মসজিদকে বলা হয় আল্লাহর ঘর। শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা সেখানে যায় পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে, নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে আত্মিক বন্ধন সৃষ্টি করতে এবং নামায শেষে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের শান্তি কামনা করতে। স্বভাবতই আশা করা হয়, বাইরের পৃথিবীতে যত অন্যায়-অপরাধ বা যুদ্ধ-বিগ্রহই সংঘটিত হোক না কেন, শান্তিময় মসজিদগুলোকে তা স্পর্শ করবে না। কেউ যদি যুদ্ধের সময়ও মসজিদে আশ্রয় নেয়, তাহলে সে নিরাপদ থাকবে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাস্তবতা মোটেও সেরকম না।
যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় মসজিদের উপর আক্রমণ হয়েছে। কখনও সন্ত্রাস দমনের নামে ইরাকে এবং সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিমান হামলায়, কখনও সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে আরব স্বৈরশাসকদের সেনাবাহিনীর হামলায়, আবার কখনও আরব বসন্তের বিদ্রোহীদের এলোপাথাড়ি মিসাইল হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এসব অঞ্চলের বিভিন্ন মসজিদ। এছাড়া ইরাকে শিয়া-সুন্নী সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে মসজিদ প্রাঙ্গণে আত্মঘাতী হামলা তো ছিলই।
গত ২৪ নভেম্বর, শুক্রবার, মিসরের সিনাই উপদ্বীপের বির আল-আবেদ শহরের আর-রাওদা মসজিদে হয়ে গেল এরকমই একটি ভয়াবহ হামলা। জুমার নামাজের পরপরই একদল সন্ত্রাসী মসজিদের ভেতর বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং এরপর মুসল্লীদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। এর ফলে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহত হয় অন্তত ২৩৫ জন এবং আহত হয় আরো অন্তত ১২০ জন। এটি ছিল সাম্প্রতিক সময়ে মিসরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। এখনও পর্যন্ত কেউ এই হামলার দায় স্বীকার না করলেও ধারণা করা হচ্ছে, সাম্প্রতিক অন্য অনেক হামলার মতো এটিও এমন এক গোষ্ঠীর কাজ, যাদের নামগুলো মুসলিম, যারা নিজেদেরকে দাবি করে মুসলিম, কিন্তু যাদের কাজকর্ম ইসলামের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।
ঘটনার বিবরণ
বির আল-আবেদ শহরটি মিসরের রাজধানী কায়রো থেকে প্রায় ২১১ কিলোমিটার দূরবর্তী একটি শহর। এর অবস্থান সিনাই উপদ্বীপের উত্তরে, যা মূল মিসরীয় ভূখন্ড থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। সিনাই প্রদেশের রাজধানী আল-আরিশ থেকে এর দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। আর-রাওদা মসজিদটি এই শহরের প্রধান মসজিদগুলোর মধ্যে একটি। শুক্রবার দুপুরে সবাই যখন জুমার নামাজে ব্যস্ত, তখন চারটি ফোর হুইলার জীপে করে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী এসে মসজিদটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তাদের একটি দল মসজিদের ভেতরে গিয়ে বোমা বিস্ফোরণ করে এবং নামাযরত মুসল্লীদের উপর গুলি করতে শুরু করে। আতঙ্কিত এবং আহত মুসল্লীরা যখন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে শুরু করে, তখন বাইরে অপেক্ষমান সন্ত্রাসীরাও তাদের উপর গুলি চালায়।
সন্ত্রাসীরা মূল রাস্তার পাশে পার্ক করা কিছু গাড়িতে আগুন ধরিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয় যেন সহজে কোনো সাহায্য আসতে না পারে। তারা সেখানে অপেক্ষা করতে থাকে এবং যখন অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছে, তখন কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সের উপরেও তারা গুলি চালায়। মিসরের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম MENA এর দেয়া তথ্যানুযায়ী, এই হামলায় নিহত হয় ২৩৫ জন এবং আহত হয় আরো ১২০ জন। তবে ধারণা করা হয়, এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। মিসরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ফুটেজে মসজিদের ভেতরে অনেকগুলো রক্তমাখা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়, যাদের অধিকাংশের মুখ সাদা কাপড় দিয়ে এবং শরীর জায়নামায দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল।
কারা হামলা করেছে?
এখন পর্যন্ত কেউ এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এটি জঙ্গি সংগঠন আইএসের কাজ। যদিও মিসরে মসজিদে হামলা এই প্রথম, কিন্তু তারা এর আগে বিশ্বের অন্য কয়েকটি দেশে মসজিদে এবং মিসরে গির্জাতে হামলা করেছিল। এই অঞ্চলে অবশ্য আল-কায়েদা সমর্থিত কয়েকটি সংগঠনেরও অস্তিত্ব আছে, কিন্তু তাদের তুলনায় আইএসই এখানে বেশি শক্তিশালী। এছাড়া এই অঞ্চলে সক্রিয় আল-কায়েদা সমর্থিত জুনুদ আল-ইসলাম নামে একটি সংগঠন বিবৃতি দিয়ে এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে।
হালকা জনবসতির সিনাই উপদ্বীপ অঞ্চলটি মিসরের মূল ভূখন্ড থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন এবং পার্বত্য অঞ্চল হওয়ায় এটি বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠির আদর্শ বিচরণস্থল। দীর্ঘদিন ধরেই এই অঞ্চলের উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সাথে মিসরীয় সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলে আসছিল। এই অঞ্চলের উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল আনসার বাইত আল-মাক্বদেস নামে একটি সংগঠন, যারা ২০১১-১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় কয়েকবার ইসরায়েলের গ্যাস পাইপ লাইনে এবং ইসরায়েলি সেনাদের উপর রকেট হামলা করে। কিন্তু মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসীর পতনের পর থেকে তারা মিসরীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্ব দেয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের নভেম্বরে তারা জঙ্গি সংগঠন আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে।
আইএসের এই স্থানীয় শাখাটি এ এলাকায় এ পর্যন্ত মিসরীয় সেনাবাহিনীর কয়েকশ সদস্যকে হত্যা করেছে। এ বছর জুলাই মাসেও আইএসের এক আত্মঘাতী হামলায় ২৬ মিসরীয় সেনা এবং সেপ্টেম্বের এক হামলায় ১৮ জন সেনা নিহত হয়। এ বছর এপ্রিল মাসে আইএসের হামলায় খ্রিস্টানদের দুটি গির্জায় মোট ৪৪ জন নিহত হয়। এছাড়াও ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিসর থেকে যাত্রা করা রাশিয়ান বিমান বিধ্বস্ত হয়ে যে ২২৪ জন যাত্রী মারা গিয়েছিল, সেটিও আইএসের আক্রমণ ছিল।
হামলার লক্ষ্য কারা ছিল
যে মসজিদটিতে হামলা করা হয়েছে, সেই আর-রাওদা মসজিদটি ছিল একটি সুফি মসজিদ। ধারণা করা হয়, সুফিরাই এই হামলার মূল লক্ষ্য ছিল। কারণ আইএস সম্প্রতি এই অঞ্চলের সুফিদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছিল। গত ডিসেম্বর মাসে আইএস সিনাই এলাকার দুজন বৃদ্ধ সুফি শেখকে হত্যা করেছিল। সে সময় আইএসের সিনাই প্রদেশের ‘ধর্মীয় পুলিশ’ হুমকি দিয়েছিল, অন্য সুফিরাও যদি তওবা না করে, তাহলে তাদেরকেও হত্যা করা হবে।
সুফিবাদ হচ্ছে ইসলামের একটি আধ্যাত্মিক দর্শন, যার বর্তমান বিবর্তিত রূপভেদকে সালাফিরা সহ অনেকেই বিদাআত তথা নবসংযোজন বলে গণ্য করে। আরব বসন্তের পর লিবিয়া, মিসর সহ বিভিন্ন দেশে সালাফিরা বেশ কিছু মাজার সংলগ্ন সুফি মসজিদ ধ্বংস করে এই অভিযোগে যে, সেখানে মাজার পূজা হয়। তবে তারা শুধু মসজিদই ধ্বংস করেছিল, সেখানকার মুসল্লীদের উপর আক্রমণ করেনি।
কিন্তু চরমপন্থী সংগঠনগুলো সুফিদেরকে শুধু ‘পথভ্রষ্ট’ নয়, বরং কাফের হিসেবে ঘোষণা করে এবং তাদেরকে হত্যা বৈধ বলে মনে করে। উদাহরণস্বরূপ গত বছর নভেম্বর মাসে আইএস পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে মাজার সংলগ্ন একটি সুফি মসজিদে বোমা হামলা করে ৫০ জনকে হত্যা করে। মিসরের সিনাইয়ের এই হামলাটি শুধু সুফিদের উপর না হয়ে একই সাথে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উপরেও হতে পারে। কারণ এই মসজিদটিতে সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতি অনেক বেশি ছিল। এছাড়া নামে সুফি মসজিদ হলেও বাস্তবে সব ধরনের মুসলমানরাই মসজিদগুলোতে নামাজ আদায় করে।
হামলার প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পরপই মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সাথে জরুরী বৈঠকে বসেন। এরপর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত এক বক্তব্যে তিনি ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং তার ভাষায়, এই ‘অপরাধমূলক’ এবং ‘কাপুরষোচিত’ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, সেসব ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘তাকফিরি’ সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার অঙ্গীকার করেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানায়, হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মিসরীয় বিমান বাহিনী বির আল-আবেদ শহরের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বিমান হামলা পরিচালনা করে। এছাড়াও সেনাবাহিনী বির আল-আবেদ এবং আল-আরিশ শহরে কার্ফিউও জারি করে।
বিশ্ব নেতৃবৃন্দও এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। আরবলীগের প্রধান আহমেদ আবুল গেইথ বলেন, এটি একটি ভয়াবহ হামলা, যা আবারও প্রমাণ করে যে, যারা চরমপন্থী সন্ত্রাসী আদর্শ লালন করে, তারাই এজন্য দায়ী, আর ইসলাম নির্দোষ। ন্যাটোর মহাসচিব একে বর্বরোচিত হামলা বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই হামলাকে ভয়ংকর এবং কাপুরষোচিত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তাদেরকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ও আরও বুদ্ধিমান হতে হবে এবং একে সামরিকভাবে দমন করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট সিসি এই হামলায় নিহত ও আহতদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করেন, পুলিশ এবং সশস্ত্র বাহিনী শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ নিবে এবং সর্বশক্তি দিয়ে নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে। নিহতদের স্মরণে তিনি মিসর জুড়ে তিন দিনের রষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন।
ফিচার ইমেজ- AFP