গরমের মাঝামাঝি সময়ে যখন আবহাওয়া উষ্ণ আর আর্দ্র, বৃষ্টির আভা তেমন নেই, তবু চারদিক ঝলমলে রঙিন- এরকম সময়ে জাপানের ট্রেনগুলো সব শূন্য হতে শুরু করে। হঠাৎ করেই দেশের সব জায়গা কেমন নীরব ও শান্ত হয়ে পড়ে। শহরের ভিড় কমতে থাকে, গ্রামের দিকে লোক সমাগম বেড়ে চলে। পারিবারিক সমাধিস্থলগুলো ফুলে ফুলে খুব রঙিন হয়ে ওঠে, কবরগুলো একেকটি মস্ত সাকুরা ফুলের তোড়া যেন। নরম তুলোট কিমোনো পরিহিতাদের গানের তালে নৃত্যরত দেখে মনে হয়, বুঝি সুন্দর কোনো এক উৎসব শুরু হলো। কিন্তু এত আয়োজন যে অনুষ্ঠানের পেছনে, তা আসলে জাপানীদের মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মাকে স্বাগত জানানোর জন্য- সেটা এত জাঁকজমকের ভিড়ে মাথাতেই আসবে না।
সূর্যোদয়ের দেশের বাসিন্দারা প্রতি বছর গরমের সময় সব ছেড়ে কিছুদিনের জন্য ফিরে যায় নিজেদের শেকড়ের কাছে, ভিটেবাড়িতে। লন্ঠন জ্বালিয়ে আর নানা রঙের ফুলের বাহারে নিজ নিজ প্রয়াত আত্মীয়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি সুন্দর অর্থবহ উৎসব পালন করে। এই উৎসবটি ‘ওবন’ উৎসব, বা ‘বন’ উৎসব নামে পরিচিত।
ওবন উৎসবের ইতিকথা
জাপানীরা প্রায় ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওবন উৎসব পালন করে আসছে। সময়ের আবর্তে ধাপে ধাপে বদলে গেছে আনুষ্ঠানিকতার নিয়ম-কানুন, কিন্তু মৃতের আত্মাকে জীবিতের পৃথিবীতে সাময়িকভাবে বরণ করার প্রথাটি কখনও বদলায়নি। মোটামুটিভাবে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস ঘাটলে ওবন উৎসবের একেবারে গোড়ার কথাগুলো জানতে পারা যায়।
ওবন শব্দটির উৎস হিসেবে ধরা হয় ‘উলাম্বানা’ শব্দটি, সংস্কৃতমতে যার অর্থ দাঁড়ায় উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা। বলা হয়, গৌতম বুদ্ধের জনৈক শিষ্য মোকুরেনের জীবনের একটি ঘটনা থেকেই প্রচলিত হয়েছে ওবন উৎসবের। মোকুরেন তার আধ্যাত্মিক শক্তি ব্যবহার করে দেখতে চেয়েছিলেন তার মৃত মা কেমন আছেন। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, তার মা মৃতদের জগতে একটি অদ্ভুত জায়গায় আটকা পড়ে আছেন, যেটি ছিল ক্ষুধার্ত ভূতের রাজত্ব। তিনি সেখানে বেশ কষ্ট পাচ্ছিলেন, যা মোকুরেনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি তড়িঘড়ি করে গৌতম বুদ্ধের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলেন। গৌতম বুদ্ধ মোকুরেনকে যা করতে বললেন তা হলো, যদি তিনি মায়ের এই কষ্টের পরিত্রাণ চান তাহলে বছরের সপ্তম মাসের ১৫ তম দিনে বৌদ্ধ সাধকদের বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে তাদের মন জয় করতে হবে।
বুদ্ধের কথামত মোকুরেন সাধকদের উপহার দিয়ে খুশি করলেন। এতে তার মা কষ্টের পরিত্রাণ পেয়ে গেলেন। মোকুরেন এটাও দেখলেন যে, জীবিত থাকাকালে মা তার জন্য কতই না ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। সব মিলিয়ে মোকুরেনের মন খুশিতে ভরে গেল, আনন্দে নেচে উঠলেন তিনি। তার এই আনন্দের নৃত্যই পরবর্তীতে ওবন উৎসবের ঐতিহ্যবাহী ‘বন ওদোরি’ নৃত্যে পরিণত হয়েছে।
ওবন উৎসবের সময়কাল
জাপানিদের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী বছরের সপ্তম মাসের ১৫ তম দিন থেকে তিনদিন ব্যাপী ওবন উৎসব শুরু হয়ে থাকে। তবে সপ্তম মাসের হিসাবটি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম। লুনার ক্যালেন্ডার বা চন্দ্র-পঞ্জিকা অনুযায়ী বছরের সপ্তম মাস হলো জুলাই, যাকে বলে ‘ফুমিজুকি’ বা ‘month of books’ । আবার সোলার ক্যালেন্ডার বা সৌর-পঞ্জিকা অনুযায়ী বছরের সপ্তম মাস হলো আগস্ট, যাকে বলা হয় ‘হাজুকি’ বা ‘month of leaves’ । তাই সমস্ত জাপান জুড়ে বিভিন্ন সময়ে ওবন উৎসব সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়, কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে বেশিরভাগ অঞ্চলেই জুলাই আর আগস্ট মাস দুটি বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। সময় যখনই হোক, উৎসবের আমেজ সব জায়গায় একই রকম আনন্দপূর্ণ।
ওবনের যত হালচাল
উৎসবের সময়কাল আর পরিক্রমা নিয়ে যতই দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর পার্থক্য থাকুক না কেন, ওবনের মূলকথা কিন্তু সমস্ত জাপানবাসীর জন্য একই। আর তাই কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা আর আয়োজন সব স্থানেই একরকম। চলুন, ওবন উৎসবের নানান রঙের আর রকমের প্রথা নিয়ে এবার জানা যাক।
ওবনদামা ও ওচুগেন
ওবনদামা আর ওচুগেন মূলত একই ধাঁচের দুটি প্রথা, যেগুলো কি না উৎসব শুরুর আগেই পালন করা হয়। ওবনদামা অনেকটা ঈদের সালামির মতো, বাবা-মা আর বাড়ির বড়রা ছোটদের কিছু হাতখরচ দিয়ে থাকে। তাই ওবনদামা বাচ্চাদের জন্য ভীষণ আনন্দের একটি প্রথা। শুরুতে এটি ছিল কেবল পায়ের মোজা আর কাঠের বিশেষ জুতা আদান-প্রদানের একটি প্রথা। পরবর্তীতে এই আদান-প্রদানটি হাতখরচে এসে ঠেকে।
ওচুগেন হলো একপ্রকার গ্রীষ্মকালীন উপহার, যা পরিবারের বড়দের দেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া কারও প্রতি পূর্ববর্তী কোনো সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও ওচুগেন আদান-প্রদান হয়ে থাকে। শুকনো খাবার, পানীয়, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস, যেমন- সুগন্ধী, সাবান, তোয়ালে ইত্যাদি ওচুগেন হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়।
ওবনের প্রথম দিন
ওবনের প্রথম দিনটি শুরু হয় মুকায়েবি বা ক্ষুদ্র পরিসরে বাড়ির সামনে আগুন জ্বালানোর মধ্য দিয়ে। ঐতিহ্যবাহী এই প্রথাটি পালনের উদ্দেশ্য, মৃত পূর্বপুরুষের আত্মাদের বাড়ির দিক নির্দেশনা দিয়ে স্বাগত জানানো।
কাগজের তৈরি নয়নাভিরাম চোচিন ল্যান্টার্ন বা কাগজের লন্ঠন দিয়ে বাড়ির আঙিনা সাজিয়ে তোলে জাপানীরা। এছাড়া অনেকে পূর্বপুরুষের সমাধিস্থলে হাতে করে এই লন্ঠনটি নিয়ে যায়, যেন লন্ঠনের আলোয় নিজের বাড়ি চিনে নিতে পারে আত্মারা। অনেকে বাড়ির দ্বারপ্রান্ত থেকে শুরু করে সমাধি পর্যন্ত লন্ঠন ঝুলিয়ে দেয়।
বন ওদোরি
ওবন উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো বন ওদোরি নৃত্য। এই নৃত্যটির উৎপত্তি হয়েছে কীভাবে- সে কথা আগেই বলা হয়ে গেছে। প্রথমদিকে খানিকটা ধর্মীয় গুরুত্বের জন্য উদযাপিত হলেও এখন কিন্তু নিছক আনন্দের জন্যই বন ওদোরি নাচ আয়োজিত হয়ে থাকে। এমনকি বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক প্রতিযোগিতাও হয়ে থাকে এই বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠানের। তবে এই নাচের মূল উদ্দেশ্য মৃত আত্মাদের সাদরে বরণ করে নেওয়া, উৎসবের আমেজে অংশ নিতে উষ্ণ আমন্ত্রণ জানানো।
বন ওদোরি নাচে যে কেউ অংশ নিতে পারে। কেবলমাত্র হাঁটতে শিখেছে এমন শিশু থেকে শুরু করে একদম বুড়োরা পর্যন্ত সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে যোগ দেয়। পরনে একটি কিমোনো হলেই হলো, সাথে জাপানী পাখা হলে তো কথাই নেই! অনেকে আবার মুখে পরে নেয় বিশেষ মুখোশ। এতে করে নাকি তারা মৃত আত্মীয়ের আত্মাদের সাথে আরও বেশি করে একাত্ম হয়ে যায়।
বন ওদোরি সচরাচর দুই ধাঁচের হয়ে থাকে। একটি হলো দেনতো ওদোরি, বা ঐতিহ্যবাহী নাচ। এই নাচের অঙ্গভঙ্গি প্রায় ৬০০ বছর ধরে চলে আসছে। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে নৃত্যশিল্পীরা বাঁশি অথবা ঢোলের তালে তালে নাচে, সাথে থাকে গান। তবে এই নাচ কেবলমাত্র সরাসরি বাজনার সাথে পরিবেশিত হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় ধাঁচটি হলো মিনিও ওদোরি, যেটি বিভিন্ন লোকগীতির সাথে পরিবেশিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই মূলত এই নাচটির উদ্ভাবন হয়। জাপানীরা অনুষ্ঠানের দিনে নিজেদের তৈরি সুসজ্জিত লম্বা টাওয়ারের চারদিকে হাত ধরাধরি করে ঘুরে ঘুরে নাচে, মিনিও ওদোরির প্রধান বৈশিষ্ট্য এটি। নাচের সঙ্গে চলে বিভিন্ন গান, যেগুলোকে ‘ওন্দো’ বলা হয়। বিভিন্ন ধরনের ওন্দো জাপানে প্রচলিত, তার মাঝে বিখ্যাত দুটি হচ্ছে ‘টোকিও ওন্দো’ আর ‘তাঙ্কো বুশি’। অবশ্য হালের অ্যানিমেশন সিনেমার বিভিন্ন মিউজিক থেকেও এখন ওন্দো তৈরি হচ্ছে।
হোয়ো/কুইয়ো
ওবন উৎসবের আরেকটি রীতি হোয়ো/কুইয়ো। সচরাচর ওবনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে এই প্রথাটি পালিত হয়। এই দিনে বাড়ির লোকেরা একজন বৌদ্ধ যাজককে নিমন্ত্রণ করেন। যাজক এসে মৃতদের উদ্দেশ্যে বিশেষ মন্ত্র পাঠ করেন, আত্মার শান্তি কামনা করে কিছু রীতি পালন করেন। এরপর তারা সবাই মিলে একসাথে দুপুরের খাবার গ্রহণ করেন এবং প্রয়াত আত্মীয়দের কথা স্মরণ করেন। এসময় তাদের বিভিন্ন পুরনো স্মৃতি রোমন্থনসহ নানান হাসি-কান্নার গল্পে সবাই মশগুল হয়ে পড়েন। হোয়ো-কুইয়োর দুপুরের এই খাবারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এতে সমস্ত খাবার নিরামিষ থাকে। কোনো প্রকারের মাছ বা মাংস তারা গ্রহণ করেন না। এই খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সবজির স্যুপ, শিমের দানা, মটর, সয়াসসে ডোবানো সেদ্ধ সবজি আর শসা।
ওবনের খাবার
যেকোনো উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হলো তার খাবার। ওবনও তার ব্যতিক্রম নয়, বরং ওবন উৎসবের ঐতিহ্যবাহী খাবারে রয়েছে বিভিন্ন চমক। তাকোয়াকি বা প্যানকেকের উপাদান দিয়ে তৈরি বিশেষ মুখরোচক খাবার ওবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফুতোমাকি বা মাকি সুশি হল মোটাসোটা এক রকমের রোল, সুশি রাইস আর শৈবালের ভেতর মজাদার পনির আর মাছের সমন্বয়ে তৈরি হয় এটি। আরও রয়েছে চিরাশি সুশি, বাটির ভেতর সুশি রাইস ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর দেওয়া হয় রান্না করা সামুদ্রিক মাছ, ডিম আর শৈবাল। এছাড়াও আছে ইনারি সুশি, টেরিয়াকি চিকেন, গ্রিল করা ভুট্টাসহ নানা জিনিস। গরমের সময়ে ঠান্ডা তরমুজের সাথে বরফের কুচি এই উৎসবের জনপ্রিয় একটি খাবার।
প্রয়াত ব্যক্তির কবরফলকে ফুলের তোড়া, উপহার সামগ্রীর সাথে বিভিন্ন ধরনের খাবার-দাবার রাখা হয়। এর মাঝে থাকে বিভিন্ন ধরনের ফল, মিষ্টান্ন, মৃত ব্যক্তির প্রিয় খাবার ইত্যাদি। তবে এই খাবারের মাঝেও কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। যেমন- কিছু অঞ্চলে শসা আর চপস্টিক দিয়ে তৈরি করা হয় ঘোড়ার প্রতিকৃতি, বেগুনের সাহায্যে তৈরি হয় গরু। জাপানীরা বিশ্বাস করে, শসার তৈরি ঘোড়া পরকাল থেকে অতি দ্রুত মৃতদের পৃথিবীতে নিয়ে আসবে। আর বেগুনের তৈরি গরু তাদের অত্যন্ত ধীরে ধীরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে পরকালে।
অনুষ্ঠানের শেষদিনটি কাটে গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে। এই দিনে জাপানীরা নদীতে ভাসিয়ে দেয় কাগজের তৈরি লন্ঠন, যাতে করে সেই আলোতে প্রয়াত আত্মারা ফিরে যেতে পারে শান্তিতে। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি এভাবেই ঘটে। জাপানীদের ধর্মীয় গুরুত্ববাহী এই ওবন উৎসব এখন আর কেবল ধর্মের গন্ডিতে আটকে নেই, সমস্ত দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই অংশ নেয় ওবনে।