থাইল্যান্ডের কথা শুনলেই হাজার বছরের প্রাচীন থাই সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ব্যাপারটা সবার আগে মাথায় আসে। ঐতিহ্যে ঘেরা দেশটির অনন্য সংস্কৃতি এবং ভিন্নধর্মী কিছু ধ্যান ধারণা রয়েছে। আর এজন্যই প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক থাইল্যান্ডে ঘুরতে আসেন। থাই সংস্কৃতির একটি বিশেষ অংশ হলো ‘স্যাক ইয়ান্ট’। এটি ‘স্যাক্রেড ইঙ্ক ট্যাটু’ নামেও পরিচিত। এর অর্থ পবিত্র ট্যাটু বা নকশা।
থাইবাসীর জন্য এই ট্যাটুগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের বিশ্বাস- এগুলো তাদের বিপদ আপদ থেকে বাঁচাবে। যুগ যুগ ধরে এমনটাই চলে আসছে। পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসকে তারা এখনও ধরে রেখেছে। প্রত্যেকটি ট্যাটুর গভীর ও অর্থপূর্ণ তাৎপর্য আছে বলে তারা মনে করেন। থাই মানুষজনের বিশ্বাস, স্যাক ইয়ান্ট তাদেরকে বিপদ ও মৃত্যু থেকে রক্ষার পাশপাশি ভাগ্য পরিবর্তন করে জীবনে শক্তি, উন্নতি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে।
প্রতি বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে ছুটির দিনে স্যাক ইয়ান্ট বা পবিত্র নকশা আঁকার উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ মন্দির ওয়াট ব্যাং ফ্রাতে প্রায় ১০,০০০ মানুষের সমাগম হয়। ব্যাংকক থেকে পশ্চিমে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে এই মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরটি ট্যাটু এবং তাবিজের জন্য বেশ বিখ্যাত। এখানকার সন্ন্যসীরা দক্ষ হাতে ট্যাটু ও তাবিজের কাজ করে থাকেন। থাইল্যান্ডের আর কোথাও বা অন্য কোনো সময় যে এই নকশা করা যাবে না তা না। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে স্যাক ইয়ান্ট উদযাপনে জাঁকজমক ভাবটা বেশি থাকে।
ইতিহাস
স্যাক ইয়ান্ট সংস্কৃতির সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন সংস্কৃতির যোগাযোগ আছে বলে ধারণা করা হয়। ‘স্যাক’ এর শাব্দিক অর্থ ট্যাটু বা নকশা। আর ‘ইয়ান্ট’ এসেছে ‘ইয়ান্ত্রা’ থেকে। এর অর্থ রহস্যময় রেখাচিত্র বা নকশা। এই ধরনের ট্যাটু শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্মেরই অংশ নয়। এর প্রচলন ব্রাহ্মণ এবং সর্বপ্রাণীবাদীদের মধ্যেও আছে। পালি সংস্কৃতিতে এসকল পবিত্র রেখাচিত্র ও মন্ত্রকে ‘খোম’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। স্যাক ইয়ান্টে প্রাচীন খামের ভাষার ব্যবহার করা হয়। কারণ থাইল্যান্ড বহু বছর অ্যাংকর সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ব্যাংককের স্যাক ইয়ান্ট মাস্টার অ্যাজার্ন নেং ওনুট বলেন,
প্রায় ১,২০০ বছর আগে খামের ভাষা অণুপ্রেরণায় স্যাক ইয়ান্ট উদযাপন শুরু হয়। এই ভাষার নিজস্ব কোনো শক্তি নাই। তবে এর মধ্যে মূল শক্তির সঞ্চার হয় ট্যাটু আঁকার মাধ্যমে।
উল্লেখ্য, অ্যাজার্ন নেং আমেরিকান নায়ক স্টিভেন ফ্রেডেরিক সিগেল এবং আমেরিকান নায়িকা ব্রুক শিল্ডসকে স্যাক ইয়ান্ট এঁকে দেন। স্টিভেন এবং ব্রুক ছাড়া আরও অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিও এই স্যাক ইয়ান্ট করান। অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, ব্র্যাড পিট, ব্রিটিশ নায়িকা কারা ডেলেভিন, সাবেক ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ বিজয়ী ক্যাপ্টেন ফ্যাবিও ক্যানাভারো এবং থাই নায়িকা চোম্পু আরায়াও এই স্যাক ইয়ান্ট আঁকিয়েছেন নিজেদের শরীরে। অ্যাঞ্জেলিনা জোলি থাইল্যান্ডে কয়েকবার আসেন স্যাক ইয়ান্ট করানোর জন্য। প্রথমবার আসেন ২০০৪ সালে। আর প্রত্যেকবারই এই দায়িত্ব পালন করেন অ্যাজার্ন নু কানপাই। ব্র্যাড এবং কারাকেও অ্যাজার্ন কানপাই ট্যাটু করে দেন।
স্যাক ইয়ান্টের উদ্ভাবনকাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে থাইবাসীর বিশ্বাস, তা অবশ্যই এক থেকে দুই হাজার বছর আগে। কমপক্ষে আইয়ুত্থায়া সাম্রাজ্যের সম্রাট নারেসুয়ান মহারাজের আমলে যে এই ঐতিহ্য ছিল তার প্রমাণ তো পাওয়াই যায়। এই ট্যাটু সেই আমলে কোনো ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হতো। উচ্চপদস্থ কিংবা নিম্নপদস্থ সকল কর্মকর্তাই এই ট্যাটু নিজেদের শরীরে খোদাই করতেন। তাছাড়া যেকোনো যুদ্ধে যাওয়ার আগে সৈন্যরা অবশ্যই এই ট্যাটু নিজেদের দেহে আঁকাতেন। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, এই স্যাক ইয়ান্ট তাদের রক্ষা করবে।
স্যাক ইয়ান্ট
প্রাচীন ঐতিহ্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে সমাজের প্রত্যেক স্তরের বা পেশার ব্যক্তির জন্য স্যাক ইয়ান্টের ধরন আলাদা আলাদা হওয়ার কথা। অর্থাৎ শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, সৈনিক সকলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ট্যাটু। আর এভাবেই প্রাচীনকাল থেকে এই ঐতিহ্য চলে আসছে। একজন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে স্যাক ইয়ান্টের এত প্রকারভেদ বা ডিজাইনের পার্থক্য বোঝা সম্ভব না। তাই এই ট্যাটু বাছাই করতে সাহায্য করেন স্যাক ইয়ান্ট মাস্টাররা। অর্থাৎ আপনার পেশা বা কাজের ধরন এবং সামাজিক অবস্থানকে মাথায় রেখেই স্যাক ইয়ান্ট করা হবে। অ্যাজার্ন নেং বলেন,
আমি যদি এমন কাউকে স্যাক ইয়ান্ট এঁকে দিই যিনি অনেক ভ্রমণ করেন, তাহলে আমি তার নিরাপত্তার বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দিব। আবার অন্যদিকে কোনো ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি বা উন্নতির ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিব।
থাইল্যান্ডের অতি পরিচিত একটি খেলা হলো ‘মুয়াই থাই’। এটি মূলত থাই বক্সিং বা দ্বন্দ্ব যুদ্ধ। এখানে গেলে দেখা যায় সব খেলোয়াড়ের সারা শরীরে স্যাক ইয়ান্ট আঁকা। তারা মনে করেন স্যাক ইয়ান্টই তাদের রক্ষাকবচ।
একসময় ট্যাটু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে মানা হলেও আস্তে আস্তে তা কমে যাচ্ছে। দিন দিন এই স্যাক ইয়ান্টের ব্যাপারটা পরিচিতি লাভ করায় থাইল্যান্ডের বাইরের অনেক পর্যটক আসেন স্যাক ইয়ান্ট করানোর জন্য। এতে এই আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানটি অনেকটা বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। আর এতে এর মূল লক্ষ্য বিচ্যুত হচ্ছে।
‘স্যাক্রেড স্কিন: থাইল্যান্ডস স্পিরিট ট্যাটুস’ এর লেখক টম ভ্যাটেরের মতে, বিষয়টি আস্তে আস্তে বাণিজ্যিক হয়ে যাওয়ার কারণে স্যাক ইয়ান্ট করানোর জন্য মানুষের ঢলও বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এজন্য স্যাক ইয়ান্ট মাস্টারদের পক্ষে সবার জন্য ঠিক ট্যাটুটা নির্বাচন করা সম্ভব হয় না। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, যে সকল পর্যটক ট্যাটু করাতে আসেন, তাদের অনেকেই এর তাৎপর্য জানেন না কিংবা এগুলোর উপর বিশ্বাসী নন। তারা তাদের ইচ্ছামতোই ট্যাটু করাতে চান। তবে থাইবাসীরা এখনও অ্যাজার্ন বা স্যাক ইয়ান্ট মাস্টারদেরকেই তাদের জন্য স্যাক ইয়ান্ট বাছাই করে দিতে বলেন।
অবশ্য অনেক থাই তরুণ-তরুণী ভিনদেশী নায়ক-নায়িকাদের মতো স্যাক ইয়ান্ট করান। ফলশ্রুতিতে তারাও নিজেদের পছন্দমতো ট্যাটু নির্বাচন করেন। স্যাক ইয়ান্টের প্রতি বিশ্বাস কমে গেলেও তা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। এখনও এতে অনেকে বিশ্বাস করেন। টম ভ্যাটের থাইল্যান্ডের কয়েকজন অধিবাসী এবং বিদেশীদের সাথে কথা বলে জানান, দৈনন্দিন ছোট-বড় বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তারা এই ট্যাটু করান। এমনকি কয়েকজন অপরাধী জানান, স্যাক ইয়ান্টের জন্যই গুলি লাগার পর কিংবা ছুরিকাঘাতে আহত হওয়ার পরও তারা প্রাণে বেঁচে যান।
স্যাক ইয়ান্ট করার জন্য দুই ফুট লম্বা একটি বাঁশের দণ্ড বা সুঁইয়ের প্রয়োজন হয়। এটা দিয়ে দেহে ট্যাটুগুলো খোদাই করা হয়। শরীরের বেশি গভীর পর্যন্ত দণ্ড বা সুঁইটি ঢোকানো হয় না বলে রক্তক্ষরণও তেমন একটা হয় না। তবে সমস্যা হলো, এসব দণ্ড দিয়ে কাজটা করা বেশ সময়সাপেক্ষ। তাই ধৈর্য্য সহকারে ব্যথা সহ্য করার মানসিকতা নিয়েই ট্যাটু করতে যেতে হবে।
তা না হলে থাইল্যান্ডে এমন স্টুডিও আছে, যেখানে ইলেকট্রিক মেশিন দিয়ে ট্যাটু করা হয়। তবে থাইবাসীদের মতে, ইলেকট্রিক মেশিন দিয়ে ট্যাটু করলে অলৌকিক শক্তির ব্যাপারটা আর থাকে না। ট্যাটু করার জন্য যে তেল ও কালির মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়, তা নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা, যেমন- পুরুষদের জন্য ব্যবহৃত হয় পাম ওয়েল ও চীনা কয়লার কালির মিশ্রণ। আর নারীদের জন্য ব্যবহৃত হয় স্বচ্ছ কালি। প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একবার সুঁইয়ে কালি লাগাতে হয়। নারীদের ট্যাটু করার সময় স্যাক ইয়ান্ট মাস্টারদের জন্য গ্লাভস পরা বাধ্যতামূলক।
থাইল্যান্ডে ট্যাটু করানো অন্যান্য দেশের তুলনায় সস্তা বলে অনেক পর্যটকই সেখানে গিয়ে ট্যাটু করান। তারা আশা করেন, যেকোনো ট্যাটুই তারা থাইল্যান্ডে করাতে পারবেন। আর তাদের এই ধারণা স্যাক ইয়ান্ট মাস্টার ও থাই অধিবাসীদের মাঝে বিরক্তির উদ্রেক করে। কারণ এতে তাদের সংস্কৃতির মূলভাব এবং গাম্ভীর্যের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না।
থাই রান্না নিয়ে জানতে পড়ে নিন এই বইটি