বর্তমানের ফুটবল জগতের কয়েকজন টেকটিশিয়ান মাস্টারের নাম বললে পেপ গার্দিওলার নাম আসাটা আবশ্যক। ২০০৭ সালে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করা এই স্প্যানিশ একে একে দায়িত্ব নিয়েছেন বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ এবং ম্যানচেস্টার সিটির মতো বড় ক্লাবগুলোর। মূলত বার্সেলোনাকে ট্রেবল জিতিয়েই লাইমলাইটে আসেন এই স্বনামধন্য কোচ।
২০০৮ থেকে চার বছর ধরে মেসি, জাভিদের সাথে ছিলেন গার্দিওলা। মাঝে এক বছর বিরতি দিয়ে বাভারিয়ানদের দায়িত্ব নিয়ে ফুটবলে ফেরেন তিনি। যদিও ঘরোয়া লিগ জিতলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আর জেতা হয়নি তাদের হয়ে। ২০১৩-১৬ সাল পর্যন্ত বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে কাজ করার পর ২০১৬ মৌসুমে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে যোগ দেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল ম্যানচেস্টার সিটিতে।
তবে ম্যানসিটিতে এসে অঢেল টাকা খরচ করার জন্য কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। যদিও গত মৌসুমে দাপটের সাথে ঘরোয়া লিগ জিতে সবার মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। ম্যানচেস্টারে এসে দুই বছরের মধ্যেই গার্দিওলা খরচ করেছেন প্রায় ৪৮৪ মিলিয়ন ইউরো। কিনেছেন ১৫ জন খেলোয়াড়। যার ফলস্বরুপ প্রথম কোচ হিসেবে ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করানোর মাইলফলক ছুঁয়েছেন এই টেকো মাথার স্প্যানিশ। ইউরোর অঙ্কেও সেটি ১ বিলিয়ন ছুঁই ছুঁই। প্রায় ৯৯৮ মিলিয়ন ইউরো।
বার্সেলোনার চার বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে গার্দিওলা খরচ করেছেন ৩৪০ মিলিয়ন ইউরো। সে তুলনায় বায়ার্নে অবশ্য কিছুটা হাত গুটিয়েই রেখেছিলেন তিনি। তিন বছর ধরে বাভারিয়ানদের দায়িত্বে থাকাকালীন অবস্থায় খরচ করেছেন প্রায় ১৭৪ মিলিয়ন ইউরো।
তবে ম্যানচেস্টার সিটিতে এসে দেদারসে টাকা খরচ করেছেন। ইতিহাদে নিজের প্রথম মৌসুমে ৮ জন খেলোয়াড় কিনতে খরচ করেন ১৬৭ মিলিয়ন ইউরো। পরের মৌসুমে মাত্র ৫ জন খেলোয়াড় আনতেই উড়িয়েছেন ১৯৯ মিলিয়ন ইউরো। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত রিয়াদ মাহরেজকে নিজ দলে ভিড়িয়েছেন প্রায় ৬৮ মিলিয়ন ইউরোতে। আর তাতেই ডলারের অঙ্কে বিলিয়ন পার হয়ে যান পেপ গার্দিওলা। চলুন দেখে আসা যাক গার্দিওলার নয় বছরের কোচিং ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দামী দশ সাইনিং।
১০. মারিও গোটজে – বায়ার্ন মিউনিখ (৩৪ মিলিয়ন ইউরো)
২০১২-১৩ মৌসুমে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে অন্যতম অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন জার্মান তরুণ মারিও গোটজে। সহজাত খেলা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন বড় বড় ক্লাবগুলোর। তবে ২০১৩ সালে বাভারিয়ানদের দায়িত্ব নেওয়া গার্দিওলা প্রথম মৌসুমেই আলিয়াঞ্জ এরেনায় ভেড়ান এই তরুণকে। তবে গার্দিওলা দায়িত্ব ছাড়ার পরপরই আবার আগের ক্লাবে ফিরে যান তিনি। তিন বছর বায়ার্নে থাকাকালীন অবস্থায় খেলেছেন ৭৩টি ম্যাচ, করেছেন ২২ গোল।
৯. এডারসন – ম্যানচেস্টার সিটি (৩৫ মিলিয়ন ইউরো)
নিজের প্রথম মৌসুমেই সিটিতে এসে নিজের খেলার ধরনের সাথে মিল খাওয়া গোলকিপার খুঁজছিলেন গার্দিওলা। সেই ফলশ্রুতিতে বার্সেলোনা থেকে দলে ভেড়ান ক্লদিও ব্রাভোকে। কিন্তু ব্রাভো আস্থার প্রতিদান দিতে না পারলে পরের মৌসুমেই সেই সময়ে গোলকিপারের জন্য রেকর্ড অঙ্কের টাকায় দলে ভেড়ান ব্রাজিলিয়ান গোলকিপার এডারসনকে। বেনফিকা থেকে ইতিহাদে এই গোলকিপারকে আনতে গার্দিওলা খরচ করেছেন ৩৫ মিলিয়ন ইউরো। সুইপার কিপার হিসেবে সুপরিচিত এই গোলকিপার গত সিজনে দারুনভাবে সামলিয়েছেন ম্যানচেস্টার সিটির গোলবার। তারই কল্যাণে লিগ ঘরে তোলার পাশাপাশি প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১০০ পয়েন্ট অর্জন করে গার্দিওলার সিটি।
৮. ডেভিড ভিয়া – বার্সেলোনা (৩৭ মিলিয়ন ইউরো)
বার্সেলোনার স্বর্ণযুগের অন্যতম সারথী এই স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড। ভ্যালেন্সিয়াতে ৫ বছরে ১০৮ গোল করে নজর কাড়েন তিনি। ২০১০ মৌসুমের শুরুতে ৩৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে গার্দিওলা ভ্যালেন্সিয়া থেকে ন্যু ক্যাম্পে ভেড়ান ভিয়াকে। কোচের আস্থারও প্রতিদান দেন স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ের এই নায়ক। নিজের প্রথম মৌসুমেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে একটি দুর্দান্ত গোল করে দলকে চতুর্থবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাতে সাহায্য করেন। বার্সেলোনা ক্যারিয়ারে ৭৭ ম্যাচ খেলে ৩৩ গোল করেন ভিয়া।
৭. লেরয় সানে – ম্যানচেস্টার সিটি (৩৭ মিলিয়ন ইউরো)
২০১৬ সালে সিটির দায়িত্ব নিয়ে প্রথম মৌসুমেই গার্দিওলা দলে ভেড়ান তরুন লেরয় সানেকে। শালকে থেকে নিজ দলে ভেড়াতে গার্দিওলাকে গুণতে হয় ৩৭ মিলিয়ন ইউরো। গত দুই মৌসুমে নিজের প্রতিভার ঝলক দেখান এই তরুণ উইংগার। গতি ও সহজাত ড্রিবলিংয়ে মুগ্ধ করেছেন ফুটবলপ্রেমীদের। দুই মৌসুমে ৫৮ ম্যাচ খেলে ১৫ গোল করেন সানে। জিতেছেন গত বছরের ঘরোয়া লিগও।
৬. বার্নার্ডো সিলভা – ম্যানচেস্টার সিটি (৪৩ মিলিয়ন ইউরো)
মোনাকোর হয়ে ২০১৬ সালে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর বড় বড় ক্লাবগুলোর চোখে পড়েন পর্তুগিজ এই তরুন। তবে গার্দিওলার অধীনে খেলতে ইচ্ছুক এই খেলোয়াড় ২০১৭ মৌসুমের শুরুতে যোগ দেন ইতিহাদে। তাকে দলে আনতে সিটির খরচ হয়েছে ৪৩ মিলিয়ন ইউরো। শুরুর একাদশে খেলার তেমন সুযোগ না পেলেও প্রায় ম্যাচেই বদলি নেমে নিজের প্রতিভার জানান দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত এক মৌসুমে ৩৫ ম্যাচ খেলে ৬টি গোল করেন বার্নার্ডো সিলভা।
৫. কাইল ওয়াকার – ম্যানচেস্টার সিটি (৪৫ মিলিয়ন ইউরো)
পেপ গার্দিওলার ট্যাকটিকসে ফুল ব্যাকদের গুরুত্ব অপরিসীম। ২০১৬ সালে রাইট ব্যাকে জাবালেতা থাকলেও সেই সময় অনেক বয়স হয়ে যাওয়াও আগের মতো ধারও ছিলো না এই আর্জেন্টাইনের। সেই প্ররিপেক্ষিতে ২০১৭ সিজনে ম্যানসিটি ৪৫ মিলিয়ন ইউরোতে টটেনহাম থেকে কাইল ওয়াকারকে দলে ভেড়ায়। গত সিজনে সিটির হয়ে ৩২টি ম্যাচ খেলেছেন এই ইংলিশ রাইট ব্যাক।
৪. জন স্টোনস – ম্যানচেস্টার সিটি (৪৭.৫ মিলিয়ন ইউরো)
ম্যানসিটির কোচ হওয়ার পর গার্দিওলা প্রথম থেকেই রক্ষনভাগকে ঢেলে সাজান। ২০১৬ মৌসুমেই ৪৭.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে ভেড়ান ইংলিশ ডিফেন্ডার জন স্টোনসকে। এর আগে এভারটনে খেলে নজর কাড়েন এই তরুণ। দুই মৌসুম শেষে ম্যানসিটির হয়ে জন স্টোনস খেলেন ৪৫টি ম্যাচ। বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডের হয়ে নজর কেড়েছেন রক্ষনভাগের এই খেলোয়াড়।
৩. বেঞ্জামিন মেন্ডি – ম্যানচেস্টার সিটি (৪৯ মিলিয়ন ইউরো)
২০১৬-১৭ মৌসুমে মোনাকোর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের অন্যতম কারিগর ছিলেন এই ফরাসি লেফট ব্যাক। দলের ফুলব্যাকদের আরো শক্তিশালী করতে গত সিজনের শুরুতেই মেন্ডিকে ইতিহাদে আনেন গার্দিওলা। সেজন্য মোনাকোকে দিতে হয়েছে ৪৯ মিলিয়ন ইউরো। যদিও ইনজুরির দরুন প্রায় পুরো মৌসুমই বেঞ্চে বসে কাটিয়েছেন এই প্রতিভাবান ফুলব্যাক। সিটিজেনদের হয়ে মাঠে নামতে পেরেছেন মাত্র ৭ বার। তবে এই মৌসুমে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে গার্দিওলা।
২. জলাতান ইব্রাহিমোভিচ – বার্সেলোনা (৫৯ মিলিয়ন ইউরো)
বার্সেলোনার চার বছর ক্যারিয়ারে গার্দিওলার সবচেয়ে দামি সাইনিং ছিলো সুইডিশ খেলোয়াড় জলাতান ইব্রাহিমোভিচ। ইন্টার মিলানের হয়ে অসাধারণ তিন মৌসুম কাটানোর পর ন্যু ক্যাম্পে মেসিদের সাথে যোগ দেন এই তারকা খেলোয়াড়। তার জন্য বার্সেলোনাকে গুণতে হয় ৫৯ মিলিয়ন ইউরো। তবে বার্সেলোনা ক্যারিয়ার এতটা সুখের ছিলোনা জলাতানের জন্য। কোচ গার্দিওলার সাথেই বিবাদে জড়িয়ে ক্লাব ছাড়েন তিনি। তার আগে কাতালানদের হয়ে দুই মৌসুমে ২৯টি ম্যাচ খেলে করেছেন ১৬টি গোল।
১. রিয়াদ মাহরেজ – ম্যানচেস্টার সিটি (৬৮ মিলিয়ন ইউরো)
পেপ গার্দিওলার নয় বছরের কোচিং ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দামি সাইনিংটি করেন চলতি মৌসুমেই। লেস্টার সিটির হয়ে চারটি অসাধারণ সিজন কাটানোর পর কিছুদিন আগেই রিয়াদ মাহরেজ যোগ দেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। ৬৮ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে ইতিহাদে আনেন পেপ। এর আগে লেস্টার সিটিকে ঘরোয়া লিগ জেতানোর পাশাপাশি প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কারটিও ঘরে তোলেন এই আলজেরিয়ান। লেস্টারের হয়ে ১৫৮ ম্যাচ খেলে ৪২টি গোল করেছেন রিয়াদ মাহরেজ। চলতি মৌসুমেই সিটিজেনদের হয়ে মাঠ কাঁপাতে দেখা যাবে তাকে।