আজ থেকে বছর দুই আগেও যদি কেউ নিছকই শখের বশে গুগল ম্যাপে স্যাটেলাইট থেকে তোলা কক্সবাজার অঞ্চলের দিকে চোখ বোলাতেন, দেখতে পেতেন বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ঘন বন। বন্য হাতিদের অভয়ারণ্য ছিল সেটি। মনের আনন্দে সেখানে ঘুরে বেড়াতো নানা রকমের জীবজন্তু। কিন্তু এখন কক্সবাজারের দৃশ্যপট একেবারেই পাল্টে গেছে। একসময় যেখানে ছিল সবুজের সমারোহ, যেখানে ছিল পাহাড়, এখন সেসব জায়গাতেই শুধু মানুষ আর মানুষ। আর ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ঘরবাড়ি। বন বা পাহাড়ের ছিটেফোঁটাও আর সেখানে অবশিষ্ট নেই।
এর কারণ হলো, কক্সবাজারের কুতুপালং ও পার্শ্ববর্তী বালুখালি গ্রাম এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। গত বছরের আগস্ট মাসে মিয়ানমার থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিতে শুরু করে এই অঞ্চলে। এবং এখন এখানে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ। ৫,৮০০ একর জায়গা জুড়ে এখন তাদের বাস। আর তাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বনভূমি। জ্বালানীর জোগান দিতে প্রতিনিয়ত কেটে ফেলা হচ্ছে আরও অসংখ্য গাছ। হাতেগোনা কিছু রোহিঙ্গা এনজিওর থেকে পাওয়া এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করলেও, শতকরা ৯৫ ভাগ রোহিঙ্গাই জ্বালানীর জন্য হয় নিজেরাই বন থেকে গাছ কেটে আনছে, নয়তো স্থানীয় বাজার থেকে কাঠ কিনছে।
এভাবে চলতে থাকলে, ২০৫০ সাল নাগাদ কক্সবাজার পরিণত হবে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল থেকে ভয়াবহতম জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হওয়া জেলায়। ২০১৮ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল এমনই তথ্য। সেখানে কেবল সম্ভাবনার দিকে আলোকপাত করা হলেও, যতই দিন যাচ্ছে, সেই সম্ভাবনা ততই বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন কী?
জলবায়ু বলতে মূলত কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের ৩০-৩৫ বছরের গড় আবহাওয়াকে বোঝায়। আর যদি এই গড় আবহাওয়ার বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়, তাহলে বলা হয়, ঐ অঞ্চলের জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। প্রচলিত ভাষায় একে আমরা গ্রিন হাউজ ইফেক্ট হিসেবেই অভিহিত করে থাকি।
কক্সবাজারের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ কী?
বৃক্ষ নিধনের ফলে গ্রিন হাউজ ইফেক্ট দেখা দেয় এবং জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে, এটা তো আমরা সকলেই জানি। এবং ঠিক এ কারণেই কক্সবাজারের জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও জ্বালানীর চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রতিদিনই একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এই অঞ্চলের বনাঞ্চল।
তৈরি হচ্ছে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পাহাড়গুলো পাথুরে নয়। বরং এ দেশের পাহাড়গুলোর ভিত্তি হলো নরম মাটি। গাছের শিকড় থেকে এই পাহাড়গুলো স্থায়িত্ব পেয়ে থাকে। কিন্তু একের পর এক বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড় করে দেয়ার ফলে ক্রমশই অস্থিতিশীল হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ভিত্তি, এবং তৈরি হচ্ছে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা।
প্রবল বর্ষণে স্বাভাবিকভাবেই নরম মাটির পাহাড় ধসের সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আর যেহেতু কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা, তাই প্রতিবছরই এখানে মাঝারি থেকে বড় আকারের ঘূর্ণিঝড় দেখা যায়। তখন পাহাড় ধসের প্রবণতা আরও বাড়ে।
দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সংকট
রোহিঙ্গারা এদেশে আসার পর থেকে প্রথম কয়েক মাস শ্যালো টিউবঅয়েলের মাধ্যমেই কাজ চলেছিল। ১৫০ ফুট পর্যন্ত গভীরতা থেকেই পানি উত্তোলন করা যাচ্ছিল। কিন্তু গ্রীষ্মকালে পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ফলে ইতিমধ্যেই শুকিয়ে গেছে অধিকাংশ শ্যালো টিউবঅয়েল।
শরণার্থী শিবিরের মানুষের জন্য প্রচুর পরিমাণ অস্থায়ী পায়খানার ব্যবস্থা করতে হয়েছে, আর সেগুলোর অদূরেই পানি উত্তোলনের জন্য রয়েছে নলকূপ। ফলে খুব সহজেই দূষিত হচ্ছে সেসব নলকূপের পানি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু নলকূপের পানির নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখতে পেয়েছে যে, শতকরা ৭০ ভাগ নলকূপের পানিতেই রয়েছে E. Coli ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য পেটের অসুখে ভুগছে শরণার্থী শিবিরের অনেকেই।
অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থী শিবিরের কাছেই কিছু ৬৫০ ফুট গভীরতার চাপকল তৈরি করা হয়েছে, যার ফলে কিছুটা হলেও পানির সংকট থেকে মুক্তি পেয়েছে রোহিঙ্গারা।
বাড়ছে গর্ভপাতের ঝুঁকিও
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সরাসরি গর্ভপাতের কোনো যোগাযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু গবেষকরা দেখেছেন, বাংলাদেশের যেসব এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের হার বেশি, সেসব জায়গায় গর্ভবতী নারীদের সন্তান নষ্ট হওয়ার হারও বেশি। বিশেষত সাম্প্রতিক অতীতে দেশের পূর্বাঞ্চল ও সমুদ্র-উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে গর্ভপাতের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ধারণা করা যাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া না হলে এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
সামগ্রিক পরিণতি
২০১৬ সালেই এক গবেষণায় উঠে এসেছিল, বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ ভূমিই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র পাঁচ মিটার উপরে অবস্থান করছে। প্রতি বছর নদী ভাঙনের ফলে এ দেশের ১০,০০০ হেক্টর জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একাধারে প্রতি বছর দেশের জনসংখ্যা যেখানে ১.২% হাড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনই ফসলী জমির পরিমাণ কমছে বার্ষিক ১% হারে। সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন ও হিমালয়ের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা তো বাড়ছেই। ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের উপকূলবর্তী ২ লক্ষাধিক মানুষকে যেমন বাসস্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে হবে, তেমনি অন্তত ২.৭০ কোটি মানুষ এর প্রভাবে ক্ষতির শিকার হবে।
কিন্তু এখন আরও জরুরি বিষয় হলো, এসব গবেষণা যখন করা হয়েছিল, তখনও কক্সবাজারে এত রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেয়নি, বন উজাড় করতে শুরু করেনি, সর্বোপরি জলবায়ুও এত দ্রুত পরিবর্তিত হতে শুরু করেনি। কিন্তু মাত্র দুই বছরের ব্যবধানেই দেশের জলবায়ু পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে ২০৫০ সালে নয়, এর অনেক আগেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশের মানুষ।
বাঁচার উপায় কী?
মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তারা রোহিঙ্গাদের কখনোই ফিরিয়ে নিতে চায় না। আর নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে নিরাপত্তাহীনতার কারণে অধিকাংশ রোহিঙ্গাই আগ্রহী বাংলাদেশেই স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার জন্য।
এই মুহূর্তে হয়তো বিদেশী সাহায্য ও নিজস্ব অর্থায়নে আমরা রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণ করতে পারছি, কিন্তু তারা যদি স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে থেকে যায়, তবে এ দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের হার আরও ত্বরান্বিত হবে। ফলে ২০৫০ সাল নয়, তার অনেক আগেই সমুদ্রের নীচে তলিয়ে যাবে এ দেশের বড় একটি অংশ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
তাই অতিসত্ত্বর কূটনৈতিক সফলতা ও বিদেশী সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। এবং এর পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে তাদেরকে আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে-
- রোহিঙ্গারা যেন আর নির্বিচারে কক্সবাজারের বৃক্ষ নিধন করতে না পারে সেদিকে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে।
- জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা মেটানোর কার্যকরী বিকল্পের ব্যবস্থা করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত না তা সম্ভব হয়, ততদিন সকল রোহিঙ্গার কাছে এলপিজি পৌঁছে দিতে হবে।
- আর যেন কোনো বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি না ঘটে, সেজন্য বন অধিদপ্তরকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
- রোহিঙ্গাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যবস্থা করতে হবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/