“প্রত্যেক ইহুদির ইসরায়েলে বাস করার অধিকার আছে” – প্রত্যাবর্তনের আইন, ধারা ১
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের উৎস অনেকের কাছে বাইবেলের ঘটনার সমসাময়িক মনে হলেও আধুনিক যুগে এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত উনবিংশ শতাব্দীতে। মধ্যযুগ থেকেই ইউরোপে থাকা ইহুদিরা বৈষম্যের শিকার হতো, তাদেরকে মূল সমাজ থেকে আলাদা করে ‘ঘেটো’তে রাখা হতো, শহরের মূল রাস্তায় প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। কোনো মহামারী ঘটলেও দায়ী করা হতো ইহুদিদেরকে, ব্ল্যাক ডেথের সময় কয়েক হাজার ইহুদিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে স্রেফ এই সন্দেহেই।
১৮৭০ এর দশকে রাশিয়ায় ইহুদিদের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা শুরু হলে সেখান থেকে অন্যত্র পালাতে থাকেন তারা। এমন সময়েই জায়োনিজমের প্রবর্তক থিওডর হার্জল দাবি করেন- ইহুদিদের নিরাপত্তার জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রয়োজন, আর সেটার জন্য আদর্শ স্থান বাইবেলের পবিত্র ভূমি, অর্থাৎ তৎকালীন উসমানি সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ফিলিস্তিন। ১৫ বছরের মধ্যে হার্জলের জায়োনিজম তত্ত্বে বিশ্বাসী প্রায় ২৫ হাজার ইহুদি তখন ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে পাড়ি জমান। ১৯০১ সালে ‘পবিত্র ভূমি’ পুনঃবাস্তবায়নের জন্য ফিলিস্তিনে জমি কেনার জন্য ইহুদিরা ‘জ্যুইশ ন্যাশনাল ফান্ড’ গঠন করে, যার শর্ত হিসেবে উল্লেখ থাকে এই জমি কখনোই বিধর্মীদের কাছে বিক্রি করা যাবে না।
মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই প্রভাবশালী ধনাঢ্য ইহুদি ব্যক্তিদের অনুরোধে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি স্থায়ী আবাসভূমি গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। উসমানি সাম্রাজ্যের পতন ঘটার পর ফিলিস্তিন ব্রিটেনের হস্তগত হয়। এই সময়েই ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিরা দলে দলে ভিড়তে থাকে, কিনে নিতে থাকে একের পর এক জমি। উপরন্তু, ইহুদিদের জমিতে আরব শ্রমিকের কাজ করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ক্রমাগত একের পর এক অভিবাসী-ভর্তি ইহুদিদের জাহাজ বন্দরে ভেড়া শুরু করতেই স্থানীয় আরব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে যে, শীঘ্রই তারা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে। অন্যদিকে ইহুদিরাও নিজেদের গোপনে সশস্ত্র করতে থাকে। ১৯২০-এর দশকেই ফিলিস্তিন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ইহুদি-আরব দাঙ্গা।
১৯৩৭ সালে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে সমগ্র ফিলিস্তিন দুই ভাগে ভাগ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হলে আরবদের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, যা কঠোরভাবে দমন করা হয়। এদিকে ইউরোপে নাৎসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হওয়া ইহুদিদের জাহাজ ভর্তি করে ইসরায়েলে পাঠাতে থাকা জায়োনিস্টরা, এবং এদেরকে দেখিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ওপর চাপ দিতে থাকে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের জন্য।
বিশ্বযুদ্ধের পর দুর্বল হয়ে পড়া ব্রিটিশদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ করা শুরু করে ইহুদি আধা-সামরিক বাহিনীগুলো। একের পর এক আক্রমণে পর্যুদস্ত ব্রিটিশরা একপর্যায়ে ফিলিস্তিন থেকে তাদের নাগরিকদের ব্রিটেনে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। জাতিসংঘ এ সমস্যা সমাধানের জন্য আলাদা কমিটি গঠন করে। আরবদের জন্য গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীর অংশ রেখে বাকি সবটুকু অঞ্চল নিয়ে ইহুদিপ্রধান ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে জাতিসংঘে এ প্রস্তাব পাশ হয়।
১৪ মে, ১৯৪৮; ব্রিটিশরা তাদের শেষ সেনাদল ইসরায়েল থেকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শেষ করতেই ইহুদি নেতা ডেভিড বেন গুরিয়ন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও, স্বীকৃতি দিতে নারাজ আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তবে কোনো দেশই তাদের মূল সেনাদল পাঠায়নি এবং অনেকগুলো দেশ একত্রে হামলা করলেও তাদের মোট সৈন্যসংখ্যা ইসরায়েলের চেয়ে কম ছিল। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি মিত্রের প্রয়োজন ছিল, ইসরায়েল ছিল সেরকমই একটা দেশ। তাই শুরু থেকেই তাদের সাহায্য করে যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ শেষে ইসরায়েল সমগ্র ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়, যেখানে UN Resolution 181-তে ৫৭ শতাংশ ভূমি নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের উল্লেখ ছিল।
১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল সংকটের পর ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে মিশরের সিনাই উপত্যকা, সিরিয়ার গোলান মালভূমিসহ পশ্চিম তীর ও গাজা দখল করে নেয় ইসরায়েল। ঐ বছরেই অধিকৃত অঞ্চল থেকে ইসরায়েলকে সরে যাওয়ার জন্য জাতিসংঘে UN Resolution 242 গৃহীত হয়। রেজল্যুশনে ফিলিস্তিনিদেরকে ‘শরণার্থী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং বেশ কিছু দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয়। কোন কোন অঞ্চল থেকে ইসরায়েল সরে যাবে তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ না থাকায় ইসরায়েল সমগ্র অঞ্চল থেকে সরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়, বিশেষ করে গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীর থেকে। আর এ সময় থেকেই ইসরায়েল সরকার এই দুই অঞ্চলে ইহুদি বসতি (Settlement) তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, এবং সামরিক শাসন জারি করে।
মূলত UN Resolution 242 -এর মাধ্যমেই মার্কিন সরকার ও গণমাধ্যম ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে যেকোনো ঘটনায় শব্দ নির্বাচনে কৌশলী হয়ে ওঠে, যা অব্যাহত রয়েছে এখন পর্যন্ত। মার্কিন মিডিয়া কীভাবে শব্দ, প্রসঙ্গ (Context) সহ অন্যান্য দিকের অপব্যবহার ঘটিয়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাত ভুলভাবে চিত্রায়ণ করে তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ২০০৪ সালে প্রকাশিত সুট ঝালি ও বাথশেবা রাটজকফের পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র ‘পিস, প্রোপাগান্ডা অ্যান্ড দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’-এ ।
মার্কিন মিডিয়ায় ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের চিত্রায়ণ
“Israel is waging a two-pronged battle: one is a military battle against the Palestinians to occupy their land, the other is a fight to occupy and control American media coverage, and keep it pro-Israel.” – Robert Jensen
১৯৬৭ সালে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা থেকে সরে না গিয়ে সেখানে সামরিক শাসন ও ধীরে ধীরে ‘ইহুদি বসতি’ নির্মাণ করার প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের হারানো দেশ ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। সেই সময়েই ইয়াসির আরাফাতের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘ফাতাহ’ (পিএলও) পশ্চিম তীর ও পরবর্তীতে জর্ডান ও লেবানন থেকে তাদের অপারেশন পরিচালনা করতে থাকে। ১৯৮২ সালে পিএলও-র এই আক্রমণের জবাব দিতে লেবাননে হামলা চালায় ইসরায়েল। এ সময় ইসরায়েলের মিত্র লেবাননের খ্রিস্টধর্মীয় উগ্র-ডানপন্থী ‘কেতায়েব পার্টি’র সদস্যরা ‘সাব্রা ও শাতিলা’ শরণার্থী ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড চালায়। রেডক্রসের হিসাব অনুযায়ী, কমপক্ষে ৩ হাজার মানুষ এই হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়। এর ফলে সারাবিশ্বে ইসরায়েলের বিপক্ষে সমালোচনার ঝড় ওঠে, এবং মানুষের মনে ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম নেয়।
হাসবারা, প্রেস অফিস এবং মার্কিন গণমাধ্যমের ফিল্টার
পিস, প্রোপাগান্ডা অ্যান্ড দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’ প্রামাণ্যচিত্র অনুযায়ী, ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের সংবাদ যেন ইসরায়েলের জন্য পরবর্তীতে বড় হুমকি না হয়ে দাঁড়ায়, এ কারণেই ইসরায়েল তাদের ‘হাসবারা’ (הַסְבָּרָה) বা পাবলিক রিলেশন অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। বিশেষ করে মার্কিন মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষভাবে এই প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ইসরায়েলের পক্ষে থাকলেও এই হাসবারার লক্ষ্য হচ্ছে মার্কিন জনমতকেও ইসরায়েলের পক্ষে রাখা, যাতে যেকোনো বিষয়েই ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পেতে পারে।
মার্কিন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের খবরাখবর পায় মূলত জেরুজালেমে থাকা ইসরায়েল প্রেস অফিস থেকে। ইসরায়েল প্রেস অফিস থেকে প্রকাশিত প্রেস রিলিজ, সাক্ষাৎকারসহ সংঘাতের অন্যান্য ঘটনাই হুবহু মার্কিন গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পায়। অন্যান্য দেশের সাংবাদিকদের তুলনায় মার্কিন সাংবাদিকদের সরাসরি ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রতিবেদন তৈরির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম দাবি করা হয়েছে ‘পিস, প্রোপাগান্ডা ও দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’ প্রামাণ্যচিত্রটিতে, যেখানে দেখানো হয় সাংবাদিকরা জেরুজালেমে বসেই পশ্চিম তীর বা গাজার সংঘাত সম্পর্কে রিপোর্ট করছে। অনেক সময় এই সাংবাদিকদের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয় না, এবং তাদের প্রেস অফিস থেকে প্রকাশিত সংবাদের উপরেই পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়। অর্থাৎ, প্রতিবেদনগুলোতে কোনো ঘটনা সম্পর্কে শুধু ইসরায়েলের মতামতই উঠে আসে, যা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পরিপন্থী।
প্রামাণ্যচিত্র অনুযায়ী, ইসরায়েল থেকে সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে পৌঁছানোর পর সংবাদকে বেশ কিছু ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো সংবাদমাধ্যমগুলোর মালিকানা। সংবাদপত্রের মালিকদের সাথে জায়োনিস্টদের সুসম্পর্ক কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত থাকায় সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠতার সাথে প্রতিবেদন তৈরি করা সম্ভব হয় না। এর সাথে দ্বিতীয় ফিল্টার হিসেবে যুক্ত হয় ইসরায়েলপন্থী রাজনীতিবিদদের চাপ। এই দুই চাপের ফলে মার্কিন গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ ইসরায়েলের গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের চেয়েও বেশি ইসরায়েলপন্থী হয়ে ওঠে! এগুলোর সাথে তৃতীয় ধাপ হিসেবে যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ইসরায়েলের পাবলিক রিলেশন অফিসের কার্যক্রম, যুক্তরাষ্ট্রের ৯টি শহরে থাকা ইসরায়েলের দূতাবাস এবং বিভিন্ন বেসরকারি ইসরায়েলপন্থী সংগঠনের চাপ, যেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান AIPAC (American Israeli Public Affairs Committee)। এই সমন্বয়ী চাপের প্রভাবে মার্কিন জনমতও হয়ে ওঠে ইসরায়েলের পক্ষে, যা মার্কিন সাংবাদিকদের বাধ্য করে ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে।
এই ফিল্টারগুলো অতিক্রম করেও যদি ইসরায়েলের নীতি সম্পর্কে সমালোচনা কোনো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন Anti-Defamation League (ADL), Honest Reporting কিংবা CAMERA (Committee for Accuracy in Middle East Reporting in America)-এর মতো সংগঠনগুলো সাংবাদিকদেরকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে এবং এগুলোকে ভুল ও পক্ষপাতিত্বমূলক বলে অ্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা চালায়। প্রতিবেদনটিতে সাক্ষাৎকার দেওয়া সাংবাদিক অ্যালিসা সলোমনের বক্তব্যনুযায়ী, “তাদের মতে, বস্তুনিষ্ঠতা মানেই ইসরায়েলপন্থী সংবাদ।” অনেক সময় নিউ ইয়র্ক টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্টের মতো তুলনামূলক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমগুলোকে বয়কট করার জন্যও জনমত অভিযান পরিচালনা করে এসব সংগঠন।
ইসরায়েল প্রেস অফিসের আরো একটি কাজ হচ্ছে সাংবাদিকদের ট্রেনিং দেওয়া, যারা ইসরায়েলপন্থী ঘরানার এবং তাদেরকে শেখানো হয় যেকোনো ঘটনাকেই বিশেষ শব্দচয়নসহ অন্যান্য পদ্ধতিতে ইসরায়েলের পক্ষে তুলে ধরা যায়। ৮০ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্রটিতে ইসরায়েল প্রেস অফিসের এই কৌশলগুলোকেই বিষদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।৬
-
প্রসঙ্গহীনতা (Lack of Context)
গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা ভঙ্গের অন্যতম প্রধান কারণ প্রসঙ্গের অবতারণা না করা। কোনো বিষয়কে তুলে না ধরে এড়িয়ে যাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। কোনো ঘটনার প্রসঙ্গ পাঠকদেরকে যেকোনো ঘটনা সম্পর্কে গভীরভাবে বুঝতে সাহাহয্য করে। অনেক ক্ষেত্রে পাঠকের সামনে কোনোরকম প্রসঙ্গের উল্লেখ না করে একজন সাংবাদিক সহজেই কোনো ঘটনা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। বিশদ পটভূমি থাকা কোনো প্রতিবেদনে যদি সেই পটভূমির কোনো উল্লেখ না থাকে তবে পাঠকের অবস্থাকে তুলনা করা যায় একজন সিনেমা দর্শকের সাথে, যিনি কোনো প্যাঁচালো থ্রিলার মাঝপথ থেকে দেখা শুরু করেছেন।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির সময়ে প্রায়ই মার্কিন মিডিয়া সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেখা যায় শুধু সংঘাতে কী পরিমাণ হতাহত হয়েছে বা কোথায় ঘটনাটি ঘটেছে, এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের সংঘাতের ইতিহাস অথবা সংঘাতের কারণ সম্পর্কে ন্যূনতম আলোকপাত করা হয় না।
ইসরায়েল গাজা ও পশ্চিম তীরে ‘ইহুদি বসতি’ নির্মাণ করা ছাড়াও পরিকল্পিতভাবে সমগ্র ফিলিস্তিনি এলাকা জুড়ে চেকপয়েন্ট তৈরি করে রেখেছে। ফলে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে হলে ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ আইডিএফের হয়রানির শিকার হতে হয় এবং প্রায় সময়ই তাদেরকে চেকপয়েন্ট অতিক্রম করতে দেওয়া হয় না। মসজিদ, হাসপাতাল, বাজার থেকে শুরু করে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে যাওয়ার অনুরোধ করলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। দেখা যায়, হাসপাতালে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখার কারণে পথিমধ্যেই মারা গিয়েছেন অনেক রোগী।
ইসরায়েলের সেনাবাহী ট্রাকের চাপায় ৪ ফিলিস্তিনি শ্রমিকের মৃত্যু হলে সমগ্র ফিলিস্তিন জুড়ে ‘প্রথম ইন্তিফাদা’ ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন, কর্মক্ষেত্রে না যাওয়া, ইসরায়েলি পণ্য বর্জন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে ইসরায়েলের অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ করতে থাকে ফিলিস্তিনিরা। এই প্রতিবাদ ঠেকাতে ইসরায়েল প্রায় ৮ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে। লাঠি দিয়ে পেটানো কিংবা প্লাস্টিকের বুলেট ব্যবহারসহ নানা যুদ্ধাপরাধ ঘটতে থাকে। প্রথম বছরেই ৩১১ জন ফিলিস্তিনি মারা যায় ইসরায়েলিদের হাতে, যাদের মধ্যে ৫৩ জনই ১৭ বছরের নিচে। বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের বোমা বা ককটেল হামলায় মৃত্যু ঘটে ১২ জন ইসরায়েলির। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির আগপর্যন্ত ৬ বছরে আইডিএফের হাতে প্রাণহানি ঘটে প্রায় ১,৬০০ ফিলিস্তিনির।
২০০০ সালের জুন মাসে দ্বিতীয় ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার কিছুদিন পরেই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন টেম্পল মাউন্ট পরিদর্শন করলে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সূচনা হয়। ২০০০-০৫ সাল পর্যন্ত চলা এই আন্দোলন ছিল আরো ধংসাত্মক। নিয়মিতভাবে রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস ছাড়াও বন্দুক, বিমান হামলা এবং ট্যাংক ব্যবহার করে ইসরায়েলিরা, বিপরীতে ফিলিস্তিনিরাও বন্দুক হামলা, আত্মঘাতী বোমা হামলাসহ বিভিন্নভাবে ইসরায়েলি সৈন্যদেরকে আক্রমণ করে। প্রায় সাড়ে ৪ বছর ধরে চলা এই সংঘাতে কমপক্ষে ৬৪৪ জন বেসামরিক নাগরিকসহ প্রায় ১,০১০ জন ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়। অন্যদিকে আইডিএফের হাতে নিহত হয় ৩ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি।
‘পিস, প্রোপাগান্ডা অ্যান্ড দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’ প্রামাণ্যচিত্রে দেখানো হয়, পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর এই দখলদারিত্বের ইতিহাস চেপে যাওয়া হয় মার্কিন মিডিয়াতে। ফলে যারা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি ‘সেটলমেন্ট’, আইডিএফের চেকপয়েন্ট কিংবা ইসরায়েলি দখলদারিত্বের ইতিহাস জানেন না, তাদের কাছে যখন কোনো ফিলিস্তিনি বোমা হামলা বা ইসরায়েলি সৈন্য হতাহতের সংবাদ পৌঁছায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা একে ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলে মনে করেন। অনেকে মনে করেন, ইসরায়েলিদের ভূমিতেই ফিলিস্তিনিরা তাদের হামলা বা আক্রমণ চালাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ডে অবৈধভাবে থাকা ইসরায়েলি সৈন্যদের প্রতিবাদেই এটি হচ্ছে, তা মার্কিন মিডিয়াতে বেমালুম চেপে যাওয়া হয়। পটভূমি ব্যাখ্যা না করার কারণে মার্কিন জনসাধারণের কাছে ফিলিস্তিনিরা ‘প্রতিবাদী’র বদলে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু ঘটলে একে স্রেফ ইসরায়েলিদের ‘আত্মরক্ষা’ হিসেবে মার্কিন মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে আলাদা থাকা পশ্চিম তীর ও গাজার অভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা কয়েক লক্ষ ইসরায়েলি সেনা প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনিদের স্বাভাবিক জীবনে বাধা সৃষ্টি করছে, যা সম্পূর্ণ জাতিসংঘের নিয়মের বাইরে। এরপরও তাদের ওপর আক্রমণ করা হলে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের ইতিহাস এড়িয়ে শুধু আক্রমণের সংবাদ প্রচার করার মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা যায়, মার্কিন মিডিয়ার মাত্র ৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান পশ্চিম তীর ও গাজায় সংঘাতের প্রতিবেদনে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব (Occupation) শব্দটির উল্লেখ করেছে।
তবে এই প্রসঙ্গহীনতা বৃহত্তর সংঘর্ষ ছাড়াও নির্দিষ্ট একটি ঘটনার ক্ষেত্রেও হতে পারে। যেমন: ২০১৫ সালের জুলাই মাসের একটি ঘটনায় দেখা যায়, ইসরায়েলি সেনাদের প্রতি পাথর ছোড়া এক ফিলিস্তিনি বালককে গুলি করে মেরে ফেলে আইডিএফ সেনারা। এএফপি কিংবা নিউ ইয়র্ক টাইমস এই পাথর ছোড়াকে উল্লেখ না করেই তাদের শিরোনাম লেখে। বিপরীতে রয়টার্স ঘটনাটির শিরোনাম লেখার সময় পাথর ছোড়ার বিষয়টি উল্লেখ করে।
-
বিভ্রান্তিকর শব্দের ব্যবহার ও সুভাষণ (Use of Misleading Words & Euphemism)
বস্তুনিষ্ঠতা ভঙ্গের অন্যতম কারণ হচ্ছে Misleading Definition অর্থাৎ ভুল শব্দ প্রয়োগ করে পাঠকের মনে কোনো ঘটনা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করা। মার্কিন মিডিয়াতেও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত সম্পর্কে পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে দেখা যায়।
ছয় দিনের যুদ্ধের পর ইসরায়েলি গণমাধ্যম গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরকে ‘Occupied Territory’ বা দখলকৃত অঞ্চল বলে অভিহিত করা শুরু করলেও কয়েক বছর পরেই দখলকৃত শব্দটি সরিয়ে, সেখানে ‘Administered Territory’ শব্দটি ব্যবহার করা শুরু করে। সেথ অ্যাকারম্যানের গবেষণানুযায়ী, মার্কিন মিডিয়াতেও শুরুর দিকে ‘Occupied’ শব্দটির প্রচলন থাকলেও ধীরে ধীরে তা কমে আসে এবং একপর্যায়ে তা প্রায় ‘ট্যাবু’ হিসেবে পরিগণিত হয়। ২০০১ সালের হিসাব অনুযায়ী ৯০ শতাংশেরও বেশি মার্কিন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান Occupied শব্দটির বদলে অন্য শব্দ ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে ব্রিটিশ সংবাদপত্র পাঠকদের মধ্যে জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৯ শতাংশ পাঠক ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলের দখলকৃত অঞ্চল সম্পর্কে অবগত আছে।
পশ্চিম তীর ও গাজার অভ্যন্তরে ইহুদি বসতি বা ‘Settlement’-কেও মার্কিন মিডিয়া উল্লেখ করে ‘Neighborhood’ হিসেবে, যা সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকেই বদলে দেয়। ইসরায়েল কৌশলগতভাবেই পশ্চিম তীর ও গাজা অঞ্চল জুড়ে নিজেদের বসতি নির্মাণ করেছে, যা সমগ্র অঞ্চলের ৪০ শতাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে, এবং এগুলো এমনভাবে সাজানো যেখানে পানির সহজলভ্যতা রয়েছে। জেরুজালেম নিয়ন্ত্রণের জন্য আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব জেরুজালেমের চারপাশেও ইসরায়েল ইহুদি বসতি নির্মাণ করেছে, এবং এই বসতিগুলোকে যুক্ত করা হয়েছে অসংখ্য রাস্তা দিয়ে, যা ফিলিস্তিনকে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। ফলে পশ্চিম তীরের অভ্যন্তরেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে চেকপয়েন্টসহ নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয় ফিলিস্তিনিদের।
‘পিস, প্রোপাগান্ডা অ্যান্ড দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’ প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যায়- সিএনএন তাদের প্রতিবেদনে ‘সেটলমেন্ট’ শব্দের বদলে ‘নেইবারহুড’ শব্দটি ব্যবহারের নীতি চালু করেছে। অন্যদিকে বিবিসির প্রতিবেদনগুলোতে নিয়মিতভাবে ‘Occupied Territory’ বা ‘Captured Land’ শব্দ ব্যবহার হতে দেখা যায়। এগুলো ছাড়াও ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদেরকে আলাদা করে রাখার জন্য তৈরি করা ‘Apartheid Wall’-কে ‘Security Fence’ (নিরাপত্তা বেড়া), ফিলিস্তিনিদেরকে ‘Militant’ ও ‘Terrorist’ বলে অ্যাখ্যায়িত করা হয়। এর বিপরীতে, ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী ফিলিস্তিনিপন্থী গণমাধ্যমগুলো মিলিট্যান্ট ও টেরোরিস্টদের ‘Freedom Fighter’ বলে অভিহিত করে, যারা ইসরায়েলের সাধারণ নাগরিকদেরকে হত্যা করে।
পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনিদের বসতি ভেঙে ফেলার ক্ষেত্রেও এই সুভাষণের (Euphemism) চর্চা দেখা যায় মার্কিন গণমাধ্যমে। মার্কিন গণমাধ্যম অনুযায়ী, বাড়ি বানানোর অনুমতি (No Building Permit) না নিয়েই নির্মাণের কারণে তা ভেঙে ফেলা হচ্ছে, যদিও তা ইসরায়েলের সীমানার বাইরে! ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের মোট ৪৮,৪৮৮টি বাড়ি ভেঙেছে, বসতিহীন হয়ে পড়েছে কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনি।
সুভাষণ (Euphemism) ব্যবহার করে গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি মার্কিন ও ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলোর এই আঘাত সম্পর্কে মুখ খুলেছেন অনেক সাংবাদিক ও গবেষক। ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক মন্তব্য করেছেন,
ফিলিস্তিনি আত্মঘাতী বোমা হামলাকে ফিলিস্তিনিরা ‘শহীদ’ বলে সম্বোধন করছে। আবার, ইসরায়েলিরা তাদের ‘Colony’-কে Neighborhood, Suburbs কিংবা ‘Exile’-কে ‘Displacement’ বলে অ্যাখ্যায়িত করছে। ইসরায়েলিরা যখন মারা যাচ্ছে, তখন বলা হচ্ছে তারা সন্ত্রাসী আক্রমণে মারা গিয়েছে, আবার ফিলিস্তিনিরা মারা গেলে বলা হচ্ছে সংঘর্ষে মারা গিয়েছে।
গার্ডিয়ানের সাংবাদিক হুইটেকার তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন,
শব্দের খেলায় ইসরায়েল বিজয়ী হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকে বলা হচ্ছে ‘প্রতিশোধ (Retaliation)’ কিংবা ‘প্রত্যুত্তর (Response)’, এমনকি তারা প্রথমে আক্রমণ করলেও।
-
ভারসাম্যহীন প্রতিবেদন (Imbalanced Reporting)
একটি প্রতিবেদন বিভিন্নভাবে ভারসাম্যহীন হতে পারে, যেমন: একপক্ষ সম্পর্কে লম্বা প্যারাগ্রাফ লেখা, কিন্তু অপরপক্ষের মতামত নিতে গেলে শুধু তাদের নাম উল্লেখ করে শেষ করা। অথবা শুধু একপক্ষের সমালোচনা করে সম্পাদকীয় লেখা, বিপরীতে তাদের পক্ষের কোনো মতামত না নেওয়া। সমানুপাতিক হারে সংঘর্ষের দুই পক্ষের মতামতই তুলে ধরা উচিত, কিন্তু যখন দেখা যায় যে, কোনো একটি বিশেষ পক্ষের প্রতিবেদনে অতিরিক্ত ছবি যোগ করা হচ্ছে, বিশেষ সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী আলোচনা হচ্ছে, তা-ও তুলে ধরা হচ্ছে, তখন বোঝা যায় যে, পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগ প্রতিবেদনটিকে পক্ষপাতদুষ্ট করে তুলেছেন।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার প্রথম ৩ বছরে ৫ শতাধিক ইসরায়েলি নিহত হয় ফিলিস্তিনিদের হামলায়, বিপরীতে দখলকৃত অঞ্চলে ইসরায়েলি সেনাদের হাতে মারা গিয়েছিল দুই সহস্রাধিক ফিলিস্তিনি। কিন্তু মার্কিন মিডিয়ায় এই সংঘাতের কভারেজের পরিসংখ্যানে এর সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী চিত্র ফুটে ওঠে।
‘পিস, প্রোপাগান্ডা অ্যান্ড দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’ প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যায়, সংঘাতের প্রতিবেদনগুলোতে শুধু যে ইসরায়েলিদের মৃত্যুর ঘটনা বেশি প্রচার করা হয় তা-ই নয়, একইসাথে তাদেরকে বেশি কাছের ও মানবিক হিসেবে প্রচার করা হয়। হামলায় ইসরায়েলিদের মৃত্যু ঘটলে তাকে ‘ম্যাসাকার’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হলেও ইসরায়েলিদের বিমান হামলায় কিংবা অন্য কোনোভাবে এর চেয়েও বেশি ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু ঘটলে একে স্রেফ সংঘর্ষে মৃত্যু বলে চালিয়ে দিতে দেখা যায়।
এছাড়াও ইসরায়েলি হতাহতের ঘটনা ঘটলে তাদের পারিবারিক তথ্য, তাদের পরিচয়, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ভিডিওচিত্র, তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্নভাবে প্রতিবেদনকে আরো মানবিক করে তোলা হয়, যা ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে একেবারেই অনুপস্থিত। লাশ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ মিছিল কিংবা মায়ের আহাজারি দেখিয়ে প্রতিবেদনে এমনভাবে শব্দ ব্যবহার করা হয়, যাতে কোনো সহমর্মিতা-সহানুভূতির ছাপ দেখা যায় না। বরং, ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু স্বাভাবিক এবং ন্যায্য বলে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়।
-
ইচ্ছাকৃত বর্জন (Selective Omission)
প্রতিবেদন তৈরির সময় কোনো ঘটনা সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা পুরো ঘটনার নির্দিষ্ট কিছু অংশ তুলে ধরা (Cherry-Picking Details)-র মাধ্যমে কোনো প্রতিবেদনকে সহজেই পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলা যায়।
‘পিস, প্রোপাগান্ডা অ্যান্ড দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’ প্রামাণ্যচিত্র অনুযায়ী, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত কভারেজের সময় মার্কিন গণমাধ্যমগুলো ইসরায়েলবিরোধী প্রতিবাদ কিংবা ইসরায়েলের প্রতি সমালোচনাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যায়। ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ইহুদিদের অনেকেই ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের অত্যাচার-নির্যাতন কিংবা এই দখলদারিত্ব মেনে নিতে পারেন না। এজন্য মাঝেমধ্যে তাদেরকে প্রতিবাদী মিছিল করতে দেখা যায়। জেরুজালেমের রাস্তায় ইসরায়েলের শান্তিকামী একটি সংগঠনের একটি মিছিলে দুই হাজারেরও বেশি লোকজন একত্রিত হয়ে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের প্রতিবাদ জানালেও মার্কিন মূলধারার গণমাধ্যমে এ ঘটনার ওপর কোনো প্রতিবেদন প্রচার করা হয়নি।
এছাড়াও ইহুদিদের অনেকেই ফিলিস্তিনিদের জন্য বাড়ি পুনঃনির্মাণ করে দেওয়ার জন্য অর্থসাহায্যসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য করে থাকেন। ইসরায়েলের প্রেস অফিস তাদেরকে অ্যাখ্যায়িত করেছে ‘Self-Hating Jew’ হিসেবে। আবার, ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যও পশ্চিম ব্যাংক ও গাজা উপত্যকায় দায়িত্ব পালন করার জন্য অস্বীকৃতি জানান। এজন্য তাদেরকে বেশ হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ধরনের সংবাদ মার্কিন গণমাধ্যমে একেবারেই প্রচারিত না হওয়ার মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন গণমাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব চোখে পড়ে।
-
সঠিক তথ্যের ভুল বিশ্লেষণ (Wrong Analysis of True Facts)
২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড টু চুক্তিতে শেষপর্যন্ত ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন একমত না হওয়ায় মার্কিন গণমাধ্যম এজন্য ফিলিস্তিনিদের দায়ী করে। তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ফিলিস্তিন এ চুক্তি বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী না হওয়ায় তারা শান্তিচুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে এবং দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
‘পিস, প্রোপাগান্ডা অ্যান্ড দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’ প্রামাণ্যচিত্রে দেখানো হয়, ফিলিস্তিন ক্যাম্প ডেভিড টু চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার ঘটনাটি সত্য হলেও, ফিলিস্তিন কেন এ চুক্তিতে একমত হয়নি, তা মার্কিন গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয় না, এবং হলেও তা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিপরীতে, ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদা সম্পূর্ণ আলাদা ঘটনা হলেও, ইসরায়েলি প্রেস অফিস এই দুটোকে একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করেছে।
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ইসরায়েলের উদার মনোভাবের ফসল হিসেবে মার্কিন গণমাধ্যম তুলে ধরলেও এই চুক্তি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার পথে অন্যতম বাধা। চুক্তি অনুযায়ী, পশ্চিম তীরের জলাধারগুলো ফিলিস্তিনিদের হাতছাড়া হয়ে যাবে, এছাড়াও ফিলিস্তিনিরা তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে না, এমনকি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলাদা কোনো সীমানা থাকবে না। ইহুদি বসতি নির্মাণের সময় রাস্তাগুলো উপড়ে ফেলা হবে না, অর্থাৎ চেকপয়েন্টগুলো আগের মতোই থাকবে। এছাড়াও চুক্তিতে জেরুজালেমের ধর্মীয় স্থান ও উদ্বাস্তু হয়ে পড়া ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে কোনো উল্লেখ করা হয়নি। এসব কারণেই ফিলিস্তিনিরা ক্যাম্প ডেভিড টু চুক্তি মেনে নেয়নি, যেগুলো মার্কিন গণমাধ্যমে একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া হয়।
-
যাচাইয়ের অভাব (Lack of Verification)
মার্কিন গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠতার আরেকটি লঙ্ঘন হলো সংবাদের উৎস ও সত্যতা যাচাই না করেই তা প্রকাশ করা, এবং এটি উভয়পক্ষ থেকেই কম-বেশি হয়ে থাকে। ২০০২ সালে হেব্রন শহরে প্রার্থনারত অবস্থায় ইহুদিদের ওপর ফিলিস্তিনিরা আক্রমণ চালিয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ করা হয়, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলে। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, প্রার্থনারত ইহুদিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ইসরায়েলি সেনাদের ওপরই কেবল গুলি চালানো হয়, এবং মৃতদের সবাই আইডিএফ-এর সদস্য।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিদের পক্ষেও মার্কিন গণমাধ্যমের এ অভিযোগের সংখ্যা কম নয়। জেনিনের যুদ্ধে কয়েক শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে সংবাদ প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায়, ৫২ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু ঘটেছে। ২০০৫ সালে মার্কিন লেখক রিচার্ড ল্যান্ডেস ‘প্যালিউড’ নামে ১৮ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্রে দেখান, মার্কিন গণমাধ্যমগুলো ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে নেওয়া বিভিন্ন ফুটেজ নিয়ে তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করে দিচ্ছেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই বানানো (Staged) ঘটনা।