মনে করেন, আপনি দৌড়াচ্ছেন এবং আপনার পেছনে দৌড়াচ্ছে মস্ত বড় বড় ষাঁড়। কেমন লাগবে আপনার? এরকম কোনো ভয়াবহ কাজ নিজ ইচ্ছায় করার সাহস দেখাবেন? অনেকে বলতে পারেন, এরকম পাগলামি কেউ করবে না? তবে এরকম পাগলামি কিন্তু প্রতি বছরই স্পেনে করা হয়। বলছি, ‘স্যান ফার্মিন’ উৎসবের কথা। এটা এই ষাঁড় দৌড়ের জন্য বিখ্যাত হলেও এই উৎসবের আরও কিছু ধাপও রয়েছে।
স্পেনের ‘স্যান ফার্মিন’ উৎসব পৃথিবীর অন্যতম পরিচিত উৎসব। ধর্মের ও সংস্কৃতির এক অনন্য মিলন দেখা যায় এই উৎসবে। প্রতি বছর ৬ জুলাইয়ের দুপুর থেকে স্পেনের পাম্পলোনায় শহরের প্রথম ধর্মযাজক ও সাধু সেইন্ট ফার্মিনকে সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে এই উৎসবের আরম্ভ হয়, যা ১৪ জুলাইয়ের মধ্যরাত অবধি চলতে থাকে। মূলত এই সেইন্ট ফার্মিনের জন্যই এত আয়োজন ও জাঁকজমক।
কে এই সেইন্ট ফার্মিন?
কথিত আছে, তৃতীয় শতকে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে পাম্পলোনা শহরে থাকাকালে এই সেইন্ট ফার্মিন ছিলেন শহরের প্রধান নেতার পুত্র। একজন ফ্রেঞ্চ ধর্মগুরু স্যান স্যাটারনিনো শহরের ধর্মহীন মানুষের মধ্যে ধর্মের বাণী নিয়ে আসে। সেইন্ট ফার্মিন তার বাণীতে এতটাই প্রভাবিত হল যে, সে ফ্রান্সের তোলুজে চলে যায় যাজক হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করতে।
পরবর্তীতে স্যান স্যাটারনিনো যে কাজের শুরু করে দিয়ে যান তা শুধু নিজ শহরেই নয়, বরং ফ্রান্সেও ছড়াতে থাকেন। এজন্য তিনি সেখানকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নজরে চলে যায়, যারা তাকে শারীরিকভাবে অনেক অত্যাচার করে এবং পরে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে হত্যা করে। তার দেহের কিছু অবশেষ পাওয়া যায় ক্যাথেড্রালে।
চুপিনাজো
প্রতি ৬ জুলাই ঠিক দুপুর ১২টার দিকে রকেট বা হাউইবাজির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্যান ফার্মিন শুরু হয়। শহরের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে শুধু আতশবাজির রঙ আকাশে দেখা যায়।
স্যান ফার্মিন যে রকেটের মাধ্যমে শুরু করা হয় তার নামই চুপিনাজো (Chupinazo)। এ সময় সকলে সাদা ও লালা পোশাক পরে পাম্পলোনার বিভিন্ন রাস্তায় উৎসবটি উপভোগ করতে নেমে পড়ে।
রিয়াউ রিয়াউ
জুলাই মাসের প্রতি ৬ তারিখ বিকাল ৪:৩০ মিনিটে সবাই রিয়াউ রিয়াউ (Riau Riau) এর জন্য একত্র হয়। ১৯১১ সালে ইগনাইসো বালেজতেনা আসকারেট এই অনুষ্ঠানের আরম্ভ করে। সিটি কাউন্সিলের সদস্যরা প্যারেড করে সিটি হল থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে শহরের ভজনালয় পর্যন্ত যায়। উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা এ সময় মিছিলে নাচ-গান করতে থাকে।
১৯৯২ সালে জনগণের কথা চিন্তা করে উৎসবের এই অংশকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, এই যাত্রায় কিছু অসাধু ব্যক্তি ইচ্ছা করে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অশান্তি ও মারামারির সৃষ্টি করে। বিভিন্ন ঝামেলার কারণে কাউন্সিলরদের যাত্রা শেষ করতে পাঁচ ঘণ্টাও লেগে যায়। ১৯৯৭ সালে আবার এই অনুষ্ঠান শুরু হয়। তবে ২০১২ সালে রিয়াউ রিয়াউতে আবার গণ্ডগল হলে এবারও এই যাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে এখনও এর প্রচলন আছে।
এনসিয়েরো (ষাঁড় দৌড়)
‘এনসিয়েরো’ (Enciarro) হলো স্যান ফার্মিন উৎসবের একটি অংশ, যার জন্যই এই উৎসব এত পরিচিত। হ্যাঁ! ষাঁড় দৌড়ের কথাই বলছি। ৭ থেকে ১৪ জুলাইয়ের প্রতি সকালে স্যান সারনিন চার্চে যখন ঠিক সকাল ৮টা বাজে তখন ক্যালে সানটো ডোমিঙ্গোর এক খোঁয়াড়ের ভেতর থেকে এই এনসিয়েরো শুরু হয়। এই দৌড়ে ১২টি ষাঁড় ব্যবহৃত হয়, যার মধ্য থেকে ৬টি ষাঁড় পরে লড়াইয়ে যোগ দেয়।
দুটো রকেট বা হাউইবাজি উৎক্ষেপণের পর ষাঁড়দের ৮২৫ মিটার দৌড়ের সায় দেওয়া হয়। খোঁয়ার থেকে ষাঁড় লড়াইয়ের মাঠের দূরত্ব এই ৮২৫ মিটার। এই দৌড় সাধারণত তিন থেকে চার মিনিট পর্যন্ত হয়; তবে অনেক সময় ১০ মিনিটও লেগে যেতে পারে যদি কোনো ষাঁড় নিজ দল থেকে আলাদা হয়ে যায় বা অসম্ভব রেগে গেলে। এখানে অংশ নেওয়া বিপজ্জনকও বটে। প্রতি বছর কমপক্ষে ২০০-৩০০ জন এই দৌড়ে আহত হয়, যদিও তা বেশি একটা আশঙ্কাজনক হয় না।
সেন্ট ফার্মিনের নিকট প্রার্থনা
এই ষাঁড় দৌড়ের একটি আবেগপ্রবণ প্রস্তাবনাও রয়েছে। দৌড় আরম্ভের পূর্বে ষাঁড়গুলো যখন খোঁয়াড়ের নিকট ছাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে তখন অংশগ্রহণকারীরা খবরের কাগজ গুটিয়ে তা উপরের দিকে তুলে ধরে এবং স্যান ফার্মিনের একটি ছবিকে লক্ষ্য করে প্রার্থনা শুরু করে। নিঃশব্দ পরিবেশে শুধু প্রার্থনার বাণী বেজে ওঠে। “A San Fermin pedimos, por ser nuestro patron, nos guie en el encierro dandonos su bendicion” (স্যান ফার্মিন, আমাদের শ্রদ্ধেয় গুরু, ষাঁড় দৌড়ে আমাদের পথ দেখাও এবং রক্ষা কর)। এরপর সবাই মিলে “ভিভা স্যান ফার্মিন, গোরা স্যান ফার্মিন” বলে চিৎকার করে। এখানে ‘ভিভা’ ও ‘গোরা’ দুটোর মানেই দীর্ঘজীবী হোক। ৮টা বাজার পূর্বে কমপক্ষে তিনবার এই ভজন পুরোটা গাওয়া হয়।
করিডা
‘করিডা’ (Corrida) অর্থ ষাঁড়ের লড়াই। স্পেনের অন্যান্য ষাঁড়ের লড়াই কিছুটা অন্য ধাঁচের হয়। এটা মূলত ‘কাসা ডি মিসেরিকর্ডিয়া’ নামক দাতব্য প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে এবং এ থেকে অর্জিত অর্থ জনকল্যাণের জন্য রাখা হয়। ৭ থেকে ১৪ জুলাই প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে ৬টি ষাঁড়কে এই লড়াইয়ে আনা হয়।
করিডা বেশ বিতর্কিত। অনেকের মতে, ঐতিহ্যের নামে এই উৎসবে ষাঁড়দের সাথে অমানবিক অত্যাচার করা হয়। তবে পাম্পলোনাবাসীর মতে, ষাঁড়ের সাথে লড়াইকারী ব্যক্তিরা সেটাকে মারা নয়, বরং ষাঁড়টার সাহস এবং সবশেষে নিজের স্বাধীনতার জন্য আত্মসমর্পণ করানোকে দেখাতে চায়। তবুও প্রতি বছর ২,৫০,০০০ ষাঁড় এই ষাঁড় লড়াইয়ের নামে মারা যায়; তাই স্পেনের এই করিডাও বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করে। এছাড়া ৫ই জুলাই বয়সে ছোট এবং আনাড়ি ষাঁড়ের মধ্যে এই করিডা সম্পন্ন হয়।
পোব্রে দি মি
স্যান ফার্মিন উৎসবের সর্বশেষ অংশ এই পোব্রে দি মি (Pobre De Mi)। যেখানে এই কর্মসূচি শুরু হয় সেখানেই এর পরিসমাপ্তি ঘটে এবং তা হলো টাউন হলের চত্বরে।
সবাই তাদের লাল স্কার্ফ ও মোমবাতি আকাশের দিকে ধরে প্রার্থনা করতে থাকে, “Pobre de mi, pobre de mi, que se han acabado las fiestas, de San Fermin”, যার অর্থ “আমি দুর্ভাগা, আমি দুর্ভাগা যে স্যান ফার্মিন শেষ হয়ে যাচ্ছে”। খুব শান্ত পরিবেশে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে ৯ দিনের এই জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের।
এল স্ট্রুয়েন্ডো
‘এল স্ট্রুয়েন্ডো’ (El Struendo) অর্থ গর্জন করা। ৯ দিনের উৎসবের যেকোনো দিন এটা পালন করা হয়। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এই অনুষ্ঠান করা হয় না; কেননা মানুষের ভীড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এই দিনে পাম্পলোনার ৫০ বছরের ঐতিহ্যের ঝলক একসাথে দেখা সম্ভবপর হয়। ঠিক রাত ১১:৫৯ মিনিটে সবাই টাউন হল চত্বরে একত্রিত হয় এবং যত জোরে সম্ভব গর্জন বা শব্দ করে। কয়েক ঘণ্টা ড্রাম, বাটি, বাঁশি এবং এরকম আরও বস্তু দিয়ে আওয়াজ করা হয়।
প্রতি বছর এই ব্যতিক্রমধর্মী উৎসব উপভোগ করতে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে পাম্পলোনায়। তবে স্যান ফার্মিনকে ঘিরে তর্ক-বিতর্কের কোনো শেষ নেই। কারও মতে, এই উৎসব বন্ধ করে দেওয়া উচিত, আবার কারও মতে উচিত নয়। আপনার কী মতামত এ সম্পর্কে?
ফিচার ইমেজ: travelchannel.com