ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নিয়মিত সাক্ষাত হলেও ইউরোপের মঞ্চে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এই প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হচ্ছে লিভারপুল ও ম্যানচেস্টার সিটি, চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে। স্বভাবতই এই ম্যাচটি ঘিরে রয়েছে প্রবল আগ্রহ ও উত্তেজনা। তাছাড়া সাম্প্রতিক কালে দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের মিশ্র ফলাফল ম্যাচটিকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। শেষ ৩ ম্যাচে লিভারপুল ও ম্যানচেস্টার সিটির স্কোর সমান; একটি করে জয় এবং ড্র। গত মৌসুমের মার্চে ১-১ গোলে ড্র করে লিভারপুলের সাথে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিতে বাধ্য হয় সিটি।
এই মৌসুমে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এতিহাদে নিজেদের মাঠে লিভারপুলকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দেয় দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সিটি। সিটির সাথে বিশাল এই পরাজয়ের পর ঘরের মাঠেই ঘুরে দাঁড়ায় লিভারপুল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্সেসাইডে সিটিকে অসাধারণ এক ম্যাচে পরাজিত করে লিভারপুল, যা এই মৌসুমে লিগে সিটির একমাত্র পরাজয়। সবদিক থেকে ৪-৩ ফলাফলের এই ম্যাচটি ছিলো দুর্দান্ত এক ক্লাসিক, ম্যাচের ৬৭ মিনিট পর্যন্ত ৪-১ এ স্বাগতিক দল এগিয়ে থাকলেও শেষের দিকে সিটির ঘুরের দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা ম্যাচটিকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়।
ইউরোপের মঞ্চে ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার বিবেচনায় আসন্ন ম্যাচে অবশ্যই এগিয়ে থাকবে লিভারপুল। এখন পর্যন্ত ৫টি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপাজয়ী রেডরা মুখোমুখি হবে একটিও চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা না জেতা সিটির বিপক্ষে। অবশ্য ২০০৫ সালে লিভারপুলের সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জয়ের পর পার হয়ে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়। ম্যাচটি ৯ বছরের মধ্যে ইউরোপিয়ান কাপে লিভারপুলের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনাল। সিটির ইতিহাসে এটি দ্বিতীয়। উয়েফার প্রতিযোগিতায় এখন পর্যন্ত ১৭ বার ইংলিশ ক্লাবগুলো নিজেদের মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে লিভারপুল খেলেছে ৯টি ম্যাচ।
লিভারপুলের ৯টি ম্যাচের ৫টিই ছিলো চ্যাম্পিয়নস লিগের নক আউট পর্বে। কিন্তু লিগে এই মৌসুমে ফর্মের বিচারে ম্যানচেস্টার সিটি এগিয়ে আছে বিশাল ব্যবধানে, ৩১ ম্যাচে ২৭টি জয়, ৩টি ড্র এবং মাত্র ১টি হার নিয়ে লিগ টেবিলের শীর্ষে গার্দিওলার শিষ্যরা। অন্যদিকে লিভারপুল রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে, ৩২ ম্যাচ খেলে তারা জিতেছে ১৯টিতে, ড্র ৯টিতে ও পরাজয় ৪টি ম্যাচে। পরবর্তী ম্যাচে ম্যানচেস্টার ডার্বিতে মুখোমুখি হবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সিটি ও ইউনাইটেড। এই ম্যাচটি জিতলেই লিগ শিরোপা নিশ্চিত করবে ব্লুরা। সবকিছুর বিবেচনায় গার্দিওলার দল এগিয়ে রয়েছে কোনো সন্দেহ ছাড়াই, খেলাটা যখন লিভারপুলের মাঠে তখন অপেক্ষা করছে আরেকটি আকর্ষণীয় ম্যাচ। আরও আলোচনার পূর্বে চলুন সংক্ষেপে জেনে নেই ইউরোপিয়ান কাপে দুই দলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড।
লিভারপুল
- ইউরোপিয়ান কাপের ১৩টি কোয়ার্টার ফাইনালের মধ্যে ৯টিতে জয় পেয়েছে লিভারপুল। সর্বশেষ ম্যাচটিতে ২০০৭/০৮ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কোয়ার্টার ফাইনালে চেলসির বিপক্ষে দুই লেগ মিলিয়ে হেরেছে ৫-৭ গোলে।
- চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নক আউট পর্বে ঘরোয়া প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ৫ বারের মধ্যে ৩ বার জয় পেয়েছে লিভারপুল।
- ইউরোপের সবগুলো প্রতিযোগিতায় ইংলিশ ক্লাবগুলোর বিপক্ষে লিভারপুলের ৫টি জয় ও পরাজয় এবং ড্র ৮টি। ঘরের মাঠে লিভারপুলের রেকর্ড অবশ্য ইতিবাচক, নিজেদের মাঠে তারা হেরেছে মাত্র ১টি ম্যাচ।
- এই মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের মাঠ অ্যানফিল্ডে অপরাজিত রয়েছে ক্লপের লিভারপুল। রাউন্ড ১৬’তে মার্সেসাইডে পোর্তোর বিপক্ষে লিভারপুলের ৫-০ গোলের জয় এই ম্যাচে প্রেরণা যোগাবে।
- অ্যানফিল্ডে সেভিয়ার বিপক্ষে ড্রয়ের পূর্বে ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় ঘরের মাঠে শেষ ৬টি ম্যাচেই জিতেছে লিভারপুল। ২০১৪ সালের অক্টোবরে রিয়াল মাদ্রিদের সাথে ০-৩ গোলে পরাজয়ের পর এখন পর্যন্ত ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় নিজেদের মাঠে অপরাজিত রয়েছে লিভারপুল।
ম্যানচেস্টার সিটি
- ইউরোপে ইংলিশ ক্লাবের বিপক্ষে প্রথম কোয়ার্টার ফাইনাল দলটির। ২০১৫-১৬ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে পিএসজির বিপক্ষে ৩-২ গোলের (বিদেশে ২-২, দেশে ১-০) জয় পেয়েছিল সিটি।
- ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় সিটি প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল ১৯৭০-৭১ সালে ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপের সেমিফাইনালে। চেলসির বিপক্ষে দুই লেগেই পরাজিত হয়েছিলো তারা।
- রাউন্ড ১৬’তে এফসি বাসেলের মাঠে ৪-০ গোলের জয় পেলেও পরবর্তী লেগে এতিহাদে ১-২ গোলে পরাজিত হয় সিটি।
- প্রতিপক্ষের মাঠে ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় সিটির রেকর্ড তেমন ভালো নয়। প্রতিপক্ষের মাঠে শেষ ১১টি ম্যাচের ৪টিতে হেরেছে এবং ৩টি ড্র। বার্সেলোনার সাথে ০-৪ গোলের ম্যাচটি ইউরোপে তাদের সবচেয়ে বড় ব্যবধানের পরাজয়।
ক্লপ ও গার্দিওলার মুখোমুখি লড়াই এই প্রথম নয়, দুইজনই ছিলেন বুন্দেসলিগার সেরা দুইটি দলের ম্যানেজার। বুন্দেসলিগায় থাকাকালীন একে অপরের মুখোমুখি হয়েছেন ৮ বার, লড়াই হয়েছে প্রায় সমানে সমানে। ক্লপ জিতেছেন ৩টি ম্যাচ এবং গার্দিওলা ৪টি জয় নিয়ে এগিয়ে রয়েছেন পরিসংখ্যানে। ফুটবলে রেকর্ড ও ইতিহাস অনেক কিছু, আবার বলতে গেলে কিছুই না।
বুন্দেসলিগা থেকে প্রথমে গার্দিওলা পাড়ি জমিয়েছে ইংল্যান্ডে। পরে ডর্টমুন্ডের দায়িত্ব ছেড়ে লিভারপুলের ম্যানেজার হয়েছেন ক্লপ। যা-ই হোক, ক্লপ মনে করেন যে, চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে তার দলের বিপক্ষে গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি এগিয়ে রয়েছে। সেই সাথে ক্লপ অবশ্য আত্মবিশ্বাসী যে, তারা প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে এবং মনে রাখার মতো একটি কোয়ার্টার ফাইনাল দর্শকদের উপহার দিতে পারবেন।
ক্লপ তার স্বভাবজাত ‘হাই প্রেসিং অ্যাটাকিং’ ভঙ্গিতেই খেলতে মুখিয়ে রয়েছেন, যা গার্দিওলার দলকে বেশ সমস্যায় ফেলতে পারে। ক্লপের মূল ভরসা হলো তার তিন ফরোয়ার্ড- মানে, ফিরমিনো ও সালাহ। ম্যাচের পরিকল্পনা সম্বন্ধে ক্লপ বলেন,
“আমরা যেভাবে আক্রমণ করি, যে পদ্ধতিতে রক্ষণ সামলাই তা প্রতিপক্ষের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। আমরা যদি তা ভালোভাবে করতে পারি তাহলে তাদের জন্য বেশ কঠিন হবে।”
ক্লপ সেই সাথে আরও যোগ করেন,
“এটা খুবই উত্তেজনার। এই কৌশল যে কাজ করবেই তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সবশেষে মাঠের খেলোয়াড়রাই গড়ে দিবে ম্যাচের ভাগ্য।”
এই মৌসুমে সালাহ রয়েছেন তার সেরা ফর্মে। ২৯ গোল নিয়ে প্রিমিয়ার লিগের সেরা গোলদাতা এখন এই ‘কিং অব দ্য ইজিপ্ট’, সেই সাথে রয়েছে ৯ এসিস্ট। ফিরমিনো ও মানেও রয়েছেন দারুণ ফর্মে, লিগে দুইজনের গোল যথাক্রমে ১৪ ও ৯। চ্যাম্পিয়নস লিগেও এই তিনজন দেখিয়েছেন অসাধারণ পার্ফরম্যান্স। লিভারপুলের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে এই মৌসুমে ফিরমিনো ৭ গোল করে রয়েছেন তালিকার তৃতীয় অবস্থানে, সেই সাথে এই ব্রাজিলিয়ানের রয়েছে ৪টি অ্যাসিস্টও। মানে ও সালাহ দুইজনেই এই প্রতিযোগিতায় লিভারপুলের হয়ে গোল করেছেন ৬টি করে। লিভারপুলের আক্রমণ সামলাতে যে গার্দিওলার ভুগতে হবে তা বলাই বাহুল্য।
গার্দিওলাও মানছেন যে, লিভারপুলের আক্রমণভাগ ভয়ংকর এবং তা ‘প্রায় অপ্রতিরোধ্য’। গার্দিওলা জানিয়েছেন যে, অসাধারণ ফর্মে থাকা সালাহ ও লিভারপুলের আক্রমণভাগকে থামানোর জন্যে তার বিশেষ পরিকল্পনা করতে হবে। গার্দিওলা তার পরিকল্পনায় সালাহকে আলাদা ভাবে রাখলেও ফিরমিনো ও মানের কথাও ভাবছেন বিশেষ ভাবে। লিভারপুলের আক্রমণভাগ নিয়ে গার্দিওলা বলেন,
“শুধু সেই নয় (সালাহ), মানে, ফিরমিনো- এই তিনজন প্রায় অপ্রতিরোধ্য। তারা অসাধারণ, চমৎকার খেলোয়াড়। যেভাবে লিভারপুল খেলে তা আমাদের জন্য বেশ জটিল। আমরা তা জানি। তারা খুবই দ্রুত গতিসম্পন্ন।”
প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা সম্বন্ধে স্বীকার করে নিলেও গার্দিওলা জানিয়ে রাখেন যে, চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের মতো ম্যাচে কোনো কিছু সহজ হবে না, এই ব্যাপারে তারা অবগত। তাই সেভাবেই তার দল প্রস্তুত।
তবে লিভারপুলের মিডফিল্ডের তুলনায় গার্দিওলার মিডফিল্ডের খেলোয়াড়দের পার্ফরম্যান্স খুবই শক্তিশালী। সানে, কেডিবি, স্টার্লিং, সিলভাদের নিয়ে গড়া সিটির মধ্যভাগ গোটা মৌসুম জুড়ে অসাধারণ পার্ফরম্যান্স করে চলেছে। প্রিমিয়ার লিগে চলতি মৌসুমে সিটির মূল শক্তি বলতে গেলে অসাধারণ মিডফিল্ড। প্রিমিয়ার লিগের অ্যাসিস্টের তালিকায় তাকালেই বোঝা যায় সিটি মিডফিল্ডাররা খেলার নিয়ন্ত্রণ কতটা নিয়ন্ত্রণ করে। কেডিবি (১৫), সানে (১) ও সিলভা (১১)- লিগের শীর্ষ ৩ অ্যাসিস্ট করা খেলোয়াড় সিটির। তাছাড়া আক্রমণে রয়েছে আগুয়েরো ও গ্যাব্রিয়েল হেসুস।
২১ গোল নিয়ে লিগ তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা আগুয়েরো ইউসিএলে গোল করেছে ৪টি। একই সংখ্যক গোল করে দলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সাবেক লিভারপুলের খেলোয়াড় স্টার্লিং। স্টার্লিং এর কথা আলাদা করে বলতে হয়। লিভারপুল ছেড়ে সিটিতে যোগ দেওয়ার পর গার্দিওলার অধীনে নিজেকে যেন নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন তিনি, এই মৌসুমে লিগে ১৬ গোলই তার প্রমাণ।
আক্রমণাত্মক লিভারপুলের বিপক্ষে গার্দিওলা সম্ভবত ড্রয়ের জন্যই নামবেন, তবে ফলাফল নিয়ে ম্যাচের আগেই চিন্তিত নন গার্দিওলা। লিভারপুলকে ৫-০ গোলে পরাজিত করা কিংবা লিভারপুলের সাথে ৪-৩ গোলে পরাজিত হওয়া গার্দিওলা সেরা ফলাফলের ব্যাপারে বলেন,
“আমি কখনোই এমন একজন ম্যানেজার ছিলাম না যে কিনা চিন্তা করে সেরা ফলাফল কি হতে পারে? আমার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হলো পার্ফরম্যান্স। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনি কী করছেন তার প্রভাবই হলো ফলাফল।”
২০১১ সালের পর এই প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগে ‘অল ইংলিশ’ ক্লাবের লড়াই দেখার জন্যে মুখিয়ে আছে গোটা ফুটবল বিশ্ব। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অসাধারণ ফুটবল উপহার দেওয়া ক্লপের লিভারপুল ও গার্দিওলার সিটির মুখোমুখি লড়াইয়ে হয়তো দেখা মিলবে আরেকটি দুর্দান্ত ও মনে রাখার মতো ক্লাসিক ম্যাচ।
ফিচার ইমেজ- liverpoolecho