মাত্র কিছুদিন আগেই ফেসবুক ও মিডিয়ায় সবচেয়ে সরগরম বিতর্কের প্রসঙ্গটি ছিল মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন ও ফলশ্রুতিতে তার মুকুট ছিনিয়ে নেওয়া। বিতর্কিত সেই সাবেক বিজয়ী সুন্দরীর পক্ষ ও বিপক্ষ অবলম্বন করে নিজের মতামতও দিয়েছেন অনেকেই। তবে সারা বিশ্বজুড়ে প্রচলিত সুন্দরী প্রতিযোগিতার চোখ ধাঁধানো এই রঙ্গলীলায় বিতর্ক কিন্তু নতুন কিছু নয়।
যারা ভাবেন সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুধু আলো ঝলমল জাঁকজমক, হাসি-আহ্লাদ, বিজয়ের গল্প ও সাফল্যের হাতছানিতে ভরা তাদের অবশ্যই জানা উচিৎ এই দশটি বিতর্কিত সুন্দরী প্রতিযোগিতার ঘটনা। এই বিতর্কগুলো থেকে সহজেই বুঝে যাবেন বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা নতুন কিছু নয়। তবে এসব ঘটনার মধ্যে অনেক সাহসিকতার নজিরও আছে। কলঙ্কই কারো কারো জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে বৃহত্তর ও মহত্তর উদ্দেশ্যে পরিচালিত করেছিল। তো জানা যাক পৃথিবী নাড়িয়ে দেওয়া দশটি সুন্দরী প্রতিযোগিতা সম্পর্কিত বিতর্কিত ঘটনা।
১০) মিস ইউনিভার্স ২০০২
বিজয় মুকুট পরার পরে নিজে থেকে অব্যাহতি দেয়া বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্থানচ্যুত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে কম নেই। এর মধ্যে অন্যতম বিতর্কিত স্থানচ্যুতির ঘটনা ঘটে ২০০২ সালে। ২০০২ সালে মিস ইউনিভার্সের ৫১তম আসরে মুকুট ওঠে রাশিয়ার অক্সানা ফেদোরোভার মাথায়। তিনিই ছিলেন মিস ইউনিভার্স হওয়া প্রথম মিস রাশিয়া। কিন্তু প্রতিযোগিতা জেতার অনতিকাল পরেই গুজব ওঠে যে তিনি অন্তঃসত্ত্বা। প্রতিযোগিতার শর্ত অনুযায়ী প্রতিযোগির বিবাহিত হওয়া বা বাচ্চা থাকা চলবে না। এর জের ধরে বিজয়ের চার মাস পরে তার খেতাব কেড়ে নেওয়া হয় ও প্রথম রানার আপ, পানামার জাস্টিন প্যাসেককে মিস ইউনিভার্স ঘোষণা করা হয়। যদিও অক্সানা বলেন যে তিনি নিজের আইনের পড়াশোনা শেষ করার জন্য স্বেচ্ছায় এই খেতাব ত্যাগ করেন।
৯) মিস ওয়ার্ল্ড ১৯৭৪
১৯৭৪ সালে মিস ওয়ার্ল্ডের ২৪তম আসরে বিজয়ী হন ইংল্যান্ডের হেলেন মরগান। কিন্তু মুকুট পরার চারদিনের মাথায় মিডিয়া আবিষ্কার করে যে তার একটি ১৮ মাস বয়সী পুত্র সন্তান রয়েছে। ফলে তাকে খেতাব ও মুকুট পরিত্যাগ করতে হয়। অফিসিয়ালভাবে মুকুট ত্যাগ করা প্রথম মিস ওয়ার্ল্ড তিনি। সাউথ আফ্রিকার অ্যানেলিন ক্রিয়েল তার স্থলাভিষিক্ত হন।
৮) মিস আমেরিকা ১৯৫১
১৯৫১ সালের মিস আমেরিকা আসরে বিজয়ী হয়েছিলেন অ্যালবামার প্রতিযোগি ইয়োলান্দে বেটবেজ ফক্স। কিন্তু সাহসী এই নারী নারীকে পণ্যে রুপান্তরিত করার অশ্লীল খেলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বসেন। তিনি জনসমক্ষে বাথিং স্যুট পরতে নারাজ হন ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন জনসভায় এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। ফলশ্রুতিতে তার প্রধান স্পন্সর ‘ক্যাটালিনা স্যুইমওয়্যার’ নিজেদের সমর্থন ফিরিয়ে নেয়। প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে যাবার পরেও ফক্স জনসাধারণের মাঝে তার তার প্রতিবাদী ভূমিকা চালিয়ে যেতে থাকেন।
৭) মিস ওয়ার্ল্ড ১৯৯৮
১৯৯৮ সালে মিস ওয়ার্ল্ডের ৪৮তম আসরে মুকুট পরেন ইসরায়েলের লিনর অ্যাবারজিল। আসর জেতার কয়েকদিন পরে তিনি প্রকাশ করেন যে প্রতিযোগিতার কয়েক মাস আগে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তাকে ছুরির মুখে জিম্মি করে ধর্ষণ করেছিল তার ট্রাভেল এজেন্ট ইউরি শ্লোমো নূর। প্রথমদিকে শক্ত প্রমাণের অভাবে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু পরে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে সেই ধর্ষকের ১৬ বছরের কারাদন্ড হয়। অ্যাবারজিল নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্যান্য মেয়েদের অনুপ্রাণিত করার কাজ শুরু করেন। তখন থেকে তিনি বিশ্বজোড়া যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজন প্রতিবাদী অধিবক্তায় পরিণত হন।
৬) মিস ওয়ার্ল্ড ২০১৪
২০১৪ সালের মিস ওয়ার্ল্ডের ৬৪তম আসরের প্রস্তুতিপর্বে হন্ডু্রাসের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত হন মারিয়া জোসে আলভারাডো। কিন্তু মূল আসরের অনতিকাল পূর্বে ১৯ নভেম্বর ২০১৪ রহস্যজনকভাবে মিস হন্ডুরাস ওয়ার্ল্ড মারিয়া ও তার বোন সোফিয়া খুন ও কবরস্থ অবস্থায় ক্যাবলোটেলস গ্রাম থেকে উদ্ধার হন। ১৯ বছর বয়সী সেই সুন্দরীর সম্মানার্থে মিস হন্ডুরাস প্রতিযোগিতার আয়োজকরা তার জায়গাটি অন্য কাউকে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে সে বছর হন্ডুরাস আনুষ্ঠানিকভাবে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে।
৫) মিস ইউনিভার্স ১৯৯৬
সাল ১৯৯৬, মিস ইউনিভার্সের ৩৫তম আসর। মুকুট পরেছিলেন ভেনেজুয়েলার অ্যালিসিয়া মাচাদো। মুকুট পরার কিছুদিনের মাথায় খবরের শিরোনামে চলে আসে যে অ্যালিসিয়ার হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়াতে কর্তৃপক্ষ তাকে সরিয়ে রানার আপ তারিন ম্যানসেলকে বিজয়ী ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত অ্যালিসিয়া তার জায়গা ধরে থাকতে সমর্থ হলেও মিস ইউনিভার্স কর্তৃপক্ষ সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে নিন্দিত হয়। তারা যে শুধু দেহভিত্তিক সৌন্দর্যের বিচার করছে তা সবার কাছে প্রকট হয়ে ওঠে। খবরের কাগজ ছেয়ে যায় অ্যালিসিয়ার ওয়ার্ক আউট করার ছবি আর তাকে ওজন ঝরাতে বাধ্য করানোয় কর্তৃপক্ষের নিন্দায়। সে সময় মিস ইউনিভার্সের এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার ছিলেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিন্দায় ভেসে যান ট্রাম্প এবং ব্যাপারটিকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে বসেন হিলারী ক্লিনটন। নিঃসন্দেহে মিস ইউনিভার্স কর্তৃপক্ষের জন্য বড়সড় স্ক্যান্ডাল ছিল এই আসর।
৪) মিস আমেরিকা ১৯৮৪
এই বছর মিস আমেরিকা হন নিউ ইয়র্কের ভেনেসা উইলিয়ামস। তিনিই এই প্রতিযোগিতা জেতা প্রথম আফ্রো-আমেরিকান নারী। আসর জয়ের পরে হঠাৎ একদিন ‘পেন্টহাউস’ ম্যাগাজিন তার কিছু নগ্ন ছবি প্রকাশ করলে তিনি তার খেতাব হারান। তার জায়গাটি দেয়া হয় প্রথম রানার আপ, নিউ জার্সির সুজেট চার্লসকে। ভেনেসা ছিলেন বর্ণপ্রথার প্রতিবন্ধকতা ভাঙার গৌরব, রাতারাতি হয়ে গেলেন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব।
৩) মিস ইউএসএ ২০০৯
মিস ইউএসএ’ প্রতিযোগিতার ২০০৯ সালের আসরের প্রথম রানার আপ, ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যারি প্রিজিন সমালোচনায় এসেছিলেন তার সমলিঙ্গ বিয়ের বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য। প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন বিচারক যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন যে ক্যারি আমেরিকার প্রতিটি রাজ্যে সমলিঙ্গ বিয়ের প্রচলনের পক্ষে কি না। ক্যারি জবাব দেন, “আমরা এমন একটি দেশে বাস করি যেখানে আপনি চাইলে সমলিঙ্গ বা বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বিয়ে করতে পারেন। আমার দেশে, আমার পরিবারে আমি মনে করি ও বিশ্বাস করি যে বিয়ে একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে হওয়া উচিৎ। কারো প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করছি না, কিন্তু আমি এভাবেই বেড়ে উঠেছি।” সমকামীতার উৎকৃষ্ট চর্চাস্থান আমেরিকাসহ বিশ্বজোড়া সমকামীতার সপক্ষের মানুষদের কাছে ব্যাপক সমালোচিত হন ক্যারি।
২) মিস ইউনিভার্স কানাডা ২০১২
এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন একজন ট্রান্সজেন্ডার প্রতিযোগি জেনা ট্যালাকোভা। স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া নারী না হওয়াতে তাকে প্রতিযোগিতার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বিপুল জনসমালোচনার মুখে কর্তৃপক্ষ তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দিতে বাধ্য হয়। জেনা সেরা ১২-তে নিজের জায়গা করে নেয়ার পর বাদ পড়ে যান। যদিও তিনি জিতেননি, কিন্তু নিজের ছাপ তিনি রেখে যান এই সুন্দরী প্রতিযোগিতায়। বর্তমানে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সফল ট্রান্সজেন্ডার মডেলদের একজন।
১) মিস আমেরিকা ২০১৪
২০১৪ সালের মিস আমেরিকা আসরে বিজয়ী হন ভারতীয় বংশোদ্ভুত নিনা দাভুলুরি। কিন্তু জেতার পরপরই তিনি জাতিগত বিদ্বেষের শিকার হন। আসরটি বসেছিল সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখে (নাইন ইলেভেনের বর্ষপূর্তির চার দিন পর)। হয়তো এর জের ধরেই বিভিন্ন নিউজ এজেন্সী তাকে মুসলিম ও আরব আখ্যা দিয়ে আল কায়েদার সাথে তার যোগসূত্র পর্যন্ত খুঁজতে তৎপর হয়ে ওঠে। এসব হলুদ সাংবাদিকতাকে পাশ কাটিয়ে নিনা সহজভাবে ব্যক্ত করেন, “সবার আগে আমি নিজেকে একজন আমেরিকান হিসেবে দেখি। এসব উক্তির বেশিরভাগই অজ্ঞতার ফসল। প্রত্যেকের বিশ্বাস ও পটভূমিকা জানা এবং এদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাতে আমরা উন্মুক্ত, সৎ ও সম্মানজনকভাবে একে অপরের সাথে সংযোগ রক্ষা করতে পারি- এটাই আমি আজীবন প্রচার করে এসেছি।” কৌশলি হয়ে ও ঠান্ডা মাথায় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এমন বিতর্কিত ইস্যুতে তিনি কম নাজেহাল হতেন না।
সর্বোপরি বলা যায়, এই সুন্দরের প্রতিযোগিতায় অসুন্দরের প্রভাবের কোনো কমতি নেই, কোনোদিন ছিলও না। এর মধ্যে থেকেই কেউ খুঁজে নেয় তার কাঙ্খিত লক্ষ্য, আর কেউ হারিয়ে যায় চিরতরে।
ফিচার ইমেজ- maniamodeling.com