বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই প্রতিনিয়ত ছুটছে অর্থ উপার্জনের পেছনে। কেউ হয়তো শ্রম ও মেধা ব্যয় করে দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে, আর কেউ সুযোগ নিচ্ছে চতুরতার। কেউ অনেক পরিশ্রম করে বিপুল অঙ্কের মালিক হচ্ছে, বিপরীতে কেউ রাতারাতি সেই সম্পত্তি হাতিয়ে নিচ্ছে। নীতিগত দিক থেকে এই দুই শ্রেণী দ্বিমুখী হলেও উদ্দেশ্যগত দিক থেকে উভয়ই কিন্তু এক! কেননা, উভয়ের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন। আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে আমরা প্রত্যেকেই নিজের অজান্তে হয়ে যাচ্ছি পুঁজিবাদের দাস। লেখক শাহ্যাদ ফিরদাউসের উপন্যাস ‘শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার’ পাঠককে পুঁজিবাদের এই ভয়ঙ্কর আগ্রাসন সম্পর্কে ভাবাতে বাধ্য করেছে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে পাঠকের ঘুমন্ত সত্ত্বাকে দেখিয়েছে, কীভাবে আমরা হারাচ্ছি আমাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সিকান্দারের দরিদ্রতার গল্পের মাধ্যমে উপন্যাসের গতিপথের সূচনা হয়। ট্রেনে চড়ে বড়লোক বন্ধুর সাথে দেখা করবার জন্য সিকান্দারের যাত্রা, উদ্দেশ্য ছিল সাময়িক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন। যাত্রাপথে তার পরিচয় হয় শাইলক নামক এক ব্যবসায়ীর সাথে। যে প্রথম দেখাতেই সিকান্দারকে অতীত বিক্রি করে দিতে বলে। বিস্মিত সিকান্দার প্রথমে রাজি না হলেও সময়ের সাথে তার মত পরিবর্তন করে এবং একসময় বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে সে তার সমস্ত অতীত বিক্রি করে দিতে রাজি হয়। আর এরই মাধ্যমে উপন্যাসে গল্পের সমস্যার উপস্থাপনা শুরু হয়।
প্রথমদিকে সিকান্দার বেশ উৎফুল্লবোধ করে এবং রাতারাতি সিকান্দারের আচরণের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয়। দেয়াটা অস্বাভাবিক নয়, কেননা লটারি জিতেও কেউ এই পরিমাণ অর্থের মালিক হতে পারে না। একসময় সিকান্দার বাড়ি ফিরে যায় আর তখনই উপন্যাসে জটিলতার প্রবেশ ঘটে যায়। সিকান্দারের এই পরিবর্তন কারো চোখই এড়ায় না। ফলে পরিবারের মধ্যেও তৈরি হয় নানা ঘাত-প্রতিঘাত। ধীরে ধীরে সিকান্দার পৌঁছে যায় চরম সংকট মুহূর্তে এবং নানান নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।
উপাখ্যানে গল্পকে অবলম্বন করে সিকান্দারের মনোবিশ্লেষণই ছিল লেখক মুখ্য উদ্দেশ্য। উপন্যাসের ধরন ও বৈশিষ্ট্যের বিচারে সন্দেহাতীতভাবে ‘শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার’ একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। উপন্যাসের পরতে পরতে অর্থনৈতিক দশাকে পাশে রেখে সিকান্দারের মানসিক অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত সিকান্দার যেন সে সময় বাস্তব জীবনের প্রতিটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করছিল। যেমন, অতীত বিক্রি করা সিকান্দারের মানসিক অবস্থা ছিল এরকম – “টাকার বাণ্ডিল হাতে এলে সমস্ত দাসত্বই মধুর, মনোরম, উপভোগ্য!” অপ্রিয় হলেও একথা সত্য যে, দরিদ্রতার মাঝে বাস করা প্রতিটি মানুষই অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীনতার লোভে মানসিকভাবে দাসত্ব মেনে নিতে সদা প্রস্তুত। নিম্ন-মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকার আশায় অসহায় আত্মসমর্পণের যে আকাঙ্ক্ষা, লেখক তা তুলে এনেছেন অকপটেই।
পুঁজিবাদের প্রাপ্তি শুধুমাত্র অর্থ-সম্পদ নয়। মানুষের সমাজ, ভাষা, শিক্ষা সব কিছুকেই গ্রাস করে নেয় পুঁজিবাদের ভয়ানক থাবা। সমগ্র বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ শুধুমাত্র একটিই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর তা হলো কেনা-বেচার বাজারি সংস্কৃতি। লেখক তার উপন্যাসে বিভিন্ন যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। পাঠকের সুবিধার্থে উপন্যাসের একটি উক্তি এখানে তুলে ধরছি-
“বাজার তৈরি করা। বাজারি সংস্কৃতি তৈরি করা। বাজারি ঐতিহ্য তৈরি করা। বাজারি ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি সবই বাজারের আওতায় নিয়ে আসা। সবই পণ্যের মানে উন্নীত করা। যদি আপনি একবার পণ্যের মানে উন্নীত করতে পারেন, সে বস্তু বা বিষয় আপাতদৃষ্টিতে যতই বিমূর্ত হোক, বাজারে বিক্রি করা সম্ভব”।
পুঁজিবাদী সমাজে এখন প্রায় সবকিছুরই বাজারিকরণ চলছে। সমাজের চারপাশে একটু ভালোভাবে চোখ মেলে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায় নানা ধরনের চাটুকারের, যারা অর্থের বিনিময়ে স্বীয় অতীত ইতিহাসকেও পণ্য বানিয়ে বিক্রি করছে প্রতিনিয়ত। সে কারণে শাহ্যাদ ফিরদাউস তার চিন্তাধারায় সার্থক বলেই মনে হয়।
সমাজে চলমান শিক্ষাব্যবস্থাও যে পুঁজিবাদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায়নি, তা-ও উপন্যাসে উঠে এসেছে স্পষ্টভাবেই। সিকান্দারের সাথে এন্তোনিওর কথোপকথনের একটি অংশে এন্তোনিও প্রতিউত্তরে বলে, “যে বিদ্যা আয়ত্ত করলে ঘরে বসে ভাত আসে যে বিদ্যার বিনিময়ে অর্থ আসে সে বিদ্যা অবশ্যই একটা পণ্য”। এক্ষেত্রে লেখক পরোক্ষভাবে বর্তমান পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থাকে কটাক্ষ করেন, কেননা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় জ্ঞানকে শুধুমাত্র চাকরি লাভের উপায় হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। একইসাথে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের সফলতা পরিমাপ করা হয় তার চাকরিতে প্রাপ্ত মজুরির পরিমাণ বিবেচনা করে! তাই লেখকের কটাক্ষকে যথার্থই মনে হয়।
পুঁজিবাদের চাপে পিষ্ট নিম্নশ্রেণির মানুষের কথাও উঠে আসে উপাখ্যানটিতে। শ্রেণীবৈষম্যের ফলে দরিদ্ররা যে দিন দিন আরও দরিদ্র হয়ে উঠছে, একটি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে তা উপন্যাসে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৬৫ সালে পৃথিবীর মোট সম্পত্তির ৬৯.৫ শতাংশ ছিল মাত্র ২০ শতাংশ মানুষের দখলে, আর বাকি ৮০ শতাংশ মানুষের জন্য ছিল ৩০.৫ শতাংশ। পরবর্তীতে পুঁজিবাদের বিস্তারের সাথে সাথে পরিসংখ্যানেও পরিবর্তন এলো। তবে সেটা সাধারণ মানুষের পক্ষে যায়নি, গিয়েছে বিপক্ষেই। নব্বই দশকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সেই ২০ শতাংশ মানুষের সম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩.৪ শতাংশে, আর বাকি ৮০ শতাংশ মানুষের সম্পত্তির পরিমাণ কমে গিয়ে ঠেকেছে ১৬.৬ শতাংশে!
পুঁজিবাদের এই বিধ্বংসী আগ্রাসন ধীরে ধীরে সমাজের সবকিছুকে পণ্যে রূপান্তরিত করছে। ফলে এক প্রজন্মের অতীতের সাথে আরেক প্রজন্মের অতীতের মধ্যে দেখা দিচ্ছে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। একদল হয়তো দুরন্ত কৈশোরে খোলা মাঠে দাপিয়ে বেড়িয়েছে রাত-দিন। অন্যদিকে, আরেকদল এখন দিনরাত পুঁজিবাদের পণ্য কম্পিউটারের মধ্যে ডুবে থাকে সবটা সময়। মাঝে বিপদে পড়ে সিকান্দারের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষেরা। এ সংকট নিয়ে বইটির ফ্ল্যাপ ওল্টালে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। প্রকাশনীর পক্ষ থেকে সেখানে লেখা হয়েছে,
“…মানুষের স্মৃতির কারবারি শাইলক আর তার শিকার সিকান্দারের কাহিনীর আড়ালে শাহযাদ ফিরদাউস ঠিক এই সময়ের সমাজে ব্যক্তি মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে পুঁজির আগ্রাসনের গল্পই আমাদের শুনিয়েছেন এই অভিনব উপন্যাসে। স্মৃতি যে শুধু স্মৃতি নয়, ইতিহাস যে কেবল অর্থহীন ভাবালুতা নয়, অনুভুতির পণ্যায়নের এই যুগে খাঁচাবন্দী সিকান্দারের মতো আর অনেক চরিত্রের চূড়ান্ত অসহায়ত্ব আমাদের সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের চারিদিকেই তো বহুজাতিকের কাছে জাতীয় নিদর্শন, চিহ্ন আর প্রতীক বিক্রি করা, এক কথায় অতীত বিক্রি করা লাখো সিকান্দার তাদের ভবিষ্যতও শাইলকদের কাছে বন্ধক দিয়ে দিচ্ছে ঘটনার স্বাভাবিক পরম্পরায়! শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার তাই তড়িতাঘাতে পাঠকের হুঁশ ফিরিয়ে আনার মতো একটি উপন্যাস। এর পরিপ্রেক্ষিত কাল্পনিক, কিন্তু নির্যাস সত্যের মতো-ই তেতো।…”
লেখক পরিচিতি
বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন শক্তিমান লেখকের নাম শাহ্যাদ ফিরদাউস। ১৯৫০ সালে জন্ম নেয়া এ সাহিত্যিকের বিভিন্ন কবিতা প্রকাশিত হয়েছে দুই বাংলার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে। সিনেমার ব্যাপারে আগ্রহ দেখানোয় দীর্ঘ দিন বিরত ছিলেন সাহিত্য রচনা থেকে। নব্বই দশকে পুনরায় মনোযোগ দেন সাহিত্য রচনায়। এবং এখনও পর্যন্ত তার ১৪ টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। তার সাহিত্যকর্মের ওপরও বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়।
শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার উপন্যাসটি কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। বাংলাদেশ থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। বইটি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লেখক বলেন,
“তের-চৌদ্দ বছর আগে আমি এমন ভাবনা ভেবেছিলাম, সেই ভাবনা থেকেই উপন্যাসটি লিখেছিলাম। আমরা ভাবনা ভুল প্রমাণিত হলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হব। তার কারণ আমার সমস্ত জীবন জুড়ে আমি মানুষের, যথার্থ মানুষের সভ্যতা নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতেও তেমন স্বপ্নের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না। আপনার যদি তেমন মনে না হয়, আমার কথা ভুল বলে মনে হয় তাহলে দয়া করে প্রমাণ দিন। প্রমাণ করুন যে আমরা ডলারের স্বপ্ন দেখি না দেখছি না! নিজের বুকে হাত রেখে বলুন, আপন মুদ্রার জন্য, সামান্য কাগজের মুদ্রার জন্য আপনার মূল্যবান জীবন বাজি রাখেননি! যদি বলেন না, আমি মুদ্রার বিনিময়ে আমার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে অস্বীকার করি তাহলে এ কথা নিশ্চিত জেনে রাখুন, আপনার জন্যই শুধু আপনার জন্যই আমি ‘শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার’ লিখেছি। আর যদি সরলভাবে স্বীকার করেন যে কেবলমাত্র মুদ্রালাভের জন্যই আপনি জীবনপণ করেছেন; তাহলে বলব, আপনার বিপুল সম্ভাবনাময় মানব জীবনের ভয়াবহ পরিণতিকে কেন্দ্র করেই আমি আপনার মর্মান্তিক ‘জীবনী’ রচনা করতে বাধ্য হয়েছি; আপনার জীবনীর নাম শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার”।
ফিচার ইমেজ: ভেক্টরফ্রী.কম
তথ্যসূত্র: শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার, লেখক: শাহ্যাদ ফিরদাউস, প্রকাশ: ২০১১