আপনি কি ‘কেক’ নামটি কখনও শুনেছেন? হয়তো খুব বোকার মতো প্রশ্ন করা হয়ে গেল। বর্তমানে এরকম মানুষ খুব কমই আছেন, যাদের কেক সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই কিংবা এর নাম শোনেননি। ছোট বাচ্চা, বয়স্ক বা বৃদ্ধ ব্যক্তি- সবার কাছেই এই কেক বেশ সুস্বাদু একটি খাবার হিসেবেই পরিচিত। ভ্যানিলা, চকলেট, স্ট্রবেরি, ব্ল্যাক ফরেস্ট, রেড ভেলভেট, বানানা এবং আরও ভিন্ন ভিন্ন ফ্লেভারের কেক দিয়ে ভরা থাকে বিভিন্ন কেকের দোকান, যেখান থেকে সহজেই আপনি আপনার পছন্দের কেক বাছাই করে নিতে পারেন।
মিষ্টি জাতীয় এই খাবারটি থেকে কোনো অসুস্থতার কারণেও বিরত থাকা বেশ কষ্টকর বটে। আজকের এই লেখাটি সকলের প্রিয় এই ‘কেক’ সম্পর্কেই লেখা।
কেকের অতীত
ইতিহাসের পাতা খুলে দেখা যায়, এখনকার কেক এবং প্রাচীন যুগের কেকের মধ্যে খুব কম মিলই রয়েছে। আগের দিনের কেকগুলো অনেকটা পাউরুটির মতো ছিল। আর কেককে মিষ্টি করার জন্য উপরে মধু দেওয়া হতো। মাঝে মাঝে একে আকর্ষণীয় ও আরো সুস্বাদু করার উদ্দেশ্যে বাদাম এবং ড্রাই ফ্রুটস দেওয়া হতো। খাদ্য গবেষকদের মতে, প্রাচীন মিশরীয়রা পৃথিবীতে প্রথমবার কেক বানানোর কৌশল আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ‘দ্য অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’ অনুসারে, ‘কেক’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৩ শতকে। ‘কাকা’ (Kaka) নামক প্রাচীন নর্স শব্দ হতে উৎপত্তি লাভ করে এই ‘কেক’ শব্দটি। মধ্যযুগীয় ইউরোপবাসীও কেক তৈরি করতে পারতো। তারা মূলত ফ্রুট কেক এবং জিঞ্জার ব্রেড বানানোর ক্ষেত্রেই নিজেদের দক্ষতা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। আর এসব কেক কয়েক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেত।
খাদ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক কেক প্রথমবারের মতো প্রস্তুত করা হয় ইউরোপে, আর সময়টা ছিল ১৭ শতকের মাঝামাঝি। উল্লেখ্য, আধুনিক কেক বলতে গোলাকার কেকগুলোকে বোঝানো হয়, যেগুলোর উপর আইসিং করা হয়। এর পেছনে মূলত ভূমিকা ছিল ইউরোপের প্রযুক্তিগত উন্নতির। ১৭ শতকের মাঝামাঝি প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে ওভেন ও কেক বানানোর জন্য বিভিন্ন আকৃতির ছাঁচ পাওয়া যেত। তাছাড়া বিভিন্ন খাদ্য উপাদানও তখন সহজলভ্য হয়, যার ফলে কেক তৈরির কাজটি সহজ হয়ে যায়। কেকগুলোকে আকার দেওয়ার জন্য তখন শুধুমাত্র একধরনের ছাঁচই ব্যবহৃত হতো, যা তৈরি করা হতো ধাতু, কাগজ বা কাঠ দিয়ে। এগুলোর মধ্যে কিছু ছাঁচ নিয়ন্ত্রণযোগ্য ছিল। কখনো কখনো কেক প্যানও ব্যবহারের প্রচলন ছিল।
আর আইসিং করার জন্য আগে ব্যবহৃত হতো মিহি চিনির গুড়া ও ডিমের সাদা অংশের মিশ্রণ। তাছাড়া এই আইসিংয়ের মিশ্রণে স্বাদ আনার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হতো।
আইসিং দেওয়ার পর আবার কেকটি ওভেনে সেঁকা হত। ওভেন থেকে বের করার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই কেকের উপর একটি শক্ত কিন্তু মসৃণ আস্তরণের সৃষ্টি হয়। আইসিং দেওয়ার যুগেও কিছু কিছু কেকের উপর এখনও ড্রাই ফ্রুটস ব্যবহার করা হত।
তবে এটাও বর্তমান যুগের কেকের সমতুল্য ছিল না। কেকের মান আজকের পর্যায়ে আসে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এই সময়ে কেক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো ময়দা এবং ইস্টের বদলে বেকিং পাউডার। ‘দ্য ক্যাসেলস নিউ ইউনিভার্সাল কুকারি বুক’ (লন্ডন ১৮৯৪)-এ লেয়ার কেকের এক নতুন রেসিপি পাওয়া যায়। এই রেসিপি তখনকার প্রচলিত রেসিপির তুলনায় ভিন্ন ছিল। ২০ শতকের প্রথম কয়েক দশকে কেকে প্রচলিত বয়েলড আইসিংয়ের বদলে আমেরিকান বাটার ক্রিম ফ্রস্টিং প্রয়োগ করা হত। এই ফ্রস্টিং তৈরি করা হত বাটার, ক্রিম, চিনির মিহি গুড়া এবং বিভিন্ন ফুড ফ্লেভার দিয়ে।
কেকের আকার সাধারণত গোলাকার হয় কেন?
কেক পূর্বে মূলত গোলাকারই হতো। যদিও বর্তমানে সময়, সংস্কৃতি এবং রন্ধনপ্রণালির পরিবর্তনের উপর কেকের আকার কীরকম হবে সেটা নির্ভর করে। আজকের এই গোলাকার কেকগুলো মূলত প্রাচীন পাউরুটি থেকে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে।
প্রাচীন পাউরুটি এবং কেকগুলো বানানো হতো হাত দিয়ে। সাধারণত রুটি তৈরির সময় যেভাবে আটা বা ময়দার বল বানানো হয়, ঠিক সেভাবে তা বানিয়ে বেলন দিয়ে একটু বেলে বা হাত দিয়ে টিপে তাওয়া কিংবা পাতলা কোনো প্যানে বসানো হত। এসব গোলাকার তাওয়াতে কেকের সবগুলো পাশ ঠিকমত সেঁকা সম্ভবপর হয়। সেজন্য ঐ সময়ে গোলাকার কেক তৈরিরই প্রচলন ছিল।
পরবর্তীতে ১৭ শতকে এসব প্যান বা তাওয়ার বদলে ছাঁচ ব্যবহার করা শুরু করলেও তা ছিল গোলাকৃতির। কারণটা আগের মতোই। প্রকৃতিগত দিক থেকেও এই গোলাকার ছাঁচই এই খাবার তৈরির উপযোগী। তবে সময়ের সাথে প্রযুক্তির উন্নতি ঘটে। ফলে ধীরে ধীরে বিভিন্ন আকারের এবং ধরনের ছাঁচ বাজারে আসতে শুরু করে, যা সাধারণ মানুষের কাছে কেকের নতুন চিত্র তুলে ধরে। ছাঁচে তৈরি কেক সবচেয়ে বেশি পরিচিত লাভ করে এবং সমাদৃত হয় ভিক্টোরিয়ান যুগে।
একটি বিষয় হলো, ১৭ শতকের এই ছাঁচগুলোর নিচে কোনো তল ছিল না। শুধুমাত্র বেষ্টনী বা কড়াটাই ছিল। লোহা কিংবা কাঠের তৈরি এই বেষ্টনী প্যানের উপর রেখে কেককে আকার দেওয়া হতো। এগুলোর কথা সেই যুগের অনেকগুলো রান্নার বই থেকে জানা গেছে। ই. স্মিথের বই ‘দ্য কমপ্লিট হাউসওয়াইফ’-এ এই সুস্বাদু খাবারটি বানানোর প্রণালীতে লেখা আছে, কেক তৈরির সময় কড়ার চারপাশে তেল বা মাখন মেখে নেওয়া এবং মাঝে এক বা দুই লেয়ারে কাগজ দিয়ে তার উপর আটা কিংবা ময়দা ছিটিয়ে নেওয়া জরুরি।
বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭২৭ সালে, যেখানে রয়েছে ৪০টি কেকের প্রস্তুতপ্রণালী। তার বইকে সেই সময়ের রান্নার, বিশেষত কেক তৈরির বর্ণনা সংবলিত একটি আদর্শ বই বলা যেতে পারে। তবে বইটির লেখিকা নিজেই জানিয়েছেন, এই বইটি তিনি নিজের ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে লিখেছেন। এতে করে বইটির কয়েকটি রেসিপি এর আগের শতকের প্রচলিত প্রণালীর উপর নির্ভর করে লেখা। যেমন- বইয়ের কিছু রেসিপিতে বার বার কাগজের বেষ্টনী বা কড়া ব্যবহার করার কথা তিনি বলেছিলেন, যা ১৭ শতকে বেশ পরিচিত একটি প্রক্রিয়া ছিল। কিন্তু তা-ও ১৮ শতকে প্রকাশিত বইটিতে এই বিষয়টি স্থান করে নেয়। এছাড়াও সেই সময়ে যে কাঠের কড়াও অনেকে ব্যবহার করতেন সেটাও তার বই থেকে বোঝা যায়। ১৭ শতকের স্যার কেনেম ডিগবি এবং আরো কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে, এসব কাগজের কড়ার তুলনায় টিনের কড়া বা বেষ্টনীই বেশি সুবিধাজনক।
তাছাড়া টিনের কড়ায় মরিচা কিংবা ময়লা পড়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। ১৯ শতকে শিল্প বিপ্লবের ফলে কেক তৈরির উপাদানগুলো সহজলভ্য হয়ে যায়। যার দরুণ এই খাবারটি বানানোর প্রবণতা এবং বিক্রিও বেড়ে যায়।
কেক কেন তৈরি হয়?
প্রাচীনকাল থেকেই কেক বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ব্যবহার করা হয়। এজন্য এদের আকারও সেই অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এখনও বিভিন্ন উপলক্ষে, যেমন- জন্মদিন, বিয়ে বা বিশেষ কোনো দিনে কেক পরিবেশন করে থাকে। অনেকে আবার নিজেই আপনজনদের জন্য এই কেক তৈরির কাজটি করে থাকেন। একসময় যখন চিনির মিহি গুঁড়ো, মসলা, বাদাম এবং ড্রাই ফ্রুটস দামি ছিল, তখন কাউকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের একটি পথ ছিল এই কেকের পরিবেশন। বর্তমানে এর মূল্য অনেক বেশি না হলেও এর পেছনের উদ্দেশ্য একই রয়ে গেছে।