গবেষণা জগতে যারা কাজ করেন তাদের কাছে জার্নাল শব্দটির মানে অন্যরকম। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে থাকতে হলে একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে তার নিজস্ব বিষয়ে নতুন কাজ করতে হয় এবং সে কাজের ফলাফল একই বিষয়ের অন্য গবেষকদের কাছ থেকে যাচাই করার জন্য জার্নাল বা প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করতে হয়।
গবেষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উপযুক্ত জার্নাল নির্বাচন করা। এখন অনেক ধরনের জার্নাল বের হয়েছে, যেখানে যেটা ইচ্ছা ছাপানো হয়। অনেক জার্নাল আবার অর্থ নিয়ে এরপর প্রবন্ধ ছাপায়। হাতেগোনা কয়েকটি জার্নাল, যেগুলো আসলেই ভালো, তারা প্রবন্ধ রিভিউ করতে এবং রঙ্গিন ছবিতে ছাপাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নেয়। কিন্তু বেশিরভাগ বড় বড় জার্নাল সাধারণত অর্থ নেয় না। তবে একটি জার্নাল ভালো কিনা সেটা শুধুমাত্র এই বিষয় দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। আরও কিছু বিষয় আছে যেগুলো এখানে সরাসরি প্রভাব ফেলে। সেসব বিষয় নিয়েই এখন আলোচনা করা হবে।
বিভিন্ন বিষয়ের গবেষকদের জন্য সেই বিষয় সম্পর্কিত বড় এবং ভালো জার্নাল পাওয়া যায়। বর্তমানে যেটা সবচেয়ে বেশি দেখা হয় সেটা হচ্ছে কোনো জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কত। যেসব জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বেশি সেসব জার্নালকে ভালো জার্নাল বলা হয়ে থাকে। যে জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর যত বেশি, সেই জার্নাল তত বেশি ভালো।
ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ব্যাপারটি বোঝা খুব সোজা। ধরি, একটি জার্নালে ২০১৫-১৬ সালে একশটি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। আবার ২০১৭ সালে সেই জার্নাল থেকে গড়ে একশটি প্রবন্ধ অন্য কোনো প্রবন্ধে সাইট বা উল্লেখ করা হয়েছে (গবেষণা জগতে এরকম করাকে Referencing বলা হয়ে থাকে)। তাহলে সেই জার্নালের ২০১৭ সালের জন্য ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর হবে ১। অনেক গবেষকের ধারণা যে, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বেশি হলেই সেই জার্নাল ভালো হবে। এরকম মনে করার মধ্যে কোনো ভুল নেই। কারণ কোনো জার্নাল থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধ যদি বেশি বেশি করে অন্য কোনো জার্নালে এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রবন্ধে সাইট করা হয়, তাহলে অবশ্যই প্রকাশিত জার্নালের গুণাগুণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। তবে সবসময় যে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর দেখেই আমরা জার্নাল নির্বাচন করবো তা কিন্তু নয়। আরও কিছু বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
প্রতিটি জার্নালের একজন এডিটর বা সম্পাদক থাকেন। সম্পাদক শব্দটি বলতে আমাদের দেশে পত্রিকার সম্পাদককেই শুধু বোঝা হয়। তাই এই পুরো লেখায় এডিটর শব্দটি ব্যবহার করা হবে। কোনো জার্নালের এডিটরের কাজ হচ্ছে যখন কোনো গবেষণা প্রবন্ধ ছাপানোর জন্য তার জার্নালে পাঠানো হয়, তখন সেটাকে প্রথমে নিজে দেখে নেয়া যে আদৌ প্রবন্ধটি সেই জার্নালের গবেষণা পরিসরের মধ্যে পড়ে কিনা। সেটা যদি মিলে যায় তাহলে প্রবন্ধটি মূল্যায়নের জন্য রিভিউয়ার ঠিক করা, রিভিউয়ার তাদের নিজস্ব মতামত দেয়ার পর সেই মতামতের উপর নির্ভর করে প্রবন্ধটির লেখককে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়।
এই সিদ্ধান্ত কয়েকভাবে হতে পারে। হয়তো প্রবন্ধটি পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেয়া বা রিভিউয়ারদের মতামতগুলো লেখককে পাঠিয়ে সেই অনুযায়ী আবারো প্রবন্ধ ঠিক করে পুনরায় রিভিউয়ের জন্য পাঠানো বা ছাপানোর জন্য সম্মতি দিয়ে দেয়া। পুরো ব্যাপারটি রিভিউয়ারদের মতামতের উপর নির্ভর করে। অনেক সময় এডিটর প্রবন্ধটি বিবেচনায় রেখে বড় বা ছোট সংশোধন দিয়েও মূল লেখকদের কাছে পাঠাতে পারেন।
একটি জার্নাল নির্বাচন করতে কিংবা জার্নালটির খ্যাতি ধরে রাখতে একজন এডিটরের খ্যাতি অনেক বড় প্রভাব ফেলে । অনেক সময় এমন হয় যে, এডিটর পেপার ফেলে রেখে দিয়েছেন। অনেক দিন হয়ে যাওয়ার পরও রিভিউয়ারদের কাছে পেপার পাঠাচ্ছেন না। আবার পাঠালেও রিভিউয়াররা দেরি করলে তাদেরকে তাগাদা দিয়ে পেপার নিয়ে তাদের মতামত লেখকদের কাছে পাঠাচ্ছেন না, যার ফলে একটি জার্নালে প্রবন্ধ ছাপাতে দেড় থেকে দুই বছর পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। এরকম হলে গবেষকরা এমন জার্নালে নিজেদের গবেষণা ছাপাতে চান না। তাই এডিটরদের দায়িত্ব এখানে অনেক বেশি।
কোনো প্রবন্ধ মূল্যায়নের জন্য যে জার্নালে যত বেশি রিভিউয়ার ঠিক করা হবে, সেই জার্নাল তত বেশি ভালো। বর্তমানে বেশিরভাগ জার্নালে তিনজন রিভিউয়ারের কাছে কোনো একটি প্রবন্ধ পাঠানো হয় এবং এই তিনজনের মতামতের উপর প্রবন্ধটির গুণগত মান পরিমাপ করা হয় এবং ছাপানো হয়। অনেক জার্নাল আছে যেখানে পাঁচ থেকে দশ জনের কাছে প্রবন্ধ পাঠানো হয় এবং তাদের মতামত নেয়া হয়। এডিটরদের কাজ এমন রিভিউয়ার ঠিক করা যাতে করে তাদের কাছ থেকে সৃজনশীল মতামত পাওয়া যায় এবং পেপারটিতে আর কী করলে সেটার মান বৃদ্ধি পাবে সেরকম মতামত পাওয়া যায়। যেসব জার্নালে এরকম কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এরকম জায়গায় নিজেদের গবেষণাপত্র ছাপানো ভালো। এতে নিজের গবেষণাকে আরও বড় পরিসরে প্রকাশ করার সুযোগ আসে এবং রিভিউয়ারদের মতামত গ্রহণ করে ও সেই অনুযায়ী কাজ করলে প্রবন্ধের মানও বৃদ্ধি পায়।
একটি জার্নালের অনেকগুলো পদ থাকে। যেমন: জার্নালের প্রধান যে এডিটর, তিনি হচ্ছেন Editor-in-Chief। এরপর থাকেন Associate Editors, তারপর Editorial Advisory Board। কোনো জার্নাল বেছে নেয়ার আগে সেই জার্নালের এই পদগুলোতে কাদের নাম আছে সেটা দেখে নেয়া উচিত। যদি এমন সব নাম পাওয়া যায় যেটা জানা এবং এমন সব নাম আছে যারা নিজেদের গবেষণা করা বিষয়ে পরিচিত মুখ, তাহলে নিজের মধ্যে একটি আত্মবিশ্বাস আসে যে এই জার্নালটি অবশ্যই ভালো।
একটি জার্নালের বয়স কত সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি জার্নাল ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে কমপক্ষে ৭-১০ বছর পর্যন্ত সময় প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো জার্নাল ৫ বছর পর আর দেখা যায় না বা বন্ধ হয়ে যায়। নেচার বা সায়েন্সের মতো জার্নালের বয়স একশো বছরের উপরে। নিজ নিজ বিষয়ে এমন অনেক জার্নাল পাওয়া যায় যাদের বয়স বিশ বছর বা তার থেকেও বেশি হয়ে থাকে। হয়তো এসব জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কম হতে পারে, কিন্তু দেখা যাবে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ এসব জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে।
সাইটেশন ইনডেক্স আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেটার মধ্যে পূর্বে বর্ণিত ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর পড়ে। কিন্তু এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং এটাকে চূড়ান্ত মাপকাঠি ধরা যাবে না। কারণ কোনো কোনো বিজ্ঞানী আছেন যারা নিজেদের সময় থেকে অনেক বেশি এগিয়ে থাকেন। তাদের প্রবর্তিত কোনো বৈজ্ঞানিক ধারণা হয়তো অনেকে বুঝতেই পারছেন না। তখন দেখা যায় তাদের গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশন কম হচ্ছে, অথচ গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ (যেমন: গ্যলিলিও)।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বছরে একটি জার্নালের প্রকাশনা সংখ্যা। ভালো জার্নালগুলোর প্রকাশনা খুব দ্রুত হয়। এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে সেই জার্নালগুলোর পাঠক এবং লেখক সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। আবার গবেষকদের আস্থা সেই জার্নালের উপর অনেক বেশি থাকে বিধায় প্রচুর পরিমাণে গবেষণা প্রবন্ধ সেখানে ছাপানোর জন্য পাঠানো হয়। এরকম জার্নালে ছাপানোর জন্য পাঠালে অনেক সময় নিজের গবেষণা দ্রুত প্রকাশ করা যায়।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জার্নালের পাবলিশার। যদিও ভালো প্রবন্ধ ছাপানোর জন্য পাবলিশারদের প্রভাব অনেক কম। কিন্তু ভালো পাবলিশাররা ব্যবসার দিকটা খুব ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারে বিধায় জার্নালের ছাপানোর গুণাগুণ অনেক বৃদ্ধি পায় এবং উন্নত হয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, একটি ভালো গবেষণা প্রকাশ করার জন্য এবং নিজের গবেষণার মূল্য অন্যদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ভালো জার্নালে প্রকাশ করার মধ্যে সুবিধা আছে। একদিক দিয়ে যেমন অনেক বেশি পাঠকের কাছে থেকে মতামত পাওয়া যায় এবং কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গিয়ে প্রবন্ধের গুণ বৃদ্ধি পায়, ঠিক তেমনই নিজের কাছে আত্মতুষ্টি আসে যে, একটি ভালো, বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে নিজের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: Wall-Pix.Net