মহাবিশ্বের সব কিছু আসলে গণিতের নিয়মে বাঁধা। ছোট্ট অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি— সব কিছুর পেছনেই আছে গণিত। এমনকি স্বয়ং মানুষের সব কিছুও গণিতের নিয়মেই বাঁধা। তবে, এতসব সমীকরণ, সব কিছুর মধ্যে বিশেষ ৬টি সংখ্যা আছে। মহাবিশ্বের ভিত্তি বা রেসিপি বলা যায় এই সংখ্যাগুলোকে। এদেরকে নিয়ে মার্টিন রাইস একটি বই লিখেছেন Just Six Numbers শিরোনামে।
বিশেষ সেই ছয় সংখ্যাকে নিয়েই এই আয়োজন।
১
মহাবিশ্বের এত বিশাল হওয়ার পেছনে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা কাজ করে যাচ্ছে: N । এর মান হলো:
১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০!
এই সংখ্যার কাজ কী হতে পারে, আন্দাজ করুন তো। পরমাণুগুলোকে একত্রে ধরে রাখার পেছনে যে তড়িৎ বল কাজ করে, তার শক্তিকে তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বল দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যায়, এটা সেই সংখ্যা।
যদি এই সংখ্যাটির মান আর কয়েক ‘শূন্য’ কম হতো, স্বল্পায়ুর ছোট্ট এক মহাবিশ্বই কেবল গড়ে উঠতে পারতো। সেই মহাবিশ্বের প্রাণগুলো পোকামাকড়ের চেয়ে বড় হতে পারতো না কোনোভাবেই। মানুষের উপযোগী পৃথিবী বা পরিবেশই তৈরি হতো না তখন। সম্ভব হতো না বিবর্তন। অর্থাৎ, মানুষ নামের কোনো প্রাণীর জন্মই হতো না সেই ছোট্ট মহাবিশ্বে।
২
ε — এপসাইলন । এর মান হচ্ছে ০.০০৭। কতটা শক্তিশালীভাবে পরমাণুরা একে অন্যকে বেঁধে রাখে, আলিঙ্গন করে- তা এই সংখ্যা থেকে জানা যায়। জানা যায়, পৃথিবীর সব পরমাণু কেমন করে তৈরি হলো। সূর্যের বুকে এবং অন্যসব নক্ষত্রের কেন্দ্রে কীভাবে হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে জন্ম নেয় পর্যায় সারণির সমস্ত পরমাণু।
এই যে আমাদের চারপাশে কার্বন আর অক্সিজেন এত সহজলভ্য এবং স্বর্ণ বা ইউরেনিয়াম এত দুষ্প্রাপ্য- এর পেছনেও সেই এপসাইলন। নক্ষত্রের বুকে কীভাবে কী হবে, তার উপরেই আসলে সবকিছু নির্ভর করে।
সহজ কথায়, এর মান যদি ০.০০৬ কিংবা ০.০০৮ হতো, আমাদের কোনো অস্তিত্বই থাকতো না।
৩
এরপরে আছে ওমেগা (Ω)। ওমেগা আমাদেরকে বলে, মহাবিশ্বে কী পরিমাণ পদার্থ আছে। সেটা হতে পারে সাধারণ পদার্থ: যেগুলো আমরা প্রতিদিন দেখি, ব্যবহার করি। হতে পারে সাধারণ পদার্থ দিয়ে তৈরি নক্ষত্র, গ্যালাক্সি কিংবা মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্যাস। এবং ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু। ডার্ক ম্যাটার নিয়ে বিস্তারিত পড়া যাবে এখানে।
মূলত পদার্থ এবং শক্তির মোট ঘনত্বকে মহাবিশ্বের বিস্তৃতি কোনোরকমে থামিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ভর-শক্তির ঘনত্ব দিয়ে ভাগ করলে যে অনুপাত পাওয়া যায়, তা-ই ওমেগা। একে সংকট ঘনত্বও বলা হয়।
কথা হলো, মহাবিশ্ব এখনো বিস্তৃত হচ্ছে কীভাবে? আসলে এর পেছনে দায়ী মহাকর্ষের বিপরীত এক বল। এই বল মূলত বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ থেকে এসেছে, যার ফলে মহাবিশ্ব বিস্তৃত হতে শুরু করে। কিন্তু মহাবিস্ফোরণের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর। স্বাভাবিকভাবেই, সেই বলটির এতদিনে অনেকটাই কমে যাওয়ার কথা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, মহাবিশ্বের পরিধি প্রতি মুহুর্তে আরো প্রবলভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এর পেছনে কাজ করছে এক বিচিত্র শক্তি। বিজ্ঞানীরা আমাদের অপরিচিত এই শক্তির নাম দিয়েছেন ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি। মহাশূন্যের ভ্যাকুয়ামে যার জন্ম বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
এমন ধারণার পেছনেও কারণ আছে। পল ডিরাক রাতারাতি হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন, ভ্যাকুয়াম বা শূন্য বলতে আমরা যা বুঝি, তা মোটেও শূন্য নয়। এর মাঝে লুকিয়ে আছে শক্তির সাগর। যে সাগর থেকে জন্ম নেয় ভার্চুয়াল কণা: পদার্থ-প্রতিপদার্থ। জন্মের পরমুহুর্তেই নিজেদের মধ্যেকার সংঘর্ষে বিস্ফোরণের ফলে এরা আবার বিলীন হয়ে যায়। পেছনে রেখে যায় প্রবল শক্তি। সেই শক্তিই হলো আমাদের এই গুপ্তশক্তি।
সহজ কথায়, গুপ্তশক্তির সাথে মহাকর্ষের চলমান যুদ্ধের স্কোরকার্ড হলো ওমেগা। এটি আমাদেরকে বলে দেয়, মহাবিশ্বের আকৃতি কেমন হতে পারে। এর মান যদি ১ এর চেয়ে অনেক বেশি হতো, তাহলে অনেক আগেই মহাবিশ্ব চুপসে যেত। আবার, এর মান ১ এর চেয়ে অনেক কম হলে গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি- কোনটিরই জন্ম হতো না।
৪
ল্যামডার (λ) মান জানা গিয়েছিল ১৯৯৮ সালে। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলোর একটি এই ল্যামডা। এই লেখায় আমরা আসলে এরই মধ্যে ল্যামডাকে নিয়ে আলোচনাও করে ফেলেছি।
মহাকর্ষের বিপরীত বল নামে যে গুপ্তশক্তির কথা উপরের পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে, সেটাই ল্যামডা। যদিও খালি চোখে পৃথিবীতে বসে এর কাজকর্ম টের পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে মহাজাগতিক পটে চিন্তা করলে, দিন দিন এই গুপ্তশক্তি আরো বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠছে। এবং হিসেব বলছে, একসময় হয়তো মহাকর্ষের সাথে যুদ্ধে পুরোপুরি জিতেও যেতে পারে এই শক্তি।
আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় হলো, এর মান খুবই ছোট। নাহয় এর প্রভাবের ফলে কোনো গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রের জন্মই হতো না। মহাবিশ্বের এত বছরের ইতিহাস জুড়ে তখন হয়তো রাজত্ব করতো কেবল শূন্যতা।
৫
Q- আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধ্রুবক। পদার্থের স্থিতি ভর-শক্তি আর মহাকর্ষ বলের অনুপাতের ১,০০,০০০ ভাগের একভাগ। এই সংখ্যার মান অনেক ছোট হলে মহাকাশে ভেসে বেড়ানো গ্যাসগুলো কখনোই এক জায়গায় জড়ো হয়ে, ঘন হয়ে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ গঠন করতে পারতো না। এমনকি কিছুটা ছোট হলেও নক্ষত্র তৈরি হওয়ার গতি ধীর হয়ে যেত। ফলে নক্ষত্রের বুকের উপাদান থেকে পরবর্তী গ্রহ বা নক্ষত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা প্ল্যানেটারি সিস্টেম তৈরি হওয়ার মতো কাঁচামালই তৈরি হতো না। আবার, এই সংখ্যা যদি অনেক বড় হতো, ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষীয় টান গিলে খেত নক্ষত্রদের। এবং মহাশূন্যের বুকে ভেসে বেড়ানো গ্যাসের হাত ধরে গামারশ্মি দখল করে নিত সবকিছু।
৬
ষষ্ঠ ধ্রুব সংখ্যাটির কথা মানুষ বেশ কয়েকশত বছর ধরেই জানে। সাধারণ মনে হলেও এখন একে নতুনভাবে দেখা হচ্ছে। D- সংখ্যাটি মহাবিশ্বের মাত্রার সংখ্যা প্রকাশ করে। এর মান হলো ৩। মহাবিশ্ব যদি দুই মাত্রার কিংবা চার মাত্রার হতো, স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, এখন আমরা প্রাণ বলতে যা বুঝি- তেমন কিছুর অস্তিত্ব থাকতো না। সবকিছুই অন্যরকম হতো। আসলে আদৌ প্রাণ বলে কিছু থাকতো কি না, কে জানে?
অনেকেই নিশ্চয়ই ভাবছেন, চতুর্থ মাত্রা তো আছে। সময়! হ্যাঁ, সময়কে চতুর্থ মাত্রা বলা হয় ঠিকই, তবে এটি বাকিগুলোর চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন। একটা নির্দিষ্ট দিকেই কেবল এটি এগোতে পারে, পেছনে ফেরার কোনো উপায় নেই। কাজেই, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা- মাত্রা হিসেবে এই তিনটির সাথে সময়ের আকাশ-পাতাল তফাৎ।
হয়তো মাইক্রোস্কোপিক স্কেলে, কিংবা আরো সূক্ষ্মভাবে তাকালে স্থান তার নিগূঢ় রহস্য ফাঁস করবে আমাদের কাছে। হয়তো জানা যাবে, মহাবিশ্বের সব কিছুই ‘সুপারস্ট্রিং’ নামের দশ মাত্রার বিচিত্র এক জিনিসের কম্পনের ফল। তবে, এখন তেমন কিছুর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কাজেই, সে গল্প আপাতত থাকুক।
শেষের আগে
এই সংখ্যাগুলোকে সহজ ভাষায় বলা যায়, আমাদের বর্তমান মহাবিশ্বের রেসিপি। কিন্তু প্রতিটি ধ্রুবককে আলাদা আলাদাভাবে দেখতে গেলে মনে হবে, জিনিসগুলো আসলে লাক বাই চান্স । কিন্তু একসাথে দেখলে?
ধরুন, আপনাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্রাশ ফায়ার করা হলো। কিন্তু সবগুলো গুলিই আপনার কানের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। এককথায় পুরো ব্যাপারটিকে কাকতালীয় বলে দেয়াই যায়। কিন্তু আমাদের কি ভেবে দেখা উচিৎ না যে, এই ব্যাপারটা কাকতাল না-ও হতে পারে? হয়তো এই সব কিছুর পেছনে আরো গভীর কোনো রহস্য আছে। ল্যামডা, ওমেগা বা ডাইমেনশনের পেছনে ঘাপটি মেরে আছে বিচিত্র কোনো সত্য।
কথা হলো, চোখ মেলে সেই সত্য দেখার মতো চোখ কি আমাদের আছে? আমরা কি কোনোদিন এদের সত্যিকারের রহস্য ভেদ করতে পারবো?
এ প্রশ্নের উত্তর সময় ছাড়া আর কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব না।