এক নারীর গল্প জানাবো আজ। এদেশের নারীদের প্রথম শিক্ষার আলো দেখিয়েছিলেন যিনি, বাঙালি মুসলিম নারীদের শিক্ষার অধিকারের জন্য লড়েছিলেন যিনি, সেই মহীয়সী নারী হলেন বেগম রোকেয়া। তিনিই প্রথম নারীদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার কথা ভেবেছিলেন। বঙ্গীয় নারীদের মধ্যে তিনিই কলম ধরেন। কলম ধরেন নারীকে পণ্যকরণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাতে। যার লেখনীতে ঘোষিত হয়েছিল মানুষ হিসেবে ভগিনীদের আত্মসম্মান ও নিজস্ব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার কথা।
সেই আলোকিত মানুষের জীবনের প্রথম অধ্যায়ের কথা আমরা উল্লেখ করেছি এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে। সেখানে আপনারা জেনেছেন তার জন্ম ইতিহাস, তার পরিবার, বেড়ে ওঠা এবং তার জ্ঞানচর্চার কথা। জেনেছেন তার বড় ভাইয়ের সাহায্য, বড় বোনের স্নেহময় আশ্রয়ের কথা। আজকের এই লেখায় থাকছে তার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের কথা।
শৈশব কাটিয়ে তখন রোকেয়া বড় হয়ে উঠছেন। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তাকে বড় ভাইয়ের সাহায্যে বইখাতার রঙিন দুনিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এদিকে রোকেয়ার মা মেয়ের বিয়ের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। জমিদার বাড়ির মেয়ের বিয়ের জন্য চারিদিক থেকে বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত ছেলের প্রস্তাব আসতে থাকে। তাছাড়া রোকেয়া ছিলেন দেখতেও বেশ সুন্দরী। কিন্তু সুপাত্রের প্রস্তাব আসলে কী হবে, রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের ও তার বড় বোন করিমুন্নেসা উভয়ই রোকেয়ার লেখাপড়ার মতো বিয়ের ব্যাপারেও ছিলেন সচেতন ও খুঁতখুঁতে। আর ভাই ইব্রাহিম সাবের চেয়েছিলেন কোনোভাবেই যেন রোকেয়ায় লেখাপড়া বন্ধ না হয়।
অনেক খুঁজে শেষ পর্যন্ত পাত্র হিসেবে নির্বাচিত হলেন সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন, বাড়ি বিহারের ভাগলপুর। তিনি লেখাপড়া করেছেন হুগলি কলেজে, বি.এ পাশ করা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তবুও কিছু সমস্যা যেন থেকেই গেল, দীর্ঘদেহী সাখাওয়াত হোসেন দেখতে তেমন সুন্দর ছিলেন না, তার ওপর তার বয়সও ছিলো কিছু বেশি। এসব ছাড়াও সাখাওয়াত ছিলেন বিপত্নীক। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও কেন ভাই ইব্রাহিম সাবের সাখাওয়াতকেই নির্ধারণ করেছিলেন প্রিয় বোনটির জীবনসঙ্গী হিসাবে? কারণ পাত্রের অমায়িক ব্যবহার, মাতৃভক্তি আর জ্ঞানচর্চার জন্য অপ্রতুল শ্রদ্ধাবোধ।
ইব্রাহিম চেয়েছিলেন বিয়ে হওয়ার পর রোকেয়ার লেখাপড়া যেন থেমে না যায়। এই লক্ষ্যে পাত্র নির্বাচনে ইব্রাহিম ভুল করেননি। সাখাওয়াতের সাথে বিয়ে রোকেয়ার জন্য পৃথিবীর বিশাল কর্মযজ্ঞের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। সাখাওয়াত হোসেন রোকেয়ার লেখাপড়ার প্রতি বেশ যত্নশীল ছিলেন। এমনকি তিনি রোকেয়ার স্বাধীন সাহিত্যচর্চার দিকেও মনোযোগ দিতেন।
তিনি চেয়েছিলেন সংসারের চাপে যেন রোকেয়ার প্রতিভা বা আগ্রহ কোনোটাই মুখ থুবড়ে না পড়ে। নিরিবিলিতে বসে সাহিত্য সাধনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাখাওয়াত হোসেন রোকেয়াকে একটি অষ্টভূজাকৃতির ঘর তৈরি করে দেন। স্বামীর অনুপ্রেরণা আর সাহায্যই জীবনের এই অধ্যায়ে রোকেয়াকে নিজের পথে অচল থাকতে সাহায্য করে। সাখাওয়াতের কাছেই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন রোকেয়া, পড়তে শুরু করেন দেশি-বিদেশি ইংরেজি বই ও পত্রিকা।
রোকেয়া ভাগলপুরে প্রথম প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। সাখাওয়াতের পরামর্শ ও সাহায্যে রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত করেন এই বালিকা বিদ্যালয়। এই উদ্দেশ্যে স্বামীর কাছে রোকেয়া পান প্রায় দশ হাজার টাকা। রোকেয়ার প্রয়োজন হলো আরেকটু সাহায্য আর অনুপ্রেরণার, নিজের কাছে নিয়ে এলেন ছোট বোন হোমায়রাকে। কিন্তু তাতে সমস্যা শুরু করলেন স্বামীর প্রথম পক্ষের কন্যা ও তার জামাতা এবং স্বামীর অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরা। কিন্তু জ্ঞানের নেশায় মগ্ন রোকেয়া তো সম্পত্তির লোভ করেননি।
বাংলার মুসলিম সমাজে তখন মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক বা ঘরোয়া কোনো শিক্ষা ছিল না বললেই চলে। তাই এই স্কুলের জন্য সব ছেড়ে দিতেও তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হননি। যদিও জীবিত থাকতেই সাখাওয়াত হোসেন এই স্কুলের জন্য অর্থের যোগান দিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে ভাগলপুরে এই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় তার মৃত্যুর পর।
১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শাহ মালেক আব্দুলের সরকারি বাসভবন গোলকুঠির বারান্দায় পাটি বিছিয়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। সম্বল একখানা বেঞ্চের মাত্র পাঁচজন ছাত্রী, তার মধ্যে ছিলো আব্দুল মালেকেরই চার কন্যা। ‘স্কুল কি ফুপ্পি’ বলে ছাত্রীরা চিনলো রোকেয়াকে নতুন পরিচয়ে। বোরখা পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে লাগলেন রোকেয়া, কিন্তু লাভ হলো না কিছু।
সেই অবস্থায় মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা এক দুঃসাধ্য সাধন করা বললেই চলে। আর সেই সাহসিকতার মূল্যও দিতে হয়েছিলো রোকেয়াকে নিজের আত্মীয় ও সমাজের চক্ষুশূল হয়ে। স্বামীর প্রথম স্ত্রীর কন্যাকে নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করেছিলেন তিনি। অথচ সেই মেয়েই বড় হয়ে স্বামীর সাথে মিলে রোকেয়ার বিরুদ্ধাচরণ করলো, সমালোচনা করলো রোকেয়ার সামাজিক কর্মকান্ডের। অন্যদিকে পূর্বেই সাখাওয়াত আর রোকেয়ার সংসারে পরপর দুটি কন্যাসন্তান আসলেও সবই অকালে মারা যায়।
সরকারি চাকরি করার জন্য সাখাওয়াতকে ঘুরতে হতো ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন ধরনের খাদ্যাভ্যাসের কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এছাড়া সাখাওয়াতের ছিলো বহুমূত্র রোগ, একসময় এই রোগের করাল গ্রাসেই নিজের দুই চোখ হারান তিনি, হয়ে পড়েন শয্যাশায়ী। রোগীর ওষুধপত্র ও সেবাযত্ন নিয়েই দিন কেটে যেতে থাকতো রোকেয়ার। একসময় ভাগলপুর থেকে সাখাওয়াতকে কলকাতায় আনা হয় চিকিৎসার জন্য। কলকাতায় ১৯০৯ সালের ৩ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এরপরই রোকেয়ার জীবনে এক কঠিন সময় আসে। চৌদ্দ বছরের বিবাহিত জীবনের ইতি ঘটার সাথে সাথে রোকেয়া যেন পরোক্ষভাবে মুক্তি পেয়ে যান সাংসারিক সকল বন্ধন থেকে। স্বামীর মৃত্যুর পর সেখানকার আত্মীয় বা স্বামীর প্রথমা স্ত্রীর কন্যা কেউই রোকেয়ার সাথে শোভন আচরণ করেননি। এর প্রধান কারণ যে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি তা অনুমান করতেও কারো তেমন কষ্ট হওয়ার কথা না। রোকেয়ার জীবনী, তার ব্যক্তিগত চিঠি ও আত্মীয়দের বর্ননা থেকে এসব বিষাদময় ঘটনার কথা জানা যায়। কিন্তু এই বিচ্ছেদ, এই বাধা বিপত্তি রোকেয়াকে দমন করতে পারেনি।
আত্মশক্তিতে বলিয়ান রোকেয়া সাহসও হারাননি কোনো বিপদে, নিয়েছেন সঠিক সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত। এই মনোবল আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুণই রোকেয়ার জীবনকে করে তোলে অনন্য। আত্মীয়স্বজনদের দুর্ব্যবহার ও বৈষয়িক জটিলতার শিকার হয়ে রোকেয়া একসময় ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বাস করা শুরু করেন। রোকেয়ার স্থানান্তরের সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে যায় ভাগলপুরে বহু কষ্টে তার স্থাপন করা বালিকা বিদ্যালয়টি। কিন্তু তা-ই বলে মনোবল হারাননি রোকেয়া, কলকাতায় এসে নতুন করে শুরু করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের পথচলা।
অনেক দুঃখের বোঝা মাথায় নিয়েও নিজেকে অসহায় বিধবা ভাবেননি রোকেয়া। ১৯১০ সালের ৩ ডিসেম্বর যখন রোকেয়া ভাগলপুর থেকে কলকাতায় আসেন তখন নির্ভরযোগ্য আপনজন বলতে কেউ ছিলো না তার। কিন্তু মনে ছিলো বিশ্বাস। ৩০ বছর বয়সী রোকেয়া কলকাতায় এসেই হাত দেন নিজের অসম্পূর্ণ কাজে। ১৩ ওয়ালিউল্লাহ রোডে বাড়ি ভাড়া করে প্রতিষ্ঠা করলেন মেয়েদের স্কুল সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়।
১৬ মার্চ, ১৯১১ সাল শনিবারে দুটো বেঞ্চ আর আটজন মাত্র ছাত্রীকে নিয়ে রোকেয়া স্কুলের প্রথম ক্লাস করলেন। স্কুলের শিক্ষিকা মাত্র একজন, রোকেয়া নিজেই। তার না ছিল কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি, না ছিলো বাড়ির বাইরে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা। কেবল মনোবল আর ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে তিনি দাঁড় করিয়ে ফেলেন সমাজের অন্ধকার সময়ে এরকম এক আলোর প্রতিষ্ঠান। স্কুল পরিচালনার জন্যও অভিজ্ঞতার দরকার, রোকেয়া সমাজের প্রভাবশালী মহিলাদের সাহায্যে কলকাতা বেথুন, গোখেল মেমোরিয়াল প্রভৃতি মেয়েদের স্কুলে নিয়মিত যাতায়াত করা শুরু করলেন, শিক্ষকদের পড়ানোর ধরন, স্কুল পরিচালনার পদ্ধতি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে থাকেন।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষার নিগুঢ় অর্থ বুঝেছিলেন রোকেয়া, তাই তো শিক্ষাকে তিনি নিজের ভাষায় বলে গেছেন-
শিক্ষার অর্থ কোনো সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের অন্ধ অনুকরণ নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা। আমি কেবলমাত্র ‘পাশ করা বিদ্যা’কে প্রকৃত শিক্ষা বলি না।
১৪ নং রয়েড স্ট্রিটের ব্যারিস্টার আব্দুর রসুলের বাড়িতে স্কুলের পরিচালনা কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে মৌলভী সৈয়দ আহমদ আলীকে কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হয়। মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে, অভিভাবকদের বুঝিয়ে, নিজের আন্তরিক প্রচেষ্টার পরেও বাঙালিদের মধ্যে প্রথমদিকে নারী শিক্ষার জন্য তেমন সাড়া ফেলতে পারলেন না রোকেয়া। তাই স্কুলের শিক্ষার মাধ্যম উর্দুই রাখতে হলো। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের সকল ছাত্রীই লেখাপড়া করতেন বিনা বেতনে। এমনকি তাদের যাতায়াতের জন্য স্কুলের পক্ষ থেকে যে গাড়ি দেওয়া হতো সে গাড়ির ভাড়াও মওকুফ করে দেওয়া হতো। তবুও ছাত্রীদের শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টার জন্য নিরন্তর যুদ্ধ করে যেতে হতো রোকেয়াকে।
নিজের সমস্ত সম্বল তিনি ব্যয় করেছিলেন এই স্কুলের পেছনে। বিনিময়ে গ্রহণ করতেন সামান্য বেতন। তবু এর মধ্যেই স্কুল চালু হওয়ার শুরুর দিকেই নেমে এলো এক বিশাল বিপর্যয়। কলকাতার বার্মা ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গিয়ে সাখাওয়াতের রেখে যাওয়া স্কুলের জন্য অনুদানের টাকাসহ রোকেয়াকে মোট তিরিশ হাজার টাকা হারাতে হয়। ফরিদপুরের কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের কাছে রক্ষিত টাকাও রোকেয়া কোনো দিন ফেরত পাননি।
চলার পথে এত বাধার পরও রোকেয়া দমে যাননি। বরং সময়ের সাথে সাথে ছোট্ট স্কুলকে পরিপূর্ণ শিক্ষা নিকেতনে পরিণত করেন। একদিকে যেমন ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে,অন্যদিকে বিভিন্ন দিক থেকে আসতে থাকে সাহায্য আর অনুদান। স্কুল প্রতিষ্ঠার এক বছর পর, ১৯১২ সাল থেকে অনেক চেষ্টার করে ৭১ টাকার সরকারি অনুদান পায় স্কুল। রেঙ্গুন থেকে এক ব্যক্তির পাঠানো সাতাশ টাকার অনুদান পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন বেগম রোকেয়া। সমাজের ধনী ও সচেতন শ্রেণীর পাঠানো অনুদান স্কুল চালানোর কাজে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
প্রায় তিন বছর পর সরকারি অনুদান বেড়ে হলো ৪৪৮ টাকা। এরই মধ্যে ছাত্রী ও ক্লাস সংখ্যা বেড়ে গেলে দুবার স্থান পরিবর্তন করে শেষ পর্যন্ত স্কুলটিকে নিয়ে আনা হলো ৮৬/এ লোয়ার সার্কুলার রোডের একটি দ্বিতল বাড়িতে। ১৯১৫ সালে মাত্র ৫টি ক্লাস নিয়ে স্কুলটি প্রাথমিক পর্যায়ে উন্নীত হলো। রোকেয়ার অনেক চেষ্টায় শিক্ষার মাধ্যম উর্দু থেকে ইংরেজি করা হলো। একসময় স্কুলটি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষণোপোযোগী হয়।
১৯৩১ সালে রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা প্রথমবারের মতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং স্কুলের প্রায় ৬০০ ছাত্রী বঙ্গীয় শিক্ষা পরিষদের পরীক্ষায়ও কৃতিত্বের সাথে পাশ করে। সেই থেকে এখনো এই স্কুল অত্যন্ত সফলভাবে নারী শিক্ষায় নিজের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে চলেছে। রোকেয়ার মৃত্যুর পর ১৯৩৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে সরকার এই স্কুলের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করে।
বর্তমানে এটি পশ্চিমবঙ্গের একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কঠোর সাধনা আর অধ্যবস্যায়ের মধ্য দিয়ে এই স্কুলের ভিত রচনা করেছিলেন রোকেয়া নিজে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত ছাত্রীদের মেনে চলতে হতো সুনির্দিষ্ট নিয়মাদি ও রুটিন। স্কুলের কল্যাণের জন্য নিজের ছোট বোন হোমাইরাকে ছাত্রীদের হোস্টেল পরিচালিকা নিযুক্ত করেন। ছাত্রীদের জন্য তৈরি তার শিক্ষাপদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও প্রশংসার দাবিদার।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা, হাতের কাজ, সেলাইয়ের কাজ, এমনকি শরীরচর্চার শিক্ষা ছাত্রীদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিলো। ভাবা যায়? যে সময়ে মেয়েদের বাড়ির বারান্দায় আসার আগে দুবার ভাবতে হতো, তখন রোকেয়া ভেবেছিলেন মেয়েদের শরীরচর্চা শিক্ষার কথা! কত সুদূরপ্রসারী চিন্তাশীল ছিলেন তিনি! ১৯৩০ সালের পর থেকেই রোকেয়ার শরীর ভেঙে পড়তে থাকে, বাসা বাঁধে নানা রোগ। ডাক্তারের পরামর্শে তার অনেকগুলো দাঁত তুলে ফেলতে হয়, পেটের সমস্যার সাথে সাথে দেখা দেয় কিডনির সমস্যা। এ সময় মাঝে মাঝে হাওয়া পরিবর্তন ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য যেতেন ঘাটশিলায়।
কিন্তু কাজের টানে আর মনের বলে বারবার ফিরে আসতেন কলকাতায়। ১৯৩২ সালের ৮ ডিসেম্বর রোকেয়া রোজকারমতো রাত ১১টা পর্যন্ত লেখালেখি করে ঘুমাতে যান। ৯ ডিসেম্বর ভোর চারটায় ঘুম থেকে জেগে ওজু করেই কেমন যেন অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ডাক্তার আসার আগেই ভোর ৫:৩০ মিনিটে ঢলে পড়েন তিনি। দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে কলকাতা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে চব্বিশ পরগণার সোদপুরের শুকচার এলাকায় আত্মীয় আব্দুর রহমান খানের পারিবারিক কবরস্থানে বেগম রোকেয়া চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
বাংলায় নারী শিক্ষায় তার মহিয়সী হয়ে ওঠার সম্পূর্ণ জানতে “বেগম রোকেয়া ও নারীজাগরণ” এই বইটি পড়ুন।