গত ২ জুলাই রোর বাংলায় প্রকাশিত ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের প্রথম লেখাটিতে পাঠকগণ আরো অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন, যেমন- এই রেলওয়ে তে কতজন যাত্রী যাতায়াত করে, ভ্রমণ করতে কত সময় লাগবে, খরচ কেমন হবে, ভ্রমণ সুবিধা ইত্যাদি। তবে দুঃখজনকভাবে এই রেলওয়েতে প্রতি বছর কত মানুষ যাতায়াত করে তার কোনো সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই আজকের পর্বটি পরিসংখ্যান বাদ রেখে পৃথিবীর দীর্ঘতম এই রেলওয়েতে ভ্রমণের উপরই আলোকপাত করা হবে। আজ আর নির্মাণ বিষয়ক পরিসংখ্যান বা পেছনের ইতিহাসের ক্লিশে কোনো গল্প নয়, বরং আপনাদেরকে কিছু সময়ের জন্য ঘুরিয়ে আনবো মাস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টকে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের উপর দিয়ে।
পাসপোর্ট আর ভিসা
দেশের বাইরে ঘুরতে যেতে হলে পাসপোর্ট এবং ভিসা লাগবেই। পাসপোর্ট কিভাবে বানাতে হয় তা আমাদের সকলেরই মোটামুটি জানা। আর রাশিয়ান ভিসার জন্যও আপনি ট্রাভেলিং এজেন্সিগুলোর সাথে যোগাযোগ করলেই জানতে পারবেন। তবে যে বিষয়টি জানা দরকার সেটি হচ্ছে রাশিয়ান ভিসার মেয়াদ কতদিন হবে। আপনি যদি ট্রানজিট ভিসায় আবেদন করেন তাহলে সর্বোচ্চ ১০ দিন রাশিয়াতে থাকার অনুমতি পাবেন। তবে টুরিস্ট ভিসার আবেদন করলে ৩০ দিন সময় পাচ্ছেন। যদি তাতেও মনে হয় ভ্রমণপিপাসা মিটবে না, তাহলে বিজনেস ভিসার জন্য আবেদন করুন, অনেক বেশি সময় থাকতে পারবেন। এক্ষেত্রে খরচও কিন্তু বেশি হবে। যা হোক ভিসার ব্যাপারটা ট্রাভেল এজেন্সির হাতেই ছেড়ে দিয়ে আমরা বরং সামনে এগোই চলুন।
কোন রুটে যাবো
ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের রুট তিনটি হলেও মূল রুট হচ্ছে মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক পর্যন্ত। অপর রুট দুটি হলো মঙ্গোলিয়া হয়ে বেইজিং পর্যন্ত ট্রান্স মঙ্গোলিয়ান রুট এবং মাঞ্চুরিয়া হয়ে বেইজিং পর্যন্ত ট্রান্স মাঞ্চুরিয়ান রুট। তবে বেইজিং কর্তৃপক্ষ এই রেলওয়েতে রাশিয়ায় অবস্থিত চীনা নাগরিক ও আরো কিছু ইউরোপীয় দেশের নাগরিক ছাড়া অন্যান্য দেশের নাগরিকদের প্রবেশাধিকার বন্ধ রেখেছে। অতএব বাংলাদেশের মানুষকে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রুটে মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টকই যেতে হবে।
কখন যাবো
আপনার পছন্দের ঋতুকেই বেছে নিন দীর্ঘ এই রেল ভ্রমণে। শীতকালীন ভ্রমণে আপনি ট্রেনের জানালায় বসে তুষারপাতে মনোরম দৃশ্য দেখতে পারবেন। বাইরে গড় তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে কম হলেও ট্রেনের ভেতরে আপনার ভয় নেই। যথেষ্ট পরিমাণ তাপ আপনাকে সরবরাহ করা হবে। তবে ভ্রমণের জন্য গ্রীষ্মকালটাই ভাল হবে যদি ট্রেনের প্রতিটা স্টপেজে আপনি কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করতে চান। প্রচণ্ড শীতে জমে যাবার চেয়ে মৃদুমন্দ হাওয়ায় বৈকাল হ্রদের তীরে কিছুক্ষণ হাঁটাকেই বরং বেশি উপভোগ করতে পারবেন। সে হিসেবে মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসই হতে পারে ভ্রমণের জন্য সেরা সময়। অন্যদিকে নিরাপত্তার কথা মাথায় আনবার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়েতে আপনি পরিবার, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে যান কিংবা একা ভ্রমণে যান, রেলওয়ে পুলিশ আপনার সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
খরচ ও সময়
মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে সাতদিন। যদিও আপনি এ সময় দশটি ভিন্ন টাইম জোনের উপর দিয়ে যাবেন, ট্রেনের ভেতরে সময় হিসাব হবে রাশিয়ান সময়েই। অন্যদিকে মঙ্গোলিয়ান রুটে যদি বেইজিং যেতে চান তাহলেও সময় লাগবে সাতদিন। আর মাঞ্চুরিয়ান রুটে গেলে লাগবে ছয়দিন।
ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের উন্নত মানের সুযোগ সুবিধার বিপরীতে খরচ অত্যন্ত কম। সম্পূর্ণ ইলেকট্রিফাইড এবং ডাবল লাইনের এই রেলওয়েতে খরচ বিশ্বের যেকোনো উন্নত রেলওয়ের তুলনায় কম। মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক তৃতীয় শ্রেণীর কম্পার্টম্যান্টে যেতে খরচ হবে বাংলাদেশি টাকায় ২০ হাজার। দ্বিতীয় শ্রেণীর কম্পার্টম্যান্টে ভ্রমণের খরচ পড়বে ৫৫ হাজার টাকা। তবে আপনি যদি একটু বিলাসবহুল কম্পার্টম্যান্টে যেতে চান তাহলে আপনাকে খরচ করতে হবে ৮৫ হাজার টাকা। উভয় ক্ষেত্রেই পুরো সাতদিনের খাবার সহ অন্যান্য সকল খরচ এই টাকায়ই হয়ে যাবে। অন্যদিকে বেইজিং যেতে চাইলে মাঞ্চুরিয়া বা মঙ্গোলিয়া, যে রুটেই যান না কেন ২য় শ্রেণীর জন্য ৬০ হাজার এবং প্রথম শ্রেণীর জন্য ৯০ হাজার টাকা খরচ করতে হবে। ৫ বছরের কমবয়সী শিশুদের কোনো ভাড়া লাগবে না যদি আপনি আপনার বেড তার সাথে ভাগাভাগি করে নেন। তবে ভাড়া না লাগলেও শিশুর জন্য ‘ফ্রি’ টিকিট একটি থাকতেই হবে! অন্যদিকে ৫ থেকে ১০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে অর্ধেক ভাড়া ধার্য হবে।
তবে ‘সুলভ মূল্য’ শব্দ দুটি ভীষণ তেতো মনে হবে যখন আপনি গোল্ডেন ঈগল ট্রেনের টিকিটের মূল্য জানবেন। এই ট্রেনে সাতদিনের ভ্রমণে আপনাকে খরচ করতে হবে ১০ লক্ষ থেকে ২২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত!
উপরে উল্লেখিত উপাত্তগুলো হচ্ছে একটি সামগ্রিক ধারণা মাত্র। টিকেটের দাম অবস্থা এবং শর্ত সাপেক্ষে পরিবর্তনীয়।
মাঝপথে থামতে চান?
ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়েতে যে সকল ট্রেন সরাসরি মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক যায় সেসব ট্রেন আপনার জন্য মানানসই নয় যদি আপনি যাত্রাপথে কোনো স্থানে এক বা দুদিন সময় কাটাতে চান। অধিকাংশ দর্শনার্থীই ইরকুটস্কে একদিন কাটাতে চায় সেখানকার বৈকাল হ্রদ আর আমুর নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। বাস্তবিকভাবেই ট্রেনের ১০ মিনিটের যাত্রবিরতিতে আপনি বৈকালের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন না। কিন্তু ‘দ্য রোশিয়া’ বা ‘গোল্ডেন ঈগল’ কিন্তু আপনাকে একদিন থাকার সুযোগ দিচ্ছে না। এক্ষেত্রে আপনি যা করবেন তা হলো মস্কো থেকে লোকাল ‘রাশিয়ান মেইলে’ উঠে পড়া। এখান থেকে স্থানীয় ট্রেনে করে আপনি ইকাটারিনবার্গ, ওমাক ও নোভাসিবার্স্ক হয়ে পৌছে যাবেন ইরকুটস্ক। এবার সেখানে যে কদিন ইচ্ছে সেখানে থাকুন তারপর রোসিয়াতে চড়ে ভ্লাডিভস্টক চলে যান।
যা সাথে নেবেন
গ্রীষ্মকালে গেলে ইচ্ছেমতো কাপড়চোপড় নিয়ে নিন তবে শীতকালে একটু বুঝে-শুনে! কেননা যাত্রাপথে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও হতে পারে! ট্রেনের ভেতর আপনি উষ্ণ থাকলেও স্টপেজে ট্রেন থেকে নামতে হলেও আপনাকে শীতের কাপড় নিতে হবে। গ্লাভস, উষ্ণ হ্যাট এমনকি অন্তর্বাসও উষ্ণ হতে হবে যদি আপনি শীতকালে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আর সময় কাটাবার জন্য বই নেবার কথা বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই।
কিনে ফেলুন টিকিট
পাসপোর্ট, ভিসা, রুট, ট্রেন এবং পর্যাপ্ত টাকা, সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে কিনে ফেলুন ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের টিকিট। সর্বনিম্ন দামে যদি টিকিট কিনতে চান তাহলে রাশিয়া পৌছে স্টেশন থেকেই টিকিট কিনুন। আর ঘরে বসে অনলাইনে কিনতে চাইলে ট্রান্স সাইবেরিয়ান এক্সপ্রেস বা আরডিযে ওয়েবসাইটে ঘুরে আসুন। আর সব ঝামেলা এড়াতে চাইলে আরো একবার ট্রাভেল এজেন্সির কথা স্মরণ করুন। হোটেল বুকিং এর জন্য এই ওয়েবসাইটটি ঘুরে আসুন।
ট্রেনে চড়া যাক এবার
যেহেতু কেবল মস্কো-ভ্লাডিভস্টক রুট দিয়ে যাচ্ছি আমরা সেহেতু এই রুটের জনপ্রিয় ট্রেনের কথাই বলা যাক। মূলত ‘ফারমেনি’ বা ‘ফার্ম’ চিহ্নিত ট্রেনগুলো দ্রুতগামী, অধিক সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ। তাই ফারমেনি ট্রেনগুলোই অধিক জনপ্রিয়। এর মধ্যে ‘রোশিয়া’ প্রধান। তুলনামূলক কম খরচে ভাল ট্রেনে ভ্রমণ করতে হলে ‘রোশিয়া’র বিকল্প নেই। তাই গোল্ডেন ঈগল নয় আমরা রোশিয়া করেই ভ্লাডিভস্টক যাবো। ‘দ্য রোশিয়া’ প্রতি একদিন পরপর মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক এর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এই ট্রেনে থাকে ১ম শ্রেণীর দুই বার্থ বা শয়নকক্ষ বিশিষ্ট স্লিপার(রাতে ঘুমানোর জন্য ব্যবস্থা যা বসার সীটের মধ্যেই ভাঁজ করা থাকে), ২য় শ্রেণীর ৪বার্থ বিশিষ্ট ও ৩য় শ্রেণীর ২ বার্থ বিশিষ্ট স্লিপার এবং একটি রেস্টুরেন্ট স্লিপার। প্রতিটি কম্পার্টম্যান্টে আছে ফ্লাট স্ক্রিন টিভি, মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা এবং অতীব জরুরি ওয়াইফাই কানেকশন! ভ্রমণ করতে আর কী চাই বলুন?
টয়লেট এবং ওয়াশরুমগুলো ওয়েস্টার্ন ধাঁচের। গোসল করার জন্য শাওয়ার পাবেন কেবল ফার্স্ট ক্লাস বার্থে। তবে টাকা খরচ করে ব্যবস্থা করতে পারেন। ট্রেনের টয়লেট মানেই পাবলিক টয়লেট। আর অন্তত বাংলাদেশি মানুষের মনে পাবলিক টয়লেট এর কথা শুনলেই বীভৎস ছবি চোখে ভেসে ওঠে। এক্ষেত্রে সে ভয় নেই। বিশেষ করে আমরা চড়ছি ফারমেনি ট্রেনে। প্রতিবার ব্যবহারের পরই একজন ব্যক্তি এসে টয়লেট পরিষ্কার করে দেবেন যাকে বলা হয় ‘প্রোভোদনিক’ বা নারী হলে ‘প্রোভোদনিতসা’। তাই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে সংকোচ বোধ করার কোনো কারণ নেই!
বাংলাদেশীদের জন্য আরো একটি দুঃস্বপ্ন হচ্ছে ট্রেনের কালক্ষেপণ। এক্ষেত্রে সে ঝামেলা নেই। রোশিয়া একেবারে সঠিক সময়েই মস্কো স্টেশন ছেড়ে যাবে। ধূমপান সম্বন্ধেও কিছু বলা প্রয়োজন। আপনি ধূমপান পছন্দ করেন না? রোশিয়া আপনার জন্যই। কারণ যাত্রীদের কম্পার্টম্যান্ট এবং রেস্টুরেন্ট সম্পূর্ণ ধূমপান মুক্ত। তবে আপনি যদি ধূমপায়ী হন তবুও চিন্তা নেই। দুটি স্লিপারের সংযোগ স্থলে যে ছোট্ট কামরা রয়েছে সেখানে গিয়ে ধূমপান সেরে ফেলতে পারেন!
টিকিট কেনার সাথেই আপনি খাবারের খরচ চুকিয়ে ফেলেছেন। তাই খাবার নিয়ে ভাবনা নেই। খাবারের মান নিয়েও ভাবতে হবে না। রেস্টুরেন্টে রয়েছে অভিযোগ বাক্স যেখানে খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলে ট্রেন কর্তৃপক্ষ সেটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। তবে একটা বিষয়ে অভিযোগ করার অবকাশ নেই আর তা হচ্ছে মেন্যু ও পরিমাণ। আপনার পেট ভরুক বা না ভরুক খাবারের পরিমাণ এবং মেন্যু নির্দিষ্ট। ব্রেকফাস্টে ডিম ভাজি আর একটি হ্যামবার্গার। মধ্যাহ্ন ভোজে আর রাতের খাবারে পাবেন ভাজা/সেদ্ধ আলু আর ‘শ্নিটসল’। সাথে স্যুপ আর সালাদ। শ্নিটসল হচ্ছে এক প্রকার রাশিয়ান খাবার যা তৈরি হয় গরুর মাংস থেকে। তবে এর বাইরে যে খেতে পারবেন না এমন নয়। রেস্টুরেন্টে আছে বিয়ার, ভদকা, শ্যাম্পেন, চকলেট এবং নানান প্রকার স্ন্যাকস। তবে এসব খেতে হলে পকেট থেকে পয়সা খসাতে হবে। তাছাড়া প্রতি স্টেশনে ট্রেন থামলেও কিনে নিতে পারেন খাবার।
যাত্রা শুরু
এবার চলতে শুরু করেছে আমাদের ট্রেন ‘দ্য রোশিয়া’। আমরা এবার ‘দ্য গ্রেটেস্ট ট্রেন জার্নি অন আর্থ’ এর অংশ। মস্কো থেকে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। গড় গতি ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার। কখনোবা সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে ছুটছে রোশিয়া, আবার বিশাল বিশাল বাঁকে কমে যাচ্ছে গতি। জানালাটা খুলেই রাখা যাক। হলিউডের সবচেয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে নির্মিত ছবির ভিজ্যুয়াল সৌন্দর্যের চেয়ে কোন অংশে কম নয় জানালার বাইরের দৃশ্যগুলো! হ্যাঁ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়ার এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত একনজর দেখার এর চেয়ে ভাল উপায় হতেই পারে না। ঘন পাইন গাছের বন, কখনো আবার বার্চ গাছের সারি, এবড়োথেবড়ো তাইগা আর সাইবেরিয়ার পার্মাফ্রোস্ট, সবই চোখে পড়বে জানালা দিয়ে।
এই ভ্রমণের অন্যতম মজাদার একটি বিষয় ঘটতে শুরু করবে এবার। কারণ আমরা মস্কো শহরের শেষ মাথায় অবস্থিত কাজানের দিকে ছুটছি। এ সময় দেখা মিলবে অনেক এশীয় যাত্রীর বিশেষ করে চীনা আর জাপানি। ইউরোপীয় পর্যটকরা ডাকুক বা না ডাকুক, কোনো এশীয় পর্যটক যদি রেস্টুরেন্টে আপনাকে বিয়ারের আমন্ত্রণ জানায় তাহলে একদম ভড়কাবেন না যেন!
আমাদের ট্রেন এবার কাজান স্টেশনে থেমেছে। কাজান শহর, রাশিয়ার ৮ম জনবহুল শহর। এই শহরে অবস্থিত ‘কাজান ক্রেমলিন’ ঘুরে আসতে পারেন চাইলে। তবে আজ নয়, ট্রেন চলে যাবে যে! কাজান স্টেশনের অপরূপ নির্মাণশৈলী দেখেই আপনার মন ভরে যাবে। আর ট্রেন থেকে নেমেই পাবেন এক ঝাঁক হকার যাদের দেখে বাংলাদেশের স্টেশনগুলোর কথা মনে পড়বে নিশ্চয়ই। আরো অবাক হবেন যখন দেখবেন হকাররা মূলত ইসলামিক, খ্রিস্টীয় ছোট ছোট স্মারক গ্রন্থ বিক্রি করছে, যেরকম বই আমাদের দেশে বাসে ট্রেনে বিক্রি হয়!
কাজান ছেড়ে আবার ছুটছে আমাদের ট্রেন। মস্কো থেকে বেরিয়ে পড়েছি আমরা। পরবর্তী গন্তব্য ইয়েকাটেরিনবার্গ। আমি সেই শহরের কথা বলছি যেখানে জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে ১৯১৮ সালে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। আর তাদেরকে গানিনা ইয়ামা নামক স্থানে গণকবরে শায়িত করা হয়েছিল। স্থানটি এখন পবিত্র বিবেচিত হয়। তবে এই ঐতিহাসিক শহরটিও ঘুরে দেখার লোভ যে আজ সামলাতে হবে। কারণ আমাদের গন্তব্য ভ্লাডিভস্টক।
আরে এসব কী হচ্ছে! জানালার বাইরে নীল ফুলে ছেয়ে যাওয়া বিস্তৃত চারণভূমি গেল কোথায়? এতো দেখি পাইন গাছে ছাওয়া ছোট ছোট পাহাড় আর টিলা! তাহলে আর সন্দেহ নেই আমরা পৌছে গেছি ক্রাসনোয়ার্স্ক শহরে। বিশাল এক গীর্জার আদলে তৈরি স্টেশন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। স্টেশনের কাছেই অবস্থিত ‘স্টুলবাই নেচার রিজার্ভ’ থেকে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। তবে এবার আর তর সইছে না। আমরা চলেছি প্যারিসের দিকে! আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। আবার রাশিয়াতে প্যারিসও চলে আসেনি। তবে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ইরকুটস্ক যাকে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য ‘প্যারিস অব সাইবেরিয়া’ বলা হয়।
ইরকুটস্ক, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং নিও ক্লাসিক্যাল যুগের স্থাপত্যশৈলীর এক লীলাভূমি। এখানে আমরা রোশিয়া থেকে নেমে পড়বো। কারণ এই শহরে একদিন না কাটালে পুরো ভ্রমণটাই বৃথা যাবে। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। কারণ একদিন পরপরই রোশিয়া ট্রেন গুলো মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক এর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। চলুন তাহলে ইরকুটস্কে ঘুরে বেড়ানো যাক।
আরশান ও টুনকা ভ্যালী সম্ভবত শুধু ইরকুটস্কই নয়, পুরো পৃথিবীরই অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এস্থানটি ভ্রমণকারীদের জন্য পৃথিবীর মাঝে একখন্ড স্বর্গ। আর রোশিয়াতে ভ্রমণকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম বৈকাল হ্রদের সৌন্দর্য খুব কমই উপভোগ করা যেত। কিন্তু যেহেতু আমরা ইরকুটস্কে একদিন অতিবাহিত করছি, তাই সার্কাম-বৈকাল রেলওয়েতে স্থানীয় ট্রেনে ভ্রমণ না করলেই নয়। এরপর ইরকুটস্ক রিজিওনাল মিউজিয়াম ঘুরে আমরা চলে যাবো ‘মনুমেন্ট অব দ্যা ফাউন্ডার অব ইরকুটস্ক’ দেখতে। সেখান থেকে ‘স্কালপচার অব দ্যা বেবর’ এবং ‘ইরকুটস্ক রিজিওনাল মেমোরিয়াল’ ঘুরেই শেষ করবো আমাদের ইরকুটস্ক ভ্রমণ।
ইরকুটস্ক থেকে আবার ট্রেনে উঠা যাক। এখান থেকে বৈকালের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমুর নদী পেরিয়ে আমরা পৌছে যাবো আমাদের গন্তব্য ভ্লাডিভস্টকে।
ভ্লাডিভস্টক, আমরা পৌঁছে গেছি! রাশিয়ার অপর প্রান্তে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলের ছোট্ট নান্দনিক শহর এই ভ্লাডিভস্টক রাশিয়ার প্যাসিফিক নৌবহর ও সামরিক জাদুঘরের জন্য বিখ্যাত। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই শহরে বিদেশী পর্যটকদের প্রবেশ নিষেদ্ধ ছিল। তবে আমাদের সৌভাগ্য আমাদের সময়ে আর নিষেধাজ্ঞা নেই! দীর্ঘ সাতদিনের ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে ভ্রমণ শেষে এই শহরে কয়েকদিন কাটালে মন্দ হয় না। আর এই শহরে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক হতে পারে যে বিষয়টি তা হচ্ছে এখানকার মনোরম ‘সি-ফুড’। তাহলে আর দেরি কেন? উপভোগ করুন সি-ফুড আর ঘুরে দেখুন ভ্লাডিভস্টক।
ফিরবার পালা
মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক পর্যন্ত সাতদিনের ভ্রমণ এই ছোট্ট আর্টিকেলে আদতে লেখা সম্ভব নয়। সবিস্তারে লিখতে গেলে মহাকাব্যের আকার ধারণ করবে। অন্যদিকে লেখক নিজেও ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়েতে ভ্রমণ করেননি। তাই সুন্দর বর্ণনা সম্ভব হয়নি। তথাপি ইন্টারনেট থেক প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একেবারে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়েতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়েছে এতে। ফিরে আসবার সময় তাই সরাসরি নিয়ে আসলাম রোর বাংলায়। আপনিও ঘুরে আসতে পারেন ‘দ্য গ্রেটেস্ট রেলওয়ে অন আর্থ’ এ আর নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে লিখে ফেলতে পারেন চমৎকার ভ্রমণ কাহিনী।
Feature Image: trans-siberian-travel