দেখতে দেখতে ব্রিক্সের দশম সম্মেলন চলে আসলো। জোহানসবার্গে এ সপ্তাহে এই সম্মেলন শুরু হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ব্রিক্সের প্রথম যাত্রা শুরু হয়। ব্রিক্স (BRICS) হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা– এই পাঁচটি দেশ যারা প্রযুক্তি এবং অর্থনীতিতে দ্রুত বর্ধমান তাদের একত্রিত সম্মেলন। পশ্চিমা বিশ্বকে টেক্কা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়।
প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকা বাদে অন্য চার দেশ নিয়ে এই সম্মেলন শুরু হয়। পরে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাও যোগ দেয়। এই পাঁচটি দেশ প্রযুক্তি, অর্থনীতি, সমাজ সংস্কার, উন্নতির ধারা ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে অলিখিত প্রতিযোগিতায় নেমেছে। নিজেদেরকে অর্থনীতিতে সাবলীল করে তুলছে দিন দিন। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও এই দেশগুলো সমানভাবে সচেতন। একটি কথা এখানে মনে রাখতে হবে, যখন ব্রিক্স প্রথম শুরু করে তখন সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। এমন অবস্থায় নিজেদের অর্থনীতির লাগাম ধরতে এই পাঁচ দেশ মিলে শুরু করে ব্রিক্স সম্মেলন।
মিন্ট রাষ্ট্রগুলো থেকে ব্রিক্স অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর ক্ষমতা একটু বেশি। কারণ মিন্টভুক্ত রাষ্ট্র কেবল উন্নয়নের স্বাদ পাওয়া শুরু করেছে; কিন্তু ব্রিক্সের দেশগুলো তাদের নিজেদের ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে এবং এরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলো থেকে যে পিছিয়ে নেই তার প্রমাণও দিয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য এই পাঁচ দেশের একজোট হওয়ার প্রধান কারণ। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের অধিকার এবং শক্তি দুটো দিক দিয়েই নিজেদের জেদ বজায় রাখছে। প্রশাসনিক দিক দিয়ে ব্রিক্সকে খুব একটা আমল দিচ্ছে না। আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মতো জায়গায় পশ্চিমা দেশ থেকেই বেশি নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ ব্রিক্সভুক্ত দেশগুলোতে পশ্চিমাদের চেয়েও যোগ্য এবং জানাশোনা প্রার্থী ঠিকই আছে। ভারতের রঘুরাম রাজন এবং অরবিন্দ সুব্রামোনিয়ামের মতো অর্থনীতিবিদরা আইএমএফ প্রধান অর্থনীতিবিদ পদে ভূষিত হলেও এর উপরের পদে যুক্তরাষ্ট্র না হয় ইউরোপ থেকে প্রার্থী নিয়োগ দেয়া হয়।
২০১২ সালের দিকে ব্রিক্স এ ব্যাপারটি নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে। তাদের মতে এসকল প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদ যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ কর্তৃক স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। এখানে পশ্চিমাদের একটি ভয় থাকতে পারে যে কোনোভাবে যদি অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণকারী বড় বড় প্রতিষ্ঠানে তাদের থেকে প্রার্থী হিসেবে বসানো হয় তাহলে হয়তো তাদের একচেটিয়া ক্ষমতা প্রদর্শনে অসামঞ্জস্যতা চলে আসতে পারে।
পশ্চিমাদের এ ধরনের আচরণের কারণে ব্রিক্স সদস্যরা কিন্তু বসে নেই। তারা নিজেরাই পরস্পরকে সমর্থন এবং সাহায্য করার জন্য New Development Bank (NDB) গঠন করে। এই ব্যাংক গঠনকালে প্রত্যেক সদস্য দেশকে মেনে নিতে হয়, তারা প্রত্যেকে গ্রাহক হওয়ার জন্য দশ বিলিয়ন ডলার করে মূলধন এখানে প্রাথমিকভাবে দেবে। এই ব্যাংক থেকে যে লাভ আসবে সেগুলো এই পাঁচ দেশের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।
এছাড়া রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে সংগঠিত হবে তার একটি গাঠনিক রূপদান এবং নিয়মের মধ্যে আনার জন্য জন্য The Contingent Reserve Arrangement নামক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে ব্রিক্স। ধারণা করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো মিলে নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য ১৯৪৪ সালে যে Breton Wood System তৈরি করেছিল, ঠিক সেরকমটি নিজেদের মধ্যেও চালু করছে ব্রিক্স। এমনও হতে পারে যে ব্রিক্সভুক্ত দেশগুলো একজোট হয়ে নিজেদের সম্মিলিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সারা বিশ্ব এখন যে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, সেটা থেকে ভিন্ন কোন প্রক্রিয়া গঠন করতে পারে এবং সেগুলো মেনে নিতে সারা বিশ্বকে বাধ্য করতে পারে।
এটা ঠিক যে ব্রিক্সের সদস্যরা বহুপাক্ষিক সম্পর্ক এবং নীতি বিষয়ে খুবই আশাবাদী। এই নীতি তাদের জন্য অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক। চীন এবং রাশিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং এই দুই দেশ অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় জাতিসংঘের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে ছাড় এবং সমর্থন পেয়েছে। তবুও তারা এ ধরনের সমর্থনে নিবেদিত নয় এবং এমন সমর্থন উল্টো তাদের মনে সংশয়ের সৃষ্টি করে।
ব্রিক্সের এই চারটি দেশের দিকে যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি দেশ ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার যোগ্যতা রাখে। প্রথমে চীনের কথায় আসা যাক। চীন ইতোমধ্যে নিজেদেরকে বাণিজ্য, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, ব্যবসায়িক গঠন, জনপ্রিয়তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমানে সমানে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিচ্ছে। এমনকি তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কনীতি অনেক বেশী দৃঢ় এবং নির্ভরশীল।
ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুমুল বাণিজ্য যুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঘোষিত হওয়া নানারকম নিষেধাজ্ঞা, অতিরিক্ত কর আরোপ ইত্যাদি নানান অসুবিধার মধ্যেও তাদের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েনি। বরং চীন তাদের বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেকটা সরিয়ে এনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক প্রযুক্তিকে এশিয়া ও তার আশেপাশের অঞ্চলে জনপ্রিয় করার মূল কারিগর হচ্ছে চীন। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, ব্রিক্সের অন্যান্য দেশের তুলনায় চীনই সবচেয়ে বেশি এটা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অর্থাৎ ব্রিক্সের শক্তিধর হওয়ার মূল কেন্দ্রে যে চীন সেটা সহজেই বোঝা যায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সাইরিল রামফোসা ব্রিক্স নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। কারণ এখানকার সদস্য হওয়ার পর এবং বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর দেশটি আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় একচেটিয়া কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও স্থিতিশীল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে ইদানিং এই দেশের অর্থনৈতিক লেনদেন এবং বাণিজ্য করার মূল লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে ব্রিক্সভুক্ত দেশগুলো।
তবে এর ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার নিজেদের ক্ষতি হতে পারে, এমনকি বিশ্বাসও হারাতে পারে দেশটি। দক্ষিণ আফ্রিকার এখন উচিত আফ্রিকার অন্যান্য দেশের উপর নজর দেয়া, তাদেরকে উন্নত করা, সেখানে নিজেদের বিনিয়োগ বাড়ানো। এতে আফ্রিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় তাদের প্রতিপত্তি বেশি থাকবে।
চীন এবং ভারত তাদের সীমান্তে অশান্তি নিয়ে কথা বলবে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য সুসম্পর্ক বজায় রাখতে দুই দেশই যে সমান ভাবে কাজ করবে সেটা নিয়ে গভীর আলোচনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ইতোমধ্যে ডিজিটাল কারেন্সি নিয়ে তার বক্তব্য দিয়েছেন। এই বিষয়ে যে কথা হবে সেটা অনুমেয় ছিল। ব্রিক্সের সবগুলো দেশ এতে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এছাড়া রাশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার নিউক্লিয়ার চুক্তি নিয়েও ইতোমধ্যে কথা হয়েছে। ব্রিক্সের আরেক সদস্য ব্রাজিলের এই দলে মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে তাদের কৃষিক্ষেত্র। ব্রিক্সের খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশেই দূর হবে ব্রাজিলের কৃষি ক্ষেত্রে শক্তির কারণে।
তবে এবারকার ব্রিক্স সম্মেলনটি একটু অন্যরকম। কারণ পশ্চিমা বিশ্বের উপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজেরাই একটি অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক তৈরির করার লক্ষ্য নিয়ে এই ব্রিক্স গঠন করা হয়। এখন দেখা যাচ্ছে ব্রিক্সভুক্ত দেশগুলো বিভিন্নভাবে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বার বার আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এমন অবস্থায় নিজেদেরকে কীভাবে আরও বেশি শক্তিশালী করে তৈরি করা যায় সেটাই প্রাধান্য পাবে ব্রিক্সভুক্ত দেশগুলোর কাছে। ব্রিক্সের ২০১৮ এর সম্মেলন নির্দ্বিধায় অর্থনীতির এই নতুন মোড়লদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে।
ফিচার ইমেজ: LaRouchePAC.com