সৃজনশীল মানুষ মাত্রই একটু ভিন্ন ধরনের, সাধারণ থেকে আলাদা। কিন্তু এই পাগলামির সীমারেখা কতটুকু হয়? অনেক সৃজনশীল মানুষই এক ধরনের বিষণ্ণতায় ভুগেন। মানসিক চাপ যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। জীবনকে সহজভাবে নেওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে উঠে তাদের জন্য। এমনকি অনেকে বেছে নেন মৃত্যুকে! ‘Eat pray and love’ এর বিখ্যাত লেখক এলিজাবেথ গিলবার্ট তার টেড টকে এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সৃজনশীলতার উৎস কী এবং এর দায়ভার মানুষের উপর কতটুকু, এ নিয়ে কিছু চমকপ্রদ কথা বলেছেন তিনি। তার কথাগুলোই তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
প্রাচীন রোম ও গ্রীসে ‘জিনিয়াস’ বলতে কোনো ব্যাক্তিকে বোঝানো হতো না। এটি ছিলো এক ধরনের ঐশ্বরিক কিছু, যা মানুষের উপর ভর করে। উত্তর আফ্রিকার মরুভূমিতে যখন কোনো দক্ষ নৃত্যশিল্পী নাচতে নাচতে ঘোরের মধ্যে চলে যেতেন, তখন ঐ অবস্থাকে বলা হতো ‘জিনিয়াস’। আর আশেপাশের লোকেরা বলে উঠতো ‘আলা আলা আলা আলা’। যেন ঈশ্বর নেমে এসেছেন তাদের মাঝে। পরবর্তীতে ‘আলা আলা’ ‘ওলে ওলে’-তে রুপান্তরিত হয়েছে। বুল ফাইটে এখনও ওলে ওলে বলা হয়। কোনো অসাধারণ কাজ হলেই সবাই মনে করতো জিনিয়াস লোকটার উপর ভর করেছে। তারা মনে করতো, মানুষ জিনিয়াসের উৎস নয় বরং মানুষের কাছে জিনিয়াস আসে। জিনিয়াস অবস্থা পার হয়ে গেলে সে মানুষটা আবার সাধারণ মানুষে পরিণত হতো। ফলে কোনো মানুষ তার কাজের পুরোপুরি সাফল্যের দাবি করতে পারতো না। কারণ, তার অসাধারণত্বের পেছনে জিনিয়াসের হাত আছে। এতে মানুষ কাজের ফলাফলের চাপ থেকে মুক্তি পেতো।
কিন্তু আধুনিক সমাজে আমরা প্রথমবারের মতো মানুষকে জিনিয়াস বলতে শুরু করলাম। যেন পুরো মহাবিশ্বের সব দায়িত্ব একজন মানুষের উপর। তখন মানুষ মনে করতে থাকে, এই সব কিছুর দায়-দায়িত্ব শুধু আমার একার। এই মানসিক চাপই তাকে সৃজনশীলতা থেকে দূরে রাখে। মানসিকতা এমন হওয়া উচিত, আমার একার পক্ষে পুরোটুকু করা সম্ভব নয়। আমার অংশ আমি করবো, বাকিটুকু প্রকৃতির উপর ছেড়ে দিতে হবে। নিজেই কাজের সব দায়িত্ব নিয়ে নেওয়ার মানে হলো জীবনকে আরও কঠিন করে ফেলা। এটা না করে যদি আনন্দের জন্য কাজ করা হয় আর পুরোপুরি নিজের ক্ষমতার উপর নির্ভর না করে প্রকৃতির উপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে এই মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সৃজনশীল মানুষেরা তাদের কাজের ফলাফল নিয়ে এক ধরনের দুশ্চিন্তায় ভোগেন। কিন্তু এলিজাবেথের মতে, কাজের ফলাফল নিয়ে চিন্তা করা আসলে সৃজনশীল মানুষদের কাজ নয়। তার কাজ হচ্ছে নিজের কাজ করে যাওয়া। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। কাজ ভালো হবে কী খারাপ হবে সেটা নিয়ে চিন্তা না করা। কারণ কাজের অসাধারণত্ব নির্ধারণের ক্ষমতা মানুষের নেই। তা নির্ভর করে কোনো একটা কিছুর উপর, যার ব্যাখ্যা মানুষের কাছে নেই।
সৃজনশীল কাজের ধরন অনেক সময় আধ্যাত্মিক পর্যায়ে চলে যায়। টেড টকে এলিজাবেথ রুথ স্টোন নামের একজন প্রতিথযশা কবির কাজের ধরন বর্ণনা করেন। রুথ যখন ভার্জিনিয়াতে মাঠে কাজ করতেন, তখন তিনি মাঝে মাঝে অনুভব করতেন একটি কবিতা তার কাছে আসছে। অনেকটা বিদ্যুৎগতিতে চলমান বাতাসের মতো। তিনি তখন দৌড়ে ঘরে যেতেন। কাগজ-পেন্সিল নিয়ে দ্রুত কবিতাটি লিখে ফেলতেন। মাঝে মাঝে তার ঘরে আসতে দেরি হয়ে যেতো। তখন কবিতাটি যেন তার মধ্য দিয়ে বের হয়ে চলে যেতো। তার ভাষায়, কবিতাটি তখন আরেকজন কবি খুঁজতো। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন হতো, কাগজ কলম নিয়ে বসতে বসতে কবিতাটি রুথের মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছে। রুথ তখন কবিতার লেজ ধরে তা নিজের শরীরের ভেতরে নিয়ে আসতেন আর কাগজে লিখতে থাকতেন। এভাবে পুরো কবিতাটিই লেখা হতো। কিন্তু উল্টোভাবে। শেষ শব্দ থেকে প্রথম শব্দ!
এলিজাবেথ গিলবার্ট Eat Pray Love বইটি লেখার সময় মাঝে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। মনের মধ্যে নানা জল্পনা কল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো তার। ভাবছিলেন, হয়তো এই বইটি একটা জঘন্য বই হতে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি তার কাজ থামাননি, নিয়মিত লিখে গিয়েছেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বই ভালো হবে নাকি খারাপ হবে তার পুরোটুকু তার হাতে নেই। তিনি শুধু প্রতিদিন লিখতে বসতে পারেন। আর লিখে যেতে পারেন। তিনি ভাবতেন, অসাধারণ কিছু হবে কি হবে না, তা নির্ধারণ হয় এমন কোনো কিছু দিয়ে, যার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই।
এলিজাবেথের মতে, সৃজনশীল মানুষের মধ্যে দুটি অংশ থাকে। একটি মানুষ নিজে। অন্যটি পুরোপুরি সে মানুষটি নয়। অনেকটা অনিশ্চিত ধরাছোঁয়ার বাইরে সে সত্তাটি। সৃজনশীলতা সে অংশের হাত ধরেই আসে। সৃজনশীল কাজ তাই এই দুই সত্তার মধ্যে এক ধরনের কথোপকথনের মতো।
কিন্তু বর্তমান সময়ের মানুষেরা খুব বেশি আমিত্বে ডুবে আছে। এর ফলে তারা জর্জরিত হচ্ছে অমানুষিক যন্ত্রণায়। আমাদের সময়ের অনেক প্রতিভাবান মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন চেস্টার বেনিংটন, রবিন উইলিয়ামস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সহ অনেক মহারথীরা। কিন্তু এই গুণীজনদের আরও অনেকদিন দরকার ছিলো আমাদের। এলিজাবেথের মতে, আমাদের এসব প্রতিভাবানদের বাঁচতে হবে। তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, সৃজনশীলতাকে একেবারে পুরোপুরি ব্যক্তিগতভাবে বিবেচনা করার ফলাফল। তার ভাষায়,
কোনো মানুষকে সৃজনশীলতার উৎস বলার মানে হলো, তাকে পুরো সূর্যটাকে গিলে ফেলতে বলা।
এলিজাবেথের মতে, কোনো মানুষকে আলাদাভাবে সৃজনশীল বলা ঠিক নয়। এ কথা ওশোও বলেছেন।
সবাইকে এটা শেখানো হয় যে, পৃথিবীতে মাত্র অল্প কিছু মানুষ সৃজনশীল। লাখের মধ্যে থাকে কিছু কবি, কিছু চিত্রশিল্পী। এটা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। প্রত্যেকটি মানুষ জন্মগতভাবে একজন স্রষ্টা। আপনি যখন শিশুদের দেখবেন, তখন বুঝবেন প্রতিটি শিশুই সৃজনশীল। কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা তাদের সৃজনশীলতাকে ধ্বংস করে ফেলি। আমরা জোর করে তাদের মধ্যে মিথ্যা বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিই। আমরা তাদেরকে বিভ্রমে ফেলে দিই। তাদেরকে ধীরে ধীরে অর্থনীতি, রাজনীতি আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়ে ঘিরে ফেলি। যখনই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঢোকে, তখন সৃজনশীলতা বিদায় নেয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে কোনো কাজকে কারণ ছাড়া ভালবাসতে দেয় না। সে যখন ছবি আঁকে কিংবা কোনো উপন্যাস লেখে, তখন সে ভবিষ্যতে থাকে। সে চিন্তা করে, এ লেখার জন্য আমি নোবেল পাবো। কিন্তু সৃজনশীল মানুষ কখনো ভবিষ্যতে বাস করে না। একজন সৃজনশীল মানুষের বাস সবসময় বর্তমানে।
কোনোকিছু তৈরি করতে হলে তার জন্য কিছু সরঞ্জাম লাগে। একজন সৃজনশীল মানুষ তা নেয় তার পরিবেশ থেকে। কিন্তু যখন সে নিজেকে সৃজনশীলতার উৎস বলে মনে করে, তখনই সে সৃজনশীলতা থেকে দূরে সরে যায়। তার চেয়ে বরং কাজটা উপভোগ করাই শ্রেয় হবে। কাহলিল জিব্রানের বিখ্যাত বই ‘দ্য প্রফেট’ এর কয়েকটি ছত্র এখানে যুক্তিযুক্ত। বইয়ের মূল চরিত্র ‘আল মুস্তাফা’ কথাগুলো বলেছিলেন সন্তান বিষয়ে । কিন্তু সৃজনশীলতার ক্ষেত্রেও কথাগুলো খাটে। সৃজনশীল মানুষের কাজ তো তার কাছে সন্তানের মতোই!
They come through you but not from you,
And they are with you yet they belong not to you.