অনুসন্ধিৎসু মনে হঠাৎই এমন প্রশ্ন উদয় পারে, মামুলি এক নুড়ি-পাথর পলিশিংয়ের মাধ্যমে কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দামি বস্তু হয়ে ওঠে? হ্যাঁ, পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বস্তু হিসেবে এখানে হীরার কথাই বলা হচ্ছে। মানুষ সুন্দরের পূজারী। প্রাচীনকাল থেকেই মানবজাতি সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য অলংকার পরিধানের রীতি চালু করেছে। শুরুর দিকে অলংকারের প্রাথমিক নিদর্শন হিসেবে ঝিনুক, শামুক, বা হাড়ের টুকরার খোঁজ পাওয়া গেলেও, আধুনিক যুগে এই জায়গা দখল করে নিয়েছে নানা রকম উজ্জ্বল পাথর ও জেমস্টোন বা রত্ন-পাথর।
বর্তমানে হীরা বা ডায়মন্ড পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান, নিরেট ও দৃঢ় বস্তুগুলোর একটি। ডায়মন্ড বিশ্বের বিখ্যাত ব্র্যান্ড Tiffany & Co. এর এক ক্যারেট বা তার একটু বেশি বর্ণহীন ক্রিস্টাল ক্লিয়ার এক্সিলেন্ট কাটের একটি এনগেজমেন্ট রিং রিটেইল স্টোর ক্রয় করতে হলে পকেট থেকে খসাতে হবে ৬,৫০০-৭৫০০ মার্কিন ডলার। অথচ গাণিতিক হিসাবে ক্যারেট ভরের একটি একক যা ২০০ মিলিগ্রামের সমান (০.২ গ্রাম; ০.০০৭০৫৫ আউন্স)। Tiffany & Co. ছাড়াও, হীরার মার্কেটে সুপরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে আছে Harry Winston, Cartier, Chopard, Van Cleef & Arpels ইত্যাদি।
অলংকার হিসেবে হীরা কীভাবে ও কেন এত দামি ও জনপ্রিয় হয়ে উঠলো, তা আলোচনা করতে পূর্বের কিছু ইতিহাস নিয়ে খানিক আলোকপাত করতে হবে। হীরা মূলত কার্বনের কঠিন রূপ যা অত্যধিক তাপ, চাপ ও একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে থাকার কারণে তৈরি হয়। বেশিরভাগ প্রাকৃতিক হীরাই পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ১০০ মাইলেরও বেশি গভীরে, ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৪৫-৯০ কিলোবার চাপে কার্বন পরমাণু থেকে হীরায় রূপান্তরিত হয়। হীরা রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সময়ও একটি বড় নিয়ামক।
প্রাকৃতিকভাবে কার্বন হীরায় রূপান্তরিত হতে হতে প্রায় ১ বিলিয়ন থেকে ৩.৫ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। আজ পর্যন্ত পাওয়া প্রায় সকল হীরার বয়সই পৃথিবী সৃষ্টির প্রথমদিককার উদ্ভিদগুলোর চেয়ে বেশি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবী গঠন হবার সময়েই এর অভ্যন্তরে আটকে পড়া কার্বন উচ্চ তাপ ও চাপে ধীরে ধীরে হীরায় পরিণত হয়েছে।
ইতিহাসবিদের মতে খ্রিঃ পূঃ ২৫০০ – খ্রিঃ পূঃ ১৭০০ অব্দের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে (সিন্ধু সভ্যতার ব্রোঞ্জ যুগে) দ্রাবিড় জাতি ভারতে সর্বপ্রথম হীরার সন্ধান পায়। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন, ভারতে সর্বপ্রথম হীরা আবিষ্কার হয় খ্রিঃ পূঃ ১০০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে। Brilliance এর তথ্যসূত্রে উল্লেখ করা আছে, খ্রিঃ পূঃ প্রায় ৪০০ অব্দে প্রাচীন ভারতবর্ষের সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’ ও ‘রত্নপরীক্ষা’তে সর্বপ্রথম হীরার লিপিবদ্ধ ইতিহাস মেলে।
প্রাচীন সেই গ্রন্থে মুদ্রা হিসেবে হীরার বিনিময় প্রথার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। বাণিজ্য মাধ্যম হিসেবে হীরা ব্যবহারের কারণে এবং ভারত ও চীনের সাথে প্রাচীন ব্যবসায়ী রুটগুলো (সিল্ক রোড) সম্পৃক্ত থাকায় মূল্যবান এই পাথরটি পৌঁছে যায় গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত। পরবর্তী কয়েক শতকে মূল্যবান এই রত্ন পাথরটি রাজ পরিবার, প্রভাবশালী পরিবারগুলোর কাছে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে স্থান পায়।
একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো সময়ে দক্ষিণ ভারতে বিশ্ববিখ্যাত ১৮৬ ক্যারেটের কোহিনূর হীরার সন্ধান মিলে।
এটি কখনো শোভা পেয়েছে মুঘল দরবারে, কখনো ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছে ইরানী যোদ্ধাদের হাতে, কখনো আবার সমৃদ্ধ করেছে আফগান শাসক কিংবা পাঞ্জাবি মহারাজাদের। এর বর্তমান অবস্থান টাওয়ার অফ লন্ডনে, ক্রাউন জুয়েলের অংশবিশেষ হিসেবে। তবে কোহিনূরই ভারতবর্ষের একমাত্র শ্রেষ্ঠ হীরা নয়। কোহিনূরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্তত আরও দুটি হীরকখণ্ডের প্রমাণ ইতিহাসে মেলে। এর একটি হলো দরিয়া-ই-নূর, আর অন্যটি গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড।
১৭৩৯ সালে ইরানী শাসক নাদির শাহ লুটের অন্যান্য জিনিসের সাথে এই তিনটি হীরাও সাথে করে নিয়ে যান। আঠারো শতাব্দী পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল, শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই হীরা পাওয়া যায়। ওই শতকের শেষ দিকে ভারতবর্ষে মজুদ হীরার পরিমাণ তলানিতে ঠেকলে অন্যান্য দেশে এর বিকল্প অনুসন্ধান শুরু হয়।
১৭২৫ সালে ব্রাজিলে হীরার একটি খনি পাওয়া গেলেও, তা তৎকালীন বিশ্বের হীরার চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত যোগান দিতে পারত না। পরবর্তী শতকে রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় কিছু হীরার খনি আবিষ্কৃত হয়। তবে, হীরা জগতের চিরচেনা চেহারা পালটে যায় ১৮৬৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার অরেঞ্জ নদীর পাশে বেশ কয়েকটি হীরার খনি আবিষ্কারের পর। ১৮৭১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় De Beers ও Kimberley নামে দুটো হীরার খনি আবিষ্কারের পর হীরার উৎপাদন মাত্রা হুট করেই বেড়ে যায়। এর ফলে বাজারে হীরার সরবরাহ আবার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু করে। সরবরাহ ক্রমশ বাড়তে থাকায় পড়তে থাকে হীরার দাম, যা অন্যান্য হীরা খনির মালিকদের জন্য উদ্বিগ্নতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ক্রমশ লোকসানে তলিয়ে যাবার দরুন অনেক মালিক খনি বন্ধ বা বিক্রি করে দিতে থাকেন। সুযোগটা কাজে লাগান ধুরন্ধর ব্রিটিশ ব্যবসায়ী সেসিল রোডস। তিনি ছোট ছোট মাইনিং অপারেশনগুলো কিনে নিতে থাকেন। যার ধারাবাহিকতায় তিনি জোহানেস নিকোলাস ডি বিয়ার ও ডিয়েড্রিক আর্নোল্ডোস ডি বিয়ার নামে দুই ভাইয়ের কাছ থেকে De Beers খনিটিও ক্রয় করে নেন। De Beers মাইনিং কোম্পানি Kimberley খনিকে সাথে নিয়ে হীরাকে আরেকটু সহজপ্রাপ্য করে তোলে। এ খনি আবিষ্কারের পর হীরের দাম বেশ কমে আসে। কিন্তু দাম ও আবেদন যেন অধিক নিম্নমুখী না হয়, সে জন্যে তারা এক কৌশলের আশ্রয় নেন। তা হলো, হীরা যতই উত্তোলন করা হোক না কেন, বাজারে হীরা সরবরাহের নাটাই থাকবে কোম্পানিগুলোর কাছেই। তখন হীরার মূল বাজার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। প্রতি বছর কত মানুষ বাগদানে হীরার আংটি ব্যবহার করছে, সে হিসাবানুযায়ী বাজারে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ফলে De Beers হীরার দাম নিয়ন্ত্রণে নিজ ইচ্ছানুযায়ী চাবুক চালাতে পেরেছে।
সেসিল রোডসের নেতৃত্বে ১৮৮৮ সালে ‘De Beers Consolidated Mines’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারা পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার বেশিরভাগ খনি নিজেদের করে নেয়। ক্যালেন্ডারের পাতা তখনো ১৯০০ সালের ঘর ছোঁয়নি। এরমধ্যেই কোম্পানিটি দক্ষিণ আফ্রিকার খনিগুলো থেকে উৎপাদিত হীরার মাধ্যমে বিশ্বের হীরা বাজারের নব্বই শতাংশই নিয়ে নেয় নিজেদের দখলে। De Beers এই বাজিমাতের ফলে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে যায় ডায়মন্ড ইন্ডাস্ট্রি, ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে হীরার দাম।
হীরার মূল্য বৃদ্ধির সাথে আরেকজন মানুষের নাম উতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি হলেন ১৮৮০ সালে জন্ম নেওয়া জার্মান বংশোদ্ভূত আর্নেস্ট ওপেনহাইমার। ১৮৯৭ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে লন্ডনের এক ডায়মন্ড সিন্ডিকেটে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেওয়ার পর, সেখানে নিজ দক্ষতা ও কর্মনিপুণতা দেখাতে থাকেন তিনি। কোম্পানিটি তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে সাউথ আফ্রিকার কিম্বারলেতে কোম্পানির খরিদ্দার হিসেবে পাঠায়। নিজ যোগ্যতার বলে তিনি ধীরে ধীরে কিম্বারলের খনিতে মেয়র পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯১৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা পুঁজিপতি জেপি মরগানের সাহায্যে একটি মাইনিং কোম্পানি গঠন করেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘Anglo American Corporation’।
প্রথম থেকেই কোম্পানিটি De Beers গ্রুপের মাইনিং অপারেশনের সাথে টেক্কা দিয়ে আসছিল। ১৯২৪ সালে ওপেনহাইমার সাউথ আফ্রিকার সাধারণ নির্বাচনে কিম্বারলে অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হয়ে সাউথ আফ্রিকার ‘হাউজ অভ অ্যাসেম্বলি’র সদস্য হন। ১৯২৭ সালের দিকে একপ্রকার জোর করেই তিনি সেসিল রোডসের প্রয়োগ করা মাইনিং সিস্টেম বাতিল করে দেন। এরপরই বিশ্বের ডায়মন্ড সাপ্লাই চেন ও মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ব্যাপক পরিবর্তনের মুখ দেখে। ফলে হীরার দাম এক লাফে বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
পৃথিবীর যেকোনো হীরার গুণগত মান নির্ণয় করা হয় 4C এর মাধ্যমে। এই 4C দিয়ে বোঝায় Color, Clarity, Cut ও Carat Weight। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত হীরার একেকটির আকার, আয়তন, বর্ণ ও স্বচ্ছতায় ভিন্নতা থাকে। তাই হীরাকে নির্দিষ্ট কোনো দামের গণ্ডিতে ফেলা সম্ভব নয়। অনেকের ভাবতে পারে, যে হীরা আকার ও আয়তনে বেশি বড়, তার দাম তত বেশি। কিন্তু এ ধারণা ভুল। জিআইএ ক্ল্যারিটি গ্রেডিং সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে হীরাকে মোট ১১টি গ্রেডে ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে IF বা F গ্রেডের হীরাকে ধরা হয় নিখুঁত বা নিটোল হিসেবে। এসব হীরার মধ্যে কোনোরকম অপদ্রব্য থাকে না, পুরোটাই খাঁটি কার্বন পরমাণুর স্বচ্ছ স্ফটিক।
হীরার দাম নির্ধারণে বর্ণ বা রঙ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডায়মন্ডের কালার গ্রেডিং শুরু হয় D থেকে, যা শেষ হয় Z এ। শ্বেত হীরার ক্ষেত্রে হীরাতে ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে D থেকে যত সামনের দিকে এগোবে, হলুদ রঙের উপস্থিতি যত বাড়বে, আর হীরার দামও তত কমবে। তবে হোয়াইট ডায়মন্ড বা শ্বেত হীরা ছাড়াও বেশ কিছু রকমের হীরা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়, যেগুলোর কালারগ্রেডিং ভিন্নভাবে করা হয়, এবং সেগুলোর দামও বর্ণভেদে হয়ে থাকে ভিন্ন।
এরপর হীরার দামে যেটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে তা হচ্ছে কাটিং আর পলিশিং। ‘জেমোলজিক্যাল ইন্সটিটিউট অভ আমেরিকা’র স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, ডায়মন্ডের কাটিংকে গ্রেডিং করা হয়েছে মোট পাঁচটি ভাগে। এর মধ্যে ‘Excellent Cut’ হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট। এছাড়াও ডায়মন্ডের বিভিন্ন আকার লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে রাউন্ড, প্রিন্সেস, ওভাল, কুশন, পিয়ার, এমেরাল্ড, হার্ট, মারকুইজ, রোজ, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সেসবের উপর ভিত্তি করেও হীরার দামে তারতম্য হয়।
বর্তমান সময়ে হীরার উৎপাদন বেশি হলেও জুয়েলারিতে ব্যবহারযোগ্য হীরা বেশ দুর্লভই বলা চলে। খনি থেকে উৎপাদিত হীরার প্রায় আশি শতাংশই রত্নপাথর হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নয়। এগুলো ব্যবহার করা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডায়মন্ডের জন্য। শ্বেত হীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া গেলেও ভিন্ন রঙয়ের হীরা খুবই দুষ্প্রাপ্য। যার ফলে রুবি (লাল), স্যাফায়ার (নীল) কিংবা এমারেল্ড (সবুজ) হীরা এত সহজে পাওয়া যায় না। সেগুলোর মূল্যও থাকে আকাশচুম্বী, জনসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রাচীনকালে উন্নত যন্ত্রপাতি না থাকাতে ডায়মন্ড মাইনিং প্রক্রিয়া চলত মাটির অল্প গভীর পর্যন্ত। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে বর্তমানে হীরার মাইনিং মাটির গভীরে ৫০০ থেকে ৬০০ মিটার নিচ পর্যন্ত করা হয়। হীরার মাইনিং একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ, অন্যদিকে কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। ফলশ্রুতিতে, হীরা উত্তোলনের পরিমাণের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে উৎপাদন খরচও। এটিও হীরার দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। জুয়েলারির দোকানে সাজানো হীরাগুলো যেমন চকচকে, উজ্জ্বল, ও দীপ্তিমান দেখায়, উত্তোলনকৃত হীরা প্রাথমিকভাবে তেমন ঝকঝকে থাকে না। খনি থেকে প্রাপ্ত হীরাকে পালিশ করার মাধ্যমে এই দীপ্তিময় রূপ দেওয়া হয়।
তবে এখানেও একটা সমস্যা বিদ্যমান। যেহেতু প্রতিটি হীরার আকার-আকৃতি ভিন্ন, তাই হীরার পলিশিং কোনো কম্পিউটারচালিত অটোমেটেড মেশিন দ্বারা সম্ভব নয়। এজন্য কোম্পানিগুলোকে নির্ভর করতে হয় দক্ষ হীরাকরদের উপর। ইংরেজিতে এদেরকে বলা হয় জেম-কাটার। হীরার কাটিং ও পলিশিংয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারস্যাপার জড়িয়ে রয়েছে বলে, সেই হীরাকারদের বেশ কুশলী ও পটু হতে হয়। এদেরকে মাইনে দিতে গেলেও কোম্পানির পকেট থেকে মোটা অংকের অর্থ খসানো লাগে।
মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের ৯০ শতাংশ হীরার কাটিং ও পলিশিং হয় ভারতে (গুজরাটের সুরাত শহরে)। ভারতে প্রায় ৭০০০ ডায়মন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটে ৬ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। হীরা পৃথিবীর অন্যতম দৃঢ় বস্তু হওয়ায় এর কাটিং ও পলিশিংয়ের জন্য যে যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তা বেশ ব্যয়বহুল। হীরার কাটিং ও পলিশিংয়ের সময় ‘ডায়মন্ড ডাস্ট’ নামে একপ্রকার অবশিষ্ট তৈরি হয়, যা মূলত হীরারই অতিক্ষুদ্র কণা। একে বর্জ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জুয়েলারিতে ব্যবহার করার মতো আকারে আনতে হলে সেই হীরার অধিকাংশই বাদ দিতে হয়। যা হীরার দাম বৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
হীরা বিশেষজ্ঞ ইরা ওয়েসম্যানের মতে, হীরা অন্যান্য পণ্যের মতোই একটি বস্তু মাত্র। তাই সেটি কখনোই বিনিয়োগের উপাদান হিসেবে বিবেচ্য হয়নি। যেকোনো হীরা বিক্রি করতে গেলে ক্রয়মূল্যের ২০-৪০ শতাংশ পাওয়া যায়। এই দরপতনের মূলে রয়েছে ডায়মন্ড ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপক ধুরন্ধর কৌশলের বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া। ১৯২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে oঅর্থনৈতিক মন্দা ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন‘ শুরু হয়। ফলে সেসময় হীরার চাহিদা কমতির দিকে ধাবিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালে অন্যান্য সৌখিন পণ্যের মতো হীরার চাহিদাও ছিল কমতির দিকে। De Beers এর কাছে প্রয়োজনের অধিক হীরার যোগান থাকলেও, এর চাহিদা ছিল কম। ১৯৩৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেল, সে সময় বিয়ের পিঁড়িতে বসা কনেদের এক-তৃতীয়াংশই কোনো ধরনের আংটি বদল ছাড়াই বিয়ে সম্পন্ন করতেন। তখন আর্নেস্ট ওপেনহাইমার ভাবেন, পণ্য হিসেবে হীরাকে এমন অবস্থায় আনতে হবে, যাতে মানুষ বেশি বেশি হীরা কিনতে আগ্রহী হয়, হীরার প্রতি তাদের বিশেষ আগ্রহ জন্মায়। সে ভাবনা থেকে কোম্পানিটি কড়া নাড়ে অ্যাড এজেন্সি N. W. Ayer & Son এর দুয়ারে।
এজেন্সিটি ক্রেতাদের ওপর এক জরিপ চালিয়ে দেখল, বেশির ভাগ মানুষই হীরাকে এক হাস্যকর বিলাসিতা হিসেবে দেখে। তখন তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ক্রেতার পকেটে থাকার অর্থের দখল নিতে হলে আগে স্থান করে নিতে হবে তাদের হৃদয়কোণে। সংস্থাটি টার্গেট হিসেবে প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলকে বেছে নেয় আর সেখানে মূল উপলক্ষ হিসেবে ধরা হয় বাগদান বা এনগেজমেন্টকে। এরপর থেকেই এজেন্সিটি হীরা এনগেজমেন্ট রিংকে বাগদানের আকর্ষণীয় উপঢৌকন হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন ধাঁচের মনকাড়া বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতে থাকে। এর ফলেই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার মারপ্যাঁচে এনগেজমেন্ট রিং হিসেবে হীরার আংটির প্রচলন ভালোভাবে শুরু হয়ে যায়। তবে, পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে De Beers এর রুচিশীল ও চমকপ্রদ কিছু বিজ্ঞাপন। এসব বিজ্ঞাপনের মধ্যে অন্যতম ছিল এর ‘A Diamond is Forever‘ স্লোগান সম্বলিত বিজ্ঞাপনটি, যা হীরার চিরাচরিত ব্যবসায়ী ধারাকে পালটে দেয়।
এরপর থেকে এ ধরনের বেশকিছু অ্যাড ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে এনগেজমেন্ট ম্যাটারিয়াল হিসেবে ডায়মন্ড রিং হয়ে দাঁড়ায় একধরনের পরিপূর্ণ উপাদান। ১৯৩০ সালের দিকে এনগেজমেন্টে ডায়মন্ড রিং দেওয়ার হার ২০ শতাংশ থাকলেও, ১৯৫০ সালের দিকে তা পৌঁছে যায় ৮০ শতাংশের ঘরে। সংখ্যাটা ২০ এর ঘর থেকে ৮০ এর ঘরে পৌঁছানোর জন্য De Beers গ্রুপের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় মধ্যবিত্ত আয়ের লোকজন। সে লক্ষ্যে তারা মধ্যবিত্ত আয়ের পুরুষদের টার্গেট করে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন বাজারে ছাড়ছিল। এর মধ্যে জনপ্রিয় ছিল ‘How can you make two month’s salary last forever?’ শীর্ষক বিজ্ঞাপনটি।
মাত্র দুই মাসের বেতন দিয়েই একজন তার প্রিয়তমাকে এনগেজমেন্ট রিং হিসেবে হীরার আংটি উপহার দিতে পারবে। ১৯৫০ সালের দিকে De Beers ফোকাস করে হলিউডের দিকে। কারণ, সে সময় হলিউডি তারকাদের নানা দিককে অনুসরণ করত ভক্তরা। De Beers এর অ্যাড এজেন্সি N. W. Ayer & Son ম্যাগি এটিঞ্জার নামে একজন মুভি পাবলিসিস্টকে ভাড়া করেন, যিনি হলিউডে ডায়মন্ডের প্রচারক হিসেবে কাজ করতে থাকেন।
তার কাজই ছিল যে মুভি ইভেন্ট বা ফটোশুটে ডায়মন্ড প্লেসমেন্টের অপশন আছে, সেখানেই ডায়মন্ডকে অডিয়েন্সের সামনে নিয়ে আসা। এছাড়াও হলিউডের তারকারা কে কী ডায়মন্ড পরেছে, তা নিয়ে পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে বিস্তারিত ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিল অ্যাড এজেন্সিটি। এতে করে কোম্পানিটি নারীদের মনে ডায়মন্ড নিয়ে একপ্রকার মোহময় আকর্ষণ তৈরি করতে সক্ষম হয়। ১৯৫৩ সালে মেরিলিন মনরো ‘Gentlemen Prefer Blondes‘ মুভিটিতে ‘Diamonds Are a Girl’s Best Friend‘ গানটি হলিউডে ডায়মন্ডের প্রভাব বিস্তারের এক চমৎকার উদাহরণ।
এসব অ্যাড ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছিল De Beers, যা মার্কেটে হীরার চাহিদা বাড়াতে বেশ সক্ষম হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে এনগেজমেন্ট রিংয়ে একক আধিপত্য বিস্তারের পর তারা নজর দেয় আন্তর্জাতিক বাজারে, ১৯৬০ সালে। জাপানে কোম্পানিটি বেশ ঢালাওভাবে মার্কেটিং ক্যাম্পেইন চালানো শুরু করে। ১৯৬৭ সালে জাপানে যখন De Beers তাদের অ্যাড ক্যাম্পেইন শুরু করেছিল, তখন হীরার এনগেজমেন্ট রিংয়ের ব্যবহার ছিল মাত্র পাঁচ শতাংশ। ১৯৮১ সালে যা গিয়ে দাঁড়ায় ৬০ শতাংশে। হীরা বাজারে নিজেদের চাহিদা বাড়ানোর পাশাপাশি তারা একচেটিয়া ব্যবসার ধারাও বজায় রেখেছিল।
আশির দশকে আফ্রিকা মহাদেশের বেশকিছু দেশে ডায়মন্ড মাইনিং অপারেশন দুর্নীতিগ্রস্থ সরকার ও যুদ্ধবাজ বিদ্রোহী গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এসব খনি থেকে প্রাপ্ত হীরা বিক্রি করে সংঘাতের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনা হতো। এসব যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলের হীরার একমাত্র খদ্দের ছিল De Beers। কারণ তারা চাইত না, বাজারে হঠাৎ বেশি পরিমাণ হীরা ঢুকে পড়ে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে যাক। De Beers গ্রুপের এহেন কর্মকাণ্ডের ফলে সেসকল দেশের যুদ্ধবাজ সন্ত্রাসীরা লোভের নেশায় হীরা উত্তোলনে আরও উৎসাহী হয়ে ওঠে। De Beers গ্রুপের এই মনোপলি বিজনেস পলিসি কেউই ভালো চোখে দেখত না। ফলে, রিপাবলিক অভ কঙ্গো, ইজরায়েল, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ De Beers গ্রুপের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললে কোম্পানিটি মার্কেটে হীরার সরবরাহ কমিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে, সেসব দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায় হীরার মূল্য। তাই, এরপর কেউ আর De Beers এর মনোপলির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে রাজি হয়নি। এভাবে De Beers সারা বিশ্বে হয়ে উঠেছিল হীরা সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে হীরার মার্কেটে De Beers এর পূর্বের একক রাজত্ব এখন আর নেই। এরমধ্যে কিছু কারণ তুলে ধরলে প্রথমেই উঠে আসবে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে De Beers কোম্পানির ব্লাড ডায়মন্ড পারচেজের কথা। এছাড়াও রয়েছে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় নতুন হীরার খনি আবিষ্কার, কোম্পানিটির অনৈতিক অ্যাড ক্যাম্পেইনের বিষয়গুলো জনসম্মুখে প্রকাশ হওয়া, ইত্যাদি। এর ফলে কোম্পানিটি ক্রমশ মার্কেটে তাদের অবস্থান হারাতে থাকে। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয় কোম্পানিটিকে। ততদিনে তাদের মনোপলি বিজনেসে ধ্বস নেমে গেছে। তাই বর্তমানে ডায়মন্ডের মার্কেটে ‘সাপ্লাই চেন কন্ট্রোল’ বাদ দিয়ে তারা শুধুমাত্র খুচরা ডায়মন্ডের ব্যবসা করে যাচ্ছে।
Statista‘র তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে ২২% মার্কেট শেয়ার নিয়ে De Beers হীরার বাজারে দ্বিতীয় সেরা ডায়মন্ড মাইনিং প্রতিষ্ঠান। যদিও ২০১১ সালে De Beers গ্রুপের প্যারেন্ট কোম্পানি Anglo American ডি বিয়ার্সের কাছে কোম্পানিটির ৪০% স্টক ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করে দেওয়ার মাধ্যমে ওপেনহাইমার পরিবার তাদের ডায়মন্ড ব্যবসা থেকে বেরিয়ে আসে। যা চলমান ছিল শত বছরেরও বেশি সময় ধরে।
ডায়মন্ড ইন্ডাস্ট্রিতে গত দুই দশকে বেশ বড় বড় পরিবর্তন এসেছে। খনি হতে হীরা উত্তোলন থেকে শুরু করে সাপ্লাই চেন সার্টিফিকেশন ও মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রেও এসেছে বেশ স্বচ্ছতা। তবুও দাম কমেনি হীরার। বিলাসদ্রব্য হিসাবে মানুষের কাছে হীরার চাহিদা ছিল সবসময় অন্যরকম, হয়তো ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে।