আগামী ২৮ তারিখে ক্যাম্প ন্যুতে মৌসুমের প্রথম এল ক্লাসিকোর উত্তেজনায় সবাইকে গ্রাস করবে। কিন্তু সে উত্তেজনার পাশেই থাকবে শূণ্যতার ছোঁয়া। বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের এ ম্যাচের গুরুত্ব অনেক। আর বেশ কয়েক বছর ধরে এই ম্যাচের প্রতিদ্বন্দ্বীতার পাশাপাশি আরও এক প্রতিযোগিতা গড়ে উঠেছিলো। ম্যাচটা যতটা ছিল বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদের, ততটাই ছিল মেসি বনাম রোনালদোর।
তবে এই দ্বৈরথ যে আর থাকছে না সেটা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিলো মৌসুমের প্রথমেই রোনালদোর জুভেন্টাস পাড়ি জমানোর মাধ্যমে। আর গত সেভিয়া ম্যাচে মেসি গুরুতর ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে ৫/৬ সপ্তাহের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান। তাই দীর্ঘ ৭ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মেসি-রোনালদোবিহীন এল ক্লাসিকো। যদিও বার্সেলোনার কষ্টের অন্য আরেকটি স্থান আছে। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ছাড়া কাতালানদের প্রথম এল ক্লাসিকো এটি।
রিয়াল মাদ্রিদের পরিস্থিতি
এল ক্লাসিকোর শুরুতেই প্রথম যে প্রশ্ন আসে তা হলো, “কোন দল ফেবারিট?” সাধারণত বার্সেলোনার মাঠে খেলা বলে অনেকে কাতালানদের এগিয়ে রাখবেন। তবে বিষয়টি এমন নয়। এল ক্লাসিকো এমন একটি ম্যাচ যা হোম না অ্যাওয়ে মাঠে খেলা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে না। বিষয়টি পরিসংখ্যান আর চলতি ফর্মের উপর নির্ভর করে। এ মৌসুমের লা লিগার তালিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে লিগে কোন দলই তাদের সেরা ফর্মে নেই। তবে বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের মধ্যে তুলনা করলে রিয়াল মাদ্রিদ পিছিয়ে থাকবে। কারণ সর্বশেষ ৫ ম্যাচে বার্সেলোনা ১ টি জয় পেলেও, হেরেছে ১ টিতে। আর রিয়াল মাদ্রিদ ১ টি জয়ের বিপরীতে হার ৩ টিতে। যার ভেতর আছে আলাভেজ ও লেভান্তের মত ছোট দলের বিপক্ষে হার।
প্রথমে রিয়াল মাদ্রিদ প্রসঙ্গে আসা যাক। রোনালদোর বিদায়, জিদানের ইচ্ছাকৃত প্রস্থানের পর। রোনালদোর পজিশনে কোনো নতুন খেলোয়াড় না কেনা ও হুলেন লোপেতেগি কোচ হয়ে আসার মত ঘটনা নিয়ে মাদ্রিদের ক্লাবটি খুশি নয়। লোপেতেগির ট্যাকটিক্সের সাথে দল এখনো পুরোপুরি থিতু হতে পারেনি, পাশাপাশি রোনালদোর শূণ্যতাও পূরণ হয়নি বলে লিগে তাদের অবস্থা বর্তমানে যাচ্ছেতাই। ৯ ম্যাচ খেলে তারা জয় পেয়েছে মাত্র ৫ ম্যাচে আর হার ৩টিতেই। সর্বশেষ ঘরের মাঝে লেভান্তের মত পুচঁকে দলের কাছে হারা রিয়াল মাদ্রিদে বার্সেলোনার মাঠে এসে যে তাদের স্বাভাবিক খেলাটা দিতে পারবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
লোপেতেগিও স্থিরভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। একে তো দলের বেহাল দশা, উল্টো এই অবস্থার জন্য তার কোচের দায়িত্ব থেকে বহিষ্কার করার গুজব মাদ্রিদ শহরে ভেসে বেড়াচ্ছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বশেষ ম্যাচে কোনোমতে জয়ের কারণেই এখনও রিয়াল মাদ্রিদের কোচের চেয়ার তার দখলে আছে। তাই এল ক্লাসিকো তার জন্য প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ একটি ম্যাচ। রিয়াল মাদ্রিদ ক্যাম্প ন্যু থেকে পরাজয় বরণ করে ফেরত আসলে লোপেতেগিকে আর সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে না দেখা যাবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
জিনেদিন জিদান অধ্যায়ের সমাপ্তির পর রিয়াল মাদ্রিদের তিনটি বড় ধরণের সমস্যা নতুনভাবে ফুটে উঠেছে। দলের মধ্যমাঠের সেই বোঝাপড়া আর নেই। লুকা মদ্রিচ বিশ্বকাপ থেকে ফিরে গত মৌসুমের ফর্মে ফিরে যেতে পারেননি। দলের আক্রমণে একজন ভালো ফিনিশারের অভাব প্রকট। স্ট্রাইকার হিসেবে করিম বেনজেমা ও মারিয়ানো ডিয়াজ অজস্র গোল সুযোগ নষ্ট করেছেন লিগের গত ৯ ম্যাচে। আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা এতটাই ব্যর্থ ছিলেন যে, দীর্ঘ ৪ ম্যাচে কোন গোল পায়নি রিয়াল মাদ্রিদ।
রক্ষণেও নাজুক অবস্থা। রাফায়েল ভারান বিশ্বকাপের পর থেকেই তার সেরা ফর্মে নেই। আর মার্সেলোর আক্রমণে গিয়ে পুনরায় রক্ষণে ফিরে এসে রক্ষণ সামলানোর দক্ষতা সেভাবে নেই। আর এ মৌসুমে মাদ্রিদ রক্ষণে ধারাবাহিক হতাশ করছেন তিনিই। তাই বার্সেলোনার মুখোমুখি হবার আগে এ সকল সমস্যার সমাধান জরুরি। কিন্তু প্রথম থেকে এসব সমস্যা সমাধানের কোন চেষ্টা দলের ভেতর দেখা যায়নি। আর এখন তো হাতে খুবই অল্প সময় বাকি।
বার্সেলোনার পরিস্থিতি
চ্যাম্পিয়নস লিগে পিএসভি, টটেনহাম ও ইন্টারের বিপক্ষে দারুণ নৈপুণ্যে বার্সেলোনা জিতলেও, লিগে যে তারা ভালো ফর্মে আছে তা নয়। অথচ লিগে টানা জয় দিয়ে দারুণ শুরু করেছিলো ভালভার্দের দল। লা লিগায় ৯ ম্যাচে কাতালানরা হেরেছে মাত্র ১টি ম্যাচ, ড্র করেছে ৩টিতে। জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদের মত ৫টি ম্যাচ কিন্তু তাদের মতো ৩টি ম্যাচে হারেনি তারা। জিরোনা, অ্যাটলেটিকো বিলবাও ও ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ড্র ও লেগানেসের বিপক্ষে হার ভালভার্দেকে খাদের কিনারায় নিয়ে ফেলেছিলো। তবে শেষ ম্যাচে সেভিয়ার বিপক্ষে জয় পেলেও তার কপালের ভাঁজ সম্পূর্ণ দূর হয়নি। মৌসুমের প্রথম থেকে যে অস্ত্রের উপর ভর করে বার্সেলোনা এগিয়েছে সেই লিওনেল মেসি ছাড়াই বার্সেলোনাকে পার করতে হবে কঠিন ৫-৬ টি ম্যাচ। তার ভেতর আসন্ন এল ক্লাসিকো অন্যতম।
চলতি মৌসুমে মেসি ছিলেন অতিমানবীয় ফর্মে। ৯ ম্যাচে লিগে এ পর্যন্ত করেছেন ৭ গোল ও ৫ অ্যাসিস্ট। ইনজুরিতে আক্রান্ত হবার ম্যাচেও গোল ও অ্যাসিস্ট করেছেন তিনি। তাই এল ক্লাসিকোতে তার না থাকা ভোগাতে পারে বার্সেলোনাকে। বিপরীতে লুইস সুয়ারেজের চলতি ফর্ম ভালো না। তার শটগুলো জাল খুঁজে পাচ্ছে না অনেক দিন থেকেই। লিগে ৯ ম্যাচে ৪ গোল করলেও পুরনো সেই সুয়ারেজকে এ মৌসুমের প্রথম থেকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া আরেকটি সমস্যা আছে। উমতিতি ও ভারমালেন ইনজুরির পাশাপাশি জেরার্ড পিকে ফর্ম হারিয়েছেন বেশ ক’দিন হলো। তাই মেসির না থাকা, স্ট্রাইকারের গোলখরা ও দুর্বল রক্ষণ নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের মুখোমুখি হওয়া অবশ্যই চিন্তার বিষয়।
হেড টু হেড
মুখোমুখি লড়াইয়ে কোন দল এগিয়ে, তা দিয়ে মনে হয় না আসন্ন এল ক্লাসিকোতে কে ফেবারিট নির্ণয় করা যায়। তবুও বলে রাখা ভালো, লা লিগায় এই দুই দল মুখোমুখি হয়েছে মোট ১৭৭ বার। বার্সেলোনা জিতেছে ৭০টি ম্যাচ, রিয়াল মাদ্রিদের পক্ষে গিয়েছে আরো ৭২টি, বাকি ৩৫টি ম্যাচ হয়েছে ড্র। এই সুদীর্ঘ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ না করে সর্বশেষ ২ ম্যাচ দেখা যাক। লা লিগার এল ক্লাসিকোতে সর্বশেষ দুই ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের কোনো জয় নেই। গত বছর সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে গিয়ে জিদানের দলকে ০-৩ গোলে হারিয়ে এসেছিলো কাতালানরা। আর ক্যাম্প ন্যুর ম্যাচ হয়েছিলো ২-২ গোলে ড্র। সার্জি রবার্তোর লাল কার্ডে পুরো দ্বিতীয়ার্ধ ১০ জন নিয়ে বার্সেলোনা খেললেও রিয়াল মাদ্রিদ পুরো ৩ পয়েন্ট নিতে পারেনি ক্যাম্প ন্যু থেকে। উল্টো ১০ জনের বার্সেলোনাই ১ গোল করে ম্যাচে সমতা এনেছিলো।
কেমন হতে পারে দুই দলের একাদশ?
রিয়াল মাদ্রিদ কোচ প্রতি ম্যাচে ভিন্ন স্কোয়াড ব্যবহার করলেও, এল ক্লাসিকোর মতো ম্যাচেও তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন বলে মনে হয় না। গোলরক্ষক থাকবেন থিবো কর্তোয়া। রাইট-ব্যাকে দানি কার্ভাহালের খেলার সম্ভবনা কম। ঠিক সময়ে ফিট না হলে তার পজিশনে খেলবেন আলভারো অদ্রিয়াজোলা অথবা নাচো। রক্ষণে রাফায়েল ভারান, সার্জিও রামোস ও মার্সেলোর খেলা নিশ্চিত।
মধ্যমাঠে থাকবেন টনি ক্রুস, লুকা মদ্রিচ ও ক্যাসেমিরো। করিম বেনজেমাকে স্ট্রাইকার হিসেবে রেখে রাইট-উইং এ গ্যারেথ বেলের থাকার সম্ভাবনা বেশি। তবে লেফট-উইং এ ইস্কো নাকি অাসেনসিও তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে অনুমান করা যেতে পারে চলতি ফর্ম ও বার্সেলোনার বিপক্ষে পারফর্মেন্সের বিবেচনায় অাসেনসিও থাকতে পারেন মূল একাদশে।
বার্সেলোনার একাদশে গোলরক্ষক পজিশনে কোনো সন্দেহ ছাড়াই মার্ক আন্দ্রে টার স্টেগান থাকবেন। রাইট-ব্যাকে নেলসন সেমেদো থাকলেও, কোচের পছন্দ ও কঠিন ম্যাচ বিবেচনায় খেলার সম্ভাবনা বেশি সার্জি রবার্তোর। উমতিতি ও ভারমালেন ইনজুরড। তাই পিকের সঙ্গী ক্লেমেন্ত লংলে। লেফট-ব্যাকে থাকবেন বার্সার বামপাশের দীর্ঘদিনের আস্থা জর্ডি আলবা।
ভালভার্দে যেভাবে গত কয়েক ম্যাচে দল সাজিয়েছেন, সেভাবে চিন্তা করলে এল ক্লাসিকোতে মধ্যমাঠের দায়িত্বে থাকবেন আর্তুর, বুসকেটস ও রাকিটিচ। স্ট্রাইকার হিসেবে লুইস সুয়ারেজ ও লেফট-উইং কৌতিনহোও নিশ্চিত। সমস্যা শুধুমাত্র মেসির পজিশন নিয়ে। সর্বশেষ ম্যাচে ইন্টারের বিপক্ষে মেসি পজিশনে ছিলেন রাফিনহা। এবং “দিয়ারিও স্পোর্টস” এর তথ্য অনুযায়ী রাফিনহাকে এল ক্লাসিকোতে ব্যবহার করতে যাচ্ছেন ভালভার্দে। এছাড়াও এ পজিশনে খেলার জন্য ম্যালকম ও ডেমবেলের মত খেলোয়াড় বার্সেলোনার স্কোয়াডে আছে।
মেসি ও রোনালদোর না থাকায় হয়ত ম্যাচে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তাপ পাওয়া যাবে না। কিন্তু এল ক্লাসিকোর উত্তাপ ঠিকই ছড়িয়ে পড়বে সবার মাঝে। তাই এবারের এল ক্লাসিকো আর্তুর, কৌতিনহো বা মারিয়ানো ডিয়াজ, মার্কো আসেনসিওদের মত তরুণদের জন্য। সুয়ারেজ, বেনজেমা বা বেল, ক্রুসদের মত পুরনো সৈনিক তো থাকবেনই। কিন্তু এ ম্যাচের মাধ্যমে লা লিগায় শুরু হতে যাচ্ছে নতুন এক অধ্যায়ের।