকল অবশ্য ক্যাডমাসকে জানাল না ইউরোপা কোথায়। তবে রাজপুত্রকে আশ্বস্ত করল এই বলে যে সে ভাল আছে এবং জিউসের সঙ্গিনী হিসেবে দেবরাজই তার দেখাশোনা করছেন। কাজেই তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ নেই। তবে ক্যাডমাসের জন্য ওরাকল জিউসের নির্দেশ পৌঁছে দিল। তাকে গ্রীসে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেবতাদের আশীর্বাদধন্য হবে সেই শহর। পরিণত হবে কিংবদন্তীতে।
ক্যাডমাস জানতে চাইলেন কোন সেই স্থান যেখানে পত্তন করতে হবে এই শহর। জবাবে ওরাকল তাকে পরামর্শ দিল এমন একটি গাভী খুঁজে বের করতে যা এখনো বাচ্চা দেয়নি। সেই গাভী দেখতে হবে আবার দুই চাঁদের মতো। জীবনে কখনো সে জোয়াল পরেনি। যে স্থানে গিয়ে সে বসে পড়বে সেখানেই ক্যাডমাসকে বানাতে হবে সেই শহর।
থিবস
ওরাকলের এহেন ধাঁধায় সমস্যায় পড়ে গেলেন ক্যাডমাস। কিন্তু খুব শীঘ্রই রহস্যের জট খুলল। দলবল নিয়ে তিনি যখন ডেলফির মন্দিরের বাইরে এলেন, তখনই সামনে আবির্ভূত হলো কালো রঙের এক গাভী। তার পিঠে চাঁদের মতো দুটো রুপালি বাঁকা দাগ, যেন রাতের আকাশে উঠেছে দুই চাঁদ।
ক্যাডমাস পরীক্ষা করে বুঝলেন- এই সেই গাভী, কারণ এর কোনো বাচ্চা হয়নি, এবং ঘাড়ে জোয়াল পড়ার কোনো দাগও নেই। সঙ্গীদের নিয়ে তিনি এই গাভীকে অনুসরণ করে দিলেন দিনের পর দিন। কখনো পাহাড়, কখনো তৃণভূমি, আবার কখনো অগভীর নদী পাড়ি দিয়ে।
কিন্তু গাভীর তো বসবার কোনো ইচ্ছে দেখা যাচ্ছে না। হয়রান হয়ে পড়লেন ক্যাডমাস ও তার সাথীরা। একপর্যায়ে বোয়েশিয়া নামে এক জায়গায় এসে থামল সেই গাভী। গ্রীক ভাষায় বোয়েশিয়া মানে ছিল ষাঁড়ের এলাকা (oxen-land)। এখানে এক প্রান্তরের মাঝে পাহাড়ের উপর বসে পড়ল সেই গাভী। ক্যাডমাস পেয়ে গেলেন তার উদ্দিষ্ট স্থান।
এককালে এই পাহাড়ি এলাকার মালিক ছিলেন বোয়েশিয়ার রাজা অক্সিজেস। তিনি এক্টেনেস গোত্র, যারা বোয়েশিয়ায় প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল, তাদের নেতা ছিলেন। কিন্তু একবার প্রবল বন্যায় বোয়েশিয়ায় প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই তারা বাধ্য হয় তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে। ফলে ক্যাডমাস যখন বোয়েশিয়ায় প্রবেশ করলেন, তখন এই অঞ্চল ছিল জনশূন্য।
এরিসের সাথে শত্রুতা
শহর তৈরির স্থান খুঁজে পেয়ে কৃতজ্ঞ ক্যাডমাস দেবতাদের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদনের সংকল্প করেন। তিনি ঠিক করলেন তাদের দেশের প্রধান দেবী এথেনার জন্য এই গাভী বলি দেবেন। কিন্তু পবিত্র আচার মেনে একে ধুয়েমুছে সাফ করা দরকার।
ক্যাডমাস সঙ্গীদের আদেশ করলেন কাছেই এক ঝর্না থেকে পানি আনতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই ঝর্না ছিল যুদ্ধদেব এরিসের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। ঝর্নার পবিত্রতা রক্ষায় তিনি নিয়োজিত রেখেছিলেন বিশালাকায় এক ড্রাগন, পুরাণে যাকে বলা হয় ইসমেনিয়ান ড্রাগন (Ismenian Dragon)। ক্যাডমাসের লোকদের দেখেই তেড়ে এলো সে। প্রত্যেককে মৃত্যুবরণ করতে হলো।
ক্যাডমাস অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলেন কেউ পানি নিয়ে ফিরে আসছে না, তখন তিনি বুঝতে পারলেন খারাপ কিছু ঘটেছ। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিজেই চললেন। ঝর্নার তীরে পৌঁছে দেখলেন সঙ্গীসাথীদের ছিন্নভিন্ন দেহ।
ক্যাডমাসকে দেখেই ছুটে এলো এরিসের ড্রাগন। ক্যাডমাস বিশাল এক পাথর তুলে তার দিকে ছুড়ে মারলেন। কিন্তু ড্রাগনের শক্ত চামড়ায় লেগে পাথর পিছলে গেলো। এবার ক্যাডমাস বর্শা মেরে ড্রাগনকে আহত করতে সক্ষম হন। ব্যথায় অস্থির ড্রাগন রেগেমগে বিশাল হাঁ করে তাকে গিলতে এলো। ক্যাডমাস দ্রুত একপাশে সরে যান, এরপর ক্ষিপ্রতার সাথে বর্শা ঢুকিয়ে দেন ড্রাগনের মুখগহ্বরে। এবার তড়পাতে তড়পাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে এরিসের প্রিয় ড্রাগন।
ক্যাডমাস এবার পানি নিয়ে ফিরে গেলেন। এথেনার উদ্দেশ্যে পশু বলির আচার সম্পন্ন করলেন তিনি। এথেনা তাকে নির্দেশ দেন ড্রাগনের সব দাঁত তুলে এর অর্ধেক মাটিতে পুঁতে দিতে।
ক্যাডমাস দেবীর কথামতো কাজ করলেন। ড্রাগনের দাঁত মাটিতে পুঁততেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো অস্ত্রধারী বর্মাচ্ছাদিত একদল লোক। এরা নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া আর মারামারিতে জড়িয়ে পড়ল। শেষাবধি পাঁচজন জীবিত ছিল, এরা নিজেদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করে। এই পাঁচজন ছিল অউডেয়াস, কোটোনিক্স, একিয়ন, পেলর আর হাইপারেনর। ড্রাগনের দাঁত বপন করার ফলে তাদের জন্ম, তাই তাদের বলা হতো ‘স্পারটোই’ (Spartoi/sown men)।
স্পারটোইরা হলো ক্যাডমাসের নতুন সহকারী। তাদের নিয়ে বছরখানেকের মাথায় ক্যাডমাস প্রতিষ্ঠা করলেন এক নতুন শহর। তিনি এর নাম দেন থিবস। কিংবদন্তী আছে- মিশরের বিখ্যাত থিবস থেকেই তিনি এই নাম নিয়েছিলেন, কারণ থিবসের প্রতিষ্ঠাতা নাকি ছিলেন এগেনর। পরবর্তীতে থিবসের বাসিন্দারা ক্যাডমাস আর তার স্পারটোইদের থেকে নিজেদের বংশধারার সূচনা দাবি করত।
এরিসের সাথে মিটমাট
এথেনা তো খুশি, কিন্তু এরিস তার ড্রাগন মেরে ফেলায় ক্যাডমাসের উপর মহাখাপ্পা। তিনি তো তাকে প্রায় মেরেই ফেলেন। কিন্তু জিউস বাধা দিলেন। তার হস্তক্ষেপে ক্যাডমাসের জন্য ভিন্ন শাস্তি ধার্য হয়। আট বছর, মতান্তরে এক বছর, তাকে এরিসের দাসত্ব করতে হবে।
সময় যা-ই হোক, ক্যাডমাসের সেবায় এরিস খুশি হলেন। ক্ষমা মিলল, সাথে মিলল দেবতার মেয়ের হাতও। ক্যাডমাসের সাথে বিয়ে হয় এরিস আর অ্যাফ্রোদিতির কন্যা হার্মোনিয়ার। মেয়ের জন্য এরিস বিশাল ভোজের আয়োজন করলেন। সব দেবতাই আমন্ত্রিত।
নবদম্পতির জন্য দেবতারা নিয়ে এলেন নানা উপহার। ক্যাডমাস নিজে নববধূকে একটি গলার হার দেন। এই হার গড়ে দিয়েছিলেন দেবতাদের কর্মকার হেফেস্তুস, মতান্তরে অ্যাফ্রোদিতি অথবা এথেনা। হার্মোনিয়ার মৃত্যুর পর এই হার যার হাতেই পড়েছে, তারই দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছিল।
ক্যাডমাসের পরিবার
হার্মোনিয়া ক্যাডমাসকে উপহার দেন একটি ছেলে, পলিডোরাস আর চার মেয়ে- অটোনি, ইনো, সেমেলি আর এগিভ। ওয়াইনের দেবতা ডায়নোসিয়াস সেমেলির ছেলে।
বহু বছর ক্যাডমাস ন্যয়ের সাথে শাসন করেন। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে এগিভের সন্তান পেন্থেউসের কাছে ক্ষমতা হারান তিনি। স্ত্রী হার্মোনিয়াকে নিয়ে এরপর ক্যাডমাস চলে যান ইলাইরিয়াতে। সেখানে মৃত্যুর পর জিউস তাদের সর্পে পরিণত করে স্বর্গ বা ইলাইসিয়ামে (Elysium) স্থান দেন।
থিবসে গবেষণাকার্য চালিয়ে দেখা খুঁজে পাওয়া গেছে বর্ণমালা আর লেখনী। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন- প্রাচীন গ্রীসে অক্ষর আর লেখার সূচনা করেছিলেন থিবসের প্রতিষ্ঠাতারাই। তাদের থেকেই এই জ্ঞান আহরণ করে ফিনিশিয়রা। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে রোমানদের মধ্যে, এবং সারা ইউরোপে। সুতরাং ক্যাডমাসের নাম কিন্তু জড়িয়ে আছে প্রাচীন গ্রীসে লিখিত লিপির উদ্ভবের সাথে।