নারী মানেই জীবনের অনেক কিছু থেকে বিরত থাকতে হবে- এই পূর্বানুমান শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বেই কম বেশি আছে; কোথাও কোথাও এই বৈষম্য প্রকট। তবুও একদল দুঃসাহসী রোমাঞ্চপ্রিয় অভিযাত্রিক নারী সকল বাধা অতিক্রম করে নিজেদের ইচ্ছার মাইলফলক স্পর্শ করেন। নিজেই হয়ে ওঠেন নিজের পথের অগ্রদূত। তেমনই ১৬ জন নারী অগ্রদূতের গল্প নিয়ে আমাদের আজকের লেখাটি।
ফিরিয়া স্টার্ক
আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগে ফ্রান্সের প্যারিসে এক দুরন্ত মেয়ের জন্ম হয়। নাম তার ফিরিয়া স্টার্ক। একটু বড় হওয়ার পর তাকে আর ঘরের চার দেয়ালে বেঁধে রাখা গেল না। তার মন ছুটে চলে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বয়স তখন খুব বেশি নয়, মাত্র নয় বছর। এমন সময় ফিরিয়াকে তার দুঃসম্পর্কের এক চাচী উপহার হিসেবে একটি বই পাঠালেন।
বইটির নাম ‘এক হাজার এবং এক রাত’। বইটি মূলত আরব্য লোকগল্পের সমাহার। মুসলিম শাসনের স্বর্ণযুগের বিভিন্ন রোমাঞ্চকর অভিযান, যুদ্ধ ও লড়াইয়ের গল্প। ফিরিয়ার কিশোরী মনে সেসব গল্প উত্তপ্ত লৌহ খণ্ডের বুকে শীতল পানির স্পর্শের ন্যায় দ্রুত আলোড়ন তুললো। তখন থেকে তার শখ, যেভাবেই হোক তিনি আরব বিশ্ব ভ্রমণ করতে বের হবেন।
কিন্তু চাইলেই তো আর আরব বিশ্বে ঘুরতে যাওয়া যাবে না! কারণ তিনি আরব বিশ্ব সম্পর্কে তখনও তেমন কিছু জানতেন না, আর ভাষার সমস্যা তো ছিলই। তাছাড়া ভ্রমণে বের হওয়ার কোনো উপায়ও তার জানা ছিল না। তবে তিনি থেমে থাকলেন না। প্রথমে আরবি ভাষা রপ্ত করলেন। তারপর ফারসি ভাষা। ভাষাতেই শেষ নয়, আরবদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভর্তি হলেন ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ বিভাগে।
এরপর তার আরব যাত্রা শুরু। ঘুরে বেরিয়েছেন সমগ্র আরব বিশ্ব। ইয়েমেন, সিরিয়া, তুরস্ক, ইরাক, সৌদি আরবসহ প্রধান প্রধান সকল দেশ ও শহর। তিনিই প্রথম বিদেশি যিনি দক্ষিণের ‘আরব মরুভূমি’ ভ্রমণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।
তারপর লিখেছেন অনেক বই। বিশেষত ভ্রমণ ও রোমাঞ্চকর অভিযান বিষয়ক। সেখানে তিনি তার নিজের ভ্রমণ পিপাসা জন্মানোর ব্যপারে লিখেছেন-
আমার নবম জন্মবার্ষিকীতে আমার এক দুঃসম্পর্কের চাচী আমাকে একটি বই উপহার দিলেন। বইটি ছিল মূলত অ্যারাবিয়ান নাইটস বিষয়ক। সেই বইটি পড়েই মূলত আমার আরব বিশ্ব ভ্রমণের ইচ্ছা জাগে। সেটিই সম্ভবত আমার প্রধান উৎসাহ।
১৯৩৪ সালে তিনি একটি বই লিখে সবার নজরে আসেন। বইটির নাম ‘দ্য ভ্যালি অফ দ্য অ্যাসাসিনেশন’। সেখানে তিনি কলমের খোঁচায় আরবদের প্রকৃত দৃশ্য বইয়ের পাতায় ফুটিয়ে তোলেন। আরবদের সম্পর্কে বহিঃর্বিশ্বের যে ভুল ধারণা বা পূর্বানুমান রয়েছে তা নিয়েও আলোচনা করেন। আরব বিশ্বে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেন-
সবচেয়ে বড় প্রশান্তির বিষয় হলো আমি একজন নারী হওয়া স্বত্বেও আমাকে কেউ কোনো বাধা দেয়নি। আমাকে বোকা বা অস্বস্তিকর মনে করেনি, যা আমাকে রীতিমতো অবাক করেছে।
প্রায় দুই ডজন বই রচনা করে ১৯৯৩ সালের মে মাসে তিনি ইতালিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অ্যামিলিয়া ইয়ারহার্ট
অ্যামিলিয়া ইয়ারহার্ট ১৮৯৭ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অ্যামিলিয়া মূলত একজন বৈমানিক ছিলেন। প্রথম নারী বৈমানিক হিসেবে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়ার রেকর্ডটি তার দখলে। তবে তার এই যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না। তার সেই রোমাঞ্চকর লড়াইয়ের গল্পটা আজ আপনাদের জানাবো।
ছোটবেলায় এক বান্ধবীকে সাথে নিয়ে তিনি ‘কানাডিয়ান ন্যাশনাল এক্সিবিউশন’ দেখতে যান। সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বিভিন্ন আকাশযানের প্রদর্শনী হচ্ছিল। অ্যামিলিয়া ও তার বান্ধবী খানিকটা আবেগতাড়িত হয়ে বিমানের সংরক্ষিত এলাকায়, তথা একটি বিমানের একেবারে নিকটে চলে গেলেন। এটি ছিল তাদের জীবনে প্রথম বিমান দেখার সুযোগ। এমন সময় একজন বৈমানিক তাদেরকে দ্রুত চলে যেতে বলেন।
বৈমানিকের ভাষা অ্যামিলিয়ার পরিচিত ছিল না, কিন্তু ভাব-ভঙ্গিমায় এতটুকু বুঝতে পারেন যে, তিনি তাদের দুই বান্ধবীকে নিয়ে একটু কটু কথা বলেছেন। এতে অ্যামিলিয়ার মন প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায়। সেই সময়েই কিশোরী মনে জেদ হয়, তিনি নিজেই একদিন বৈমানিক হবেন এবং এসব বিমান নিয়ে পুরো দুনিয়া ঘুরে বেড়াবেন। তবে এই ইচ্ছা পূরণ করার মতো কোনো উপায় তার জানা ছিল না।
১৯১৯ সালে অ্যামিলিয়া প্রথম স্মিথ কলেজে এবং সে বছরেই কলেজ পরিবর্তন করে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হন। ১৯২০ সালটি তার কাছে বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়। সেই বছর ২৮ ডিসেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের লং বিচ এলাকায় একটি আকাশযান প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। অ্যামিলিয়ার বাবা তাকে সেই প্রদর্শনীতে নিয়ে যান। সেখানে টাকার বিনিময়ে বিমানে চড়ানো হতো।
১০ ডলারের বিনিময়ে মাটি থেকে ৬০-৯০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় ঘুরিয়ে আনা হয়। অ্যামিলিয়া তার বাবাকে বিমান ভ্রমণের খরচ দেয়ার জন্য রাজি করিয়ে ফেললেন। অ্যামিলিয়া প্রথমবারের মতো বিমানে উঠলেন এবং ১০ মিনিট আকাশ ভ্রমণের সুযোগ পেলেন। এতে তার বৈমানিক হওয়ার শখ আরও বহুগুণ বেড়ে গেলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যেভাবেই হোক তাকে বৈমানিক হতেই হবে।
কিন্তু বৈমানিক হওয়ার প্রশিক্ষণ বেশ ব্যয়বহুল। এজন্য তখনকার দিনে ১,০০০ ডলারের প্রয়োজন হতো। কিন্তু অ্যামিলিয়া নাছোড়বান্দা। টাকা জোগাড় করার জন্য চাকুরি নিলেন। বিভিন্ন কোম্পানিতে লেখক, ফটোগ্রাফার এমনকি ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন অ্যামিলিয়া। ১৯২১ সালের ৩ জানুয়ারি অর্থ জোগাড় করে তিনি বৈমানিক হওয়ার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হলেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ছিল লং বিচ এলাকায়।
সেখানে তিনি ‘কার্টিস জেএন-৪’ নামক একটি বিমান দ্বারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেন। তার প্রশিক্ষক ছিলেন নিটা স্নোক সাউদার্ন। বিমান পরিচালনা বিদ্যা অর্জন করতে তার মাত্র ৬ মাস সময় লাগলো। এ সময়ে তার মা খুশি হয়ে তাকে ১,০০০ ডলার দেন। ১৯২১ সালের মাঝামঝি সময়ে অ্যামিলিয়া সেই ডলার দিয়ে দুই সিটের ছোট একটি বিপ প্লেন কেনেন। ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি পুরোপুরি বৈমানিকের মর্যাদা লাভ করেন। ১৯২৩ সালের ১৫ মে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান সংস্থা থেকে বৈমানিক হিসেবে লাইসেন্স লাভ করেন।
এর মধ্য দিয়ে তিনি নারী বৈমানিকদের অগ্রদূত হয়ে ওঠেন। বিমান চালনা বিদ্যা নিয়ে তিনি বইও লিখেছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের নানা শহরে। স্বল্প জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করিয়েছেন। ১৯৩৭ সালের ২ জুলাই এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়।
বেরিল মার্কহাম
বেরিল মার্কহামের বয়স তখন ৮০ বছর। তাতে কী! এই বয়সে এসে তিনি বিশ্ব রেকর্ড গড়লেন। বিমান পরিচালনা করে আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্ব পাশ থেকে পশ্চিম পাশ অতিক্রম করলেন, যা তার আগে মাত্র একজন পুরুষ বৈমানিক করতে সক্ষম হয়েছিল। অর্থাৎ নারী হিসেবে তিনিই প্রথম; সামগ্রিক বিবেচনায় দ্বিতীয়।
তিনি এখানেই থেমে থাকেননি। আরও বড় রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি সমগ্র ইউরোপ হয়ে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত টানা ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুসারে যাত্রাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু উড্ডয়নের ২০ ঘন্টার মাথায় বিমানের তেল ফুরিয়ে যায়। একপর্যায়ে তার বিমান বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু ভাগ্য ভালো, তিনি প্রাণে রক্ষা পান। তিনি নোভা নামক এলাকার একটি জলাশয়ে ছিটকে পড়েন। সেখান থেকে দুই জেলে তাকে উদ্ধার করেন।
অভিযান সফল না হলেও তার এই দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডের উৎসাহ দিতে নিউ ইয়র্কে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান। পরবর্তীতে তার এই কাহিনী নিয়ে অনেক নাটক-সিনেমাও নির্মিত হয়েছে।
ইংল্যান্ডে জন্মলাভ করলেও বেরিল মাত্র ৪ বছর বয়সে পরিবারের সাথে কেনিয়া চলে যান। তখন কেনিয়া ব্রিটিশদের কলোনি ছিল। তিনি বৈমানিক হওয়ার পাশাপাশি লেখালেখি ও উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি কেনিয়ায় একটি ঘোড়ার দৌড় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।
জীবনে তিনবার বিয়ে করেছিলেন। নিজ নামের দ্বিতীয় অংশ ‘মার্কহাম’ তার দ্বিতীয় স্বামী ‘মান্সফিল্ড মার্কহাম’ এর নাম থেকে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮৬ সালের ২৩ আগস্ট ৮৩ বছর বয়সে কেনিয়ার নাইরোবিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ইসাবেলা বার্ড
ইসাবেলা বার্ড ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম অনুসন্ধানী লেখক, ফটোগ্রাফার ও পরিবেশবিদ। তিনি ইংল্যান্ডের ব্রগব্রিজ শহরে ১৮৩১ সালের ১৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডের সংসদ সদস্য স্যার ফিলিপ গ্রে ইগার্টনের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরিণত বয়সে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ শুরু করেন।
তিনি বিশ্বখ্যাত পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা রয়েল জিওগ্রাফিক সোসাইটির প্রথম নারী ফেলো নির্বাচিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ভ্রমণ, পরিবেশ বিজ্ঞান ও ফটোগ্রাফি বিষয়ক কমপক্ষে ১৮টি বই প্রকাশ করেন ইসাবেলা।
ভ্রমণের অংশ হিসেবে তিনি আমেরিকা, ভারত, কুর্দিস্তান, ইরান, পারস্য উপসাগর, মরক্কো, তিব্বত, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, জাপান ও চীনসহ নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। তার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা ছিল ব্রিটিশ সেনাদের সাথে বাগদাদ থেকে তেহরান ভ্রমণ করা।
বিয়ের পর তিনি নাম পরিবর্তন করে ইসাবেলা বিশপ রাখেন। তার স্বামীর নাম ছিল জন বিশপ।
১৯০৪ সালে তিনি মরক্কো ভ্রমণে যান। সেখান থেকে ফিরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই অসুস্থতা তার জন্য মৃত্যু নিয়ে আসে। ১৯০৪ সালের ৭ অক্টোবর তিনি দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।
এনি স্মিথ পেক
এনি স্মিথ পেকের প্রধান পরিচয় হলো তিনি একজন আমেরিকান পর্বতারোহী। এছাড়াও তিনি নারীবাদী নেত্রী, লেখক, প্রশিক্ষক ও সুবক্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৮৫০ সালের ১৯ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভিডেন্স শহরে জন্মলাভ করেন তিনি। পড়ালেখা করেন ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে এখানেই শিক্ষকতা করেন।
১৮৮৫ সালে ইতালির কেপ মিজেনো বিজয়ের মধ্য দিয়ে তার পর্বত যাত্রা শুরু হয়। এরপর তিনি ইউরোপ, আমেরিকা, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, মেক্সিকো, সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের অসংখ্য পর্বত বিজয় করেন।
কিন্তু তার শুরুটা মোটেও সুখকর ছিল না। প্রথমদিকে তার কাজকে সবাই ‘অর্থহীন ও হাস্যকর’ বলে পরিহাস করত। তিনি বলেন,
একজন নারীর জন্য পর্বতারোহী হয়ে ওঠা খুবই কঠিন কাজ। বিশেষত এতে অর্থের ব্যয় হয়। স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। পরিশেষে সবাই বোকা ও হাসির পাত্র মনে করে। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
তার সম্মানে ১৯২৮ সালে আমেরিকার দক্ষিণে অবস্থিত হুয়াস্কারান পর্বতের নাম পরিবর্তন করে ‘কেম্বার স্মিথ পেক’ রাখা হয়। ১৯৩৫ সালের ১৮ জুলাই তিনি নিউ ইয়র্ক শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
বেসি কলেমান
বেসি কলেমান বিশ্বের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী পাইলট। পাশাপাশি আদিবাসী আমেরিকান নারী হিসেবেও তিনি সর্বপ্রথম বিমান পরিচালনার লাইসেন্স অর্জনকারী। ১৮৯২ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি আমেরিকার টেক্সাসে জন্মগ্রহণ করেন। পড়ালেখা করেন ল্যাংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ছোটবেলা থেকেই তিনি পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও নারীদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি আমেরিকাতে। নারীদের পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল ফ্রান্সে।
কিন্তু তাতে তিনি থেমে যাননি। প্রথমে ফরাসি ভাষা শেখেন। তারপর টাকা জমিয়ে পাড়ি জমান ফ্রান্সে। সেখানে গিয়ে তিনি একটি পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি বিমান চালনায় দক্ষতা অর্জন করে আমেরিকা ফিরে আসেন এবং আন্তর্জাতিক বিমান পরিচালনা সংস্থার লাইসেন্স অর্জন করেন।
নিজের এই কষ্টকর লড়াই থেকে আমেরিকান ও আদিবাসী নারীদের মুক্ত করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি। এজন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ফান্ড কালেকশন শুরু করেন। কিন্তু ভগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেই স্কুল বাস্তবে রূপদান করার আগেই ১৯২৬ সালের ৩০ এপ্রিল মাত্র ৩৪ বছর বয়সে এক বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এমি ক্রোকার
এমি ক্রোকার ছিলেন একজন আমেরিকান রাজকন্যা। কিন্তু রাজকীয় জীবন তার পছন্দ হল না। ঘুরে বেড়িয়েছেন এ দেশ থেকে ও’ দেশ। চির বোহেমিয়ান জীবনকে করে তুলেছেন রহস্যময়। লিখে গেছেন অসংখ্য বই।
এমির জীবনের অন্যতম রহস্যময় অধ্যায় তার প্রেমের জগত। অসংখ্য পুরুষের প্রেমে পড়েছেন অথবা অসংখ্য পুরুষ তার প্রেমে পড়েছে। বিয়েও করেছেন অনেক, অন্তত পাঁচজন স্বামীর সন্ধান তো পাওয়াই যায়।
১৮৬৪ সালের ৫ ডিসেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বয়স যখন মাত্র ১১ বছর তখন তার বাবা এডউইন বি ক্রোকার মারা যান। মারা যাওয়ার সময়ে তিনি তৎকালীন ১০ মিলিয়ন ডলার অর্থ রেখে যান। এর দুই বছর পর মা মারগ্রেন্টস রোডস এমিকে পড়ালেখা করার জন্য জার্মানির স্কুল অফ ড্রেসডেনে পাঠান। সেখানে গিয়েই মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার প্রথম প্রেমের যাত্রা শুরু হয়। প্রথম প্রেমিকের নাম ছিল প্রিন্স আলেকজান্ডার অফ সাক্স উইগমা। এরপর বিভিন্ন সময়ে নানা প্রেমিক ও স্বামীদের সূত্রে পৃথিবীর অসংখ্য জায়গায় ভ্রমণ করে বেড়ানোর সুযোগ পান তিনি।
তবে তার মৃত্যুর সময়ে শুধু তৃতীয় স্বামী জ্যাকসন গৌরুড এবং ৫ সন্তানের মধ্য থেকে ২ কন্যা পাশে ছিল। ১৯৪১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি নিউ ইয়র্কে মৃত্যুবরণ করেন।
রেইমন্ড ডি লারোচে
রেইমন্ড ডি লারোচে ১৮৮২ সালের ২২ আগস্ট ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণকারী পাইলট। তিনি বিশ্বের প্রথম লাইসেন্সধারী নারী পাইলট।
ছোট বয়সেই তিনি খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কিশোরী বয়সে যোগ দেন নাট্যদলে।
১৯০৮ সালে এক বিমান প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে গেলে তার মধ্যে পাইলট হওয়ার ইচ্ছা জাগে। পাশাপাশি বিশিষ্ট পাইলট উইলবার রাইট তার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। ফলে ১৯০৯ সালে তিনি বিমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন। সে বছরের ২২ অক্টোবর তিনি ‘ভিশন’ নামক একটি বিমান পরিচালনা করে দক্ষতার প্রমাণ দেন।
১৯১০ সালের জুলাই মাসে ১ সপ্তাহব্যাপী বিমান প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের মহড়ায় অংশ নিচ্ছিলেন। মহড়ার একপর্যায়ে ৮ জুলাই তার বিমান বিধ্বস্ত হয়। তিনি মাটিতে ছিটকে পড়েন। অনেকের ধারণা ছিল, তিনি হয়তো আর বাঁচবেন না। কিন্তু ২ বছর পরে সুস্থ হয়ে তিনি আবার বিমান পরিচালনায় যোগ দেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর পাইলট হিসেবে যোগদান করেন এবং অনেকগুলো অপারেশন সাফল্যের সাথে পরিচালনা করেন।
প্রথম দুর্ঘটনায় জীবন রক্ষা হলেও দ্বিতীয়বার আর সেই সুযোগ পেলেন না রেইমন্ড। ১৯১৯ সালের ১৮ জুলাই এক বিমান দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। এভাবেই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বিশ্বের প্রথম নারী পাইলট জীবন হারান।
এ পর্যন্ত আপনাদের সামনে মোট আটজন নারী অগ্রদূতের জীবনের গল্প তুলে ধরা হলো। আগামী পর্বে আরো আটজনকে নিয়ে আমরা আলোচনা করবো। আজ এ পর্যন্তই।
ফিচার ইমেজ- telegraph.co.uk