২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। বড়দিনের কাছাকাছি সময়ের কথা। স্বজনদের সাথে বড়দিন পালন করতে আসা লোকদের জমজমাট ভিড় লিমার এয়ারপোর্টে। প্লেনের নাম ল্যানসা-১৮৮৮এ ইলেক্ট্রা। আরও অনেক যাত্রীর সাথে প্লেনে চরেছেন জুলিয়ান কোপেক ও তার মা মারিয়া কোপেক। তাদের গন্তব্য পিউক্যালাপ্পা, আমাজন নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা পেরুর একটি জনাকীর্ণ শহর।
লিমা থেকে পিউক্যালাপ্পা যেতে আকাশপথে সময় লাগে এক ঘণ্টা। কিন্তু জুলিয়ান ও তার মা যেখানে যাচ্ছেন তা পিউক্যালাপ্পা থেকেও কয়েকশো মাইল ভিতরে। পেরুভিয়ান রেইনফরেস্টের গহীনে অবস্থিত একটি বাড়িতে। নাম হেমবল্ট হাউস, যা প্রাণীবিদদের গবেষণাগার বা মিলনস্থল বলে পরিচিত ছিল।
এক ঘণ্টার সফরের প্রথম আধা ঘণ্টা নির্বিঘ্নেই কাটলো সবার। যাত্রীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ ও অনেকদিন পর পরিবারকে দেখার চাপা উত্তেজনা। স্যান্ডউইচ ও ড্রিংকসের স্বল্প বিরতির পর সবাই যার যার মতো সিটে জায়গা করে নিয়েছে। জুলিয়ান এবং তাঁর মা বসেছেন একেবারে শেষের দিকে, বামপাশের দুটি সিটে। সদ্য গ্র্যাজুয়েট, ১৭ বছরের কিশোরী জুলিয়ান বরাবরের মতোই বেছে নিয়েছে জানালার পাশের সিটটি।
হঠাৎ পুরো প্লেনটি অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। আর চারদিকে বাতাসের ভয়াবহ গর্জন। জুলিয়ান যেন দেখতে পেলেন প্লেনের ডানদিক থেকে অন্ধ করে দেয়ার মতো তীব্র আলো জ্বললো কয়েকবার। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে প্লেনটি।
কোনো দানবীয় শক্তি যেন প্লেনটি ধরে ঝাঁকাচ্ছে! যাত্রীরা সবাই চিৎকার করছে, তাদের বড়দিনের গিফটে ঠাঁসা ব্যাগগুলো, খেলনা, খাবার সব মালপত্র তাদের মাথায় ভেঙ্গে পড়ছে। জুলিয়ান শুনলেন তাঁর মা মারিয়া বলছেন, “এখন সব শেষ”।
ঐদিন আসলেই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল ঐ প্লেনে থাকা ৯১জন মানুষের জন্য। ৬ জন ক্রুসহ ৮৬ জন যাত্রী ছিলেন প্লেনটিতে। ৮৬ জনের যাত্রীর মধ্যে ৮৫ জনই মৃত্যুবরণ করেন, বেঁচে থাকেন শুধু জুলিয়ান কোপেক।
কীভাবে? তা তিনি নিজেও জানেন না। প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যেও পাইলট প্লেন থামানোর চিন্তা করলেন না, সোজা গিয়ে ঢুকে পড়লেন কালো মেঘে ঢাকা ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে। প্লেন ক্র্যাশের কুখ্যাত রেকর্ড আছে ল্যানসা বিমানের। এটি ল্যানসার সর্বশেষ বিমান ছিল। বিভিন্ন বিমানের ভাঙা অংশ জোড়াতালি দিয়ে বানানো হয়েছিল এটি। এই ধরনের প্লেন শুধু মরু অঞ্চলে ব্যবহৃত হয় এবং আমেরিকায় এর চলাচল অনেক আগেই নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
স্বাভাবিকভাবেই বজ্রাঘাতে মাঝ-আকাশেই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল বিমানটি। বিমান ভাঙ্গার এই পুরো সময়টি কীভাবে কেটেছে তা বলতে পারেন না জুলিয়ান। হয়তো জ্ঞান হারিয়েছেন কয়েকবার। তিনি শুধু মনে করতে পারেন তীব্র বাতাসের স্রোত। মাটি থেকে ১০ হাজার ফুট উপর থেকে তিনি দ্রুত নিচের দিকে নামছেন। বাতাসে কানে তালা লেগে গেছে, চোখ খুলে রাখতে পারছেন না। খেয়াল হল তিনি সেঁটে আছেন তাঁর প্লেনের সিটের সাথে। কিন্তু সাথে তো তাঁর মা এবং আরেকজন ছিলেন! তাদের আর খোঁজ পেলেন না জুলিয়ান।
প্রায় দশ মিনিট ধরে আকাশে রইলেন জুলিয়ান। যতই নিচে নামেন চোখে পড়ে সবুজ গাছ, ঠিক যেন ব্রকলির মতো! আরও কাছে আসতে থাকে গাছগুলো, তারপর সব অন্ধকার।
জুলিয়ান কোপেকের বাবা-মা দুজনই পেরুর বিখ্যাত প্রাণী বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর মা মারিয়া কোপেক ছিলেন প্রখ্যাত পাখিবিদ এবং বাবা হ্যানস উইলহেম কোপেক প্রাণীদের জীবনপ্রণালী নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জুলিয়ানের বাবার পক্ষে তার জন্মস্থান জার্মানিতে কাজ করা কষ্টসাপেক্ষ হয়ে পড়ে। তাছাড়া জীববিজ্ঞান নিয়ে হাতে-কলমে গবেষণা করতে চাইতেন তিনি। তাই পেরুর রেইনফরেস্টকেই বেছে নেন তার কর্মস্থল হিসেবে। সঙ্গী হন তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী মারিয়া কোপেক। পেরুর পিউক্যালপ্পাতে কিছুকাল থাকার পর ১৯৫৪ সালে জন্ম হয় জুলিয়ানের।
মারিয়া ও উইলহেম কোপেক প্রায় সবসময়ই তাদের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এবং নতুন প্রজাতি খোঁজার অভিযানগুলোতে সঙ্গে নিতেন ছোট জুলিয়ানকে। জুলিয়ান সব সময় বলেন, “আমার বাবা-মা এবং প্রকৃতিই আমার শিক্ষক”।
তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৯৬৮ সালে পেরুতে তাঁরা স্থাপন করেন পেরুভিয়ান রেইনফরেস্ট ও বায়োলজিক্যাল রিসার্চ সেন্টার। উন্নততর গবেষণা ও রেইনফরেস্ট রক্ষার জন্য ১৯৬৮ সালের ৯ জুলাই সপরিবারে তারা পেরুভিয়ান রেইনফরেস্টে পাড়ি জমান। রিসার্চ সেন্টারটির নাম দেন পেঙ্গুয়ানা।
“অনেকের কাছে জঙ্গলে থাকা অনেক কষ্টসাধ্য ও অস্বস্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে এটি রিসার্চের জন্য সাময়িক ‘ছুটি’ ছিল মাত্র”, বলেন জুলিয়ান। ঠিক করা ছিল, নতুন প্রাণের সন্ধান ও বিলুপ্ত প্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি যাবতীয় কাজ করতে তাঁদেরকে ৫ বছর এই রেইনফরেস্টে থাকতে হবে।
তবে তারা পুরোপুরি একা ছিলেন না। জায়গাটি প্রাণীবিদদের বেশ পরিচিত হওয়ায় তাদের মতো অভিযানকারীরা প্রায়ই এখানে আসতেন। তাছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারাও এই ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেন।
জীববিদ বাবা-মায়ের সুবাদে জন্মের পর থেকেই প্রকৃতির সাথে বড় হয় জুলিয়ান। ১৪ বছর বয়সে পেরুর শহুরে জীবন ত্যাগ করে, একরাশ উচ্ছ্বাস আনন্দ নিয়েই জঙ্গলে আসেন তিনি। স্কুলের বন্ধুদের মাধ্যমে আবার স্কুলের পড়াশোনাও এগিয়ে রাখতেন। বাবা উইলহেম ছিলেন অঙ্কে পাকা। অবসরে তার কাছে অঙ্ক শিখতেন জুলিয়ান। অবসরে বই ছিল সঙ্গী, তাই পড়ার যোগ্য যাই পেতেন পড়ে ফেলতেন।
সবচেয়ে বেশি শিখেছেন প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার কলাকৌশল, যা কোনো বই দ্বারা শেখানো যায় না। জঙ্গলে ৩ বছর কাটিয়েছেন জুলিয়ান। হাতে-কলমে শিখেছেন জঙ্গলের নিয়ম। ১৯৭০ সালে শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশে তাকে পেরু ফিরে যেতে হয় বাবা-মাকে পিছনে ফেলে। অন্যথা ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে পারবেন না জুলিয়ান।
যখন জুলিয়ান চোখ খুললেন, তখন তার সব চেতনা লোপ পেয়েছে। তীব্র সবুজাভ আলোর ফিনকি দেখতে পেলেন শুধু। আস্তে আস্তে মনে পড়ল প্লেন ক্র্যাশের শিকার হয়েছেন তিনি। কয়েকবার উঠতে চেষ্টা করেও পারলেন না।
হাতের সোনালি ঘড়িটা তখনও কাজ করছে। সকাল ৯টা বাজে। ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১। তিনি বুঝলেন, তার বাঁ চোখ ফুলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার অপছন্দের চশমাটাও চোখে নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি একই জায়গায় থাকলেন।
নিজের সিটটির চারদিকে চক্কর দিতে থাকেন জুলিয়ান। ধীরে ধীরে বোঝার চেষ্টা করেন কী হয়েছে? প্লেন ক্র্যাশ হলে এর চিহ্নটিও কেন পাওয়া যাচ্ছে না? তাঁর মা কি বেঁচে আছেন? তাহলে কোথায়?
দুর্ভাগ্যক্রমে মারিয়া কোপেক ১৯৭১ সালের নভেম্বরে পেরুতে আসেন। জুলিয়ান তাঁর ছাত্রজীবনের শেষ অনুষ্ঠানটি পালন করতে চাইছিলেন, যা ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। অগত্যা মা মারিয়া কোপেক ঠিক করেন মেয়ের সাথে একসাথে ২৪ ডিসেম্বরই পিউক্যালপ্পা যাবেন। বাবা বারংবার মানা করেছিলেন তাদের ল্যানসা বিমানে চড়তে, জুলিয়ানের মনে পড়ে।
মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের কারণে স্নায়ু অবশ হয়ে যায় জুলিয়ানের। শরীরের বিভিন্ন স্থানে গভীর ক্ষত, বাঁ কাঁধ ভাঙা। কিন্তু আশ্চর্য যে কোনো রক্তপাত নেই। স্নায়ু অবশ থাকায় ঐ সময় কোনো ব্যথাই অনুভব করেননি তিনি।
মাথার উপরে উদ্ধারকারী প্লেনগুলোর গর্জন শোনেন তিনি। কিন্তু এত গভীর গাছে ঢাকা জঙ্গলে তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। আরও কয়েক চক্কর দেয়ার পর সাহস সঞ্চারিত হয় তার, যেমন করেই হোক তাকে বেরোতে হবে জঙ্গল থেকে।
এত বছরের অভিজ্ঞতা এবং প্রকৃতির শিক্ষা জুলিয়ান কোপেকের জীবন বাঁচালো। পেঙ্গুয়ানায় থাকার সময় তারা যখন জঙ্গলে ঘুরতেন, সাথে থাকত কাগজ, কম্পাস, ছুরি ইত্যাদি। রাস্তা যাতে হারিয়ে না ফেলেন তাই গাছে চিহ্ন এঁকে রাখতেন। এখন জুলিয়ানের কাছে সেগুলো কিছুই নেই। তাই হাঁটার সময় প্রতিটা গাছের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। যতক্ষণ না গাছটি মুখস্থ হয়ে যায়।
বিমান থেকে ঝরে পড়া কিছু মিষ্টি সাথে নিলেন জুলিয়ান। গাছের পাতায় জমে থাকা পানি শুষে খেয়ে তৃষ্ণা মেটালেন। মোট ১১ দিন সম্পূর্ণ একা আমাজন জঙ্গলে কাটালেন সাহসী এই কিশোরী।
বাবা-মায়ের কাছে শেখা অসখ্য জিনিসের একটি ছিল পাখির ডাক শুনেই তাদের চিনতে পারা। তিনি ভাবলেন, “আমি যেহেতু বেঁচে গেছি, নিশ্চয়ই অন্য যাত্রীরাও বেঁচে আছেন”। তাই তিনি আশা ছাড়লেন না, যদি প্লেনের কাউকে পাওয়া যায়।
হঠাৎ জুলিয়ান শুনতে পেলেন পানি পড়ার টপটপ শব্দ। আশার আলো যেন আরও জ্বলে উঠল। তাঁর বাবা সবসময় বলতেন, “যদি কোনদিন জঙ্গলে হারিয়ে যাও আর পানি খুঁজে পাও তাহলে সেখানেই থাকো। পানির প্রবাহ লক্ষ্য করো। যেখানে পানি আছে, সেখানে মানুষ আছে।”
“পানি যেখানে, জনপদ সেখানে”- এই মন্ত্র তাঁর জীবন বাঁচায়। তিনি পানির স্রোত ধরে এগোতে লাগলেন। পাখির শব্দ, পিচ্ছিল, স্যাঁতসেঁতে ঘাস আর মাথার উপর অযথাই ঘুরতে থাকা উদ্ধারবিমানের আওয়াজ উপেক্ষা করে চলতে লাগলেন জুলিয়ান।
তৃতীয় দিনে তিনি খুঁজে পেলেন বিধ্বস্ত বিমানটির টার্বাইন। ঐ মুহূর্তে এই সামান্য পাওয়া তাকে অসামান্য আনন্দ দিল। চতুর্থ দিনে শুনতে পেলেন শকুনের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। একটি অশুভ আশঙ্কা গ্রাস করলো তাকে। নিশচয়ই আশেপাশে মরদেহ পড়ে আছে।
ধীরে ধীরে শকুনদের অনুসরণ করে তিনি দেখলেন দূরে প্লেনের তিনটি সিট পড়ে আছে। প্রত্যেকটি সিট তাতে বসা যাত্রীদের সহ তিনফুট গভীরে ঢুকে পড়েছে। উপরে বীভৎসভাবে ঝুলে আছে তাদের পা। কাঠি দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলেন মৃতদের মধ্যে তাঁর মা-ও ছিলেন কিনা।
শকুনদের ডাকে যেমন ভয় পেয়েছিলেন জুলিয়ান, হোটাজিন পাখির শব্দে ততটাই খুশি হলেন। তার মা-র কাছে তিনি শিখেছেন, এই ধরনের পাখিরা সাধারণত ঘনবসতির এলাকায়ই থাকে এবং এরা মানুষের অনেক উপকারেও আসে।
নদীর স্রোত অনুসরণ করা এত সহজ ছিল না। প্রায়ই জুলিয়ানকে বড় বড় গাছের গুড়ি পার হতে হতো। ধীরে ধীরে অবশভাবও কমতে শুরু করেছে আর ব্যথা অনুভূত হতে শুরু করেছে।
অবশেষে যখন সেই স্রোত মিলিয়ে বড় নদীতে যেয়ে মিশলো তখনই হতাশ হয়ে উদ্ধারকারী বিমান তাদের কাজ বন্ধ করে দিল! এর কারণ ছিল উদ্ধারকর্তাদের প্রচুর ভুল তথ্য দিয়ে হয়রান করা হচ্ছিল, তাই তারা সব ব্যাপারেই এখন সন্দেহপ্রবণ ছিলেন আর ধরেই নিয়েছিলেন যে কেউ বেঁচে নেই।
অন্যদিকে জুলিয়ান ভাবলেন সবাইকে উদ্ধার করা হয়েছে শুধু তাঁকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি! তবে ঐসময় তার সহযাত্রীদের করুণ পরিণতি জানতেন না বলেই হয়তো মনে সাহস ধরে রাখতে পেরেছিলেন জুলিয়ান।
রাতগুলো কাটতো অসহ্য যন্ত্রণায়। প্রথম কিছুদিন তীব্র ব্যাথায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন বিধায় ঘুমোতে অসুবিধা হতো না। কিন্তু এখন তিনি প্রায় সারারাত জেগে থাকেন। আশ্রয় নেন এমন জায়গায় যেখানে পিঠ ঠেকানো যায়। নাকে, মুখে বিষাক্ত পোকাগুলো ঢুকে যেতে চায়। “ওরা যেন আমাকে পুরো গিলে ফেলতে চায়!” স্মৃতিচারণ করেন জুলিয়ান। কামড়, ব্যথার অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মাঝেও তিনি ভাবতেন তার মায়ের কথা, বাবার কথা, স্কুলের বন্ধুদের কথা। ধার্মিক ছিলেন বিধায় প্রায়ই প্রার্থনা করতেন। নিজেকে প্রশ্ন করতেন, “কেন শুধু আমি বেঁচে গেলাম?”।
এই প্রশ্নের উত্তর কী কারো দেয়া সম্ভব? ধারণা করা হয় যে যখন ঝড়োহাওয়া হয় বাতাসের নিন্মমুখী চাপ কমতে থাকে। ফলে জুলিয়ান যখন নিচে পড়ছিলেন তখন বাতাসের গতি তার পড়ে যাওয়াকে অনেক ধীর করে দেয়। উপরন্তু নিচে থাকা গাছপালাগুলো তার জন্য বালিশের মতো কাজ করে। আর সাথে সেঁটে থাকা সিটটি প্যারাসুটের কাজ দেয়।
তবে তাঁর ক্ষতগুলো মোটেও উপেক্ষা করার মতো ছিল না। তাঁর ডান হাতের কাটায় পোকা জমতে শুরু করে। জুলিয়ানের মনে পড়ে পোষা কুকুর লোবোর গায়ে একবার ক্ষত থেকে পোকা ধরেছিল, তখন বাবা কেরোসিন ঢেলেছিলেন ক্ষতে। ফলে পোকা সব মারা যায়।
কিন্তু এখানে কেরোসিন পাবেন কোথায়? পোকা নিয়েই পার করতে থাকলেন দিন। বড় নদীর উৎস খুঁজতে খুঁজতে সোজা ঢাল দেখতে পান জুলিয়ান। সময়ের হিসাব আর এখন নেই তার। হাতের ঘড়িও কাজ করছে না। বুঝতে পারলেন যে জনপদ থেকে বেশি দূরে নন।
কিন্তু অনাহারে শরীর বিপর্যস্ত। মিষ্টিগুলোও এখন অবশিষ্ট নেই। ভাবলেন হয়তো অবশেষে ব্যাঙ খেয়েই ক্ষুধা মেটাতে হবে তাঁকে। বন্য পশু এর আগেও খেয়েছেন জুলিয়ান, কিন্তু তা ছিল সুস্বাদু মশলায় মাখানো বারবিকিউ করা। এখন শীতকাল, জঙ্গল স্যাঁতসেঁতে। আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা নেই। যা-ই হোক কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যাঙ ধরতে পারলেন না। পানি খেয়েই দিন গুজরান করলেন।
কীট নয় শুধু, বড় বড় প্রাণীদের সাথেও দেখা হয় জুলিয়ানের। নদীতে পানি খেতে আসে বল্গা হরিণ। যদিও এখানে মানুষ দেখে অভ্যস্ত নয়, তা-ও ভয় পায় না তারা। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বাচ্চা কুমিরের আওয়াজ পেলেন জুলিয়ান। ভয়ে লক্ষ্য করলেন যে পিছনে মা কুমিরটিও তেড়ে আসছে। তিনি জানেন যে, কুমিররা ভয় পেলে পানিতে পালায়। তাই ডাঙ্গায় না উঠে চুপচাপ জুলিয়ান গা ভাসিয়ে দিলেন স্রোতের অনুকূলে। জানেন পানিতে কুমিররা তাকে আক্রমণ করবে না।
খাবারের অভাবে গভীর অবসাদে থাকেন জুলিয়ান, কিন্তু ক্ষুধা অনুভব করেন না! মরীচিকার মতো দূরে মানুষের বাসার চাল দেখতে শুরু করেন, আর শুনতে থাকেন মুরগির ডাক। প্রায়ই হতাশা ঘিরে ধরে তাঁকে। “কী লাভ? কেন ছুটছি? আমি কি আদৌ বের হতে পারবো?” এমন আরও চিন্তা আসে তার মাথায়।
ভাসতে ভাসতে নদীর মাঝ বরারবর সাঁতার কাটেন জুলিয়ান। এখানে স্টিং রে বা অন্যকিছুতে পা কাটার ভয় নেই। কিন্তু পিরানহা মাছ থাকলে ভিন্ন কথা। জুলিয়ান তা-ও জানেন যে পিরানহারা স্থির পানিতে আক্রমণ করে। তাই যেখানে স্রোত বেশি সেখানেই সাঁতরান তিনি।
দশম দিনে তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। দূরে একটি বড় নৌকা বাঁধা আছে। পায়ের সমস্ত অবশিষ্ট শক্তি একত্রিত করে তিনি নৌকার কাছে যান। সেখানেই রাখা আছে একটি কেরোসিনের বোতল। এতদিনে পোকাগুলো বংশবিস্তার করে ফেলেছে জুলিয়ানের ক্ষতে। কেরোসিন ঢেলে কোনভাবে ৩০টি পোকা বের করলেন তিনি।
দেখতে পেলেন একটি তাম্বু। এর চৌকাঠেই শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন মানুষের। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে। কেউই আসছে না। ভাবলেন নৌকাটি নিয়ে চলে যাবেন কিনা। কিন্তু ঐ সময় দাঁড় টানার মতো কোনো অবস্থাই জুলিয়ানের ছিল না। তিনি ভেঙ্গে পড়েছিলেন।
“নৌকা নিলেও আমি হয়তো বাঁচব না। কিন্তু এই নৌকাটি নিশ্চয়ই কারো কাজে লাগে। তাঁর জীবন বিপন্ন করতে চাই নি আমি”। এতসব ভাবতে ভাবতেই ১১ দিনে প্রথম শুনতে পেলেন মানুষের কণ্ঠস্বর!
“তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমি দেবদূত দেখছি”। ২০১১ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী হোয়েন আই ফেল ফ্রম দ্য স্কাই বইটিতে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দেন জুলিয়ান কোপেক। তার ঘটনা নিয়ে এরপর মিডিয়ায় যথেষ্ট চাঞ্চল্য তৈরি হলেও ৪০ বছর অপেক্ষা করেন জুলিয়ান নিজের মুখে ঘটনাটি বলার জন্য। তাকে প্রায়ই প্রশ্ন করা হতো কেন সবাইকে ফেলে একা চলে আসলেন? সহযাত্রীদের কেন বাঁচালেন না?! কেউ বা জানতে চায় ভবিষ্যতে এমন হলে কীভাবে কেউ বাঁচবে? এসব প্রশ্ন এড়াতে চান জুলিয়ান।
“জঙ্গলই আমাকে বাঁচিয়েছে”। এভাবেই বলেন তিনি। এখন তাঁর একমাত্র স্বপ্ন পেরুর পেঙ্গুয়ানাকে জনবসতি থেকে রক্ষা করা, প্রাণীকূলকে বাঁচানো। তাঁর পিতার স্বপ্নের রিসার্চ সেন্টার এখন একটি জাতীয় প্রাকৃতিক রিজার্ভের স্বীকৃতি পেয়েছে।
** তাঁর মা মারিয়া কোপেক দুর্ঘটনার পর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে চিকিৎসা ও পরিচর্যার অভাবে জঙ্গলেই মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
১) When I Fell From the Sky, by Juliane Koecpke (2011).
Featured Image: Businessinsider.com