শখের কাজগুলো আমরা সাধারণত অবসর সময়েই করে থাকি। আমাদের শখ, এমন কিছু নির্দিষ্ট কাজ যা আমাদের আনন্দ দেয়, যেটা আমরা ভালোবাসি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় আমাদের কাছে শখের কাজগুলো করার সময় তো দূরে থাক, বরং প্রয়োজনীয় কাজের সময় পর্যন্ত নেই যেন। ফলে জীবন এবং ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠছে বিরক্তিকর। আজ এমন কিছু শখের কাজ নিয়ে লেখা হবে, যেগুলোর এক বা একাধিক পছন্দমতো বেছে নিয়ে আপনি ব্যক্তিজীবনের উন্নতি করতে পারেন। এই শখগুলো একাধারে আনন্দের এবং সুলভ। সুতরাং প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে বিশ্রামের নির্দিষ্ট সময় বের করে নিয়ে, সেই সময়ে শখের কাজটি করতে পারেন। এতে করে দৈনন্দিন কাজেও উদ্যম ফিরে আসবে।
রোজকার ব্যায়াম
ব্যায়াম করার জন্য জিমে ভর্তি হতে হবে, নির্দিষ্ট পোশাক থাকা লাগবে- এসব ধারণা অনেকটাই ভুল। বাড়ির সিঁড়িতে কয়েকবার ওঠানামা, কয়েকবার বুকডন দেওয়া ইত্যাদিও আপনার পেশীকে শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ব্যায়াম করা অনেকে প্রয়োজনের কারণে অভ্যাসে পরিণত করে, কিন্তু আপনি যদি এটাকে শখ হিসেবে দেখতে শুরু করেন, তাহলে সময় বের করতে কষ্ট হবে না। কঠিন ব্যায়ামের পরিবর্তে করতে পারেন যোগব্যায়ামও। বিভিন্ন আসন ও ধ্যান আপনার শরীরকে সুস্থ, মনকে সুস্থির রাখবে।
গাছ লাগান
সেই যে একদিন ছোট একটা চারাগাছ, বা চোখে মেলানো ভার এমন একটা বীজ অনেক খুঁজে বের করা একটা পাত্রে অল্প একটু মাটিতে লাগিয়েছিলেন, দুদিন না যেতেই সেখানে নতুন পাতা এলো, সবুজ দুটো পাতা যেন প্রাণের উচ্ছ্বাসে আপনার সাফল্যের কথা জানাচ্ছে। তারপর সেই গাছে ফুল আসে, ফল হয়। অথবা হয় না, গাছের রোগ হয়। গাছকে সারাতে আপনারও ঘুম হারাম হয়ে যায়। এ আনন্দের তুলনা কোথায়?
গ্রামে থাকলে উঠানে পুরো একটা বাগান করে ফেলা সম্ভব। শহরের বাসাতেও কিন্তু বারান্দা বা শোবার ঘরে আপনি ছোট ছোট খুশির জন্ম দিতে পারেন। আপনার এই শখটি আপনাকে ও প্রকৃতিকে উপকৃত করবে।
রান্না করুন
রান্না করতে না জানলে আজই টুকটাক কিছু রান্না করা শুরু করুন। গবেষণায় দেখা যায়, যেসব লোক নিজেরা রান্না করে খায়, তারা কিনে খাওয়া লোকেদের তুলনায় নীরোগ স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। নিজে যত বেশি রান্না করবেন, তত কম প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ভেজাল আর ময়লা জিনিস আপনার পেটে যাবে। তাছাড়া রান্না করতে জানা একটা গুণ বটে, আর নিজে রাঁধলে যে খরচ বাঁচে একথা কে না জানে?
বই পড়া
শেষ কবে ক্লাসের বইয়ের বাইরে বই পড়েছিলেন? এমন অনেক বইপোকা আছেন, যারা ইন্টারনেট চালু করে বিনা কাজে সারাদিন নিজেদের পছন্দের কাজ বই পড়াকে ভুলে থাকেন। বই আপনাকে নিজে কাছে টেনে নেবে, এমন ভাবাটাও ভুল। বই পড়ার অভ্যাসটাও অভিমানে দূরে চলে যাবে। সুতরাং টেবিলের পাশে রাখুন পছন্দের বইটি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অথবা ঘুমাতে যাওয়ার আগে বই পড়ুন। আলোকিত হবেন নিঃসন্দেহে, তাছাড়া আপনার জীবনের মূল্যবান সময় অধিকতর মূল্যবান কিছুতে কাজে লাগছে, আপনি সময় কম নষ্ট করছেন ভেবে আপনার মানসিক চাপ কমবে। গবেষণায় বলা হয়, বই আপনার মানসিক চাপকে ৬৯ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে।
দাবার ছকে ঘুরে বেড়ান
শখ করে একবার হয়তো দাবার বোর্ড কেনা হয়েছিল, পরে না খেলে উঠিয়ে রেখেছেন আলমারিতে। এবার বোর্ডের ধুলো ঝেড়ে ঘুঁটি সাজিয়ে বসুন। দাবা আমাদের মস্তিষ্কের যুক্তি তৈরির ক্ষমতাকে শাণিত করে। আপনার স্মৃতিশক্তি আর পরিকল্পনা করার শক্তিও বৃদ্ধি করবে দাবার সাদাকালো বোর্ড।
আত্মরক্ষার শিক্ষা
মার্শাল আর্ট, জুডো, কুংফু, তায়কোয়ান্ডো- যেকোনো একটাতে পছন্দ ও সাধ্যমতো ভর্তি হয়ে যান। শারীরিক শক্তি এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এটা আপনার বাস্তব জীবনের পাথেয় হয়ে দাঁড়াবে।
সাঁতার শিখুন
সেই যে কবিতাটা, সাঁতার না জানায় বাবুর জীবনের ষোল আনাই মিছে হয়ে গেল, এমন করে জীবন মিছে না করতে চাইলে সাঁতার শেখাটা জরুরি। আর যদি সাঁতার জেনে থাকেন, সপ্তাহে অন্তত দুদিন নেমে পড়তে পারেন পানিতে। সাঁতার একটি ভালো ব্যায়ামও!
সেলাই ও বুনন
সুঁচ-সুতা নিয়ে কাজে নেমে পড়ুন অবসরে। কাপড়ে মনের মতো কিছু ফুটিয়ে তোলা আপনাকে প্রশান্তি দেবে। সেলাই করা একধরনের ধ্যানের মতো। হতাশা আর দুরারোগ্য ব্যথাও কমানো যায় এই শখে।
লিখুন
লেখার শখ তৈরি করুন। যা ভাবছেন, তা লিখে ফেলুন। এভাবে মনের বিক্ষিপ্ততা কমানো যায়। নিজের ডায়েরি রাখতে পারেন, সারাদিন যা যা ঘটল, টাকাপয়সা খরচের হিসাব, দিনের রুটিন সবকিছু এতে লিখে ফেলতে পারেন।
লেখার মাধ্যমে আপনি ধীরে ধীরে নিজেকে আরো বেশি চিনতে সক্ষম হবেন। আপনার খুশি আর অখুশির কারণগুলো বুঝতে পারবেন।
নতুন ভাষা শিখুন
একাধিক ভাষা জানা ব্যক্তিদের চিন্তা অধিকতর পরিশীলিত হয় বলে জানা যায়। মস্তিষ্কের উন্নয়নের কথা বাদ দিলেও বাইরের দেশের অন্য ভাষাভাষী মানুষের সাথে যোগাযোগে আপনি একধাপ এগিয়ে থাকবেন। পাশাপাশি জীবনবৃত্তান্তে আপনার কয়েকটা ভাষা জানার যোগ্যতা আপনাকে অন্যদের চাইতে বেশি আকর্ষণীয় করে তুলবে।
স্বেচ্ছাসেবা দিন
প্রতিদিন আপনার আশেপাশে হাজারটা প্রজেক্টে কাজ চলছে। এসব জায়গায় স্বেচ্ছাসেবা প্রদান করে আরো বেশি মানুষের সাথে পরিচিত হতে পারবেন। আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ দক্ষতা ও ব্যক্তিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। পথশিশুদের জন্য বিদ্যালয়, বা পথের মানুষদের জন্য রান্না করা, বিভিন্ন দুর্যোগে আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত হওয়া মহৎ শখ। এর সাথে পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে প্রজেক্টে অন্যান্য দেশ থেকে অংশগ্রহণকারী আহবান করা হয়। এগুলোয় যাওয়া শুরু করলে নিজের চারপাশ সম্পর্কে আপনার ধারণা বদলাতে বাধ্য। অন্যের খুশিতে খুশি হয়ে আপনি ক্রমশ উন্নততর হয়ে উঠবেন।
সাইকেল চালানো
পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও বাইসাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একদিকে পৃথিবী দূষণে জর্জরিত, অন্যদিকে জ্বালানিবিহীন সাইকেল আপনাকে ব্যায়ামও করিয়ে নেবে। সাইকেল শরীরের জন্য উপকারী আবার অর্থসাশ্রয়ীও বটে।
অরিগ্যামি
কাগজ ভাঁজ করে বিভিন্ন আকৃতি দেওয়ার এই মজার শিল্পটি জাপানের শিশুরা বহুদিন আগেই চালু করে দিয়েছিল। এটা এমন একটা শখ, যেটা আপনি যেখানে সেখানে বসেই করতে পারেন। খুব যে টাকা খরচ হবে, এমনও নয়। ইউটিউবে নানা রকম প্রাণী, ফুল, ফল ও বস্তুর মতো করে কাগজ ভাঁজ করার অজস্র ভিডিও দেওয়া আছে। ঘরে বসেই এগুলো শিখিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে পারেন বন্ধুদের। আজকাল অনেকে অরিগ্যামি দিয়ে ঘর সাজিয়ে থাকেন।
মাছ ধরা
আমাদের দেশে এটা একসময় অত্যন্ত জনপ্রিয় শখের বস্তু ছিল। একটু সময়সাপেক্ষ হলেও মাছ ধরার এই শখ কিন্তু ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে আপনাকে ধৈর্যশীল হতে শেখায়। দেশের গ্রামাঞ্চলে খালবিল বা নদীনালা থেকে মাছ ধরা সম্ভব হলেও শহরে এটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
শখ যেন আবার নেশায় পরিণত না হয়, শখ পূরণের জন্য যেন অন্য কারোর ক্ষতি না করা হয়, সেদিকে লক্ষ্ রাখতে হবে। কথায় বলে, প্রত্যেক মানুষ নির্দিষ্ট কোনো কাজের দক্ষতা নিয়ে জন্মায়। অনেকেই নিজের জন্য সেরা কাজটি খুঁজে পান না সারা জীবনে। শখের কাজগুলো করতে গিয়ে হয়তো সেই কাজটির সাথে পরিচয় হয়ে যেতে পারে আপনার। যদি নাইবা হয়, আপনার বেছে নেওয়া চমৎকার শখটি আপনার মূল্যবান মস্তিষ্ককে শয়তানের কারখানা অন্তত হতে দেবে না।
ফিচার ইমেজ- Lifehack