Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বজুড়ে ঐতিহ্যবাহী সব বিয়ের খাবার

বিয়ে বা পরিণয় মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নানা দেশের নানা জাতি নানা আঙ্গিক, ঐতিহ্য, আচার ও অভিলাষ অনুসারে বিয়ের আয়োজন করে থাকে। আয়োজন যেমনই হোক এর উদ্দেশ্যে কমবেশি নবদম্পতির মঙ্গল ও সুখ কামনা, তাদের সমৃদ্ধি, অটুট বন্ধন ও নবপ্রজন্মের আগমনের প্রতিই শুভকামনা জানান দেওয়া। দুটি মনের মেলবন্ধনের এই অপরূপ ঘটনা নানা দেশ ও এলাকা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রীতি ও ঐতিহ্যের রঙে রঙিন। নানা দেশে তাদের নিজ নিজ প্রথা ও চল অনুযায়ী বিয়েতে পরিবেশিত বিশেষ বিশেষ খাবার নিয়েই থাকছে আজকের আয়োজন।

সিডার গাছের চারা, বারমুডা

বারমুডায় কোনো জুটির বিবাহের সময় ঐতিহ্যানুযায়ী বর-কনে জুটিকে তার বিবাহ উপলক্ষ্যে প্রস্তুতকৃত কেকের ওপর একটি সিডার গাছের চারা রাখতে হয়। বিবাহের পর যখন তারা প্রথমবারের মতো একসঙ্গে তাদের নতুন বাসায় আসেন তখন নবদম্পতি এই চারাটি সেখানে রোপণ করেন এবং পরবর্তী বছরগুলোতে আনন্দের সাথে প্রত্যক্ষ করেন তাদের প্রণয় ও সম্মিলনের প্রতীক এই চারাটির বেড়ে ওঠা।

সিডার গাছের চারা দেয়া কেক; Source: foodnetwork.ca

বর-কনের বিবাহ উপলক্ষ্যে প্রস্তুতকৃত কেক কিন্তু কম আগ্রহের বিষয় নয়। নিজেদের বিয়ের কেক আনার দায়িত্ব কিন্তু বর ও কনে উভয়ের ওপরেই বর্তায়। বিবাহ অনুষ্ঠানে বর সোনার তবকে (Gold Leaf) মোড়া কেক নিয়ে আসেন যা কিনা সম্পদ ও উন্নতির প্রতীক। অপরপক্ষে কনে রূপোর তবকমোড়া, স্থানীয় রাম (একপ্রকার মদ্য) দিয়ে ভেজানো ৩ স্তরের ফ্রুটকেক নিয়ে আসেন যা ফলপ্রসূতা, বিশুদ্ধতা এবং সমৃদ্ধিকে নির্দেশ করে।

বেম কাসাডোস, ব্রাজিল

বিবাহ উপলক্ষ্যে প্রস্তুতকৃত কেক ও অঢেল ডোসে (ক্যান্ডিজাতীয় খাদ্যবিশেষ) কিংবা মিষ্টি খাবারের (যেমন- ঘন দুধ, কোকো পাউডার, মাখন ও চকোলেট স্প্রিংকেল সহযোগে তৈরি চমৎকার ব্রিগাডেইরো) বুফে চেখে দেখার পাশাপাশি ঐতিহ্যমণ্ডিত ব্রাজিলিয়ান বিয়ের অতিথিগণ বাড়ি ফেরার সময়ও সাথে করে নিয়ে যান এক সুমিষ্ট উপহার। দৃষ্টিনন্দন মোড়কে মোড়া এই মিষ্টি খাবারটির নাম ‘বেম ক্যাসাডোস’, পর্তুগিজ ভাষায় যার অর্থ ‘ভালোভাবে বিবাহিত’।

এই খাবারটি মূলত স্যান্ডউইচের মতো, যেখানে দুটি ছোট কুকি কিংবা স্পঞ্জকেকের অভ্যন্তরে পুর হিসেবে মিষ্টি স্বাদযুক্ত ‘ডুলসে-ডি-লেচে’ (ঘনকৃত দুধকে ধীরগতিতে আরো ঘন করে ক্যারামেলের ন্যায় রূপ ও আস্বাদযুক্ত মিষ্টি দ্রব্য যা খাবারে ব্যবহৃত হয়), এগ-কার্ড (ডিম সহযোগে তৈরি দধিজাতীয় খাদ্যবিশেষ), জ্যাম, ক্রিম বা মধুর যেকোনো একটি ব্যবহৃত হয়, যা কিনা নবদম্পতির মিঠে সম্মিলনকে নির্দেশ করে। এরপরে সেগুলোকে চিনির ওপর ঘুরিয়ে প্রতিটিকে আলাদাভাবে সুন্দর মোড়কে মুড়ে বো দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। অতিথিবৃন্দকে খাওয়ানোর আগে নিজস্ব ইচ্ছানুযায়ী (স্রষ্টার কাছে) কিছু প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করা হয়।

‘বেম ক্যাসাডোস’; Source: weddingideasnow.com

ফ্রান্স

ফ্রান্সের ঐতিহ্যবাহী বিয়ের কেক খুব ব্যতিক্রমী কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি  দেখতে কিছুটা তাদের বহু জনপ্রিয় আইফেল টাওয়ারের মতো। এই কেকটির নাম ‘ক্রোকামবুস’ (croquembouche) এবং প্রকৃতপক্ষে এটি কেক নয়! এটি আসলে অনেকগুলো ক্রিমপাফ কিংবা প্রফিটেরোল (চৌক্স) টাওয়ারের ন্যায় সাজিয়ে তৈরি খাবার যার প্রতিটি একক ক্যারামেলকৃত চিনি কিংবা কিছুক্ষেত্রে চকোলেট মোড়ানো থাকে। অতিথি প্রতি সাধারণত তিন-চারটি পাফ বরাদ্দ থাকে এবং পাফযুক্ত এই বিশালাকার টাওয়ারটিকে অনেকটা পিরামিডের ন্যায়ও দেখায়। চিনিযুক্ত আমন্ড, ফুল এবং ফিতা সহযোগে সাজানো খাবারটিকে এক টুকরো খাবারযোগ্য শিল্পকর্ম বললেও ভুল হবে না।

‘ক্রোকামবুস’; Source: onewed.com

ইতালি

বলা হয় কীভাবে মহাসমারোহে উৎসব উদযাপন করতে হয় ইতালিয়রা বরাবরই ভালো করে জানেন। তাদের ঐতিহ্যবাহী বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রায় ১৪টির মতো পদে সাজানো খাবারের পসরা থাকতে পারে, যার মধ্যে পুর দেয়া (স্টাফড) মাশরুম, জলপাই, স্যালামি, পিকলড পেপার (লবণাক্ত জল কিংবা ভিনেগারে নিমজ্জিত বেলপেপার), ক্যালামারি (বেবি স্কুইড), প্রসুট্টো ( ইতালীয় শুকনো, পাতলাভাবে কাটা কাঁচা হ্যাম বা শুকরের পায়ের মাংস) এবং অন্যান্য এন্টিপ্যাস্টি (ঐতিহ্যবাহী ইতালীয় খাবারের অন্যতম প্রধান পদ) অন্যতম। সঙ্গে থাকবে পাস্তা, সালাদ ও স্যুপ। ইতালীয় বিবাহ অনুষ্ঠানগুলো একটি সাংকেতিক বার্তা বহন করে। পাকানো খামির ভেজে বানানো বড়া গুঁড়োচিনিতে গড়িয়ে বানানো ‘বো-টাই’ কুকি অতিথিদের মধ্যে পরিবেশন করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, এগুলো শুভবার্তা বয়ে আনে।

বো-টাই কুকি; Source: beyondthechickencoop.com

এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগত মেহমানদের ক্যান্ডিকৃত আমন্ডে ভরপুর উপহারের বাক্স প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে অমিষ্ট আমন্ডের সাথে থাকা চিনি জীবনের তেতো-মিষ্টি অভিজ্ঞতা তথা ভালো-মন্দের মিশেলেই যে জীবন- এই দর্শনকে তুলে ধরে।

ইতালীয় বিয়ের খাবার। Source: pinterest.com

কোলানাটস, নাইজেরিয়া

নাইজেরিয়ার দক্ষিণভাগের ইগবো উপজাতি ঔষধি হিসেবে কোলানাট ব্যবহার করে। উচ্চমাত্রায় ক্যাফেইনসমৃদ্ধ এ খাদ্যটিকে তারা ক্ষুধা দূর করা ও শক্তি পাওয়ার জন্য চিবিয়ে খেয়ে থাকে। কোলানাটগুলো কোনো বিয়েতে কনে পক্ষ থেকে দেওয়া যৌতুকসামগ্রীর মুখ্য উপাদান এবং নবদম্পতির বৈবাহিক জীবনে পারস্পরিক মতভেদ ও বিভেদ ঘুচিয়ে এক হবার ক্ষমতা নির্দেশক প্রতীক হিসেবে বিয়েতে কোলানাট পরিবেশন করা হয়।

কোলানাট; Source: bellafricana.com

প্রচলিত নিয়মানুসারে, বর-কনে ও তাদের পিতামাতার মধ্যে একটি কোলানাট ভাগ করে না খাওয়া হলে বিয়েকে সম্পূর্ণ ধরা হয় না।

রাইস বল স্যুপ, চীন

চীনে বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, সুন্দর ও বিপত্তিহীন বিয়ের নিশ্চয়তা লাভের জন্য বর ও কনের বিয়ের দিন কিংবা তার আগের রাত্রে ‘ট্যাঙ ইউয়ান’ নামক মিষ্ট রাইস বলযুক্ত স্যুপ খেতে হয়। কিন্তু মজার কথা হচ্ছে এই রাইসবলগুলো চিবানো যাবে না, কেননা তাতে রাইসবলগুলোর গোল, মসৃণ আকার নষ্ট হয়ে যাবে। তাই শর্ত মোতাবেক সৌভাগ্য পেতে হলে এই রাইসবলগুলোকে গিলে খেতেই হবে তাদের।

‘ট্যাঙ ইউয়ান’ স্যুপ; Source: womensweekly.com.sg

এছাড়াও ঐতিহ্যবাহী চীনা বিয়েগুলোতে ১২-১৪ কোর্সের খাদ্যোৎসব হয়ে থাকে, যেখানে বুনো রাজহাঁসের মাংস (যারা সারাজীবনের সঙ্গী এবং একত্রে চলাচল করে) বৈবাহিক স্বর্গসুখ ও বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও অন্যান্য অর্থবহ খাবারের মধ্যে রয়েছে পেকিং ডাক- একপ্রকার লালরঙা খাবারের পদ (যেহেতু লাল সৌভাগ্যের রং হিসেবে বিবেচিত), সি-কিউকাম্বার, শার্ক-ফিন স্যুপ, রোস্ট সাকলিং পিগ, সুইট রেডবীন স্যুপ এবং সুইট বান প্রভৃতি।

ফ্রুটকেক, ইংল্যান্ড

এই রীতিটির শেকড় মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডে প্রোথিত। সেই সময় বিবাহে আগত অতিথিরা ফল, বাদাম ও মারপিজিয়ান (চিনি, মধু, আমন্ড ও আমন্ডের তেল দিয়ে তৈরি খাবার) ছোট ছোট কেক নিয়ে আসতেন এবং সেগুলোতে নবদম্পতি তাদের চুম্বন এঁকে দিতেন। এই কেকগুলো ছিলো উর্বরতা ও সৌভাগ্যের প্রতীক। কেকের উপরিভাগের স্তরটিকে এরপর রেখে দেওয়া হবে এই দম্পতির প্রথম সন্তানকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার সময়ের জন্য। তাই এই কেকের এই অংশটিকে ‘ক্রিশ্চেনিং কেক’ বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেকের উপরিভাগের এ স্তরটিকে রেখে দেয়া হয় দম্পতির প্রথম বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের জন্য।

প্রিন্স উইলিয়াম এবং কেট মিডলটনের বিয়ের কেক; Source: janeaustensworld.wordpress.com

ব্রিটিশ রাজপরিবারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিয়ের কেকের ফরমায়েশের ক্ষেত্রে নিজস্ব পছন্দই প্রাধান্য পায়। এক্ষেত্রে তাদের রুচিবোধ অনেকটা স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা ও ঐতিহ্যগত চলের মিশেলে তৈরি। প্রিন্স উইলিয়াম তার ছোটবেলার প্রিয় চকলেট বিস্কুট কেককেই বেছে নিয়েছিলেন। অপরপক্ষে, কেট মিডলটন প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী বহুস্তরী ইংলিশ ফ্রুটকেক বেছেছিলেন।

জর্ডান আমন্ডস, গ্রিস

গ্রিস এবং অন্যান্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বিয়েগুলোতে বহুল পরিবেশিত খাবার ক্যান্ডির প্রলেপযুক্ত আমন্ড বাদাম। বৈবাহিক জীবনের মসৃণ-বন্ধুর পথ চলারই যেন প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ তেতো আমন্ড ও মিষ্টিস্বাদের ক্যান্ডির এই যুগলবন্দী। এগুলো নতুন সম্পতির জন্য সৌভাগ্যের আশাজাগানিয়া আশীর্বাদস্বরূপ, যেখানে তিক্ত অভিজ্ঞতার চেয়ে মধুর সময়ের পাল্লাই যেন ভারী থাকে এটাই কাম্য। ছোট ছোট থলে কিংবা রূপোর ট্রেতে করে এই আমন্ডগুলো অতিথিদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং তা সবসময় বিজোড় সংখ্যক হারেই দেয়া হয়। যেহেতু বিজোড় সংখ্যাসমূহকে পূর্ণসংখ্যায় দ্বিখণ্ডিত করা যায় না, সেহেতু ধরা হয়, নবদম্পতি কখনোই সম্পর্ক ভেঙে আলাদা হয়ে যাবে না।

জর্ডান আমন্ড; Source: pinterest.com

এই আমন্ডগুলোর স্থানীয় ভাষায় সাধারণ নাম কৌফেটা (koufeta)। এগুলোতে হোয়াইট চকলেট কিংবা চিনির প্রলেপ দেওয়া হলে একে ‘বম বম ইয়ারা’ (bom bom yara) হিসেবে ডাকা হয়। এছাড়াও প্রায়ই নববধূ নিজের দস্তানার অভ্যন্তরে কিছুটা চিনি লাগিয়ে নেয় যেন তার বৈবাহিক জীবন মিষ্টতায় ভরপুর হয়ে থাকে। অর্থাৎ রোস্ট করা ভেড়ার মাংস ও ওউজি (মৌরির স্বাদ-গন্ধযুক্ত একপ্রকার গ্রিক মদ), প্লেট ভাঙা ও জোরদার উদ্দাম নৃত্যের পাশাপাশি গ্রিক বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোর ঝুলিতে কম উপভোগ্য পণ্য থাকে না!

রুটিভাঙা খেলা, বুলগেরিয়া

বুলগেরিয়ান বিয়েতে রুটি বা ব্রেডের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বিয়ের আগের বৃহস্পতিবারে কনের মা ‘পিটকা’ ব্রেডের খামির মথিত করে থাকেন। পিটকা অনেকটা ‘মাংকি ব্রেড’ এর ন্যায় টেনে ছিড়ে খাবার রুটি। রুটির খামিরের ফুলেফেঁপে ওঠাকে নতুন পারিবারিক এককের গঠনের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

চলছে রুটিভাঙা খেলা; Source: zikata.wordpress.com

বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বর ও কনে উভয়েরই মা বর ও কনেকে রুটি ও মধু খাওয়ান। এটি বর ও কনেকে তাদের পরিবারে স্বাগত জানাবার পাশাপাশি তাদের সুখময় জীবনের শুভকামনা জানাতে পালিত একটি আচার। এরপর নবদম্পতির মাথার ওপর বিশাল একটি রুটি ধরা হয় এবং একটি কিনার ধরে বর ও অপরটি ধরে কনে টানেন। যার ভাগে বৃহদাকার অংশ ছিঁড়ে আসে ধরে নেয়া হয় বৈবাহিক জীবনে তার প্রাধান্য ও আধিপত্য বজায় থাকবে।

ভারত

চমৎকার রঙ-বেরঙের জিনিসের পসরা, ফুল, মেহেদী, ঘোমটা ও সঙ্গীতের পাশাপাশি ভারতীয় বিয়েগুলোতে দেখার আছে আরো অনেক কিছুই। বিয়ের কেকের পরিবর্তে হিন্দু বিয়েগুলোতে বর ও কনেকে মধুমিশ্রিত দই খেতে হয়। প্রসাদ হিসেবে ব্যবহৃত এই খাবারটির নাম ‘মধুপাক’ এবং এটিই বিবাহের শুভসূচনা করে দেয়। এক্ষেত্রে দধি চির-সুস্বাস্থ্যের প্রতীক।

মধু ও দধি; Source: blog.brilliance.com

এছাড়াও প্রায় হপ্তাখানেক ধরে চলা বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে মানুষ নানা ধরনের খাবার, যেমন- নান, তরকারি, রোস্ট করা আলুসহ নানান পদের খাবার খেয়ে থকে। বিয়ের পর থেকে খাবারে একে একে যোগ হতে থাকে মাংসাশী পদগুলো, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মদও। তবে প্রথানুসারে, নববধূ ও তার স্বামীর একে অপরকে মিষ্টি খাওয়াতে হয়। প্রথানুসারে অনেক ক্ষেত্রে সেটি পূর্বে উল্লিখিত মধু-দধির মিশ্রণ। শিখ এবং পাঞ্জাবি বিয়েতেও মিষ্টির অবাধ অংশগ্রহণ রয়েছে। বাগদানের দিন কনেপক্ষকে ‘মিঠাই’ তথা নানান মিষ্টি, ফল প্রভৃতি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। বিয়ের অনুষ্ঠান চলাকালীন বউয়ের মা নবদম্পতিকে লাড্ডু নামক মিষ্টি খাওয়ান।

মিঠাইসহ অন্যান্য উপহার; Source: sociable7.com

ফয় থং, থাইল্যান্ড

ফয় থং (অর্থানুসারে কিছুটা সোনালি রেশমি সুতার সমতুল্য) ডিমের কুসুম ও চিনির সিরা দিয়ে তৈরি একপ্রকার প্রাচীন থাই মিষ্টদ্রব্য। নুডলসের ন্যায় লম্বা লম্বা সুতোর মতো খাবারটি বিয়েতে পরিবেশিত হয় যা বর ও কনের মধ্যবর্তী চিরন্তন ভালবাসাকে নির্দেশ করে। এ খাবারটি বানানো বেশ কঠিন ও কষ্টসাধ্য। এজন্য একটি পিতলের তৈরি ওক (বোল আকৃতির প্যান) ও ছোট খোলাপার্শ্বযুক্ত কোন আকৃতির অংশ প্রয়োজন যেন সুতোর ন্যায় অংশগুলো যথাসম্ভব লম্বা করা যায়।

ফয় থং; Source: invitationsbyajalon.com

আইরিশ হুইস্কি কেক ও মীড, আয়ারল্যান্ড

ইংরেজ প্রথার মতোই প্রথাগত আইরিশ বিয়ের কেকও ফল ও বাদাম সহযোগে তৈরি। তবে এতে সাদা রঙের প্রলেপ দেওয়া হয় এবং এর সর্বোপরের স্তর একটি আইরিশ হুইস্কি কেক। এই আইরিশ হুইস্কি কেকটি দম্পতির প্রথম সন্তানের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার সময় ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।

আইরিশ হুইস্কি কেক; Source: harsanik.com

মীড নামক মধুযুক্ত মদও আইরিশ বিয়েতে পরিবেশিত হয়। বিশ্বাস করা হয়, এটি পৌরুষ ও জন্মক্ষমতাবর্ধক হিসেবে কাজ করে। প্রাচীন আমলে, নবদম্পতিকে আরো একপ্রকার মদ ভাগ করে পান করতে দেয়া হতো। এটি বলবত্‍ থাকতো তাদের বিয়ের পর হতে নতুন চন্দ্রমাস আগমনের সময় পর্যন্ত। ধারণা করা হয়, এই ঘটনা থেকেই ‘হানিমুন’ তথা ‘মধুচন্দ্রিমা’ কথাটির আগমন হয়েছে।

মীড; Source: bigdaythewediquetteway.blogspot.com

কাজুনোকো, জাপান

জাপানে, হেরিং মাছের ডিমকে বলা হয় কাজুনোকো। এটি উর্বরতা ও পারিবারিক উন্নতির প্রতীক। হলুদ কিংবা গোলাপী আভাযুক্ত মাছের ডিমগুলো রোদে শুকিয়ে খাঁটি লবণের মাধ্যমে একত্রে সংরক্ষণ করে একটি বড়সড় ডিমের দলা বানানো হয়। এটি ভাতভিত্তিক খাবার যেমন সুশির সাথে প্রায়ই পরিবেশন করা হয় এবং নতুন বছরের উৎসবেও এর ভালো কদর রয়েছে।

কাজুনোকো ও সুশি; Source: blog.brilliance.com

এছাড়াও জাপানের অত্যন্ত বিখ্যাত বিবাহরীতির একটি হচ্ছে ‘সান-সান-কুদো’ যেখানে ৩টি ভিন্ন আকৃতির কাপ একে অপরের ওপর সাজানো থাকে এবং এগুলো থেকে বর ও কনেকে ‘সাকে’ (গাঁজন প্রক্রিয়ায় ভাত থেকে তৈরি মদবিশেষ) নামক পানীয় পান করতে হয়। সান অর্থ তিন যা ৩টি জুটিকে নির্দেশ করে: বর-কনে, বরের পিতা-মাতা এবং কনের মা-বাবা। ৩টি জুটি ৩ বার করে পান করলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৯।

‘কু’ অর্থ হলো ৯ যা তাদের কাছে একটি সৌভাগ্যসংখ্যাও বটে। প্রথম তিন চুমুক দুটো পরিবার ও এই জুটির একীভবনকে নির্দেশ করে, দ্বিতীয় চুমুকে নির্দেশিত হয় মানব চরিত্রের ঘৃণা, লিপ্সা ও অজ্ঞতার মতো ত্রুটিবিচ্যুতি, তৃতীয় চুমুক অর্থ এই ত্রুটিগুলো থেকে মুক্তি। এই মুহূর্তটির মাধ্যমে নবদম্পতির দাম্পত্যজীবন ও এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের শুভসূচনা হয়।

সান-সান-কুদো; Source: kyoto-wakon.watabe-wedding.co.jp

জুজুবে ও চেস্টনাট ছোঁড়া, দক্ষিণ কোরিয়া

বিয়ের পর পাইবায়েক নামক পারিবারিক দক্ষিণ-কোরীয় অনুষ্ঠানে নববধূ তার শশুরবাড়ির সবাইকে জুজুবে (কর্কন্ধু বা এক প্রকারের কুল/খেজুর) ও চেস্টনাট পরিবেশন করে। এগুলো মূলত উর্বরতার প্রতীক। শেষে তারা এই ফলগুলো নববধূর দিকে ছুঁড়ে মারেন এবং মেয়েটি সেটি তার জামার কোঁচড়ে লুফে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। যতবেশি পরিমাণে সে এগুলো লুফে নিতে পারবে সে ততসংখ্যক সন্তানের জননী হবে বলে ধরে নেওয়া হয়।

পাশাপাশি বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ‘ইয়াক শিক’ (Yak Shik) নামক আঠালো ভাত দিয়ে তৈরি মিষ্টান্নবিশেষে ব্রাউন-সুগার ও মধু ব্যবহারের পাশাপাশি কিসমিস, চেস্টনাট, পাইননাট ও জুজুবে খচিত থাকে। এছাড়াও বিয়ের দিন পরিবেশিত খাবারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী অর্থ থাকে। ‘কুক সূ’ (kuk soo) নামক লম্বা নুডুলস সুখী দম্পতির দীর্ঘায়ু কামনা করে পরিবেশন করা হয়। এমনকি ইয়াক শিকে দেয়া ফল ও কিসমিসের টুকরোও অর্থবহন করে। সেগুলো সন্তানের প্রতীক।

পাইবায়েক অনুষ্ঠান; Source: youtube.com

নরওয়ে

নরওয়ের ঐতিহ্যবাহী বিয়ের কেক হলো ‘ক্রান্সকেক’, যার অর্থ ‘আংটি আকৃতির কেক’। নামটি আয়োজনের সাথে মানানসই হলেও বিয়ে ব্যতীত নরওয়ের অন্যান্য অনেক অনুষ্ঠানে এই কেকের চল রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাপ্টিজম এবং ছুটিছাটায় দেওয়া পার্টি ও ডিনারের আয়োজনে অন্যতম খাবার এটি। আমন্ড, চিনি, ডিমের সাদা অংশ সহযোগে তৈরি ক্রান্সকেককে অসংখ্য রিং আকৃতির কেকের সমষ্টি বললে ভুল বলা হবে না। রিং আকৃতির অসংখ্য কেক একটির ওপর অপরটি চাপিয়ে কোণের ন্যায় আকৃতি দেয়া হয়। আদর্শ ক্রান্সকেক বেশ নরম ও সহজেই চর্বণযোগ্য, কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে নিজের আকৃতি ও অবস্থান টিকিয়ে রাখার মতো যথেষ্ট শক্ত। অনেক সময় এই কেক-স্থাপনাটির কেন্দ্রবিন্দুতে এক বোতল মদ রাখা হয়, যেন সঠিক আকৃতি বজায় থাকে। ডেনমার্কেও এই কেকের চল আছে।

ক্রান্সকেক; Source: pinterest.com

মরক্কো

বেশিরভাগ মরক্কান বিয়ে ও এর সাথে সম্পর্কযুক্ত অনুষ্ঠানাদি বেশ কিছুদিন ধরে চলে এবং তাই এখানে খাবারদাবারের সংখ্যাও অপ্রতুল নয়। তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘ট্যাজিন’ (একধরনের স্টু) অনেকটা ঘরোয়াভাবেই পরিবেশন করা হয়। একটি বড় কেকের চেয়ে বিশাল এক ঝুড়ি ফলই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিষ্টিজাতীয় খাবার হিসেবে দেয়া হয়। তবে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই পাঠক। যদি কোনো মরোক্কান বিয়েতে মেহমান হয়েই যান তাহলে আপনাকে খালিহাতে বাড়ি ফিরতে হবে না! বরং পেস্ট্রিতে ভরপুর একটি বাক্স দিয়ে তবেই বিদায় জানানো হবে আপনাকে।

ট্যাজিন; Source: thespruce.com

জার্মানি

ধরুন, প্রথমবারের মতই কোনো জার্মান বিয়েতে আমন্ত্রিত হয়েছেন। সেখানে আপনাকে Hhochzeitssuppe সাধা হলে অবশ্যই হ্যাঁ বলে দেবেন। এটি ‘বিয়ের স্যুপ’ যা প্রকৃতপক্ষে স্বচ্ছ, ব্রথের ন্যায় সবজি ও ছোট ছোট মিটবলযুক্ত (Fleischklößchen) স্যুপ। দেখতে অতি সাধারণ মনে হলেও প্রথাগত প্রণালি অনুসরণ করলে এটি প্রস্তুত করতে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগতে পারে। কাজেই এটি যে শুধু বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যের জন্যই তৈরি হয় সেটা বলাই বাহুল্য।

হচজেইটসসুপ্পে; Source- bildderfrau.de

ভিয়েতনাম

মুগডাল ও ট্যাপিওকা দিয়ে তৈরি ও খাদ্যসজ্জার্থে সবুজ কলাপাতায় মোড়ানো মিষ্টান্নবিশেষ ‘বানহ জু জে’ ভিয়েতনামি বিয়েগুলোর এক ঐতিহ্যমণ্ডিত অংশ। অনেকাংশে ‘একীভবনের কেক’ অর্থবাহী এই কেক দম্পতির মধ্যবর্তী বৈবাহিক সম্পর্কের প্রতীক। সোনালি ট্যাপিওকার পুর ‘সোনার হৃদয়’ নির্দেশ করে যা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের শরীরেই সগর্বে বিরাজমান এবং স্পন্দিত হচ্ছে যেহেতু তারা একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধতা ও বিশ্বস্ততার বহিঃপ্রকাশ করে।

‘বানহ জু জে’; Source: youtube.com

সুইডেন

সুইডিশ বিয়ের কেন্দ্রবিন্দু ‘প্রিন্সেসটার্টা’ (রাজকন্যার কেক) নামক কেক। এটি মারপিজিয়ানের প্রলেপযুক্ত একপ্রকার ডোম আকৃতির কেক যার ওপরে ছোট ফন্ডেন্টনির্মিত গোলাপ বসানো থাকে।

প্রিন্সেসটার্টা; ছবিসূত্র-  pinterest.com

ইউক্রেন

যেকোনো ঐতিহ্যবাহী ইউক্রেনীয় বিয়ের প্রধান খাবার হলো ‘কোরোভাই’, যা একপ্রকার মিষ্টিস্বাদযুক্ত ব্রেডবিশেষ। এই ব্রেডটি কনে ও বর উভয়ের বাড়ির মানুষ বানায়। এটি দুটি পরিবারের একীভূত হবার প্রতীকী নিদর্শন।

কোরোভাই; ছবিসূত্র- proudofukraine.com

মেক্সিকো

স্পেনে উদ্ভূত একধরনের শর্টব্রেড কুকি হলো ‘পোলভোরোন’ যা বিয়ে এবং খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দেবার অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়।

পোলভোরোন; ছবিসূত্র- mexicoguru.com

ফিলিপাইন

সুমান (কলাপাতায় মোড়ানো রাইসকেক), লেচে ফ্ল্যান (কাস্টার্ড জাতীয় মিষ্টান্ন) ও অন্যান্য চিনিযুক্ত আঠালো মিষ্টিজাতীয় খাবার ফিলিপাইনের বিয়েতে পরিবেশন করা হয়। চিনি এখানে সুখময়তা ও মিষ্টতা নির্দেশ করে।

সুমান; ছবিসূত্র- queencleopatra.hubpages.com

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই পরিণয় এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। নানান দেশ, জাতি, ধর্ম ও রীতিনীতির নানান রঙে এই বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার প্রয়াসে মত্ত থাকে সবাই। নানান ঐতিহ্যগত নীতি ও আচার এবং নানান খাবারের সব নিদর্শন বিবাহকে আনন্দমন্ডিত ও অনাগত ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা অর্জনের লক্ষ্যেই সাজানো।

ফিচার ইমেজ: don.komarechka.com

Related Articles