‘অ!’-তে আমরা চিত্র-বিচিত্র কিছু চরিত্র এবং তাদের কার্যকলাপ দেখতে পাই। এই চরিত্রসমূহের একটির সাথে আরেকটির কোনো যোগসাজশ নেই। তথাপি এরা পরস্পরের সাথে একটি ঠুনকো, দুর্বল তন্তু দ্বারা সংযুক্ত। এই চরিত্রগুলো কারা এবং তারা কীভাবে একে অপরের সাথে সংযুক্ত, তার বর্ণনায় এই সিনেমার গল্প এগিয়ে গিয়েছে। এখানে আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন মোট ছয়টি গল্পের সমাবেশ ঘটেছে।
প্রথম গল্পের মূল চরিত্র রাধা (এষা রেবা) এবং তার পার্টনার কৃষ্ণাবেনী (নিত্থিয়া মেনন)। তারা উভয়ে মিলে রাধার বাবা-মাকে নিজেদের সম্পর্কের ব্যাপারটি মেনে নিতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছে।
নালা (প্রিয়দর্শী পুলিকোন্ডা) একজন বেকার যুবক। কিছুতেই কাজ খুঁজে পাচ্ছে না সে। এখন সে এসেছে একটি রেস্টুরেন্টে এবং নিজেকে শেফ দাবী করে একটি অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থানের পথ খুঁজছে। এই রেস্টুরেন্টের কিচেনেই তার সাথে বন্ধুত্ব হয় কথা বলতে পারা গোল্ডফিশ নানী এবং বনসাই চ্যান্টির সাথে। গোল্ডফিশের কণ্ঠ দিয়েছেন অভিনেতা নানী এবং বনসাইয়ের কণ্ঠ দিয়েছেন রাভি তেজা। এই গল্পটি দর্শককে কিছুটা হলেও ডিজনীর সিনেমাগুলোর কথা মনে করিয়ে দেবে।
তৃতীয় গল্পে আমরা দেখি শিভাকে (শ্রীনিবাস আভাসারালা)। পেশায় দারোয়ান শিভা হতে চায় বিজ্ঞানী এবং বানাতে চায় টাইম মেশিন। এমতাবস্থায় তার সাথে দেখা করতে আসে পার্বতী (দেবদর্শিনী), যার কথা শুনে সে হতবাক হয়ে যায়। কেননা, পার্বতীর মতে সে আর শিভা একই মানুষ।
আরেকটি গল্পে দেখা যায় ছোট্ট বাচ্চা মোকশাকে। সে মায়ের সাথে তাদের রেস্তোরাঁয় কাজ করে। এই মোকশাই একসময় অহংকারী জাদুকর ইয়োগির (মুরলী শর্মা) সাথে অবতীর্ণ হয় এক স্নায়ুযুদ্ধে।
মীরা (রেজিনা ক্যাসান্ড্রা) একজন ওয়েট্রেস এবং মাদকাসক্ত, যে তার প্রেমিকের সাথে মিলে এক ধনী ব্যক্তির সম্পদ লুটের প্ল্যান করে।
সিনেমায় আরো আছে কালী (কাগজ আগারওয়াল), যাকে দেখেই বোঝা যায় যে, সে মানসিক সমস্যায় ভুগছে। নিজের জন্মদিনে সে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করে।
এ সকল আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর সম্পর্কহীন চরিত্রগুলোর মাঝে সংযোগ কী, তা নির্ণয়ের মাঝেই এই উদ্ভাবনী গল্পের মূল রহস্য নিহিত। খেয়াল করলে দেখবেন, চরিত্রসমূহের নামকরণের ক্ষেত্রে পরিচালক ভগবত গীতা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন, যা তার মিথলজিপ্রিয়তার পরিচয় বহন করে। এছাড়া সিনেমার মূল থিম কী, সেই বিষয়ক একটি ক্লু তিনি সিনেমার ওপেনিং ক্রেডিটে ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকা গানের মাধ্যমেই দিয়েছেন।
‘অ!’-এর ব্যাপারে কোনো স্পয়লার দেওয়া মানে সিনেমাটি দর্শকদেরকে যে সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্স প্রদান করে, তার প্রতি অন্যায্য আচরণ করা। কনটেক্সটের বাইরে গিয়ে বলতে গেলে বলা যায়,
There has never been a time when you and I have not existed, nor will there be a time when we will cease to exist.
ভগবত গীতার এই উক্তি সিনেমার ক্ষেত্রে পুরোপুরি সঠিক। একসময় দেখা যায়, মীরা রেস্টুরেন্টের বেইজমেন্টে গিয়ে একটা রুবিকস কিউব খুঁজে পায়। সে সেটি অন্ধকার কোণের দিকে ছু্ড়ে মারে। স্বল্পকালের মধ্যেই রুবিকস কিউবটি তার দিকে ফিরে আসে, সম্পূর্ণভাবে মেলানো অবস্থায়।
সিনেমার প্লট এখানে আমরা রুবিকস কিউব হিসেবে ধরে নিতে পারি। পরিচালক প্রশান্ত ভার্মাকে ধরে নেওয়া যায় মীরা হিসেবে। তিনি যেন প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে বসে থাকা দর্শককের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন, “দেখি আপনারা এই সিনেমার প্লট বুঝতে পারেন কিনা!“
সিনেমার পোস্টার থেকে শুরু করে ট্রেইলারসহ বিভিন্ন জায়গায় এর ব্যাপারে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো রেখেছেন পরিচালক। যৌন নিপীড়ন, শিশু নির্যাতন, মানসিক রোগ, আত্মহত্যা প্রবণতা, লিঙ্গ পরিচয়ের মতো সংবেদনশীল ব্যাপারগুলো এখানে পরিপক্বতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া, এখানে কমার্শিয়াল ক্লিশে ব্যাপারগুলোও অনুপস্থিত। পুরো মুভিতে ওপেনিং ক্রেডিটের সময় ছাড়া আর কোনো গান নেই। কমার্শিয়ালিজম থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে সিনেমার ভেতরেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বলে মনে হলো। কেননা, নালাকে যে ডিশ বানাতে দেওয়া হয়, সেটির নাম বুরিড। এটি একটি ফ্রেঞ্চ ডিশ, যা আমাদের এদিকে অতটা সহজলভ্য নয়। এটি মেইনস্ট্রিমের সাথে একাত্ম না হওয়ার অভিপ্রায়েকেই ফুটিয়ে তোলে।
‘অ!’-কে জনরার ভিত্তিতে ভাগ করতে গেলে দেখতে হবে একদম শেষ পর্যন্ত। কেননা, শেষের আগপর্যন্ত এখানে সাসপেন্স, থ্রিলার, কমেডি, রোমান্স এ সকল জনরার এক পার্ফেক্ট প্যাকেজই পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু প্রশান্ত এবং সিনেমার ক্রুরা যেমন দাবি করেছিলেন যে এই সিনেমায় কোনো মূল চরিত্র নেই, এই কাহিনীর মূল উপজীব্য তার চিত্রনাট্য; সেটি পুরোপুরি অটুট থেকেছে। এ প্রক্রিয়ায় তেলুগু সিনেমার প্রচলিত কাঠামোও ভেঙেছেন তারা। কেননা, এই ইন্ডাস্ট্রির সিনেমা তারকাদের স্টারডমের উপর ভর করেই চলে অধিকাংশ সময়। এছাড়া নানী, রবি তেজা, কাজল, রেজিনার মতো তারকারা এই স্বল্প বাজেটের প্রজেক্টে যুক্ত হয়ে নিজেদের উন্মুক্ত মানসিকতারও পরিচয় দিয়েছেন।
পরিচালক এই সিনেমার গল্পকে এমনভাবে প্রদর্শন করেছেন, যেভাবে টলিউডে এর আগে কোনো গল্প প্রদর্শিত হয়নি। পুরো ভারতেই এভাবে কয়টি গল্প প্রদর্শিত হয়েছে তা-ও গবেষণার বিষয়। গল্পের সারাংশ শুনে বা এত বড় স্টার কাস্ট দেখে আপনার মনে হতে পারে, এখানকার ঘটনাবলী জটিলতায় পরিপূর্ণ বা বুঝতে কষ্ট হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। শেষে খুব সহজেই রহস্যের যবনিকাপাত ঘটে।
সিনেমার ছয়টি গল্প কীভাবে একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত তা আগে থেকেই ধারণা করা যায় না। কারণ নিজের আঁটসাঁট বর্ণনার মাধ্যমে পর্দায় একটি ঘটনার পর কী হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে ভাবার খুব একটা অবকাশ দর্শককে দেন না প্রশান্ত। আবার এত স্টারে ভরা কাস্টে কোনো চরিত্রকেই ওভারপাওয়ারিং বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। সকল চরিত্র মিলে চিত্রনাট্যকে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়।
এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ভালো দিক সম্ভবত এর ইন্টার্যাকটিভনেস। পর্দার চরিত্রগুলোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দর্শক। দর্শকের চোখের সামনেই গল্পের ঘটনাগুলো ঘটে এবং তাদেরকেই ডটগুলো কানেক্ট করতে হয়। এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে যাওয়ার ব্যাপারও দৃশ্যায়িত হয়েছে সুন্দরভাবে। যেমন- একটি দৃশ্যে একটি চরিত্র বলে, “আমার চারপাশে সকল দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।” তারপরের দৃশ্যটি শুরু হয় অন্য গল্পের অন্য একটি চরিত্রের দরজায় টোকা দেওয়ার মাধ্যমে। অপর দৃশ্যে দেখা যায় এক লোক কফি অর্ডার করে এবং চিনি দিতে বলে। ঠিক তখনই তাকে যে সার্ভ করছে তার মোবাইল বেজে ওঠে এবং স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ‘Sugar’। তার বয়ফ্রেন্ডের নাম্বারকে সে এই নামেই সেইভ করেছে। এগুলো সৃষ্টিশীল চিত্রনাট্য লেখনীর উদাহরণ।
তারকায় ঠাসা কাস্ট নিজেদের চরিত্রায়ণে ছিল অসাধারণ। নিজেদের অভিনীত চরিত্রসমূহে প্রাণের সঞ্চার করেছেন তারা। দর্শক হিসেবে এসব চরিত্রের সবগুলোর ব্যাপারেই আপনি কিছুটা হলেও কেয়ার করবেন এবং অনুভূতি জন্মাবে। এজন্য মার্ক কে. রবিনকে তার সংগীতায়োজন এবং কার্তিক ঘাত্তামানেনিকে তার সিনেম্যাটোগ্রাফির জন্য প্রাপ্য কৃতিত্ব দিতে হবে, যা সিনেমার ন্যারেটিভের সাথে মিশে গেছে অনায়াসে।
‘অ!’ এমন একটি সিনেমা যেটি আপনি খুব ভালোবাসবেন অথবা খুব ঘৃণা করবেন। সিনেমার ঘটনাবলী যে গতিতে আগায়, সেটি কারো কারো কাছে ভালো না-ও লাগতে পারে। এছাড়া একে যদি আপনি আর দশটি তেলুগু সিনেমার মতো ভাবেন, যেখানে নিজের প্রিয় তারকাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ টাইপের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়, তাহলে হতাশ হবেন। সিনেমার কনসেপ্টের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। হয় আপনার ভালো লাগবে, নয়তো লাগবে না। প্রশান্ত আর নানী এই প্রজেক্ট নিয়ে বলতে গেলে জুয়াই খেলেছেন। বিশেষত, এমন এন্ডিং অনেকটাই অপরিচিত তাদের দর্শকদের কাছে। তবে তাদের ভাগ্য শিকে ছিঁড়েছে।
এই সিনেমা কি আপনার দেখা সেরা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের কাতারে পড়বে? অবশ্যই না! এ ধরনের আরো ভূরি ভূরি সিনেমা আছে ভিন্ন দেশে, ভিন্ন ভাষায়। আবার, মানসিক সমস্যার ব্যাপারটি যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, সেটি নিয়ে অভিযোগ থাকতে পারে। তবে এই সিনেমায় একটি প্রয়াস করা হয়েছে নতুন কিছু করার এবং প্রচলিত প্রথা ভাঙার। তাই এই সিনেমা সংশ্লিষ্টরা বাহবা পেতেই পারেন।