ঢাকার অধিবাসী কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিচরণ হয়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিচরণ করে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য দেখেনি, এমনটা হতেই পারে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ঘুরতে আসা অনেক দর্শনার্থীই জানেন না এই ভাস্কর্যের প্রকৃত ইতিহাস। অনেকে মনে করেন রাজু শহীদ হয়েছে ভাষা আন্দোলনে, আবার অনেকে মনে করেন রাজু শহীদ হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে! প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে খুব কম সংখ্যক মানুষই অবগত। তাই আসুন জেনে নিই সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য তথা রাজুর আত্মত্যাগের প্রকৃত ইতিহাস।
১৯৯২ সালের ১৩ই মার্চ
দেশে স্বৈরতন্ত্রের অবসানের পর কেবল এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শুরু হয়ে গেছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলগুলোর ক্ষমতা প্রদর্শন ও দখলদারিত্বের রাজনীতি। সেদিন সকালে ছাত্রদল কর্মী, মতান্তরে ছাত্রশিবির কর্মীকে পেটাই করার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাস উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় পুলিশের সাথে সাধারণ ছাত্রদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। দুপুরে সংঘর্ষ চলাকালীন কনুইয়ে ব্যথা অনুভব করেন মইন হোসেন রাজু। সে কারণে বাসায় ফিরে না গিয়ে হলের পথ ধরেন শহিদুল্লাহ হলের এই বাসিন্দা। হলের ১২২ নাম্বার রুমে রাজুর জন্য সিট বরাদ্দ ছিল। সেখানেই বিশ্রাম নিতে যান তিনি।
ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষের মাধ্যমে যে ঘটনা দুপুরেই শেষ হতে পারতো তা আর দুপুরে শেষ হয়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্রদলের নেতা কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে শুরু হয় গুলি বিনিময়। যেখানে শিক্ষার্থীরা আসে জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে, সেখানে চলতে থাকে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম। ইতোমধ্যে এ খবর পৌঁছে যায় রাজুসহ ক্যাম্পাসের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কানে। তৎক্ষণাৎ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ক্যাম্পাসে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য’ নামের একটি ব্যানার সামনে রেখে সন্ত্রাসবাদের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। সে মিছিলে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাসবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। উত্তাল ক্যাম্পাসে সে সময় পর্যন্ত দু’পক্ষের রক্তক্ষয়ী বন্দুকযুদ্ধ চলছিল। মিছিলকারীদের সকলেই জানত যে, সন্ত্রাসীদের গুলি বর্ষণের কারণে যে কারুরই প্রাণহানি হতে পারে। তা জানা সত্ত্বেও মিছিলের অগ্রভাগে থেকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছিলেন মইন হোসেন রাজু। প্রিয় ক্যাম্পাস সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে না দেবার প্রত্যয়ে মৃত্যুকে ক্ষুদ্র করে দৃঢ় চিত্তে মিছিল সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। একদিকে চলছিল সন্ত্রাসের ত্রাস আর অন্যদিকে ছিল ত্রাসের বিরুদ্ধে বিমূর্ত প্রতিবাদ।
গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে অকস্মাৎ সন্ত্রাসীরা মিছিলটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। ঘাতকের ছোঁড়া একটি বুলেট আচমকা রাজুর মস্তিস্ক ভেদ করে চলে যায়। গুলির আঘাতে রক্তসিক্ত হয়ে মাটিতে এলিয়ে পড়েন রাজু। দ্রুত পদে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের স্বপ্ন বুকে নিয়ে প্রাণের ক্যাম্পাসের মায়া ত্যাগ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি।
তার মৃত্যুতে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় আরও একবার নতুন করে জাগ্রত হয়। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় তৎকালীন ছাত্র-জনতা। রাজুর মৃত্যুতে নাগরিক কবি শামসুর রাহমান রচনা করেন তার অন্যতম বিখ্যাত কবিতা ‘পুরাণের পাখি’। তিনি তার কবিতার মাধ্যমে মইন হোসেন রাজুর এই আত্মত্যাগকে আরও মহিমান্বিত করেন। কবির ভাষায়-
রাজু, তুমি মেধার রশ্মি-ঝরানো চোখ মেলে তাকাও
তোমার জাগরণ আমাদের প্রাণের স্পন্দনের মতোই
প্রয়োজন।
দিনদুপুরে মানুষ শিকারীরা খুব করেছে তোমাকে।
টপকে-পড়া, ছিটকে-পড়া
তোমার রক্তের কণ্ঠস্বরে ছিল
পৈশাচিকতা হরণকারী গান। ঘাতক-নিয়ন্ত্রিত দেশে
হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলে তুমি,
মধ্যযুগের প্রেতনৃত্য স্তব্ধ করার শুভ শ্লোক
উচ্চারিত হয়েছিল তোমার কণ্ঠে,
তোমার হাতে ছিল নরপশুদের রুখে দাঁড়াবার
মানবতা-চিহ্নিত প্রগতির পতাকা
তাই ওরা, বর্বরতা আর অন্ধকারের প্রতিনিধিরা,
তোমাকে, আমাদের বিপন্ন বাগানের
সবচেয়ে সুন্দর সুরভিত ফুলগুলির একজনকে,
হনন করেছে, আমাদের ভবিষ্যতের বুকে
সেঁটে দিয়েছে চক্ষুবিহীন কোটরের মতো একটি দগদগে
গর্ত।
রাজু স্মারক ভাস্কর্য এবং রাজু
১৯৯২ সালের ১৩ই মার্চের রাজুর আত্মত্যাগ স্মরণে এবং সন্ত্রাসবিরোধী চেতনা ধরে রাখার প্রত্যয়ে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়ে নানামুখী বাধা-বিপত্তির উৎপত্তি ঘটে। কখনো স্থান সংকট, আবার কখনো সন্ত্রাসীদের হুমকি। সবকিছু মিলিয়ে ভাস্কর্যটি নির্মাণে একটু সময় লাগছিল। সকল চড়াই-উৎরাই পেড়িয়ে অবশেষে ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীর নকশায় ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এতে সহযোগী হিসেবে কাজ করেন গোপাল পাল। আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাউদ্দিন খান (আতা খান) ও মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি লায়ন নজরুল ইসলাম খান বাদল। নির্মাণ কাজ শেষে ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৭ তারিখে ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য এ. কে. আজাদ চৌধুরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র টিএসসি’র মোড়ে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে। এটি ১৬ ফুট দীর্ঘ, ১৪ ফুট প্রশস্ত এবং ১০ ফুট উঁচু। সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যটি আট জন নারী-পুরুষ একে অন্যের হাত ধরে সন্ত্রাসদের বিরুদ্ধে ঐক্য এবং হার না মানা মুখাবয়ব প্রকাশ করছে।
সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য এখন আর শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার প্রেরণায় রূপান্তরিত হয়েছে। রাজু স্মারক ভাস্কর্য সম্পর্কে কবি, শিল্প সমালোচক ও স্থপতি রবিউল হোসেন বলেন,
“আমার মতে, রাজু ভাস্কর্য দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সেরা একটি ভাস্কর্য। এটি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে”।
রাজু স্মারক ভাস্কর্য সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিদ্যায়তনের সহযোগী অধ্যাপক এস এম কায়সার বলেন,
“ভাস্কর্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদের প্রতীক”।
১৯৬৮ সালের ২৯ জুলাই বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন মইন হোসেন রাজু। পরিবারের সাথে প্রথমে চট্টগ্রাম এবং পরবর্তীতে ঢাকায় বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৯৮৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এ সময়ে যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। পালন করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সমাজকল্যাণ সম্পাদকের দায়িত্ব এবং ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
রাজুর আত্মত্যাগ স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে এবং প্রতি বছর ১৩ই মার্চ ‘সন্ত্রাসবিরোধী দিবস’ পালন করে আসছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ধরনের প্রগতিশীল সংগঠন। এই দিবসে রাজুর স্মৃতিফলকে ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়।
বর্তমানে রাজু স্মারক ভাস্কর্য
যে স্বপ্ন নিয়ে মইন হোসেন রাজু নিজের জীবন দান করেছিলেন সে স্বপ্ন হয়তো আজও স্বপ্নই থেকে গেছে। প্রাণের ক্যাম্পাস পরিপূর্ণভাবে সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্তি পায়নি। এখনো সময়ে-অসময়ে লুটপাট, চাঁদাবাজি চলে সেখানে। তবে শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ করতে পিছপা হয় না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বা যেকোনো ধরনের দাবি জানাতে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে। দল-মত নির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল সংগঠন তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে দাঁড়ায় রাজুর ছায়াতলে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার মইন হোসেন রাজু পড়াশোনাতেও ছিলেন মনোযোগী। তাই সেদিন মিছিলের সময়েও তার কাঁধে ছিল ব্যাগ। ব্যাগের নোট খাতায় ছিল নিজ হাতে লিখে রাখা জীবনানন্দ দাশের কবিতা। আরও ছিল রঙ করার ব্রাশ ও হকিয়ার। সে ব্যাগটি এখনো সংরক্ষিত আছে ডাকসু’র সংগ্রহশালায়। আরও সংরক্ষণ করা আছে ১৩ই মার্চের রাজুর পরিহিত শার্টটি; যার গায়ে এখনো লেগে আছে ঘাতকের করা গুলির আঘাতে রাজুর শরীর থেকে ঝরে পড়া রক্তের দাগ।
কবি শামসুর রাহমানের কবিতার শেষ ক’টি লাইন দিয়েই শেষ করি –
শোনো, এখন যাবতীয় গাছপালা, নদীনালা,
ফসলের ক্ষেত, ভাসমান মেঘমালা, পাখি আর মাছ-
সবাই চিৎকারে চিৎকারে চিড় ধরাচ্ছে চরাচরে, ‘চাই
প্রতিশোধ।
নক্ষত্রের অক্ষর শব্দ দু’টি লিখে দিয়েছে আকাশে
আকাশে।
যে-তোমাকে কবরে নামিয়েছি বিষণ্নতায়, সে নও তুমি।
প্রকৃত তুমি ঐ মাথা উঁচু ক’রে আজও নতুন সভ্যতার
আকর্ষণে
হেঁটে যাচ্ছ পুঁতিগন্ধময় গুহা-কাঁপানো মিছিলে,
তোমার অঙ্গীকার-খচিত হাত নীলিমাকে স্পর্শ করে
নিঃশঙ্ক মুদ্রায়,
ওরা তোমাকে যতই পুড়িয়ে ভস্ম করুক হিংসার আগুনে,
তুমি বারবার আগুন থেকে বেরিয়ে আসবে পুরাণের
পাখি।
ফিচার ইমেজ- hiveminer.com