সবার ধারণা বাংলাদেশে হুমায়ুন আহমেদ সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তার বই প্রচুর বিক্রি হয় এবং তার বইগুলোই সবসময় বেস্টসেলার। তিনি দেশের প্রচুর মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন বইয়ের মাধ্যমে। কিন্তু বিক্রির পরিমাণ দিয়ে যদি বেস্ট সেলার বই এবং বেস্ট সেলার লেখক নির্ধারণ করা হয়, তাহলে সেখানে সবার আগে নাম থাকবে কাসেম বিন আবুবাকারের। হুমায়ুন আহমেদের বই যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পরিমাণ বিক্রি হয়েছে কাসেম বিন আবুবাকারের বই। তার লেখা ‘ফুটন্ত গোলাপ’ বিক্রি হয়েছে দশ লক্ষাধিক কপি। হুমায়ুন আহমেদের কোনো বই-ই এত পরিমাণ বিক্রি হয়নি।
কিন্তু বর্তমান বই পড়ুয়াদের অনেকে তার নামও শুনেনি। তারা বিশ্বাসই করতে পারছে না কাসেম বিনের বই কীভাবে বিক্রির দিক থেকে এমনকি হুমায়ুন আহমেদকেও ছাড়িয়ে যায়? যার নাম কখনো শুনেনি, আলোচনায় আসেনি তাকে নিয়ে বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে কেন এত তোলপাড়? এমন একটা সময়ে হুট করে বিদেশি মিডিয়াগুলো কেন তাকে ফোকাস করে লেখা প্রকাশ করছে? এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য একটু গভীরে যেতে হবে।
যেভাবে এলেন আলোচনায়
গত ২৬ শে এপ্রিল এএফপি’র বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ডেইলি মেইল তাকে নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টের শিরোনাম ছিল “Islamic romance novels set hearts aflutter in Bangladesh”। এরপর এই রিপোর্টকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রেরইয়াহু নিউজ, মধ্যপ্রাচ্যেরআরব নিউজ, মালয়েশিয়ারদ্য স্টার ওমালয়মেইল, পাকিস্তানেরদ্য ডন, ফ্রান্সের ফ্রান্স টুয়েন্টি ফোর ও রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল, হাঙ্গেরিরহাঙ্গেরি টুডে ইত্যাদি সংবাদমাধ্যম তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে দেশেও তাকে নিয়ে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়।
অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক মাধ্যম তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করাতে ফেসবুকের বই পড়ুয়া সমাজ কিছুটা নড়েচড়ে বসেন। গুরুত্ব দিয়ে খবরটা লক্ষ্য করেন। একই প্রতিবেদন যদি দেশীয় কোনো সংবাদ মাধ্যম করতো, তাহলে হয়তো কেউ হয়তো তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতো না। দেশীয় কোনো গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি, অথচ বিখ্যাত কতগুলো আন্তর্জাতিক মাধ্যম এক বা একাধিক কারণে তাকে খুঁজে নিয়েছে- এমন ঘটনায় অনেকেই অবাক।
ফেসবুকে বই পড়ুয়াদের গ্রুপগুলোতে অনেকেরই বক্তব্য এমন- আমি তো প্রচুর বই পড়ি, উনি যদি এত বিখ্যাত হয়েই থাকেন তাহলে উনার বই সম্বন্ধে আগে কেন জানলাম না? ‘গুডরিডস’ নামে বই পড়ুয়াদের জন্য আলাদা একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আছে। সেখানেও অনেকের আওয়াজ এমনই শোনা যায়।
বর্তমান পাঠকদের কেউ কেউ কেন তাকে চিনতে পারেনি
মূলত কাসেম বিন আবুবাকার বাংলায় জনপ্রিয় ছিলেন ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকের সময়ে। তখন হুমায়ুন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের মাঠে থাকলেও তার বিপ্লব তখনো ঘটেনি। এমন অবস্থায় বইয়ের মাঠের রাজা ছিলেন কাসেম বিন আবুবাকার। সাধারণত কোনো বই কালকে জয় করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পাঠক পর্যন্ত বিস্তৃত হতে হলে বইটি সাহিত্যমানে অনেক ভারী হতে হয়। কোনো বই যখন তার অসাধারণত্বের গুণে উত্তরোত্তর প্রজন্ম পর্যন্ত পাঠকের মনে স্থান করে নিতে পারে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের লেখকও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পাঠকের মনে স্থান করে নেন। কাসেম বিন আবুবাকারের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। তিনি প্রায় একশোয়েরও অধিক বই লিখেছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কালোত্তীর্ণ হতে পারেননি। পরের প্রজন্মের পাঠকের মনকে জয় করতে পারেননি।
কেন কালোত্তীর্ণ হতে পারেননি
কোনো পাঠক যখন একটা ভালো বই পড়ে, তখন তিনি চান অন্য পাঠকরাও সেটা পড়ুক। বন্ধুদের সাথে বা ছাত্রছাত্রীদের সাথে বা পরিবারের সাথে সেই বই বা লেখক সম্বন্ধে কথা বলেন। ঐ বইটি পড়তে উৎসাহ দেন। আধুনিক যুগে ভালো বইয়ের ইতিবাচক পর্যালোচনা করেন ফেসবুকের বই পড়ার গ্রুপে কিংবা গুডরিডসে। মীর মোশাররফ হোসেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, সৈয়দ মুজতবা আলী, হুমায়ুন আহমেদ, জহির রায়হান ইত্যাদি লেখকদের বইয়ের বেলায় মানুষ সাধারণত বলে, বইটা পড়তে পারেন। এই বই পড়লে আপনার অতিবাহিত সময় বিফলে যাবে না। কিন্তু কাসেম বিন আবুবাকারের কোনো বইয়ের বেলায় মানুষ কখনো বলে না- “ভাই বইটা পড়ে দেইখেন, সকলকে সাজেস্ট করছি।”
সারা দেশে সবচেয়ে বেশি বই বিক্রি হওয়া লেখক, কিন্তু তারপরেও কেউই পড়ার জন্য অন্যদের উৎসাহ দিচ্ছে না। কারণ কী? তখন দেখতে হবে তার উপন্যাসের উপাদান কী? অনেকে বলে থাকেন তিনি ‘ইসলামী উপন্যাসিক’। কিন্তু তিনি নিজেকে ইসলামী উপন্যাসিক বলে দাবী করেন না। তবে ঘুরে ফিরে এটা বারবার বলেন যে, পাঠক যেন শরীয়ত সম্মত উপায়ে সুন্দর ইসলামী জীবন-যাপন করতে পারে সে উদ্দেশ্য নিয়ে উপন্যাস লিখেন। ভাত খাওয়া হলো, তবে মাথার পেছন দিক থেকে ঘুরিয়ে।
তবে ইসলাম নিয়ে লিখলে তো সেটা সুশীল পাঠকদের অবহেলার কারণ হতে পারে না। তাকে নিয়ে অনলাইন জগতে অনেকে ঠাট্টায় মেতে উঠেছে। ইসলাম নিয়ে লিখলে তো আর সেটা ঠাট্টার কারণ হতে পারে না। মূলত সেসব আলোচনার মূল কেন্দ্র হচ্ছে- তিনি ইসলামের ফ্লেভারে এমন কিছু মিশিয়ে দিচ্ছেন যেটা যৌন সুড়সুড়িমূলক। তার লেখা থেকে দুটি উদাহরণ দেই-
“শফিক বিসমিল্লা বলে শফিকুনের ঠোটে কিস করা শুরু করলো।”
“রফিকুন বোরখা পড়ে ডেটিংয়ে যায়, কারণ বোরখা ছাড়া ডেটিং নাজায়েজ।”
খেয়াল করুন, কোনো লেখক যদি লিহতো, “নায়ক ঢোক গিলে নায়িকার ঠোটে কিস করা শুরু করলো”- তাহলে সেটা হতো লেখালেখিতে হারাম বিষয়। এরকম জিনিস গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সেখানে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দটি ঢুকে যাওয়াতে সেটি অন্য একটি মাত্রা পেয়ে গেলো। সরাসরি মেনেও নেয়া যাচ্ছে না, আবার ধর্মীয় দিক থেকে ফেলেও দেয়া যাচ্ছে না। সাধারণ পাঠক এখানে দ্বন্দ্বে পড়ে যায়, ধরে নেয় এটি ধর্মেরই উপদেশ মূলক বাণী- সকল কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে হয়। ব্যাস, কাসেম বিন আবুবাকারের লাইন হয়ে গেল হালাল!
বিয়ের আগে ডেটিং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য বিষয়। কিন্তু সেখানে বোরকা এনে এমন বার্তা দিচ্ছেন যে, সকল ক্ষেত্রে পর্দা মানা জরুরি। তৈরি হয়ে গেলো আরেক ধরনের দ্বন্দ্ব। বোরকা পড়ে ডেটিং করলে কি সেটা আসলেই জায়েজ হয়ে যায়? এরকম আরো উদাহরণ আছে।
যৌনতা মানুষের আদিম সঙ্গী। ধর্মের দিক থেকে অবাধ যৌনতা গ্রহণযোগ্য নয়। আবার ধর্মও অবশ্য পালনীয় বিষয়। এমন অবস্থায় এমন কিছু যদি পাওয়া যায় যেখানে ধর্মও ঠিক থাকবে, আবার যৌন উপলব্ধিও ঠিক থাকবে, তাহলে এটা কেন মানুষ লুফে নেবে না?
মূল প্রশ্ন থেকে আমরা দূরে সরে গিয়েছি। কেন তার বই কালোত্তীর্ণ হতে পারেনি। যদি লাখ লাখ মানুষ তার বই লুফে নেবে তাহলে কেন তার বই কালকে জয় করে নিতে পারেনি, নতুন প্রজন্মের পাঠক-পাঠিকারা কেন তার নাম পর্যন্ত শুনেনি?
তখনই চলে আসে একসাথে অনেকগুলো উত্তর- মানুষ নিজে নীল ছবি (পর্নো) দেখলেও অন্য কাউকে দেখতে বলে না। মানুষ চটি (একধরনের অশ্লীল সাহিত্য) পড়লেও সেটা কারো সাথে শেয়ার করে না। ভিডিও ওয়েবসাইটগুলোর মাঝে সবচেয়ে বেশি ভিজিটর থাকে নীল ছবিরগুলোতেই। সেসব চটি গল্প এবং ভিডিও একবার দেখে নিলে আর কেউ সেটার কথা মনে রাখে না। আদর দিয়ে সংগ্রহ করে রাখে না। ঠিক একই কারণে কাসেম বিন আবুবাকারের বইগুলো মানুষ পড়লেও কেউ আদর দিয়ে যত্ন করে রাখে না। কেউ চায় না বইটি তার সন্তান পড়ুক।
আচ্ছা, এখানে চটি আর পর্নোর সাথে তুলনা করে দেখতে হলো? একটু বেশি হয়ে গেলো না? আসলে তুলনা করা যায়। কাসেম বিনের বই বাবা-মায়েরা সন্তানদের জন্য নিষিদ্ধ করে দেন। সন্তান যদি চুরি করে সেই বই পড়ে ফেলে এবং বাবা-মা ধরতে পারে, তাহলে শক্ত শাস্তি দেন। পাশাপাশি কয়েক মাসের জন্য সন্তানের যেকোনো ধরনের বই পড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কাসেম বিনের অনেক অনেক পাঠক আছে যারা স্কুল জীবনে তার বই পড়েছিল লুকিয়ে লুকিয়ে। কেউ কেউ দরজা বন্ধ করে কেউ কেউ টেক্সট বইয়ের ভেতর লুকিয়ে। কারণ নিষিদ্ধ বই। নিষিদ্ধ জিনিসে আগ্রহ বেশি।
একটা নমুনা তুলে ধরি। লেখক হয়তো কোথাও বলতে চাইছেন মেয়েদের টেনিস/ব্যাডমিন্টন খেলা উচিৎ নয়। কারণ এতে মেয়েদের দেহের অবয়ব বোঝা যায়, যা আব্রু নষ্ট করে। এটা বলার জন্য তিনি এমন উদাহরণ দিলেন- অমুক মেয়ে টেনিস/ব্যাডমিন্টন খেলেছিল। খেলার সময় তার বুকের এই এই জিনিসগুলো নড়ছিল, দেহের এই এই অংশ বাইরে থেকে ফুটে উঠছিল ইত্যাদি। উপন্যাসে মেসেজ দিচ্ছেন এসব করা উচিৎ নয়, এগুলো পাপ, কিন্তু তার বর্ণনা দিচ্ছেন রগরগে উপায়ে তাহলে সেটা অশ্লীল হবে না কী কারণে? বাবা মায়েরা সেটা সন্তানদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে না কেন?
কাসেম বিনের উপন্যাস সম্পর্কে বিখ্যাত ইসলামী সাময়িকী ‘মাসিক মদিনা’র সম্পাদক আহমদ বদরুদ্দিন খান বলছেন- “উনার একটা উপন্যাস ‘বোরকা পড়া সেই মেয়েটি’। মেয়েটিকে বোরকা পড়িয়েছেন পাশাপাশি মেয়েটিকে তিনি এমন প্রেমে জড়িয়েছেন তার গল্পের মাধ্যমে সেটা ইসলামে অবৈধ। প্রেম নামে যে জিনিসটাকে ইসলামী মোড়কে তুলে আনছেন সেটা আপত্তিজনক। …এই বইটি একটু পড়ে মনে হয়েছে এটি রুচিসম্মত না।’’
কাসেম বিনের বই হয়তো অনেক বেশি বিক্রি হয়েছে, কিন্তু সাহিত্যের মানের দিক থেকে নীচের পর্যায়ে রয়েছে বলে তা পাঠকের মন জয় করে পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারেনি। তার কারণেই কিছুদিন আগেও তুমুল জনপ্রিয়তায় থাকা এই লেখককে অনেকেই চিনতে পারেনি প্রথমে।
তিনি কেন সফল
নাগরিক সুশীল লেখকেরা এমন একটা জগৎ নিয়ে লেখালেখি করেন যেখানে অনেক পাঠক খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। এই পাঠক সমাজটা বিশেষ করে গ্রামের দিকেই বেশি। তারা প্রথাগত উচ্চমআর্গীয় সাহিত্যমান সম্পন্ন লেখা হজম করতে পারেন না। এই দিকটাই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কাসেম বিন আবুবাকার। তিনি সরল গতির এমন গল্প তৈরি করলেন যেখানে বাংলা সিনেমা টাইপ নাটকীয়তা বিদ্যমান। যেমন নায়ক জুডো, কারাতে কুংফু ইত্যাদি জানে। নায়িকাকে গুণ্ডারা গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়। মাইরের সর্ব কৌশলে পারদর্শী নায়ক এসে গুণ্ডাদেরকে ঠেঙিয়ে প্যাঁদানি দিয়ে সাইজ করে নায়িকাকে উদ্ধার করে আনে। নায়িকা বেশ গরীব, নায়ক প্রচণ্ড বড়লোক ইত্যাদি। এ ধরনের নাটকীয়তার পাশাপাশি থাকবে প্রেমকাহিনী। এবং এই দুইয়ের মাঝে থাকবে একটি মেসেজ, অনৈসলামিক কাজ করা উচিৎ নয়। এই সরল রৈখিক উপন্যাস মানুষ গ্রহণ করে নিলো এবং লেখক হয়ে গেলেন সুপার হিট।
আবার তার বইয়ের নামগুলোও অনেক ক্যাচি (আকর্ষণীয়)। যেমন বইয়ের নাম যদি হয়- ‘ভুল করেছি আমি ছাত্রী জীবনে প্রেম করে’ তাহলে বইয়ের নাম থেকেই ভেতরের আগ্রহোদ্দীপক প্রসঙ্গ সম্পর্কে কিছু একটা ধারণা করতে পারে পাঠক। সেরকমই কাসেম বিনের এই নামের উপন্যাসগুলোও আবেদন তৈরি করতে পারে- ফুটন্ত গোলাপ, বিদেশী মেম, ক্রন্দসী পিয়া, প্রেমের পরশ, বিলম্বিত বাসর, প্রেম ও স্বপ্ন, তোমার প্রত্যাশায়, পাহাড়ী ললনা, অনন্ত প্রেম, শেষ উপহার, শহরের মেয়ে, বহু রুপিনী, অমর প্রেম, আমি তোমার, ধনীর দুলালী, আধুনিকা, প্রেম বেহেস্তের ফুল, একটি ভ্রমর পাচঁটি ফুল, পল্লী বালা, অবশেষে মিলন, ভালোবাসি তোমাকেই, বালিকার অভিমান, বাসর রাত, অলোকিক প্রেম, সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে, প্রেমের ফসল ইত্যাদি।
ভিন্ন দিক থেকে
ব্যক্তিগতভাবে একজন প্রবীণ বই বিক্রেতার সাথে যোগাযোগ করে কাসেম বিনের বইয়ের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি জানান- আগে কাসেমের বই প্রচুর চলতো, দুই দিন পর পর এক স্তূপ বই এনে মেঝেতে ফেলতেন আর হুড়মুড়িয়ে শেষ হয়ে যেতো। এখন হুমায়ুন আহমদে, জাফর ইকবাল, সেবা প্রকাশনী আর বাতিঘর প্রকাশনীর জন্য আলাদা আলাদা তাক আছে। কিন্তু তখন কাসেম বিনের বই তাকে রাখারও সুযোগ ছিল না। ঐ মেঝের স্তূপেই শেষ হয়ে যেতো। সেই যুগ এখন আর সেখানে নেই। কাসেম বিনের বই তেমন একটা পাওয়া যায় না।
তিনি আবার ভিন্ন একটি তথ্য জানান। তখনকার সময়ে মোবাইল, ফেসবুক, পত্রিকা ইত্যাদি ছিল না। ছেলে-মেয়েরা প্রেমে পড়তো, চিঠি চালাচালি করতো। কিন্তু চিঠি লিখতে গিয়ে বাধতো বিপত্তি। প্রিয়তমের জন্য মনের ভেতরে যে অনুভূতি কাজ করে ভাষায় সেটা আর বের করে আনতে পারে না। সবার তো আর ভেতরের কথা লিখে ফেলার ক্ষমতা থাকে না। সবাই তো আর লেখকদের মতো অনুভূতি প্রকাশে পারদর্শী নয়। কিন্তু প্রেমে মগ্ন মন চাইছে সে অনুভূতি বের হয়ে আসুক। তখন তারা আশ্রয় নেয় কাসেম বিনের বইয়ের লাইনে।
সেখানে যে ভাষায় নায়িকার (এবং নায়কের) বর্ণনা দেয়া হয়েছে, সেই ভাষা ব্যবহার করে কোনো মজনু তার প্রেয়সীকে প্রেমপত্র লিখলে সেই প্রেয়সী মুহূর্তের মাঝে গলে দ্রবীভূত হয়ে যেতে কোনো সময় লাগবে না। উদাহরণ দিচ্ছি-
“সাবিহা বাবুজীর কথা শুনে আনন্দে মোহিত হয়ে নিজেকে সামলাতে পারছে না… এবার হাত ছাড়ুন, পানি খাবেন বললেন। …কায়সার হাত না ছেড়ে গালে চেপে ধরে বলল, আপনার নরম হাতের ছোঁয়ায় ও আপনার মধুর কণ্ঠের কথা শুনে এবং সর্বোপরি আপনার রূপসুধা পান করে আমার পিয়াস মিটে গেছে। সত্যি, যিনি আপনার নাম রেখেছেন তিনি ধন্য। আপনার নামের অর্থ নিশ্চয়ই জানেন?
সাবিহা আরো বেশী লজ্জা পেয়ে কথা বলতে পারল না। কেঁপে উঠে না সূচক মাথা নাড়ল। কায়সার বলল, সাবিহা অর্থ সৌন্দর্যময়ী। আল্লাহ্ পাক সত্যি সত্যি আপনাকে সৌন্দর্যের রানী করে তৈরি করছেন। আপনার নাম সার্থক।
বাবুজীর কথা শুনতে শুনতে সাবিহা ক্রমশ লজ্জা বেশী পেয়ে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। কোন রকমে বলল, প্লীজ ছাড়ুন। বাবার নামাজ পড়া হয়তো এতক্ষণে শেষ হয়েছে, এবার এসে পড়বে। কায়সার তার দুটো হাতের তলায় চুমো খেয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, আল্লাহ্ তুমি আমার মনের বাসনা পূরণ করো।’’
আরেকটি দৃশ্য তুলে ধরছি। এটি ‘ফুটন্ত গোলাপ’ উপন্যাসের শুরুর দিকে বর্ণিত। নায়কের নাম সেলিম, নায়িকার নাম লাইলী। নায়িকা লাইব্রেরী থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বাংলা সিনেমা স্টাইলে ধাক্কা খেয়ে বসে নায়কের সাথে এবং অবশ্যই বই খাতা পড়ে যায় হাত থেকে। সেখানে লেখক বলছেন এভাবে-
“ইয়া আল্লাহ একি হল বলে লাইলী কি করবে ভেবে না পেরে সেলিমের দীর্ঘ বলিষ্ঠ স্বাস্থ্য ও পৌরুষদীপ্ত চেহারার দিকে লজ্জামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সব কিছু ভুলে গেল।”
“আর সেলিম তার দিকে চেয়ে খুব অবাক হল। এত রূপ যে কোনো মেয়ের থাকতে পারে, সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। লাইলীর টকটকে ফর্সা গোলগাল মুখটা শুধু দেখা যাচ্ছে। কারণ সে বোরখা পরে আছে।”
এখান থেকে সামান্য অনুমান করা যায় প্রেমে কাঙ্গাল কত যুবক যুবতীর সহায়ক হয়েছে কাসেম বিন আবুবাকারের এসব বই। লেখকের দাবী অনুসারে মেয়েরা তাকে নিজের গায়ের রক্ত দিয়েও চিঠি লিখেছে। তিনি বলেছেন মেয়েরা তাকে বিয়ে করার জন্য এখনো মরিয়া।
হঠাৎ বিদেশি মিডিয়ায় ফোকাসের কারণ কী
মানুষ তাকে ভুলে যেতে বসেছে। হুমায়ুন আহমেদের জয়জয়কার চারদিকে। ১৫ বছর আগেই তলানিতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। এমন অবস্থায় হুট করে কেন তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে গেল আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো? এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক ঠিকভাবে বলা এখনো সম্ভব নয়। তবে কিছুটা অনুমান করা যায়। সেসব দেশে বাংলাদেশের প্রতি একটি স্বভাবজাত নেতিবাচকতা বিদ্যমান। আর বর্তমানে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে জোরালোভাবে। সেসব দেশ জঙ্গিবাদের জন্য পুরোপুরিই ইসলামকে দায়ী করে। তাকে নিয়ে প্রতিবেদন করে হয়তো পরোক্ষভাবে এই বার্তা দিতে চাইছে যে, যে দেশে এত বড় সংখ্যক মানুষ বাম ধারার সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে ইসলামী ভাবধারার সাহিত্যকে গ্রহণ করে নিয়েছে, সেই দেশ জঙ্গি হবে না তো কী হবে?
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন কি খুবই মূল্যবান?
অনেকগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের মাঝে ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনটাই প্রধান। এখন ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনটা কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ? এবার একটু নড়েচড়ে বসুন। আমার ব্যক্তিগত উত্তর হচ্ছে- ‘না’। বাংলাদেশে কিছু কিছু ম্যাগাজিন বা কিছু পত্রিকা দেখবেন একটু নিচু শ্রেণীর পাঠকদেরকে টার্গেট করে সংবাদ প্রকাশ করে। ইচ্ছে করেই সেখানে মানসম্পন্ন সংবাদ দেয়া হয় না। তাদের ইচ্ছাতেই এমন ধাঁচের সংবাদ পরিবেশন করা হয় যেন ঐ ‘বিশেষ’ ধরনের পাঠকেরা এগুলো কিনে নেয়। কারণ ‘বিশেষ’ ধরনের পাঠকদের মানসম্পন্ন পত্রিকা-সাময়িকী কিনে পড়ার স্ট্যামিনা নেই। পত্রিকার মার্কেটে তারা একেবারেই আলাদা, আর এই আলাদাদের ধরতে হলে দরকার আলাদা ফ্লেভার। এরকম ফ্লেভারেরই ম্যাগাজিন হচ্ছে ডেইলি মেইল।
ব্যক্তিগত একটি উদাহরণ দেই। জ্যা-মারি লরেট নামে একজন লোক নিজেকে হিটলারের সন্তান বলে দাবী করেছিল, অবৈধ সন্তান। তার দাবীর পক্ষে বেশ কিছু প্রমাণও আছে। কিন্তু বিপক্ষেও প্রমাণ আছে। তার দাবী বলছে হিটলারের জারজ সন্তান ছিল আবার ডিএনএ টেস্ট বলছে হিটলারের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। অবস্থা এমন হয়েছে যে শতভাগ মেনেও নেয়া যায় না, আবার একেবারে ফেলেও দেয়া যায় না।
কোনো দায়িত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যম হলে দুই দিক আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতো আসলে সন্তান কিনা। কিন্তু ডেইলি মেইল করলো কি বিপক্ষের যুক্তিগুলোকে পুরোপুরি ফেলে দিয়ে পক্ষের যুক্তিগুলো রেখে একদম দৃঢ় গলায় দৃঢ় গলায় বলছে “হিটলারের জারজ সন্তান ছিল”।
সেজন্য বলছি ডেইলি মেইল যদি কোনো খবর প্রকাশ করে থাকে তাহলে সেটিকে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করার কিছু নেই। তাদের লক্ষ্য করা পাঠকগোষ্ঠী ঐ শ্রেণীরই।
তথ্যসূত্র
১. Islamic romance novels set hearts aflutter in Bangladesh, Daily Mail
২. একজন কাসেম বিন আবুবাকার ও হুজুগ, চিররঞ্জন সরকার, চ্যানেল আই অনলাইন
৩. আলোচনায় কাসেম বিন আবুবাকার, কালের কণ্ঠ
৪. কাসেম বিন আবুবাকারের এত পাঠক কীভাবে? বিবিসি বাংলা
৫. কেন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কাসেম বিন আবুবাকার? ভোরের পাতা
৬. bbc.com/bengali/news-39749051
৭. ইসলামী উপন্যাস লিখিনি, পকেটে আমার দশ টাকা এর বেশি খরচ কীভাবে করি – কাসেম বিন আবুবাকার, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৯ এপ্রিল, ২০১৭