সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট তার ক্ষমতাকালীন প্রথম ১০০ দিনের মধ্যেই প্রায় ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই থেকে মার্কিন রাজনীতিতে প্রেসিডেন্টের প্রথম ১০০ দিনের গুরুত্ব ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পায় এবং একে খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে গত ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেখতে দেখতে ক্ষমতা গ্রহণের ১০০তম দিন চলে এসেছে। আগামী ২৯ এপ্রিল শনিবার হোয়াইট হাউজে পদার্পণের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের ১০০তম দিন উদযাপন করবেন তিনি। এ উপলক্ষে সমর্থকদের নিয়ে বিশাল এক সমাবেশের আয়োজনও করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
নির্বাচনের আগে গত বছরের ২৩ অক্টোবর নির্বাচনী প্রচারণার সময় পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম ১০০ দিনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। নির্বাচনে জয়লাভের পর তার নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপও গ্রহণ করেন এই প্রেসিডেন্ট।
কী কী অঙ্গীকার ছিল ট্রাম্পের ঘোষণায় ?
- সংবিধানকে সমুন্নত করবে এবং দ্বিতীয় সংশোধনী সমর্থন করবে এমন কিছু বিচারক নিয়োগ দেয়া।
- বেকারত্ব নিরসন ও অবৈধ অভিবাসী সীমিতকরণের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল স্থাপন।
- অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তি পূনঃমূল্যায়ন এবং বহিরাগতদের চাকুরী প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
- ওবামাকেয়ার বাতিল ও প্রতিস্থাপন।
- শক্তি উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতা অপসারণ।
- সংবিধানে কংগ্রেসের মেয়াদ আরোপক একটি সংশোধনের চেষ্টা।
- বন্দুক-মুক্ত অঞ্চল বাদ দেয়া।
- ‘প্রতিটি নতুন আইন প্রণয়নের জন্য পুরাতন দুটি আইন অপনীত হবে’ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা।
- মার্কিন পরিকাঠামোকে সাইবার আক্রমণ ও অন্যান্য সকল আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেয়া।
- চীনকে মুদ্রা কারসাজির কারিগর হিসাবে ঘোষণা দেয়া।
- চীনের অন্যায্য ভর্তুকি আচরণের জন্য আইনকানুন জোরদার করা।
এসব ছাড়াও জলবায়ু চুক্তি বাতিলসহ বেশ কয়েকটি বাণিজ্য শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন এই প্রেসিডেন্ট।
উল্লেখযোগ্য কী কী ঘটলো এই ১০০দিনে ?
ক্ষমতা গ্রহণের পর বেশ কয়েকবার অম্ল-মধুর স্বাদের ভেতর দিতে যেতে হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। কখনো কখনো যদিও বা সমর্থকদের ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন, কখনও আবার সমালোচনার তীরে বিদ্ধও হয়েছেন। ওয়াশিংটনের হালচাল বুঝতেও কিছুটা কালক্ষেপণ করেছেন তিনি। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সীমান্ত অভিবাসন, জলবায়ু চুক্তিসহ নানা বিষয়ে আলোচিত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট।
কর্মসংস্থান
উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা জোরদার করতে পদক্ষেপ নেবেন ট্রাম্প এবং এর পাশাপাশি ১০ বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন কর্মসংস্থান তৈরি করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। একই সাথে কর্পোরেট কর ৩৫% থেকে কমিয়ে ১৫% এ নামিয়ে আনারও পরিকল্পনা করছেন ট্রাম্প।
অভিবাসন
ক্ষমতা গ্রহণের পর অভিবাসন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হিসেবে মেক্সিকো সীমান্তে ২,০০০ মাইলেরও অধিক লম্বা এক অভেদ্য সীমান্ত প্রাচীর তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই প্রাচীর নির্মাণহেতু অর্থের ক্ষতিপূরণ অবশ্যই মেক্সিকো দেবে বলে জানান তিনি। এ প্রকল্পের জন্য তিনি নানা ভাবে সমালোচিতও হয়েছেন। একই সময়ে মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট তার যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। এর পাশাপাশি অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বিতাড়িত করতে অসম্মতি জানানো তথাকথিত আশ্রয়স্থল শহরে যুক্তরাষ্ট্রীয় অনুদান বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন ট্রাম্প।
উদ্বাস্তু
যুক্তরাষ্ট্রকে সন্ত্রাসী আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখার অজুহাতে ৭টি মুসলিম দেশ ও অন্যান্য শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ আদেশ জারি করে আবারো সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি এবং প্রতিবাদ স্বরূপ মার্কিন বিমান বন্দরগুলোতে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরবর্তীতে ঐ ৭টি মুসলিম দেশের বিমানযাত্রীদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ওয়াশিংটনের একটি আদালত সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়।
এই রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও ৬টি দেশের ওপর ৯০ দিনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ট্রাম্প। এছাড়াও ১২০ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। এই আদেশও যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই ও ম্যারিল্যান্ড প্রদেশের আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একইসাথে তারা এ আদেশের বিরুদ্ধে মামলাও করেন।
পররাষ্ট্র নীতি
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ এনে দেশটির একটি বিমান ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হামলা চালানোর পরবর্তী সময়ে ওয়াশিংটন-মস্কো সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়, যার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহল নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
কিছুদিন পর আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ নানগরহারে ইসলামিক স্টেটের অবস্থান লক্ষ্য করে সবচেয়ে বড় ‘অপারমাণবিক বোমা’ হামলা চালায় মার্কিন সামরিক বাহিনী। জিবিইউ-৪৩/বি ম্যাসিভ অরডিন্যান্স এয়ার ব্ল্যাস্ট (এমওএবি) বা ‘মাদার অব অল বোম্বস’ নামক বোম্বটি ব্যবহার করে আবারও বিশ্ব রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হন ট্রাম্প।
সমসাময়িক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া ইস্যু সমগ্র বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। উভয় পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান যেকোনো মুহূর্তে বিশ্বে চরম অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। এদিকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ইস্যুতে আলোচনার জন্য পুরো সিনেটকে হোয়াইট হাউজে ডেকেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এরকম পুরো সিনেটকে ডেকে কোনো বিষয়ে আলোচনার করার ঘটনা এর আগে মার্কিন ইতিহাসে খুব বেশি ঘটেনি।
বাণিজ্যচুক্তি
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথেই ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি চুক্তি বাতিলের নির্বাহী আদেশ দেন ট্রাম্প। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর কিছুদিন পর বিদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত বাণিজ্যিক চুক্তি (নাফটা) পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। মার্কিন চাহিদা পরিপূর্ণ না হলে তা বাতিল হতে পারে বলেও হুমকি দেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তন
বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে আনতে ওবামা সরকারের ‘ক্লিন পাওয়ার প্ল্যান’ বাতিল করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। পরিকল্পনাটি বাতিল করে ‘এনার্জি ইন্ডিপেন্ডেন্স এক্সিকিউটিভ অর্ডার’ নামে নতুন নির্বাহী আদেশ সাক্ষর করেন ট্রাম্প। এ ব্যাপারে ট্রাম্প বলেন, তার এই নির্বাহী আদেশ কয়লার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। তবে এ আদেশ জারি করে পরিবেশবাদীদের বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
গর্ভপাত
গর্ভপাত অবৈধ করা উচিত এবং গর্ভপাতকারীকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত বলে মন্তব্য করেন এই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। ২০০০ সালে এক বক্তব্যে ট্রাম্প বলেছিলেন তিনি গর্ভপাতকে সমর্থন করেন। ক্ষমতায় আসার পর এ ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করায় আবারও সমালোচিত হন তিনি।
জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের অবস্থান সর্বনিম্ন
নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের ১০০তম দিনের সন্নিকটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবচেয়ে কম জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১০০তম দিন উদযাপনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ওয়াশিংটন পোস্ট-এবিসি নিউজের এক যৌথ জরিপ বলছে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা মাত্র ৪৩%; যা ১৯৪৫ সালের পর যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য সর্বনিম্ন। ১০০তম দিন উদযাপনের সময় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জনপ্রিয়তা ছিল ৬৯%।
তবে ট্রাম্পকে ভোট প্রদানকারীদের মধ্যে ৯৬% ই ট্রাম্পের পক্ষে পূর্ণ আস্থা রেখেছেন বলেও জরিপে জানা যায়। এ প্রশ্নে বারাক ওবামা সমর্থন পেয়েছিলেন ৭৩% সমর্থকের। তবে এসব কথায় কান দিতে নারাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি এক টুইটার বার্তায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “No matter how much I accomplish during the ridiculous standard of the first 100 days, & it has been a lot (including S.C.), media will kill!”
প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিভিন্ন নির্বাহী আদেশ জারি করতে গিয়ে তাকে পড়তে হয়েছে নানান বিপাকেও। এই ১০০ দিনে রাজনৈতিকভাবে কতটুকু সফলতা অর্জন করেছেন ট্রাম্প এ নিয়ে চলছে ব্যাপক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। তবে সার্বিক কার্যক্রম খুব বেশি একটা পক্ষে নেই ট্রাম্পের। কাজকর্মে আনাড়ি ভাবও বেশ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। এ ব্যাপারে দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে লেখক ফিলিপ রথ ট্রাম্প সম্পর্কে বলেন, “শাসনব্যবস্থা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য বিষয়ে তিনি অজ্ঞ একজন প্রেসিডেন্ট।”