জীবনের অর্থ কী? জীবন মানে অপেক্ষা, এক অনন্ত, চলমান, ক্ষয়হীন অপেক্ষা। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকে শুধুই অপেক্ষা। জন্মের পূর্বেই জন্মের জন্য অপেক্ষা, জন্মের পরে পূর্ণতা পাওয়ার অপেক্ষা, অপেক্ষা থাকে কত স্বপ্ন-ইচ্ছা, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের, অপেক্ষা থাকে কত না পাওয়াকে পাওয়ার, অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার। আর জন্মের মুহূর্ত থেকেই তো এক মহাপ্রতীক্ষা থাকেই প্রতিটি জীবনের মৃত্যুর প্রতীক্ষা, সমাপ্তির প্রতীক্ষা, যেন জীবন কোনো কবির সৃষ্টি করা কাব্য, যার শেষ ছন্দ থাকে মিলে যাওয়ার অপেক্ষায়।
আবার কারো কারো জন্য মৃত্যুতেও শেষ হয় না অপেক্ষার, পড়ে থাকে আরেক অসীম অনন্তের অপেক্ষা, জীবনের পর এক মহাজীবনের অপেক্ষা, কাব্যের পর এক মহাকাব্যের অপেক্ষা। যেন এক ধার্মিক প্রাণ অনন্ত সময় ধরে মুক্তির সন্ধান চাচ্ছে, যেন কোনো ধর্মভীরু ঈশ্বরের সন্ধান চেয়ে বসে আছে জনম জনমের পথ। জীবন যেন এমনই এক প্রতীক্ষার গল্প। এই প্রতীক্ষার গল্প নিয়েই স্যামুয়েল বেকেটের সাজানো যুগান্তকারী নাটক ‘ওয়েটিং ফর গডো’।
কিন্তু অন্যান্য সকল অপেক্ষার সাথে বেকেটের বলা অপেক্ষার একটা বড় পার্থক্য থেকেই যায় অপেক্ষার সার্থকতায়। ‘ওয়েটিং ফর গডো’তে বেকেট অপেক্ষার চেয়ে বেশি স্পষ্ট করে বলতে চেয়েছেন, সেই অপেক্ষার সার্থকতার বিষয়ে যাবতীয় আয়োজনের লক্ষ্যের বিষয়ে। বুদ্ধিমান মানুষের চাওয়া আর আকাঙ্ক্ষার বিষয় অনেক ও বিবিধ, তাদের অপেক্ষা সীমাহীন। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সেই অপেক্ষার পরে কি তৃপ্তি আসে?
সকল ক্ষেত্রে সেই অপেক্ষা কি তাদের জন্য সুখ ও সফলতা নিয়ে আসে? বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ জানে না তাদের অপেক্ষার কারণ। বোঝে না অপেক্ষার পরে ঠিক কিসের জন্য আশা করে আছে তারা। সারা জীবন ধরে কিংবা জীবনের শেষ মুহূর্তে তারা যে শান্তির ও তৃপ্তির আশা করে আছে তা বাস্তবিক কেমন বা কোন রূপে তা তাদের কাছে ধরা দিতে পারে। মানুষের সমস্ত অস্তিত্ব ও অস্তিত্বের সার্থকতাকে যেন প্রশ্নবিদ্ধ করে যায় বেকেটের এই যুগান্তকারী সৃষ্টি। নাটকটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে এক অন্তহীন অপেক্ষা, নাটকের শেষেও তা থাকে সফলতাহীন, সমাপ্তিহীন বরং সময়ের সাথে অপেক্ষা আরো বেশি সন্দিহান হয়ে পড়ে।
নাটকের শুরু হয় প্রধান দুই চরিত্র ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগনের নির্জন রাস্তার পাশে এক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত অপেক্ষা দিয়ে, যেখানে আর কেউ নেই, তাদের আর কিছু করার নেই, কার জন্য তারা অপেক্ষা করছে তা তাদের জানা নেই, এমনকি যার জন্য তাদের অপেক্ষা সে তাদের কথা জানে নাকি বা তাদের অপেক্ষায় সাড়া দিয়ে তারা আসবে নাকি তা পর্যন্ত অজানা তাদের।
নাটকের শুরুর দৃশ্যই যেন বলে দেয় কী হতাশা আর অনিশ্চয়তায় পূর্ণ এই নাটক! স্যামুয়েল বেকেট তার এই যুগান্তকারী সাহিত্যকর্মটি সৃষ্টি করেন ১৯৪৮ সালে। জীবনের হতাশাপূর্ণ দর্শনকে তুলে ধরা মাত্র দুটি অঙ্কে বিশেষ কোনো কার্মকান্ড বা ঘটনাপ্রবাহ ছাড়া নাটকের একটা বিশেষ ধারার সৃষ্টিতে নাট্যকারের ছিলো এটাই প্রথম প্রচেষ্টা। অনস্বীকার্যভাবে সাহিত্যের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল নাটকের একটি হয়ে নাটকটি জায়গা করে নেয়। পরবর্তীতে এটা হয়ে ওঠে সমসাময়িক সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বকারী এক সৃষ্টি।
প্যারিসের এক ছোট্ট থিয়েটারে ১৯৫৩ সালে নাটকটি প্রথম মঞ্চায়িত হয় এবং সেখানেই এর পরে চারশোবারেরও অধিক মঞ্চায়িত হয়। ব্যাপক জনপ্রিয়তা একে এনে দেয় ফ্রান্সের অন্যান্য মঞ্চে প্রদর্শনের সুযোগ এবং সেই সাথে বিভিন্ন ভাষায় তা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবী বিভিন্ন প্রান্তে। স্থান, কাল, পাত্র, বচন, সৃষ্টির ধরন- সবকিছুতে রেখে যাওয়া সৃষ্টিগত শূন্যতা এক অসাধারণ শূন্যতাবোধ সৃষ্টি করে দর্শকের হৃদয়ে।
এই নাটকের সর্বত্র যে হতাশা, অস্থিরতা বা শূন্যতা কথা বলছে তা একদিক দিয়ে যেমন সামনে আসে মানব জীবনের হতাশার প্রতিচ্ছবি হয়ে, অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের অন্তঃসারশূন্য সমাজের ছবিও আঁকে। আবার গাছের নিচে দুজনের অপেক্ষা করতে করতে এস্ট্রাগনের ভ্লাদিমিরকে তাদের মিলিত আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করা যেন মানব অস্তিত্বের ওপরই একরকম প্রশ্ন তোলে।
এস্ট্রাগনের নিজের জুতা খোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা ইঙ্গিত দেয় নিজের অস্তিত্বকে ঝেড়ে ফেলার ইচ্ছার দিকেই। এস্ট্রাগনের ঘুমিয়ে পড়ার ফলে ভ্লাদিমির একা হয়ে পড়ার আতঙ্ক যুদ্ধপরবর্তী সমাজের বিচ্ছিন্নতাকেই চিত্রায়িত করে। ভ্লাদিমিরের বাইবেলের প্রতি অনুরাগ এবং বাইবেলের গল্পের প্রতি অবিশ্বাস সেই সমাজে ধর্মের অবস্থাকেই নির্দেশ করে। এভাবেই নাটকের ছোট ছোট অঙ্কায়ন জীবন ও সমাজের স্তরে স্তরে লুকানো হতাশা ও শূন্যতাকেই তুলে আনে।
তবে সবচেয়ে বেশি যে চরিত্রের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির মাধ্যমে নাট্যকারের তুলে ধরা অস্তিত্ব সংকটের রূপায়ন পূর্ণতা পায় তা হলো গডোর চরিত্র, যদিও দর্শকেরা বা নাটকের চরিত্ররা কখনোই জানতে পারে না গডো কে বা কেমন। অনেক সাহিত্যবিশারদের মতে, গডো নামটি এসেছে ইংরেজি শব্দ গড (God) থেকে। গডো চরিত্রটি অপেক্ষারত ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগনের কাছে ঠিক তেমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন এই পৃথিবীর বিশ্বাসী মানুষেরা ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবছে।
সাধারণ বিশ্বাসী মানুষ জানেন না ঈশ্বর কেমন বা কে। তারা জানেন না ঈশ্বরকে তারা কোথায় পাবেন। তারা জানেন না ঈশ্বর তাদের আশীর্বাদ করবেন নাকি অভিশাপ দেবেন, তবুও তারা সেই সত্ত্বার অপেক্ষায় থাকেন, তার করুণার মুখাপেক্ষী হয়। নাটকটিতে ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগনের জীবনও এই একই ভেলায় ভাসমান বলে দেখানো হয়েছে। নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা তাদের কখনো না দেখা, কখনো না জানা গডোর জন্য অপেক্ষায় থাকে।
আশায় বুক বাঁধে গডো তাদের হতাশাক্রান্ত, পুনরাবৃত্তিময়, দুর্বিষহ জীবনকে অর্থবহ ও সহজ করে তুলবে। নাটকের দুটি অঙ্কে যেন এই কথাই বারবার উঠে আসে দর্শকের সামনে। এ যেন কোনো কথা ও কর্ম ছাড়াই মানুষের পুরোটা জীবন ও ধর্মের সারাংশকে নীরবে মঞ্চায়িত করা। নাটকটির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব এটাই যে, এটা মানুষের জীবনের হতাশা ও আশা, দুর্ভোগ ও আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা ও বিশ্বাসকে একইসাথে সবচেয়ে কম শব্দে মঞ্চায়িত করে।
জীবনের অল্প পরিসর জুড়ে থাকা মানুষগুলোও কিন্তু গুরুত্বহীন নয়, তেমনি নাটকে এমন কিছু ক্ষুদ্র চরিত্র থেকেই যায়, যারা স্বল্প পরিসর জুড়ে ক্ষুদ্র ভূমিকা পালন করলেও তা ফেলনা হয় না। আর বিশেষ করে নাটকটি যদি হয় স্যামুয়েল বেকেটের মতো নাট্যকারের, তাহলে তো ধরে নেওয়াই যায় যে, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর চরিত্রেরও আছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা।
ওয়েটিং ফর গডো নাটকের তুলনামূলক ক্ষুদ্র চরিত্র পোজো ও লাকি। যদিও সম্পূর্ণ নাটকে তাদের উপস্থিতি খুবই সামান্য, কিন্তু সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক ফুটে ওঠে সেই সামান্য ভূমিকার মধ্যেই। পোজো ও লাকিকে দুই অঙ্কেই দেখা যায় পালাক্রমে একে অপরের মনিব ও চাকরের ভূমিকায়। সমাজের মালিক ও শ্রমিক দুই শ্রেণীকেই যেন প্রতিনিধিত্ব করে এই দুই চরিত্র। একদিকে যেমন দেখা যায় লাকিকে নামে ভাগ্যবান হলেও মানসিক ও শারীরিকভাবে চরম নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হতে, অপরদিকে পোজো মনিব হলেও তাকে সুখী দেখা যায় না।
বরং প্রতিনিয়ত নিজের সম্পদ, সম্মান আর অবস্থান হারানোর ভয়ে তাকে তটস্থ থাকতে দেখা যায়। আর এই কারণেই দেখা যায় নিজের অধীনস্থের ওপর অকারণ নির্যাতন করে নিজের ক্ষমতা জাহির করতে। সমাজের দুই শ্রেণীর মানুষদের জীবনের বাস্তবতা যেন এক অনবদ্য চিত্রে ফুটে উঠেছে নাটকের এই অংশে। সেই সাথে তাদের অবস্থান ও ক্ষমতার পরিবর্তনও দেখায় সময়ের আমোঘ নিয়মকে।
সাহিত্যকে বলা হয় জীবনের দর্পণ। জীবনের সত্য ও মরীচিকাকে স্পষ্ট করে এই সাহিত্য। বেকেটের ওয়েটিং ফর গডোকে এজন্যই ধরা হয় সেই সমসাময়িক সময়ের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যগুলোর একটি হিসেবে। জীবনের অর্থ-অনর্থ, আশা-হতাশা, প্রতীক্ষা-প্রাপ্তির এক দুর্লভ নাট্যচিত্র এই নাটক। বিশেষ কোনো ঘটনা সূচনাতে না থাকলেও এবং সেই সাথে বিশেষ কোনো সমাপ্তি না থাকলেও দর্শককে রেখে যায় গভীর চিন্তার জগতে, হয়ে ওঠে দর্শকের ভাবনার জগতের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের অনন্য এক খোরাক।