ধূমপানে বিষপান, এ কথা কে না জানে! সিগারেটের প্যাকেটে স্পষ্ট করে লেখা থাকে, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিংবা ধূমপান ক্যান্সারের কারণ। তবে সর্বজনবিদিত এ সত্য ধূমপায়ীদের উপর প্রভাব ফেলে খুব কমই। যারা ধূমপানে অভ্যস্ত, শত নিষেধ কিংবা সতর্কীকরণেও তাদের মন থেকে ধূমপানের প্রবণতা দূর করা যায় না। তাদের মুখে একটিই কথা, “মৃত্যুর পেছনে তো আরো কত কারণই আছে। শুধু ধূমপানে আবার ওসব হয় নাকি!“
তবে আসলেই যে ধূমপান কতটা ক্ষতির কারণ, নতুন করে তার প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির করা এক জরিপের ফলাফলে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ধূমপান কেবল মানুষের আয়ুই কমায় না, এর ফলে দেশ অর্থনৈতিকভাবেও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সব মিলিয়ে জরিপের ফলাফলে যেসব সংখ্যা উঠে এসেছে, তা রীতিমতো ভয়জাগানিয়া।
সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল জেলার ১০,০০০টি পরিবারের উপর জরিপটি পরিচালনা করেছে, যেখানে তাদের সহযোগী হিসেবে আরো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি এবং ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে। গত শনিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) ঢাকা ক্লাবে একটি কনফারেন্সের মাধ্যমে “Economic Cost of Tobacco Use in Bangladesh: A Health Cost Approach” গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান।
এ গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রধান তিন ধরনের ক্যান্সারে (ফুসফুস, স্বরযন্ত্র ও মুখ) আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তামাক অব্যবহারকারীদের চেয়ে ১০৯ শতাংশ বেশি। এছাড়াও তামাক ব্যবহারকারীদের সাত ধরনের প্রাণঘাতী রোগ, যেমন- স্ট্রোক, হৃদরোগ ও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তামাক অব্যবহারকারীদের চেয়ে ৫৭ শতাংশ বেশি।
এছাড়া গবেষণাটি আরো বলছে:
- সরাসরি তামাক ব্যবহার কিংবা পরোক্ষ ধূমপানের ফলে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যা থেকে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩০,৫৭০ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১.৪ শতাংশ।
- সরাসরি তামাক ব্যবহারে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১,০০,৯৬১ জন মানুষের মৃত্যু হয়, এবং পরোক্ষ ধূমপানে মৃত্যু হয় ২৪,৭৫৭ জনের। এই মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের বার্ষিক মৃত্যুর ১৩.৫ শতাংশ।
- প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩০ বছর বা তার বেশি বয়সী ৭০ লক্ষ মানুষ তামাক ব্যবহারের সাথে সংশ্লিষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়।
তামাক ব্যবহারের ফলে রোগাক্রান্ত মানুষদেরকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। এ সম্পর্কিত সংকট নিরসনের লক্ষ্যে সরকারের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের পরিমাণও বেড়ে গেছে, যার ফলে দেশকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস এবং অকালমৃত্যুর ফলেও দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ব্যহত হচ্ছে।
গবেষণাটি জানাচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তামাকের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে জনমনে যে বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে, সেটিও সম্পূর্ণ ভুল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক খাত থেকে লাভের পরিমাণ ২২,৮১০ কোটি টাকা। বিপরীতে সরাসরি তামাক ব্যবহার কিংবা পরোক্ষ ধূমপানের ফলে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যা থেকে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩০,৫৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ কেবল ঐ এক অর্থবছরেই ঘাটটির পরিমাণ প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। তামাক চাষ ও ধূমপানের ফলে উদ্ভূত পরিবেশগত অবনতি বিবেচনায় আনলে এ ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বৃদ্ধি পেত।
বর্তমান বিরুপ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে গবেষণাটি সরকারের কাছে প্রস্তাব রেখেছে উচ্চ কর আরোপের মাধ্যমে দেশে তামাকজাতীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করার। এছাড়াও এ গবেষণায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তামাক নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার সংক্রান্ত আইনকে আরো কঠোর করে তোলা এবং সময়োপযোগী সংশোধনের উপর। বিশেষভাবে আহবান জানানো হয়েছে যেন তামাক উৎপাদনে চাষীদেরকে নিরুৎসাহিত করা হয়, পাশাপাশি তামাক ব্যবহারকারীদের এ কুঅভ্যাস ছাড়তে সাহায্য করা হয়।
আরো কিছু গবেষণার ফলাফল
উল্লেখ্য, গত বছর অনুরূপ আরেকটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল। “Global Adult Tobacco Survey (GATS) 2018” শীর্ষক সেই গবেষণাটির মতে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহার করে। শতকরা হিসেবে এই হার ৩৫.৩ শতাংশ। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১৩ লাখ। শতাংশের হিসেবে এই হার ছিল ৪৩.৩ শতাংশ। অর্থাৎ ৮ বছরে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার কমার হার ১৮.৫ শতাংশ।
অপর এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১৮ শতাংশ মানুষ ধূমপান করে, ২০.৬ শতাংশ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক গ্রহণ করে, এবং অনির্ধারিত পরিমাণ মানুষ দুটিই গ্রহণ করে। বাংলাদেশে একজন ধূমপায়ীর সিগারেট বাবদ মাসিক গড় খরচ ১০৭৭.৭ টাকা, এবং বিড়ি বাবদ ৩৪১.৯ টাকা।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৫% মানুষের বিশ্বাস ছিল তামাক ব্যবহারের ফলেই স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক বা ক্যান্সার হয়ে থাকে। ৬৫.৮ শতাংশ ধূমপায়ী তামাক ব্যবহারকারী এবং ৫৭ শতাংশ অধূমপায়ী তামাক ব্যবহারকারীকে, যারা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়েছে, তাদেরকে বলা হয়েছে তামাক ব্যবহার ত্যাগ করতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন
এছাড়া ২০১৮ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছিল বাংলাদেশে তামাক ও ধূমপানের ভয়াবহতার প্রতিচ্ছবি। সেখানে বলা হয়েছিল:
- যেকোনো ধরনের তামাক ব্যবহারে (ধোঁয়াযুক্ত বা ধোঁয়াবিহীন) প্রতিবছর বাংলাদেশে ১,৬১,০০০ জন মানুষ মারা যায়, যা দেশের বার্ষিক মোট মৃত্যুর ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের প্রতি পাঁচজনে একজন ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ তামাক ব্যবহার।
- প্রতিবছর বাংলাদেশে ৬৬,৭৪৯ জন মানুষ কার্ডিওভাস্কুলার রোগসমূহে মারা যায়, যার পেছনে প্রধান কারণ তামাক ব্যবহার। তামাকের কারণে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৪১ শতাংশই মারা যায় কার্ডিওভাস্কুলার রোগসমূহে।
- তামাক ব্যবহারের ফলে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২৪ শতাংশের মৃত্যুর কারণ সেরিব্রোভাস্কুলার রোগসমূহ, অর্থাৎ মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত না পৌঁছানো।
- ধূমপান করে না এমন ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫-৩০ শতাংশ হৃদরোগ এবং ২০-৩- শতাংশ স্ট্রোকের শিকার হতে পারে কেবল পরোক্ষ ধূমপানের ফলে।
- প্রজ্ঞার হিসেবানুযায়ী, বিদ্যমান কর ব্যবস্থা সংস্কার ও সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে তামাক খাত থেকে বছরে ১০,০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব।
- দাম বৃদ্ধি করা হলে দেশের অন্তত ৬০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দেবে, এবং এর ফলে অন্তত বিশ লক্ষ মানুষ তামাক ব্যবহারের ফলে অকালমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে।
শেষ কথা
সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমছে। এর প্রধান কারণ দেশে শিক্ষার হার ও আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি। কিন্তু তারপরও এ কথা অনস্বীকার্য যে, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে পুরোপুরি তামাকমুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন একদমই সহজ হবে না।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাই এখনও ধূমপান ও তামাক ব্যবহারের ভয়াবহতাকে খুব একটা আমলে নিচ্ছে না। শিক্ষিত যে জনগোষ্ঠীর উচিত সবার আগে ধূমপান ও তামাক ব্যবহারকে ‘না’ বলা, সেই তারাই এগুলোকে ‘ফ্যাশন’ হিসেবে গণ্য করছে। তামাকের ক্ষতিকর দিকসমূহ জানার পরও, তারা সেগুলোর কোনো তোয়াক্কা করছে না।
শিক্ষিত মানুষগুলোই যখন অশিক্ষিতের মতো আচরণ করে, তখন আসলে বলার আর কিছু থাকে না। যখন এই মানুষগুলো তথাকথিত ‘শো অফ’ করা বন্ধ করবে, যখন তাদের আড্ডার প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে থাকবে না সিগারেট বা অন্য কোনো নেশাদ্রব্য, তখনই দেশ অনেকটা এগিয়ে যাবে তামাকের অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভের পথে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/