দশ-বারো বছর আগেও যখন এদেশের শিক্ষার্থীরা বোর্ড পরীক্ষার জন্য ‘কম্পিউটার: বিজ্ঞানের এক অবাক বিস্ময়’ নামক রচনা মুখস্থ করত, তখন কি কারও কল্পনায় এসেছে যে ধীরে ধীরে এই কম্পিউটারকে প্রতিস্থাপন করবে হাতে থাকা পাঁচ/ছয় ইঞ্চির একটি ডিভাইস? ঐ সময়ে শুধুমাত্র কথা বলা আর ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর মাধ্যমটি একদিন হয়ে উঠবে সবসময়ের সঙ্গী? মানুষ হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি, তার হাতে থাকা একটি যন্ত্র তার গলার স্বর শুনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে তথ্য সরবরাহ করবে। আর এই সব কল্পনাকে সত্যিতে পরিণত করতেই অ্যান্ড্রয়েড ফোনের পথচলা।
অ্যান্ড্রয়েড ফোন বলতে আমরা বর্তমানে ব্যবহৃত টাচস্ক্রিন ফোনগুলোকে বুঝি। যারা অ্যান্ড্রয়েড ফ্যান, তাদের হয়তো পরিচয় আছে সর্বপ্রথম অ্যান্ড্রয়েড ফোন টি-সিরিজের জি ওয়ানের সাথে। কিন্তু আসলে অ্যান্ড্রয়েড জগতের প্রথম সদস্য গুগল এবং এইচটিসি (HTC) এর সমন্বয়ে তৈরি ‘সুনার (Sooner)’ ফোনটি। কিন্তু ২০০৭ এ প্রায় একই সময়ে আইফোনের প্রথম ফোন লঞ্চ হওয়ায় গুগল প্রতিদ্বন্দ্বিতা জোরদার করার লক্ষ্যে সুনার এর লঞ্চিং বন্ধ রাখে। ২০০৮ সালে টি সিরিজের জি ওয়ানের মধ্য দিয়েই শুরু হয় পথচলা। কিন্তু এই ফোনটিতে মাল্টিটাচের পাশাপাশি কিবোর্ডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এরপর অ্যান্ড্রয়েড ফোনে বহু পরিবর্ধন-পরিমার্জনের পর এটি এসেছে আজকের এই অবস্থায়।
একটা সময় মোবাইল ফোন জগতে নোকিয়া, মটোরোলা কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা থাকলেও অ্যান্ড্রয়েড ফোন আসার পর বাজারে জনপ্রিয়তা বাড়ে স্যামসাং, এইচটিসি এসব কোম্পানির। ধীরে ধীরে বেড়েছে প্রতিদ্বন্দীর সংখ্যা। বর্তমানে বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করছে বিভিন্ন চীনা কোম্পানি। যাদের মাঝে অল্প সময়ে ব্যবসাসফল হয়ে ওঠা OnePlus এর কথা না বললেই নয়।
প্রতি বছর অ্যান্ড্রয়েড ফোনে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ফিচার। যারা টেকফ্রিক (প্রযুক্তির সাথে যারা আপডেটেড থাকতে পছন্দ করেন) তাদের জন্য ফ্ল্যাগশিপ ফোন নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মধ্যেই পড়ে। বাজারে জনপ্রিয় কোম্পানির ফ্ল্যাগশিপ ফোনগুলো যখন ক্রেতাদের সাধ্যের থোড়াই কেয়ার করছে, তখন ওয়ান প্লাস বাজারে অন্যান্য কোম্পানির ফ্ল্যাগশিপ ফোনের প্রায় সকল ফিচারসহ ফোন এনেছে মধ্যবিত্তদের সাধ্যের নাগালে।
ওয়ান প্লাসের যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন ‘অপ্পো’ (Oppo) এর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। আদতে ওয়ান প্লাস অপ্পোর একটি ‘সাব ব্র্যান্ড’। শুরুর দিকে সেটি অস্বীকার করলেও, পরবর্তীতে চীন সরকারের নথিপত্র থেকে দেখা যায়, কোম্পানিটির মূল কলকাঠি অপ্পোর হাতে। ওয়ান প্লাস বর্তমানে প্রচলিত মোবাইল কোম্পানিগুলো থেকে একটু ভিন্ন। অন্যান্য কোম্পানি যখন হাই এন্ড (উন্নত লেটেস্ট ফিচার সমৃদ্ধ) থেকে লো এন্ড (কিছুটা অনুন্নত পুরনো ফিচার) সব ধরনের ফোন বাজারজাত করে, সেখানে ওয়ান প্লাস বছরে একটি কি দুটি হাই এন্ড ফোন বের করে। যাত্রাকালে ওয়ান প্লাসের স্লোগান ছিল, “নেভার সেটেল (Never Settle)”। তাদের মতে ব্যবহারকারীরা স্বল্পদামে লো এন্ডের ফোনের জন্য কখনোই ‘সেটেল’ হবে না। যা আসলেই তারা সত্যি বলে প্রমাণ করেছে এই কয়েক বছরের ব্যবসাতেই।
ওয়ান প্লাস বাজারে প্রথমেই আনে কাস্টম রোম সায়ানোজেনমড (CyanogenMod) এর সমন্বয়ে ওয়ান প্লাস ওয়ান। তৎকালীন বাজারের হার্টথ্রব স্যামসাং গ্যালাক্সি এস ৫ এর সাথে পাল্লা দিয়ে শিরোনামে উঠে আসে দ্য অরিজিনাল ‘ফ্ল্যাগশিপ কিলার’ ওয়ান প্লাস ওয়ান। এর মূল কারণ হিসেবে বলতেই হয় এর দামকে। ২.৫ গিগাহার্জ স্ন্যাপড্রাগন ৮০১, ৩ জিবি র্যাম, ৩১০০mAh ব্যাটারি সম্বলিত এই ডিভাইসটির অফ কন্ট্র্যাক্ট মূল্য ছিল ৪০০ ডলার (১ ডলার= ৮২ টাকা প্রায়)। সেখানে স্যামসাং এস৫ এর মূল্য ছিল প্রায় ৬৯৯ ডলার। আর আইফোন ৫ এর মূল্য ছিল ৭৫০ ডলার। অতিরিক্ত পণ্য বাজারজাত না করার জন্য কোম্পানিটি একটি ভিন্ন পন্থার আশ্রয় নেয়। তারা ঘোষণা দেয়, অন্যান্য দশটা ফোনের মতো ডিজিটাল স্ক্রিনের সাহায্যে এই ফোন কেনা যাবে না। একমাত্র তারাই ফোন কিনতে পারবেন, যাদের আগ্রহে সাড়া দিয়ে কোম্পানি আমন্ত্রণ পাঠাবে। শুরুতে কোম্পানিটির বিক্রয় পন্থার জন্য ক্রেতাদের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু নতুন কোম্পানি হিসেবে মানুষের চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত ফোন বাজারজাতকরণ রোধ করে কোম্পানিটি তাদের লাভের অঙ্কটা বেশ ভালোভাবেই কষে ফেলে। কারণ, তাদের দাবি অনুযায়ী প্রায় ১.৫ মিলিয়ন ফোন বিক্রি হয়েছিল সেই বছর।
ওয়ান প্লাস ২ আসে ২০১৫ সালের জুলাইয়ের দিকে। এর আগে তারা প্রচার লাভের জন্য নিয়ে আসে প্রতিযোগিতার সুযোগ। এর মধ্যে লেডিস ফার্স্ট (Ladies first) প্রতিযোগিতাটি উল্লেখ্য, যেখানে ওয়ান প্লাসের নাম শরীরে বা কাগজে এঁকে ছবি তোলার আহ্বান জানানোর কারণে এটি বিপুলভাবে সমালোচিত হয়। আরেকটি প্রতিযোগিতা ছিল স্ম্যাশ দ্যা পাস্ট (smash the past)। যেখানে পুরোনো ফোন ভেঙে ভিডিও আপলোড করতে বলা হয় এবং বিজয়ীকে এক ডলার মূল্যে নতুন ফোন দেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এই পরিকল্পনাটিও সমালোচিত হয় তীব্রভাবে। কিন্তু দিনশেষে তাদের প্রচারণা ছিল ব্যবসাসফল।
সেই বছর অক্টোবরেই আসে ওয়ান প্লাস এক্স। বলতে গেলে বেশ স্বল্পমূল্যেই (২৫০ ডলার) বাজারে আসে এই ফোন। এতে ওয়ান প্লাস ওয়ানের স্ন্যাপড্রাগন ৮০১ এর ভার্শন ব্যবহার করলেও, নতুনত্ব হিসেবে আসে অ্যামোলেড (AMOLED) ডিসপ্লে, সাথে আগের চেয়ে উন্নত ৮ মেগা পিক্সেল ক্যামেরা। অ্যামোলেড ডিসপ্লের সুবিধা হলো, এটি LED ডিসপ্লে অপেক্ষা উজ্জ্বলতর, কিন্তু ‘ব্যাটারি পাওয়ার কনজাম্পশন’ কম। কিন্তু সায়ানোজেন ব্যবসা থেকে পিছু হটায় তারা এবার নিয়ে আসে অ্যান্ড্রয়েড অক্সিজেন ওএস (Android Oxygen OS)।
২০১৬ এর জুনে আসে ওয়ান প্লাস থ্রি এবং নভেম্বরে আসে ওয়ান প্লাস থ্রি টি। দুটি ফোনেই ব্যবহার করা হয় কোয়াল্কমের অত্যাধুনিক চিপসেট স্ন্যাপড্রাগন ৮২০। এর র্যাম সাইজ ছিল ৬ জিবি, যা কিনা বিভিন্ন সাধারণ ল্যাপটপের চাইতে বড়।
দুটি ফোনের প্রায় সব ফিচার একই থাকলেও পার্থক্য ছিল সেলফি ক্যামেরাতে। ওয়ান প্লাস থ্রি টির সেকেন্ডারি ক্যামেরা ছিল ১৬ মেগা পিক্সেল, যেখানে থ্রি এর ছিল ৮ মেগা পিক্সেল।
হিসেব অনুসারে ২০১৭ সালে প্রকাশ হওয়ার কথা ওয়ান প্লাস ফোরের। কিন্তু বলতেই হবে, চীনারা এখনও কিছুটা কুসংস্কারে বিশ্বাসী। চারের মান্দারিন উচ্চারণ আর মৃত্যুর উচ্চারণ প্রায় একই রকম হওয়ার কারণে ফোরের বদলে বাজারে আসে ওয়ান প্লাস ফাইভ।
সেই বছরেরই শেষ দিকে আসে ওয়ান প্লাস ফাইভ টি। ফোন দুটির কনফিগারেশন প্রায় একই হলেও ভিন্নতা দেখা যায় ডিজাইনে।
এ বছরে এসেছে কোম্পানিটির নতুন ফোন ওয়ান প্লাস সিক্স। অন্যান্য ফ্ল্যাগশিপ ফোনের মতোই ফোনটিতে ব্যবহৃত হয়েছে কোয়ালকমের স্ন্যাপড্রাগনের লেটেস্ট বেস্ট ভার্সন ৮৪৫। বর্তমান সময়ে এই স্ন্যাপড্রাগনের বন্দনায় রত হয়েছেন অ্যান্ড্রয়েড ভক্তরা। কারণ, একটি চিপসেটই নির্ধারণ করে একটি ফোনের পারফর্মেন্স। ফোনের স্পিড, রেজুল্যুশন, সেন্সর, গ্রাফিক্স এবং নিত্যনতুন টেকনোলজির মূল হচ্ছে এই স্ন্যাপড্রাগনের চিপসেট। নতুন এই চিপসেটে যুক্ত হয়েছে এক্সটেন্ডেড রিয়েলিটি, উন্নত হয়েছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি। এই তিনের সমন্বয়ে আরও কার্যকর হয়েছে ‘হিউম্যান মেশিন ইন্টারেকশন সিস্টেম’।
ফোনটিতে রয়েছে ৬/৮জিবি র্যাম, যা নিঃসন্দেহে গেমার এবং অন্যান্য ভারী অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারকারীদের জন্য সুখবর। র্যাম বেশি থাকার কারণে ফোনটি দীর্ঘদিন ব্যবহারের পর ধীরগতির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে এক্সটেন্ডেড মেমরির সুবিধা না থাকায় আপনাকে ৬৪/১২৮ জিবি রমেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। ফোনটিতে ব্যবহার করা হয়েছে অপটিক অ্যামোলেড ডিসপ্লে, পারফর্মেন্সের দিক দিয়ে যার অবস্থান হলো স্যামসাংয়ের ব্যবহৃত সুপার অ্যামোলেডের পরেই। এই ফোনে রয়েছে নন রিমুভেবল ৩৩০০mAh ব্যাটারি।
আজকাল ফোন কেনার আগে সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ফিচার হলো ক্যামেরা। অনেকেই মনে করেন, মেগা পিক্সেল বেশি হলেই ক্যামেরা পারফর্মেন্স ভালো হয়। কিন্তু ক্যামেরা পারফর্মেন্সের সাথে সবচেয়ে জরুরি হলো তার অ্যাপার্চার সাইজ। বাজারে বর্তমানে লোয়েস্ট অ্যাপার্চার সাইজ f/1.5 স্যামসাং এর দখলে থাকলেও ডুয়াল ক্যামেরার (১৬+২০ মেগা পিক্সেল) ওয়ানপ্লাস সিক্স ফোনটির পারফর্মেন্স বেশ প্রশংসনীয়। দুটি ক্যামেরাতেই রয়েছে অ্যাপার্চার সাইজ f/1.7 । আর এর ফ্রন্ট ক্যামেরা হলো ২০ মেগা পিক্সেল (f/2.0)।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়ান প্লাস সিক্স এর সকল পারফর্মেন্স অন্যান্য ফ্ল্যাগশিপ ফোন, যেমন- স্যামসাং এস ৯, আই ফোন ১০- এদের সাথে টক্কর দেয়ার মতো। উপরন্তু এর ডিসপ্লেতে আই ফোনের মতো নচ ব্যবহৃত হওয়ায় ডিজাইনেও বেশ স্টাইলিশ ভাব এসেছে। অনেকের মতে, এর ক্যামেরা পারফর্মেন্স স্যামসাং এস ৯ কিংবা আইফোন ১০ এর মতো এত ভাল না হলেও তাদের সাথে তুলনীয়। ফোনটিতে ওয়ারলেস চার্জিংয়ের সুবিধা নেই, আছে ফাস্ট ড্যাশ চার্জিং কিন্তু পুষিয়ে দেওয়ার জন্য আছে ওয়ারলেস বুলেট হেডফোন। অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে সাথে হেডফোন জ্যাকও রয়েছে।
পরিশেষে বলতে হয়, বর্তমানের ফ্ল্যাগশিপ ফোনগুলো যদি ৯৫ পেয়ে উত্তীর্ণ ছাত্র হয় তবে ওয়ান প্লাস সিক্সকে ৯০ এর কম দেওয়া চলে না। কিন্তু দামের কারণে ওয়ান প্লাস হলো আকর্ষণীয় ব্যবহার দিয়ে মন জয় করা ছাত্র।
ফিচার ইমেজ: CNET