উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ। সুইজারল্যান্ডের ফরাসিভাষী অঞ্চলের শহর নয়শাটেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় সাহিত্যের অধ্যাপক আর্থার পিয়াজেঁ ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে ফিরতেই দেখতে পেলেন তার ছোট্ট ছেলে বেশ কান্না করছে। দৌড়ে গেলেন তিনি, দেখতে পেলেন ছেলের হাতে বেশ কিছু ব্যান্ডেজ বাঁধা। স্ত্রী রেবেকা আর বাচ্চার দেখাশোনা করা মেয়েটি পাশে বসা। জানতে পারলেন- প্রতিদিনকার মতো প্রামে (শিশু বহন করা চার চাকার ঠেলে নিয়ে যাওয়া গাড়ি) করে বাচ্চাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই একজন তার বাচ্চাকে ছিনিয়ে নিতে গিয়েছিল। তারপর মেয়েটির সাথে ধস্তাধস্তি হলে লোকটি পালিয়ে যায়। সৌভাগ্য এই যে, খুব বেশি আঘাত লাগেনি বাচ্চাটির গায়ে। নাম তার জ্যঁ পিয়াজেঁ।
বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। জ্যঁ পিয়াজেঁ তখন ১৫ বছরের বালক। প্রাণীবিজ্ঞানের প্রতি অত্যধিক আগ্রহের কারণে ইতোমধ্যেই শামুক প্রজাতির (মলাস্ক) ওপর দুটো প্রতিবেদন লিখে স্থানীয় জীববিজ্ঞানীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, অন্তত কোনো ১৫ বছর বয়সী বালকের কাছ থেকে কেউই এত ভালোমানের প্রতিবেদন আশা করেনি। যা-ই হোক, হঠাৎ একদিন বাসায় বেশ লম্বা চিঠি এলো, চিঠিটি পাঠিয়েছেন জ্যঁ পিয়াজেঁর সেই ছোটবেলার দেখাশোনাকারী মেয়েটি। চিঠিতে মেয়েটি লিখেছে- সেদিনের মিথ্যা কথা বলার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আসলে কেউই সেদিন শিশু জ্যঁকে কেড়ে নিতে আসেনি, বরং তার অসতর্কতার কারণেই জ্যঁ আঘাত পেয়েছিল। চাকরি হারানোর ভয়ে সেদিন মিথ্যা কথা বলতে হয়েছিল তাকে! পিয়াজেঁ দারুণ অবাক হলেন, কারণ তিনি এতদিন সত্যি সত্যি ভাবতেন তাকে ছোটোবেলায় কেউ অপহরণ করার চেষ্টা করেছিল, এবং এই গল্প শুনতে শুনতে তার অবচেতন মনেই গেঁথে গিয়েছে এই কাহিনী আসলেই বাস্তবে তার সাথে ঘটেছিল! এমনকি আসল ঘটনা জানার পরেও তার মনে অপহরণ হওয়ার স্মৃতির রেশ থেকে যায়। ঠিক তখন থেকেই পিয়াজেঁ মানুষের জ্ঞান এবং মনস্তত্ত্ব নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
গবেষণার শুরু
জ্য পিয়াজেঁ তার ক্যারিয়ার নিয়ে এগোলেন দর্শন আর যুক্তিবিদ্যার দিকে। নয়শাটেল বিশ্ববিদ্যালয় আর জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করার সময়েই আগ্রহী হয়েছিলেন মনোঃবিশ্লেষণ বা Psychoanalysis-এর দিকে। ইউরোপের মনোবিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু তখন ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব। গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার পর সুইটজারল্যান্ড থেকে পিয়াজেঁ পাড়ি জমালেন ফ্রান্সে, কাজ করবেন ফরাসি মনস্তত্ত্ববিদ আলফ্রেড বিনেটের সাথে, যিনি কাজ করছেন কীভাবে মানুষের বুদ্ধি মাপা যায় তা নিয়ে। বিনেট তখন একটা স্কুল চালাচ্ছেন, পড়ানোর পাশাপাশি ছাত্রদের বুদ্ধি মাপামাপিও চলছে। তার সহকারী হিসেবেই ঐ স্কুলেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন পিয়াজেঁ। মূলত বিনেটই প্রথম বুদ্ধি মাপার আইকিউ টেস্টের নিয়ম তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে আরেক মনস্তত্ত্ববিদ লুইস টারম্যান সংশোধন করেন।
বিনেটের সহকারী থাকা অবস্থাতেই পিয়াজেঁ খেয়াল করেন, বাচ্চারা বেশ কিছু প্রশ্নের ভুল উত্তর দিচ্ছে, যেগুলো আবার বড়রা সহজেই পেরে যাচ্ছে। বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে পিয়াজেঁ একইরকম ফল পেতে লাগলেন। বাচ্চাদের ভুল উত্তর নিয়ে পিয়াজেঁ খুব একটা মাথা ঘামাননি, যতটা ঘামিয়েছেন কেন একটি বয়স পার হলে সেই উত্তর দেওয়ার সক্ষমতা ব্যক্তির মধ্যে তৈরি হয় তা নিয়ে।
১৯২৩ সালে পিয়াজেঁ বিয়ে করলেন, যোগ দিলেন নয়শাতেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান আর দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে। ইতোমধ্যেই তার তিন সন্তান হলো, আর পিয়াজেঁ তাদেরকে একেবারে ছোটোবেলা থেকেই তাদের বেড়ে ওঠা পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন, নোট নিতে থাকলেন সন্তানদের আচরণের। মূলত এই পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করেই পিয়াজেঁ পরবর্তীতে প্রকাশ করলেন তার বিখ্যাত তত্ত্ব: ‘বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন তত্ত্ব’ বা Theory of Cognitive Development।
বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন তত্ত্ব
জ্যঁ পিয়াজেঁ অনেকদিন ধরেই বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করছিলেন, এবং সময় যত গড়াচ্ছিল ততই তার তত্ত্বে পরিবর্তন আসছিল। প্রথমে সমাজবিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্য, তারপর বায়োলজিক্যাল মডেল, এরপর যুক্তিবিদ্যার মডেল, এবং শেষমেশ তার মূল তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বে তিনি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে একটি শিশু তার চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা লাভ ও জ্ঞান অর্জন করে, কীভাবে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটে। মানুষের বুদ্ধি সবসময় একই রকম থাকে এই ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি মত দেন, ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সাথে তার বয়সের সাথে সাথে পরিবেশের প্রভাবও জড়িত।
পিয়াজেঁর কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট তত্ত্ব অনুযায়ী, শিশুরা মানসিক বিকাশের চারটি ধাপ অতিক্রম করে। তার তত্ত্ব শুধু শিশুরা কীভাবে জ্ঞান অর্জন করে তার দিকেই নজর দেয় না, বরং বুদ্ধিমত্তার প্রকারভেদ সম্পর্কেও আলোচনা করে। পিয়াজেঁ বিশ্বাস করতেন, শিশুরা শিখন প্রক্রিয়ায় বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এই প্রক্রিয়ায় তারা অনেকটাই বিজ্ঞানীদের মতো বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়, পরীক্ষাগুলো পর্যবেক্ষণ করে, বোঝার চেষ্টা করে এবং শেষমেশ পারিপার্শ্বিক জিনিস সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। যখন শিশুরা তাদের আশেপাশের অবস্থাগুলোর সাথে পরিচিত হয়, তখন তারা নতুন জিনিস সম্পর্কে জানে এবং তার জানা জিনিসের সাথে এই নতুন জ্ঞান মেলানোর চেষ্টা করে। এভাবেই শিশুর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটে। পিয়াজেঁর তত্ত্বের ধাপগুলো হলো:
সেন্সরিমোটর ধাপ (জন্ম থেকে ২ বছর)
জন্মের পরপরই শিশুরা তাদের চলাফেরা ও ইন্দ্রিয় দিয়ে পরিবেশকে বোঝার চেষ্টা করে। তারা কোনো ঘটনা একবার হয়ে গেলে বার বার করার চেষ্টা করে। যেমন: মুখে আঙুল ঢুকিয়ে চোষা। ৪-৮ মাস বয়সে শিশুরা শোনা, দেখা, ধরাসহ সাধারণ কিছু কাজের মাধ্যমে পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। তারা বুঝতে পারে তাদের শরীর ছাড়াও আশেপাশে আরও অনেক জিনিস আছে। শিশুরা পরিবেশ থেকে নিজেদেরকে আলাদা মনে করতে থাকে। ৮-১২ মাস বয়সে তারা বুঝতে পারে যে তাদের কাজ তাদের আশেপাশের পরিবেশে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তারা এ সময় তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে পারে। তারা কয়েকটি ঘটনা মিলিয়ে নতুন কাজ করে। যেমন: লাঠি দিয়ে যে কোনো কিছু টেনে আনা যায় তা বুঝতে পারে। ১-২ বছর বয়সী শিশুরা বস্তু দিয়ে নানা পরীক্ষা চালায়। আলাদা আলাদা কাজ করলে যে আলাদা আলাদা ফল আসে এটি তারা অনুধাবন করতে পারে।
প্রি-অপারেশনাল ধাপ (২-৭ বছর)
সেন্সরিমোটর ধাপ পার হওয়ার পর এই ধাপে পা রাখে শিশুরা। সাধারণত ২ বছর বয়স হলেই বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন প্রি-অপারেশনাল ধাপে প্রবেশ করে। এ সময় শিশুরা কথা বলতে শেখে, চিহ্নের মাধ্যমে চিন্তা করা শেখে এবং শব্দ ও ছবির মাধ্যমে বস্তুকে চিহ্নিত করতে পারে। যেমন: তার সামনে হয়তো গরু নেই, কিন্তু গরুর ছবি দেখলে তারা চিনতে পারে এটি গরু। বস্তু চেনার পর তারা জানার চেষ্টা করে কোনো ঘটনা কেন হয়, কীভাবে হয়। তারা এ সময় প্রচুর প্রশ্ন করতে থাকে।
শিশুরা এই ধাপে বেশ আত্মকেন্দ্রিক হয় এবং অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারে না। তারা মনে করে তারাই পৃথিবীর কেন্দ্র, এবং তাকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর সবকিছু হচ্ছে। তারা বেশ স্বার্থপর হয়ে ওঠে। যদিও এ সময় তাদের চিন্তাক্ষমতার বিকাশ ঘটে এবং তারা ভাষা ব্যবহার করতে পারে, তবুও তারা শুধু মূর্ত জিনিস সম্পর্কেই চিন্তা করতে পারে, বিমূর্ত জিনিস সম্পর্কে নয়। তারা বুঝতে পারে তারা অনেক কিছু সম্পর্কেই জানে, কিন্তু কীভাবে এতকিছু জেনেছে তা বুঝে উঠতে পারে না।
কংক্রিট অপারেশনাল ধাপ (৭-১১ বছর)
কংক্রিট অপারেশনাল ধাপে শিশুরা মূর্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে যুক্তির মাধ্যমে চিন্তা করতে পারে। এছাড়াও বস্তুর নিত্যতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে; যেমন: একটি ছোট ও মোটা গ্লাস, একটি চিকন ও লম্বা গ্লাসের সমান পানি সংরক্ষণ করতে পারে। তাদের চিন্তাভাবনা আরো গঠনমূলক হয়ে ওঠে, যুক্তির মাধ্যমে চিন্তাশক্তির আরো বিকাশ ঘটে, তবে তা-ও কেবল মূর্ত বিষয়কেন্দ্রিক। বিমূর্ত বিষয় সম্পর্কে তখনও পরিপূর্ণ ধারণা শিশুদের মধ্যে গড়ে ওঠে না। এ সময় তারা আর আত্মকেন্দ্রিক বা স্বার্থপর থাকে না, তারা বুঝতে পারে তারা ছাড়াও বাকিরা অন্যভাবে চিন্তা করতে পারে।
ফরমাল অপারেশনাল ধাপ (১১ বছর থেকে তদূর্ধ্ব)
বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের শেষ ধাপে কিশোররা বিমূর্তভাবে চিন্তা করতে পারে এবং কাল্পনিক জিনিস সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে। তারা এ সময় নৈতিক, দার্শনিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করতে শুরু করে, যেগুলোর জন্য তাত্ত্বিক এবং বিমূর্তভাবে চিন্তা করার সক্ষমতা প্রয়োজন। এছাড়াও Deductive যুক্তি অর্থাৎ, একটি সাধারণ জিনিস থেকে একটি নির্দিষ্ট তথ্য আহরণ করতে শুরু করে। সমস্যার সমাধানও এ পর্যায়ে তারা করতে শেখে। এবং এভাবেই বুদ্ধির বিকাশ ঘটতে থাকে।
তত্ত্বের প্রভাব
পিয়াজেঁর আগে মনস্তত্ত্ববিদগণ ভাবতেন যে শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই চিন্তা-ভাবনা করে, তারা প্রাপ্তবয়স্কদেরই ছোট রূপ। কিন্তু পিয়াজেঁ এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেন। মূলত, এই বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন তত্ত্বের মাধ্যমেই তিনি দেখান যে শৈশব মানবজীবনের এক অনন্য সময় এবং মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। শৈশবের সামাজিকীকরণ ঠিকভাবে না হলে পরবর্তীতে ব্যক্তিজীবনে এর বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। পিয়াজেঁ এই তত্ত্বের সাহায্যে প্রমাণ করেন প্রাপ্তবয়স্ককদের তুলনায় শিশুরা ভিন্নভাবে চিন্তা করে, একইসাথে শিশুদের মানসিক বুদ্ধিবিকাশ কীভাবে হয়, তারও বিভিন্ন ধাপ দেখিয়ে যান তিনি।
পিয়াজেঁর তত্ত্ব মনোবিজ্ঞানে এক নতুন মাইলফলক তৈরি করে। কেবল মনোবিজ্ঞানই নয়, সমাজবিজ্ঞান, শিক্ষা এবং জেনেটিক্সের ক্ষেত্রেও পিয়াজেঁর এই তত্ত্ব শিশুর মানসিক বিকাশ, সামাজিকীকরণসহ নানা জিনিস ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত কতে থাকে। মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন রথী-মহারথীরাও পিয়াজেঁর কাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সায়েন্স অফ ফলস মেমোরি’ বইয়ে দুই গবেষক ব্রেইনার্ড ও রেইনা পিয়াজেঁ সম্পর্কে লিখেছিলেন,
তিনি একাই শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে চলা সামাজিক বা আবেগীয় উন্নতিকে বাদ দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের দিকে মনোবিজ্ঞানীদের আগ্রহ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত মনোবিজ্ঞানের বেশিরভাগ গবেষণাই পিয়াজেঁর কাজ ও তার কাজের সমালোচনার ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল, যেমনটা ছিল ঠিক তার আগের দশকে ফ্রয়েডের তত্ত্ব নিয়ে।