শুরুটা না হয় একটি ছবি দিয়েই করা যাক। লেখাটি পড়ার চেষ্টা করুন। এবার লেখাটিকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেখুন। হুবহু একই রকম দেখা যাচ্ছে, তাই না?
চলুন আরেকটি ছবি দেখি।
এই ছবিটিকেও একইভাবে দেখার চেষ্টা করুন।
হ্যাঁ, এই লেখাগুলোর ধরণটাই এমন যে আপনি ১৮০ ডিগ্রি কোণে ঘুরিয়ে দেখলেও একইরকম লাগে। এ ধরনের লেখাকে অ্যাম্বিগ্রাম বলা হয়ে থাকে। ইংরেজি ‘Ambigram’ শব্দটি এসেছে দুটি ল্যাটিন শব্দ থেকে; একটি হলো ‘Ambi’ যার অর্থ উভয় এবং অপরটি হলো ‘Gram‘ যার অর্থ বর্ণ। তাহলে অ্যাম্বিগ্রাম এর অর্থ দাঁড়ায় ‘উভয় বর্ণ‘।
অ্যাম্বিগ্রাম হলো এমন এক ধরণের গ্রাফিক্যাল চিত্র বা লেখা যেটা শুধু একদিক থেকেই বানান করা যায় তা নয়, বরং আরেকটি দিক বা ভিন্ন অরিয়েন্টেশন থেকেও একইভাবে বানান করা যায়। ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে বোস্টনে বন্ধুদের সাথে এক আড্ডার সময়ে এই শব্দটি আসে ডগলাস আর. হফস্টাডারের মাথায়। পরে তিনি তার বইতে এটি প্রকাশ করেন।
কবে শুরু হলো এই অ্যাম্বিগ্রাম?
শুরুর কথা বলতে গেলে যেতে হবে ১৮৯৩ সালে পিটার নিউয়েল নামক এক আর্টিস্টের সময়ে। তিনি মূলত বাচ্চাদের বইয়ে এবং মার্ক টোয়াইন ও লুইস ক্যারোলের বইতে চিত্রাঙ্কন করে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি নিজের দুটি চিত্রণ সম্পর্কিত বই ছাপিয়েছিলেন, যেখানে তিনি ইনভার্টিবল বা উল্টানো চিত্রণের সমাহার ঘটিয়েছিলেন। তার বইয়ের চিত্রগুলো এমন ছিল যে, সেগুলোকে উল্টিয়ে দেখলে একেবারে অন্য রকমের আরেকটি চিত্র দেখা যায়।
নিউয়েলের ‘Topsys & Turvys’ নামক বইয়ের শেষ পাতায় ‘THE END’ লেখাটিকে উল্টালে ‘PUZZLE’ শব্দটি পড়া যাচ্ছিলো! ১৯০২ সালে তার দ্বিতীয় বই ‘Topsys & Turvys Number 2’ তে তিনি ‘THE END‘ এর একটি ভ্যারিয়েশন অ্যাম্বিগ্রাম আনেন যেটিকে উল্টালে ‘PUZZLE 2‘ দেখা যায়।
১৯০২ সালের পর টুকটাক এমন কাজ থাকলেও তা উল্লেখ করার মতো নয়।
১৯০৮ সালে দ্য স্ট্র্যান্ড নামক এক ম্যাগাজিনের জুন মাসের সংস্করণে কিউরিওসিটিস কলামে মিশেল টি. ল্যাভিন নামের এক ব্যক্তি ‘chump‘ শব্দটি এমনভাবে লেখেন যে, সেটিকে ১৮০ ডিগ্রিতে ঘুরালেও ‘chump‘-ই পড়া যায়। ল্যাভিন খুব জোর দিয়ে বলেন- এই ‘chump‘ শব্দটিই ইংরেজি ভাষার একমাত্র শব্দ যার এমন অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে!
সেই বছরেই ‘দ্য স্ট্র্যান্ড’ ম্যাগাজিনের আগস্ট সংস্করণে ‘honey‘ শব্দটি এমন হাতের লেখায় লেখা প্রকাশ করা হয় যে সেটিকেও উল্টালে একই রকম লাগে। নিউ জার্সির ভি কে অ্যালিসন নামক এক ব্যক্তি লেখাটি পাঠান এবং দাবি করেন তিনি সফলতার সাথে রিভার্সিবল নতুন একটি শব্দ আবিষ্কার করেছেন।
ল্যাভিন বা অ্যালিসন কেউই হয়তো জানতেন না ঐ ম্যাগাজিনের সেপ্টেম্বর সংস্করণে তাদের জন্য কী চমক অপেক্ষা করছে। সেপ্টেম্বর সংস্করণে বি. আর. ব্লিঘ নামক এক ব্যক্তি ‘W H Hills‘ এই নামটিকে এরকম রোটেশনাল শব্দ হিসেবে লিখেন এবং তিনিও দাবি করে বসেন এটাই একমাত্র নাম যেটির এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
এরপর ক্ল্যারেন্স উইলিয়ামস ‘BET‘ শব্দটির অ্যাম্বিগ্রাম করেন এবং ‘B‘ অক্ষরটির ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি আরো ৫টি রিভার্সিবল শব্দের উদাহরণ দেন; যেমন- bung, mow, pod, hoy ও dip।
এরপর ১৯৬৯ সালে রেমন্ড লোয়ি ‘NEW MAN’ কোম্পানির লোগো ডিজাইন করেন অ্যাম্বিগ্রামের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, যা এখনো ঐ কোম্পানির লোগো হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এবার আসি ১৯৭০ সালে। এ সময় একইসাথে জন ল্যাংডন এবং স্কট কিম নামক দুই ব্যক্তি অ্যাম্বিগ্রামকে জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছিলেন সবার কাছে।
৬৭ বছর বয়সী অ্যামেরিকান ল্যাংডন বলেন, “Ambigram is a word or sequence of words that conceal some kind of symmetry”। ক্ল্যাসিক অ্যাম্বিগ্রামে একটি শব্দকে উল্টালেও হুবহু একইরকম লাগে। জন ল্যাংডনের মতে অ্যাম্বিগ্রামের অনেক প্রকারভেদ হতে পারে। যদি এমন হয় যে একটি শব্দকে আপনি স্বাভাবিকভাবে যেমন দেখছেন, আয়নার প্রতিফলনেও তেমনটিই দেখছেন, সেটাও অ্যাম্বিগ্রাম হবে। কেননা অ্যাম্বিগ্রাম মানেই হলো সিমেট্রি বা প্রতিসাম্যতা। তার আঁকা প্রথম মিরর ইমেজ লোগো ‘Starship’।
একই সময়ে স্কট কিমও অনেকগুলো অ্যাম্বিগ্রাম করেন যেগুলো পরিচিতি পেয়েছিল মার্টিন গার্ডনার এবং ডগলাস হফস্টাডারের কাজের মাধ্যমে।
এরপর বিখ্যাত লেখক ড্যান ব্রাউন তার বাবা রিচার্ডের মাধ্যমে ল্যাংডনের কাজকে জানতে পারেন এবং তার বেস্টসেলার বই ‘Angels & Demons’-এ এবং এর মুভি রিলিজের পর তার ডিভিডিতে ‘This is an Ambigram’ নামে একটি অধ্যায় যুক্ত করেন। এছাড়া ল্যাংডন ড্যান ব্রাউনের বইয়ের কভারে ব্যবহারের জন্যেও অ্যাম্বিগ্রাম তৈরি করেছেন। ড্যান ব্রাউন তার কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তার উপন্যাসের নায়ক চরিত্রের নাম দেন রবার্ট ল্যাংডন।
এরপর বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই অ্যাম্বিগ্রাম এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার শুরু হয়। যেমন- মিউজিক অ্যালবামের কভার, বইয়ের কভারে ইত্যাদি। The Transformer মুভি সিরিজের লোগোতে একটি রোবটের মুখ দেখা যায়, যেটিও অ্যাম্বিগ্রামের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।আজকাল অনেক অ্যাপেরও দেখা মিলবে অ্যাম্বিগ্রাম তৈরির জন্য।
অ্যাম্বিগ্রামের নানা ধরণ
অ্যাম্বিগ্রামের অনেক ধরণ রয়েছে। এখন চলুন সেসব নিয়েই জানা যাক।
থ্রি-ডি অ্যাম্বিগ্রাম
এক্ষেত্রে এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ বা শব্দ দেখা যায়। জ্যামিতির ব্যবহার এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয়।
চেইন অ্যাম্বিগ্রাম
এক্ষেত্রে এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন এক বা একাধিক শব্দ পরস্পর যুক্ত হয়ে থাকে। সাধারণত বৃত্তাকার ডিজাইনে করা হয় চেইন অ্যাম্বিগ্রামে।
ফিগার-গ্রাউন্ড অ্যাম্বিগ্রাম
একটি শব্দের মাঝের ফাঁকা জায়গাগুলো আরেকটি শব্দের সৃষ্টি করে এ ক্ষেত্রে।
মিরর-ইমেজ অ্যাম্বিগ্রাম
একটি শব্দকে স্বাভাবিকভাবে যেমন দেখা যায়, আয়নার প্রতিবিম্বেও যখন তেমন দেখা যায়।
ন্যাচারাল অ্যাম্বিগ্রাম
একটি শব্দ যখন স্বাভাবিকভাবে লিখলেই অ্যাম্বিগ্রাম হয়ে যায়। যেমন- NOON, dip, SOON ইত্যাদি।
রোটেশনাল অ্যাম্বিগ্রাম
বিভিন্ন এঙ্গেলে রোটেট করেও যখন একই রকম দেখা যায়। সাধারণত ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে করা হলেও ৯০ ডিগ্রি বা ৪৫ ডিগ্রিও আঁকা যায়।
সিম্বায়োটোগ্রাম
একটি অ্যাম্বিগ্রামকে যখন রোটেট করা হয়, তখন যদি ভিন্ন একটি শব্দ পড়া যায়, তাহলে তাকে সিম্বায়োটোগ্রাম বলা হয়ে থাকে।
ওসিলিয়েশন অ্যাম্বিগ্রাম
এ ধরণের ডিজাইনে কোনো প্রতিসাম্যতা থাকে না, কিন্তু বর্ণগুলোর কার্ভ কীভাবে দেখছেন সেই অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন শব্দ দেখতে পারেন।
আপনিও হতে পারেন অ্যাম্বিগ্রাম ডিজাইনার!
চেষ্টা করলে আপনিও হতে পারেন অসাধারণ অ্যাম্বিগ্রাম ডিজাইনার। রোটেশনাল অ্যাম্বিগ্রাম দিয়েই শুরুটা করতে পারেন।
ধরুন আপনি ‘online’ শব্দটির অ্যাম্বিগ্রাম করতে চান।
ধাপ-১
চিত্রের মতো শব্দটিকে একবার সোজা করে, তার নিচে উল্টো করে শব্দটি লিখুন। o, n, l, i, e প্রতিটি অক্ষরকে কতভাবে লেখা যেতে পারে তা খুঁজে বের করুন।
ধাপ-২
এবার মিলিয়ে দিন উপর-নিচ বর্ণ দুটোকে। বেছে নিন আপনার পছন্দের স্টাইল!
ধাপ-৩
ডিজাইন করুন এবং স্কেচ করুন নিজের মতো করে।
ব্যস হয়ে গেলো ‘online‘-এর অ্যাম্বিগ্রাম। এভাবে আপনি আরো কিছু চেষ্টা করে দেখতে পারেন। করতে পারেন বাংলাতেও।
ক্যালিগ্রাফি জগতে এই অ্যাম্বিগ্রাম যুক্ত করেছে এক নতুন মাত্রা। আজকাল অনলাইনে অ্যাম্বিগ্রাম তৈরি করা যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখন অ্যাম্বিগ্রামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, অদূর ভবিষ্যতে আরো জনপ্রিয়তা পাবে এই অ্যাম্বিগ্রাম।