
ফিরে এসেছে বজ্রের দেবতা থর। সুপারহিরো ফিল্মের জগত সম্পর্কে যদি আপনার বিন্দুমাত্র ধারণা থেকে থাকে, তাহলে পুরো বিশ্বের বক্স অফিসে থর র্যাগনারক যে তাণ্ডব চালাচ্ছে, তা আপনার অজানা নয়। শুধু সাধারণ দর্শকই নয়, সমালোচক মহলও সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে মারভেলের সর্বশেষ অন্তর্ভুক্তিকে। তাইকা ওয়াইতিতি তার হিউমেরাস স্টোরি-টেলিংয়ের মাধ্যমে নর্স পুরাণের দেবতা থরকে সম্পূর্ণ নতুন রূপ দান করেছেন। শুধু থরই নয়, আমরা নতুন রূপে দেখতে পাই থর ফ্র্যাঞ্চাইজির সাথে প্রথমবার যুক্ত হওয়া হাল্ককেও। সুপারহিরো মুভির গাঢ় ও অন্ধকার আবহকে দূরে ঠেলে দিয়ে মারভেল বরাবরই হালকা থিমের সিনেমা উপহার দিয়ে আসছে। কিন্তু এই প্রথম কোনো সুপারহিরো ফিল্ম পুরো দুই ঘণ্টার ফান রাইড উপহার দিয়েছে আমাদের।

টিম ‘রিভেঞ্জারস’ ©Disney Pictures
থর র্যাগনারক মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স (সংক্ষেপে MCU)-এর ১৭তম এবং থর ফ্র্যাঞ্চাইজির ৩য় সিনেমা। থর ফ্রাঞ্চাইজির প্রথম ফিল্ম ‘থর’ বের হয় ২০১১ সালে, যেটি পরিচালনা করেন কেনেথ ব্রেনাহ। থরের দ্বিতীয় ছবি ‘থর: দ্য ডার্ক ওয়ার্ল্ড’ মুক্তি পায় ২০১৩ সালে। প্রথম ছবিটি আশানুরূপ সাড়া ফেলতে অক্ষম হলে পরিচালক পরিবর্তন করা হয় দ্বিতীয়টিতে। ‘থর: দ্য ডার্ক ওয়ার্ল্ড’ এর দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় এলান টেইলরের কাছে। কিন্তু এবারও একই দশা। ২০১৩ সালে মারভেল মোটামুটি সব গুছিয়ে নিয়েছে। অন্য সব ফ্রাঞ্চাইজ দর্শক-সমালোচক দুই মহলেই ভালো সাড়া ফেললেও থর ফ্রাঞ্চাইজ একদমই অপয়া যাচ্ছিল মারভেলের জন্য। ফলে পরের চার বছরে থরের আর কোনো একক মুভি বের করেনি মারভেল।
২০১৫ সালে যখন দ্বিতীয় অ্যাভেঞ্জার ফিল্ম বেরিয়েছে, তখন MCU অনেক শক্তভাবেই তাদের ভিত গেড়ে নিয়েছে হলিউডে। তখন হঠাৎ করেই তারা থরের তৃতীয় ছবিটি তুলে দেয় নিউজিল্যান্ডের ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচ্চিত্র পরিচালক তাইকা ওয়াইতিতির হাতে। ঝুঁকি নিয়ে মারভেল প্রেসিডেন্ট কেভিন ফাইগির এমন দূরদর্শী সিদ্ধান্ত অবশ্য এটাই প্রথম না। কমেডি সিরিজ ‘কমিউনিটি’ এর পরিচালক রুশো ব্রাদার্সের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন আমেরিকা ফ্রাঞ্চাইজ। দুজন কমেডি সিরিজ ডিরেক্টর যেমন মারভেলকে তাদের অন্যতম সেরা দু’টি ছবি উপহার দিয়েছে, তেমনি এবার নিউজিল্যান্ডের একজন ইন্ডি ফিল্ম ডিরেক্টর আমাদের উপহার দিয়েছে সুপারহিরো ফিল্মের ইতিহাসে তর্ক-সাপেক্ষে সবচেয়ে এন্টারটেইনিং ছবিটি।

থর র্যাগনারকের প্রধান চরিত্ররা; source: hdwallpapers.com
প্লট
মৃত্যুর দেবী হেলা আসগার্ড আক্রমণ করেছে। নর্স পুরাণের দেবালয় হচ্ছে আসগার্ড। মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে এই আসগার্ড। সবচেয়ে শক্তিমান অ্যাভেঞ্জার থর এবং মারভেলের অন্যতম সুপারভিলেন লোকির উত্থান এই আসগার্ডেই। হেলার আক্রমণে যখন আসগার্ড বিপর্যস্ত, তখন মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে থর আটকে আছে একজন বন্দি গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে। গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে নিজের প্রথম লড়াইয়েই মুখোমুখি হয় তার একসময়ের বন্ধু হাল্কের সাথে। হেলার হাত থেকে মাতৃভূমি আসগার্ডকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল থরকে পাড়ি দিতে হবে বহু বাধা, বহু পথ। দীর্ঘ পথের এই মহাজাগতিক এডভেঞ্চারে থরের সাথে যোগ দেয় হাল্ক, লোকি এবং ভ্যালকারি।

মুখোমুখি থর এবং হাল্ক; ©Disney Pictures
রিভিউ
তাইকা ওয়াইতিতির পরিচালনা ছিল এককথায় অসাধারণ। তিনি শুধু থর ফ্র্যাঞ্চাইজকেই পুনর্জীবিতই করেন নি, নতুন রূপ দিয়েছেন সিনেমার প্রতিটি চরিত্রকে। আগে থর বললেই আমাদের চোখের সামনে ভাসতো হাতুড়ি হাতে লম্বা চুলওয়ালা ক্রিস হেমসওর্থ। থরের চিরায়ত ইমেজকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছেন ওয়াইতিতি। এই সিনেমায় আর থরের সেই হাতুড়ি নেই। নেই সেই লম্বা চুলও। এমনকি থরের পোশাকও বদলে গেছে এই সিনেমায়। শুধু থর নয়, ওয়াইতিতির ছাপ পড়েছে হাল্ক এবং লোকির ইমেজেও। সবুজ হাল্ককে আগে আমরা কখনো কথা বলতে দেখি নি (হাল্কের দ্বিতীয় সত্তা ব্রুস ব্যানার অপরদিকে একজন বাকপটু ব্যক্তি), দেখেছি কেবল গর্জন করতে। কিন্তু এই মুভিতে আমরা সবুজ হাল্ককে শুধু কথা বলতেই দেখি না, আমরা আবিষ্কার করি যে হাল্ক আসলে খুবই রসিক সুপারহিরো। প্রথমবার সুপারহিরো মুভি পরিচালনা করতে এসে ওয়াইতিতি ভালোভাবেই নিজের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। তার পরিচালনায় যেমন ছিল টারান্টিনোর মতো হিউমার, তেমনি ছিল স্নাইডারের মতো মোমেন্ট। পরিচালক এবং অভিনেতাদের মতে এই সিনেমার ৮০ ভাগই ছিল ইম্প্রোভাইজড। অর্থাৎ ৮০ শতাংশ ডায়ালগই স্ক্রিপ্টের বাইরে, পরিচালক-অভিনেতাদের উপস্থিত বুদ্ধির ফসল।

পরিচালনার পাশাপাশি ‘কর্গ’ নামে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন ওয়াইতিতি; ©Disney Pictures
ছবির প্রধান চরিত্রগুলোতে সবার অভিনয়ই ছিল চোখে পড়ার মতো। থর চরিত্রে ক্রিস হেমসওর্থকে এবং হাল্ক/ব্যানার চরিত্রে মার্ক রাফেলোকে আমরা নতুন করে খুঁজে পেয়েছি। ভ্যালকারি চরিত্রে টেসা থম্পসনের অভিনয়ও অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রথম মহিলা সুপারভিলেন কেট ব্লানচেট হেলা চরিত্রে ছিলেন এককথায় অনবদ্য।

ছবির একটি দৃশ্যে টেসা থম্পসন, ©Disney Pictures
থর র্যাগনারকের আরও কিছু অনন্য দিক-
- থর র্যাগনারক এক কথায় একটি মৃতপ্রায় সুপারহিরো ফ্র্যাঞ্চাইজ (থর ফ্র্যাঞ্চাইজ)-কে পুনর্জীবিত করেছে।
- অনেকের মতেই থর র্যাগনারক ইতিহাসের সবচেয়ে এন্টারটেইনিং এবং হিউমেরাস সুপারহিরো মুভি।
- থর র্যাগনারকের ভিলেন হেলা (কেট ব্লানচেট) ইতিহাসের প্রথম একক মহিলা সুপারভিলেন। এর আগে আমরা কখনোই সুপারভিলেনের চরিত্রে একজন নারীকে দেখি নি।
- এই প্রথম সুপারহিরোদের সাধারণ মানুষের মতো করে দেখানো হয়েছে। সিনেমায় আমরা সুপারহিরোদের সবসময় একটা বাঁধাধরা সুসজ্জিত ইমেজেই দেখতে পাই। সুপারহিরোরা সবসময় সুপারহিরোদের মতোই থাকে। তাদেরকে কখনো সাধারণ মানুষের মতো সুখ-দুঃখের আলাপ করতে দেখা যায় না, মান-অভিমান করতে দেখা যায় না। সুপারহিরোদের প্রতিচ্ছায়া সবসময়ই নিখুঁত, কখনোই তাদের কোনো ট্রিক মিস হতে দেখা যায় না। থর: র্যাগনারকে এরকম অনেক দৃশ্যই আছে যেগুলোতে আপনারা থর, হাল্কদের মানব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন। ঘুমোতে-গোসল করতে দেখবেন, সুখ-দুঃখের আলাপ করতে দেখবেন, মান-অভিমান করতে দেখবেন। ‘Hulk like fire, Thor like water’ সংলাপটি এর স্বাক্ষর বহন করে।
- থর: র্যাগনারকের একটি অন্যতম চমৎকার দিক হচ্ছে, এটি MCU-এর চিরায়ত ফর্মুলা থেকে বেরুতে পেরেছে। মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স হওয়ার পর থেকে মারভেল বলতে গেলে একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলা অনুসরণ করে তাদের সব সিনেমা বানিয়ে আসছে। র্যাগনারক সেই ফর্মূলার ধার ধারে নি। ওয়াইতিতি মিউজিকে মোড়ানো আগাগোড়া হিউমেরাস এবং এন্টারটেইনিং একটি সিনেমা বানাতে চেয়েছেন এবং বানিয়েছেনও। মারভেলের অন্য সব সিনেমার মতো অলরাউন্ডার হতে চায় নি র্যাগনারক।
- থর র্যাগনারকে মিউজিকের ব্যবহারও অনেক দৃপ্ত। বলতে গেলে MCU-এর ইতিহাসে সবচেয়ে বোল্ড মিউজিক্যাল স্কোরের ব্যবহার হয়েছে র্যাগনারকে। বিশেষ করে র্যাগনারকের টাইটেল সং ‘ইমিগ্রেন্ট সং’ খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নর্স রূপকথার উপর লেখা এই গানের কথা থরের প্রতিমূর্তির সাথে অনেক সামঞ্জস্যপূর্ণও বটে।

থর র্যাগনারকের সেটে ক্রিস হেমসওর্থ এবং মার্ক রাফেলো, ©Disney Pictures
মারভেলের একটি বি টাউন মুভি হয়ে ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সের সবচেয়ে বড় ফিল্ম জাস্টিস লীগের সাথে টক্কর দেয়া থর র্যাগনারকের একটা অন্ধকার দিকও আছে। সেটা হচ্ছে সিনেমার স্টোরি। পুরো সিনেমা এতটাই হিউমার এবং ভিজ্যুয়াল নির্ভর যে, সিনেমার মূল কাহিনীর উপর কখনোই স্ট্রেস করতে দেখা যায় নি।

ছবির স্ক্রিনিং-এ সিডনিতে ক্রিস হেমসওর্থ ও মার্ক রাফেলোর সাথে পরিচালক তাইকা ওয়াইতিতি; source: Twitter
পরিশেষে, থর র্যাগনারক একটি রোলারকোস্টার ভ্রমণের মতো। এই সিনেমা আপনাকে শুধু আনন্দই উপহার দিবে। থর, হাল্কদের এই কসমিক এডভেঞ্চার কাহিনী নির্ভর না, এমনকি থরের বাকি দুই মুভির সাথেও র্যাগনারক তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। কালারফুল সেট, সরস সংলাপ এবং দৃপ্ত মিউজিকের সাথে আমাদের পরিচিত সুপারহিরোদের নতুন রূপে উপস্থাপন করেছে থর র্যাগনারক। সুপারহিরো ঘরানার সিনেমাগুলোর জন্য র্যাগনারক একটি নতুন সংযোজনও বটে।
IMDB: ৮.২/১০
রোটেন টমেটোস: ৯২% ফ্রেশ
মেটাক্রিটিক: ৭৩/১০০