ডেনজেল ওয়াশিংটন; হলিউডের সুপরিচিত এক নাম। তার সফলতার আগে হলিউডের পরিচালক, প্রযোজক, সমালোচকরা বিশ্বাস করতেন, একজন কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাকে মূল নায়ক হিসেবে শ্বেতাঙ্গ দর্শকরা গ্রহণ করতে অভ্যস্ত নন। ডেনজেল ওয়াশিংটন এই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেছেন। মঞ্চ কিংবা সিনেমা সবখানেই তিনি তার অভিনয়ের সুবাদে পেয়েছেন তুমুল দর্শকপ্রিয়তা।
তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা, যিনি আজ পর্যন্ত নয়বার অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন এবং দুবার অস্কার জিতেছেনও। তার মতো মাত্র পাঁচজন অভিনেতা অস্কারে সেরা অভিনেতা ও পার্শ্ব অভিনেতা উভয় পুরষ্কার জিতেছেন। বাকি পাঁচজনের মাঝে আছেন রবার্ট ডি নিরো, জিন হেকম্যান, কেভিন স্পেসি, জ্যাক ল্যামন এবং জ্যাক নিকলসন।
ডেনজেলের জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্কে। তার বাবা ছিলেন একজন ধর্মযাজক এবং মা কেশ পরিচর্যাকারী। এ দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে ডেনজেল ছিলেন মেঝ। শৈশব ও কৈশোরে ডেনজেল কখনো অভিনেতা হওয়ার কথা চিন্তাও করেননি। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা থাকায় তার প্রথম পছন্দের বিষয় ছিল জীববিজ্ঞান এবং এ বিষয় নিয়েই তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তীতে বিষয় পাল্টে ভর্তি হলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। পরবর্তীতে তা-ও পছন্দ না হওয়ায় শেষে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।
সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা যখন প্রায় ঠিক, তখনই হুট করে সহপাঠীদের জোরাজুরিতে তাদের একটি নাটকে অভিনয় করলেন। এ অভিনয় তার পেশাগত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। পড়াশোনা শেষে তিনি চলে গেলেন সানফ্রান্সিকোতে এবং সেখানকার আমেরিকান কনজারভেটরি থিয়েটারে যোগদান করলেন। অবশ্য এর আগেই ডেনজেল নিউ ইয়র্কের ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।
আমেরিকান কনজারভেটরি থিয়েটারে এক বছর কাজ করার পর ডেনজেল স্বাধীনভাবে পেশাদার অভিনয়ের মাধ্যমে উপার্জনের সুযোগ খুঁজতে শুরু করলেন। তিনি প্রথমে ম্যারিল্যান্ডের মঞ্চে উইংস অব দ্য মর্নিং নাটকে অভিনয় করে নজর কাড়েন। পরবর্তীতে তার অভিনয়ের দক্ষতার কারণে বিভিন্ন টেলিভিশন সিরিজে তাকে সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে কার্বন বয় সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথম বড় পর্দায় কাজ করেন।
১৯৮০ এর দশকে তিনি সমান তালে টেলিভিশন সিরিজ ও সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি যখন গ্লোরি সিনেমায় অভিনয়ের কারণে সেরা সহ-অভিনেতার অস্কার পুরষ্কার জেতেন, তারপর থেকে সিনেমার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে শুরু করেন। নব্বইয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত তার অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করে রেখেছে। এ সময় তিনি সত্য ঘটনা ও আত্মজীবনী কেন্দ্রিক অনেকগুলো সিনেমায় অভিনয় করেছেন, যার মধ্যে আছে মধ্যে আছে ম্যালকম এক্স (১৯৯২), দ্য হারিকেন (১৯৯৯), রিমেম্বার দ্য টাইটানস (২০০০), দ্য গ্রেট ডিবেটার্স (২০০৭), আমেরিকান গ্যাংস্টার্স (২০১০) ইত্যাদি।
ম্যালকম এক্স এবং দ্য হারিকেন সিনেমায় তিনি অস্কারের জন্য মনোনীত হলেও চূড়ান্ত পুরষ্কার আর পাননি। ২০০১ সালে ট্রেইনিং ডে সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি সেরা অভিনেতার অস্কার লাভ করেন। ম্যালকম এক্স চরিত্রটি তাকে এতটাই মুগ্ধ করে যে, তিনি ম্যালকম এক্সের সম্মানে তার এক পুত্রের নাম রাখেন ম্যালকম। সত্য ঘটনা কিংবা আত্মজীবনী কেন্দ্রিক সিনেমা ছাড়াও নব্বইয়ের দশকে ডেনজেল বেশ কিছু বিনোদনধর্মী বড় বাজেটের সিনেমায়ও কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দ্য পেলিকান ব্রিফ (১৯৯৩), ফিলাডেলফিয়া (১৯৯৩), ক্রিমসন টাইড (১৯৯৩) ও কারেজ আন্ডার ফায়ার (১৯৯৬)। এর মাঝে কারেজ আন্ডার ফায়ার সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তাকে দশ মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়।
পর্দায় ডেনজেল বেশিরভাগ সময়ই একজন শক্তপোক্ত দৃঢ় চরিত্রের মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেন। তার অভিনয়ে একধরনের সহজাত ভাব আছে। ২০০০ সাল থেকে তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে আছে আউট অব টাইম (২০০৩), ম্যান অন ফায়ার (২০০৪), ইনসাইড ম্যান (২০০৬), দ্য টেকিং অব ফেলহ্যাম ১২৩ (২০০৯), আনস্টপেবল (২০১০), ফ্লাইট (২০১২), সেফ হাউজ (২০১২), টু গানস (২০১৩), দ্য ইকুইলাইজার (২০১৪) ইত্যাদি। অভিনয়ের পাশাপাশি ডেনজেল ওয়াশিংটন পরিচালক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন। ২০০২ সালে তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা এন্টনি ফিশার মুক্তি পায়। এরপর তিনি আরও দুটো সিনেমা পরিচালনা করেছেন।
১৯৭৭ সালে এক টেলিভিশন সিরিজে অভিনয় করার সময় ডেনজেলের সাথে পরিচয় হয় সহ-অভিনেত্রী পল এটার। পরিচয়ের পাঁচ বছর পর তারা বিয়ে করেন। ১৯৮৪ সালে তাদের প্রথম পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ১৯৮৭ সনে তাদের কন্যার জন্ম হয়। ১৯৯১ সালে ডেনজেল পরিবারে জমজ দুই পুত্রের আগমন ঘটে। ডেনজেল বর্তমানে সপরিবারে লস অ্যাঞ্জেলেসে বসবাস করছেন।
এ পর্যন্ত যারা তার সাথে সিনেমায় অভিনয় করেছেন তারা সবাই তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছেন। টম হ্যাঙ্কস তো মুগ্ধ হয়ে বলেই ফেলেছেন, এখন পর্যন্ত যত অভিনেতার সাথে তিনি কাজ করেছেন তাদের ভেতর সবচেয়ে বেশি অভিনয় তাকে শিখিয়েছেন ডেনজেল ওয়াশিংটন। ডেনজেলের সাথে কাজ করা আর অভিনয় স্কুলে অভিনয় শেখা একই কথা। ডেনজেল নিজে অবশ্য আল পাচিনো ও রবার্ট ডি নিরোর সাথে সব সময় অভিনয় করতে মুখিয়ে থাকেন। এছাড়াও জিন হ্যাকম্যান, জুলিয়া রবার্টস ও ডাকোটা ফেনিংয়ের সাথে অভিনয় করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছেন বলে স্বীকার করেন। অভিনয় জগতে ডেনজেল ওয়াশিংটন জুলিয়া রবার্টসের খুব ভাল বন্ধু।
ডেনজেল ওয়াশিংটনের সিনেমা কেবলই যে অভিনয় দক্ষতার প্রকাশ- তা কিন্তু নয়। বাণিজ্যিকভাবেও তার সিনেমার রয়েছে সফলতা। পরিচালক, প্রযোজকরা তাকে নিয়ে সিনেমা করে বাণিজ্যিক সফলতা সর্ম্পকে একধরনের নিশ্চয়তা পান। ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক রিপোর্ট অনুসারে, ডেনজেলের পেছনে যত টাকা ব্যয় করা হয়, তার দশগুণ অর্থ সাধারণত প্রযোজকরা বাজার থেকে আয় করতে সক্ষম হন।
ফোর্বসের হিসেব মতে, ডেনজেলের মোট সম্পদের পরিমাণ ২২০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ডেনজেল তার দানশীলতার জন্যও বিখ্যাত। ২০০৬ সালে তিনি আফ্রিকার শিশুদের কল্যাণের জন্য এক মিলিয়ন ডলার দান করেন। নেলসন ম্যান্ডেলার শিশু তহবিল এবং এইডস আক্রান্ত রোগীদের জন্য তিনি বেশ মোটা অংকের অর্থ দান করেছেন।
ডেনজেল সুবক্তা হিসেবেও পরিচিত। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও বক্ততায় জীবনঘনিষ্ঠ তার বক্তব্যগুলো বিপুল প্রশংসিত হয়েছে। নিজের পঞ্চাশ বছর বয়সে পদার্পণ উপলক্ষ্যে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমার এক বন্ধু প্রায়ই বলেন, প্রথম পঞ্চাশ বছর ছিল অন্যের জন্য। পরের পঞ্চাশ বছর আমার নিজের জন্য। ব্যাপারটাকে আমি এভাবেই দেখতে পছন্দ করি।
অবশ্য এই পরের পঞ্চাশ বছরে আপনি আপনার পরিচিত মানুষদের মৃত্যুবরণ করতে দেখবেন। আর ওদের কবর দেওয়ার সময় চিন্তা করবেন কত অল্প বয়সে ওরা মারা যাচ্ছে। সম্প্রতি আমার এক বন্ধু ৫৮ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। যখন আমার বয়স ছিল ২০ বছর, তখন ৫৮ বছর ছিল অনেক বয়স। এখন এটা কোনো বয়সই না।
নিজের অভিনয় সর্ম্পকে ডেনজেল ১৯৯৫ সালে বলেছিলেন, জনপ্রিয় ও বিখ্যাত হওয়ার চিন্তা আমি কখনও করিনি। তারকা হওয়ার জন্য আমি অভিনয়ে আসিনি। মঞ্চে আমি যখন অভিনয় শুরু করি, তখন আমি কেবল অভিনয়টাই ভালোভাবে করতে চেয়েছি, যা আমি এখনও চেষ্টা করে চলেছি। আমি নিজেকে কখনোই একজন চিত্রতারকা হিসেবে চিন্তা করতে পারি না। এমনকি তা হওয়ার কোনো ইচ্ছাও আমার নেই।
আমি কেবলই একজন অভিনেতা, যে মানুষকে বিনোদন দিয়ে চলেছে। আমি আরো নিখুঁত অভিনয় করতে চাই। মানুষ আমার সর্ম্পকে যা ভাবে বা চিন্তা করে, তার সাথে আমি বা আমার কাজের উদ্দেশ্যে মিল আছে সামান্যই। হয়তো ভবিষ্যতে আমার চিন্তা পাল্টেও যেতে পারে, কিন্তু আপাতত আমি এমনিই। আমি সব সময়ই এক শিক্ষকের উপদেশ মেনে করে কাজ করি। তিনি বলেছিলেন, ব্যর্থ হওয়ার ভয়ে কখনও ভয় পাবে না।
অন্যান্য তারকা অভিনেতাদের মতো ডেনজেল ওয়াশিংটনের সাথেও গণমাধ্যমের সর্ম্পকটা অম্ল-মধুর। বর্তমান যুগের সংবাদপত্র সর্ম্পকে তার মন্তব্য হচ্ছে, এখন ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পত্রিকা না পড়লে কিছুই জানবেন না। আবার পড়লে ভুল জানবেন। এখন সবাই কে কার আগে আপনাকে বিষয়টা জানাবে সেই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। বিষয়টা সত্য না মিথ্যা সেই সর্ম্পকে কারো কোনো মাথাব্যথা নাই। অথচ সত্যিকার গণমাধ্যমের কাজ প্রতিযোগিতার চেয়ে সত্যটা জানানো।