১.
২০০০ সালের এপ্রিল মাসে মারা গেছেন তিনি। তার মৃত্যুর পরে ব্রাজিলের এক দৈনিক পত্রিকা শিরোনাম করেছিলো, ‘বারবোসার দ্বিতীয় মৃত্যু!’
কে এই বারবোসা?
পুরো নাম ছিল মোকির বারবোসা নাসিমেন্তো। ১৯৫০ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলের গোলকিপার ছিলেন, ছিলেন সে সময়ের সেরা গোলকিপারও। সেই বিশ্বকাপে দারুণ খেলেছিলেন, কিন্তু ফাইনালে মাত্র একটা ভুলের কারণে সারাজীবনের মতো ব্রাজিলিয়ানদের কাছে খলনায়ক হয়ে যান তিনি।
২.
১৯৫০ সালে বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর বসেছিল ব্রাজিলে। এর ঠিক এক বছর আগে, ১৯৪৯ সালে নিজেদের মাটিতে আয়োজিত কোপা জিতেছিলো ব্রাজিল। ফাইনালে প্যারাগুয়েকে বিধ্বস্ত করেছিল ৭ গোলের বিশাল ব্যবধানে। জিজিনহো নামের একজন খেলোয়াড় ফাইনালে করেছিলেন হ্যাটট্রিক।
কোপায় সেটা ছিল মাত্র তৃতীয় শিরোপা ব্রাজিলের। মনে রাখা প্রয়োজন, বিশ্ব ফুটবলে তখনও ব্রাজিল এমন কোনো পরাশক্তি নয়, তখন পর্যন্ত একবারও বিশ্বকাপ জেতেনি তারা। আজকের পাঁচ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলকে দিয়ে তখনকার ব্রাজিল দলকে বিচার করতে গেলে ভুল হবে। তবে নিজেদের মাটিতে আয়োজিত বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো বিশ্বসেরার ট্রফি তুলবে ব্রাজিল, এমনটাই ভেবে নিয়েছিলো সে দেশের মানুষ। সে আশার পালে আরও হাওয়া দিয়েছিল দলের সবার দুর্দান্ত ফর্ম।
সে দলেরই গোলকিপার ছিলেন বারবোসা। ১৯৪৫ সালে যোগ দিয়েছিলেন রিও ডি জেনিরোর ক্লাব ‘ভাস্কো ডা গামা’তে। সেখানে ৫ বছরে তিনবার জেতেন সিটি চ্যাম্পিয়নশিপ, ১৯৪৮ সালে জেতেন ‘আমেরিকানো ডি ক্যাম্পিওস’, যা বর্তমানে ‘কোপা লিবার্তোদোরেস’ নামে পরিচিত। আর পরের বছরের কোপার কথা বলা হয়েছে আগেই। সব মিলিয়ে দারুণ একটা দল নিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করেছিল ব্রাজিল, আর বারবোসা ছিলেন সেই দলের অন্যতম সারথী।
৩.
সেবারের বিশ্বকাপ হয়েছিলো ১৫টি দল নিয়ে, দলগুলোকে ভাগ করা হয়েছিল ৪টি গ্রুপে। ৩ গ্রুপে ৪টি করে দল এবং বাকি গ্রুপে ৩টি দল নিয়ে বিশ্বকাপ হওয়ার কথা ছিল। উরুগুয়ে ছিল ৩ দলের গ্রুপে। গ্রুপের বাকি দুই দল ছিল বলিভিয়া আর ফ্রান্স।
কিন্তু বিধি বাম! বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয় ফ্রান্স। ফলে উরুগুয়ের গ্রুপে দল হয়ে যায় ২টি, বাকি দলটির নাম বলিভিয়া। ফলে অন্য সব গ্রুপের দলগুলোকে যেখানে খেলতে হলো ৩টি করে ম্যাচ, সেখানে মাত্র ১টি ম্যাচ খেলেই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল উরুগুয়ে। বলিভিয়াকে তারা হারাল ৮-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে।
নিয়ম ছিল চার গ্রুপের চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে আরেকটা গ্রুপ করা হবে, নিজেদের মধ্যে খেলার পর পয়েন্টের ভিত্তিতে হওয়া শীর্ষ দল পাবে বিশ্বসেরার খেতাব। চার গ্রুপের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলো ব্রাজিল, স্পেন, সুইডেন আর উরুগুয়ে। স্পেন আর সুইডেনকে আক্ষরিক অর্থেই গুঁড়িয়ে দিল ব্রাজিল, অপর দিকে দ্বিতীয় ম্যাচে সুইডেনকে হারাতে পারলেও স্পেনের সাথে প্রথম ম্যাচ ড্র করল উরুগুয়ে। সেই টুর্নামেন্টে কোনো দল জিতলে পেতো ২ পয়েন্ট, ড্র হলে ১। ফলে প্রথম ২ ম্যাচ শেষে ব্রাজিলের সংগ্রহ হলো ৪ পয়েন্ট, উরুগুয়ের ৩। এর মাধ্যমে ব্রাজিলের সাথে শেষ ম্যাচটা উরুগুয়ের জন্য হয়ে গেল অঘোষিত ফাইনাল, অন্য দিকে ড্র করতে পারলেই যথেষ্ট ছিল ব্রাজিলের। মারাকানার ফুটবল তীর্থে জুলাই মাসের ১৬ তারিখ নির্ধারিত হলো এই অঘোষিত ফাইনালের জন্য।
৪.
উরুগুয়ে তখন আটবার কোপা আমেরিকা এবং একবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কিন্তু সময়টা খুব ভালো যাচ্ছিল না সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের, ভুগতে হচ্ছিলো প্রায় প্রত্যেকটা ম্যাচেই। অন্যদিকে ব্রাজিল উড়ছিলো রীতিমতো, সুইডেন আর স্পেনকে তারা হারিয়েছিল ৭-১ আর ৬-১ ব্যবধানে। পাশাপাশি, খেলা ব্রাজিলে হওয়ায় ফেভারিট ছিল স্বাগতিকরাই। সমীকরণটাও ছিল সহজ, ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে ব্রাজিল।
শিরোপার এতটা কাছে থাকায় চারিদিকে তাই সাজসাজ রব পড়ে যায়। তাতে যোগ দেয় ব্রাজিলের সংবাদপত্রগুলোও। দেশটির প্রভাবশালী দৈনিক ’ও মুন্ডো’ জাতীয় দলের বিশাল এক ছবিসহ ক্যাপশনে ‘এরাই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন’ লিখে ম্যাচ শুরুর আগেই একটা সংস্করণও প্রকাশ করে ফেলে। এমনকি জাতীয় দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের নামাঙ্কিত স্মারক মুদ্রা পর্যন্ত বাজারে ছাড়া হয়েছিলো! বাদকদের এক দলকেও প্রস্তুত রাখা হয়, তাদের দায়িত্ব ছিল ম্যাচ শেষে জয়ী দলের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো। ব্রাজিলের জাতীয় সঙ্গীত এবং এগারো জন খেলোয়াড়কে নিবেদন করে ‘ব্রাজিল ক্যাম্পিও’ নামে বিশেষ একটি গানের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল বাদকরা। কিন্তু উরুগুয়ের জাতীয় সঙ্গীতকে প্রস্তুতির তালিকাতেই রাখা হয়নি।
ব্রাজিলিয়ানদের প্রস্তুতির এই বহর দেখে ভড়কে যান উরুগুয়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও। ম্যাচ শুরুর আগে দূতাবাস থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা উরুগুয়ের ড্রেসিংরুমে ঢুকে অধিনায়ক অবদুলিও ভ্যারেলাকে অনুরোধ করেছিলেন,
‘হারের ব্যবধান যেন কোনোমতেই ছয় পর্যন্ত না যায়। চার পর্যন্ত আমরা সন্তুষ্ট!’
কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারেননি একজন, ভ্যারেলা। ব্রাজিলের এই তোড়জোড় দেখে কোচ হুয়ান লোপেজ পর্যন্ত রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলার নির্দেশ দেন শিষ্যদেরকে। উরুগুয়ে ফুটবলের ‘ব্ল্যাক চিফ’ নামে খ্যাত ভ্যারেলা তার সতীর্থদের বলেছিলেন,
‘হুয়ান খুব ভালো মানুষ। কিন্তু আজ তার সিদ্ধান্ত ভুল। এসব কথার কোনো মূল্যই থাকবে না, যদি আমরা ম্যাচটা জিততে পারি। তাই হারের জন্য আমরা কোনোভাবেই মাঠে নামব না। চার গোলের ব্যবধানে তো প্রশ্নই আসে না।’
মারাকানার নির্মাণকাজ তখনও শেষ হয়নি পুরোপুরি। প্রায় এক লাখ নিরানব্বই হাজার দর্শকের মধ্যে উরুগুয়ের সমর্থক ছিল একশ’রও কম! টানেল দিয়ে ভ্যারেলা তার দল নিয়ে মাঠে প্রবেশ করতেই বজ্রনিনাদে ফেটে পড়ে সমর্থকরা। টিমমেটদের ভরসা দিয়ে ভ্যারেলা বলেছিলেন,
‘চিন্তার কোন কারণ নেই, গ্যালারির কেউ খেলবে না।’
খেলা শুরু হওয়ার পর অসাধারণ খেলতে থাকে ব্রাজিল। কিন্তু দুর্দান্ত খেলেও প্রথমার্ধে গোলশূন্য ছিল তারা। বিরতির ঠিক পরেই গোল করে ফ্রিয়াকা ৪৭ মিনিটে এগিয়ে দেন ব্রাজিলকে। ২ লাখ দর্শকের গর্জনে মারাকানা নামের জনসমুদ্র তখন ফুঁসছে। ৬৬ মিনিটে গোল করে উরুগুয়েকে সমতায় ফেরান শিয়াফিনো।
তখনো আশায় বুক বেঁধে আছে ব্রাজিলিয়ানরা। কারণ একটা ড্র’ই এনে দেবে বিশ্বকাপ।
কিন্তু খেলা শেষ হওয়ার ১১ মিনিট আগে ডান দিকে বল পেয়ে যান উরুগুয়ের উইঙ্গার অ্যালসিডেস ঘিগিয়া। ব্রাজিলের সেন্টারহাফ বিগোদাকে বোকা বানালেন। শিয়াফিনোর গোলটির উৎসও ছিলেন এই ঘিগিয়া, সেবার একই জায়গা থেকে ক্রস করেছিলেন তিনি। এবারও সবাই ভাবলো, ঘিগিয়া ক্রস করবেন। এই ‘সবাই’-র মধ্যে ছিলেন বারবোসাও। ভেবে নিজের পজিশন থেকে একটু সরে যান ব্রাজিল গোলরক্ষক। ভুল করে ফেললেন তিনি, এই ভুলটাই তার বাকি জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ক্রস না করে শট নেন ঘিগিয়া।
গোল!
নিস্তব্ধতা নাকি হিরণ্ময়! আসলেই কি তাই?
জনসমুদ্রের গর্জন থেমে গেল ঘিঘিয়ার গোলের পর। এ ব্যাপারে অনেক পরে ঘিগিয়া বলেছিলেন,
‘কেবল মাত্র তিনজন মানুষ মারাকানাকে নিস্তব্ধ করে দিতে পেরেছিলেন। পোপ দ্বিতীয় জন পল, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা এবং আমি।’
শেষ বাঁশি বাজার পর অনেকেই লাফিয়ে পড়েছিলো মারকানার ছাদ থেকে, আত্মহত্যাও করে অনেকে। পরের কয়েকদিন শহরের প্রতিটি ঘরের জানালা বন্ধ ছিল। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। মনে হচ্ছিলো, ব্রাজিলিয়ানদের আপন কেউ মারা গেছে। সম্মান ভূলুণ্ঠিত হওয়ার নির্মম বেদনা সইতে পারেনি কেউই। সবাই-ই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন, ফুটবল ইতিহাসে ১৬ জুলাই যেন আর কখনোই ফিরে না আসে।
উৎসবের মুখরতা থেকে ব্রাজিলিয়ানদের নীরবতা ছুঁয়ে যায় ভ্যারেলাকেও। ফাইনালের পর সারারাত একটি বারে কাটিয়ে দেন তিনি। খুন হয়ে যেতে পারেন, এই ভয়ে তার কোনো সতীর্থই রাস্তায় বের হননি।
এরপরেই উৎপত্তি হয় সেই বিখ্যাত শব্দের। মারাকানার দুঃখ, ‘মারাকানাজ্জো’।
মারাকানা বিপর্যয়ের পর ১৯৫০ বিশ্বকাপের গোলরক্ষক বারবোসাকে দায়ী করে গোটা ব্রাজিল। তারা কখনোই ক্ষমা করেনি এই গোলরক্ষককে। এখানে বর্ণবাদের একটা ভূমিকা ছিল বলেও ধারণা করা হয়। কারণ এরপরে প্রায় ৫০ বছর ব্রাজিল দলে আসেননি কোনো কালো গোলকিপার। ১৯৯৯ সালে এই ‘প্রথা’ ভাঙেন দিদা। বারবোসার সাথে বলির পাঁঠা বানানো হয় আরও দুই কালো খেলোয়াড় বিগোদা ও জুভেনালকে। বিগোদা আর জুভেনাল কোনোক্রমে বেঁচে গেলেও জনরোষ থেকে বারবোসা আর রেহাই পাননি।
খেলা ছাড়ার পর তিনি একবার ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশনে যান। কিন্তু ফেডারেশনের সভাপতি বারবোসা এসেছেন শুনে দরজা বন্ধ করে দেন। মারাকানা ট্র্যাজেডির ৪৩ বছর পরও বারবোসাকে ব্রাজিলের কোনো ম্যাচে ধারাভাষ্য দিতে দেয়নি দেশটির ফুটবল ফেডারেশন। ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপের আগে বারবোসা ব্রাজিলের ড্রেসিংরুমে যেতে চাইলে ব্রাজিলের তৎকালীন সহকারী কোচ মারিও জাগালো তা নাকচ করে দেন। তার মনে হয়েছিলো, বারবোসা হয়তো ব্রাজিলের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসছেন! একবার এক বারে গিয়েছিলেন বারবোসা। সেখানে এক মহিলা তার ছেলেকে বারবোসাকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘দেখো, এই লোকটা ব্রাজিলকে কাঁদিয়েছিল।’
চরম হতাশ বারবোসা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
‘আমাকে সারাজীবনে যা শুনতে হয়েছে তাতে আমি প্রতিক্রিয়া দেখালে আমার জায়গা হতো হয় কবরে, নয়তো জেলখানায়।’
তিনি আরও বলেছিলেন,
‘ব্রাজিলের আইনে যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ ৩০ বছর। কিন্তু আমার জন্য তা হয়ে গেছে ৫০ বছর।’
বিনা দোষে আজীবন সাজা দেয়ার জন্য ব্রাজিলের জনগণকে দোষারোপ করতেই পারেন মোকির বারবোসা!