আজ থেকে ঠিক নব্বই বছর আগে কলকাতায় যখন জাহাজ ব্যবসা রমরমা ছিল, তখনই নির্মিত হয় প্যাডেল স্টিমার পিএস মাহসুদ। ১৯২৯ সালে কলকাতার গার্ডেন রিচ ওয়ার্কশপে তৈরি করা হয়েছে এই প্যাডেল স্টিমার। বৃহত্তম প্যাডেল রকেট স্টিমার মাহসুদের প্যাডেলে ভর করেই আমরা বাংলাদেশের দীর্ঘতম সফরে বেরিয়েছি, তেরোটি নামচেনা নদী পারি দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
শতাব্দী প্রাচীন এই রকেট স্টিমারে আমরা কয়েকজন ইতিহাসপ্রেমী ভ্রমণকারী চেপে বসেছি। কিন্তু এর আগে সদরঘাটের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে নিজেদের বোকামির কারণে৷ কে জানতো, রকেট স্টিমারের টিকিট বাদামতলী ঘাট থেকে পাওয়া গেলেও লঞ্চ ছাড়ে লালকুঠি ঘাট থেকে? বিকেল থেকে কয়েক দফা বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে আছে৷ তার উপরে রাস্তা কাটা থাকায় বাদামতলী থেকে লালকুঠি ঘাট পর্যন্ত রিকশা চলাচলের অযোগ্য অবস্থা। যাই হোক, ভুল ঘাটে চলে গেলেও একদম শেষ মুহূর্তে এসে রকেট আমাদের তুলে নিলো তার শতবর্ষী পুরনো ডেকে।
শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আর এই একটা ভ্রমণে গিয়েই বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক নদ-নদীর বেশ কয়েকটিকে ছুঁয়ে যাওয়া সম্ভব। বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, মেঘনা, পদ্মা, ডাকাতিয়া, কীর্তনখোলা, বাঁশখালি, গাবখান নদী, সন্ধ্যা নদী, কালীগঙ্গা, কাতছা নদী, বালেশ্বর এবং পাঙ্গুচি- অন্ততপক্ষে এই তেরোটি নদীর বুক চিড়েই ঢাকা থেকে মোড়েলগঞ্জ পৌঁছায় প্যাডেল স্টিমার। কিছুদিন আগেও খুলনা পর্যন্ত যেতো এই রকেট৷ প্রায় সাতাশ ঘণ্টার সফর ছিল সেটা। নাব্যতা সংকটের কারণে রকেট স্টিমার এখন আর খুলনা পর্যন্ত না গেলেও বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত যায়৷ মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত এই প্যাডেল স্টিমারে যেতে প্রায় বিশ ঘণ্টা সময় লাগে।
বর্তমানে গোটা পৃথিবীতে খুব বেশি রকেট স্টিমার নেই। তার মধ্যে মাসহুদ, অস্ট্রিচ, লেপচা এবং টার্ন – এই ৫টি আছে বাংলাদেশে। এর প্রত্যেকটিই মাসহুদের কাছাকাছি সময়ে একই জায়গায় তৈরি হয়েছিলো। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো ‘মাসহুদ’ এবং ‘অস্ট্রিচ’৷
প্রায় শতবর্ষী পুরনো এই স্টিমারগুলোতে শুরুর দিকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হতো কয়লা। আশির দশকের শুরুতে এগুলোকে কয়লার প্যাডেল স্টিমার থেকে ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তরিত করা হয়। বড় বড় দুটি প্যাডেল দিয়ে লঞ্চটি সামনের দিকে এগোয় বলে এর অন্য নাম প্যাডেল স্টিমার। তবে রকেট স্টিমার নামেই বেশি পরিচিত এই যানবাহনগুলো। ওই সময়ে এই স্টিমারগুলোই সবচেয়ে দ্রুতগতির নৌযান ছিল, তাই নাম রাখা হয়েছিল রকেট।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
রকেটে উঠে আমরা আমাদের কেবিনের চাবি বুঝে নিলাম। সাধারণ লঞ্চে কেবিন আর নদীর মাঝখানে এক চিলতে ডেক থাকে। কেবিনে বসে সেই ডেক ছাপিয়ে নদী দেখা একটু কষ্টসাধ্যই বটে। কিন্তু রকেট স্টিমারের কেবিন থেকে সরাসরি নদী দেখা তো যায়ই, সেই সাথে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দও শোনা যায়৷ বুড়িগঙ্গার দুই ধারে রাতের ঢাকাকে অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছিল, নদীর ধারে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কারখানার ল্যাম্পপোস্টের রংবেরঙের আলোর জন্য৷
নয়টা বাজতেই স্টিমারের কেবিন বয় এসে জানালো, খাবারের অর্ডার দেওয়ার কথা। স্টিমারে দু ধরণের মিল পাওয়া যাবে। একটিতে ভুনা খিচুড়ি, ডিম আর দেশি মুরগির ঝোল। আরেকটিতে সাদা ভাত, দেশি মুরগির ঝোল, পাতলা ডাল আর সবজি। খরচ পড়বে ২০০ টাকা। শুনেছি, স্টিমারে রান্নার স্বাদ অতুলনীয়। তবে কালের আবর্তনে সেই স্বাদ কিছুটা হলেও নষ্ট হতে পারে ভেবে, খুব বেশি আশা না করেই দ্বিতীয় মেন্যুটি অর্ডার করা হলো। রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই বাটলারের সাজিয়ে দেওয়া খাবারের স্বাদ আস্বাদন করলাম। রান্না নেহাতই খারাপ না হলেও খুব আহামরি নয়। রাত এগারোটায় চাঁদপুরে পৌঁছলাম আমরা। স্টিমারে বসেই চাঁদপুরের তিন মোহনার পাড়ের বড়স্টেশন দেখা গেলো। মোলহেডের ঠিক মাঝখানে থাকা মনুমেন্ট “রক্তধারা” দেখা গেলেও, ইলিশের ভাস্কর্যটা দেখা যায়নি৷
চাঁদপুর ঘাটে অনেক যাত্রী। নামলো, আবার নতুন যাত্রী উঠলো। এর সব কিছুই আমরা আমাদের কেবিনে বসে দেখতে পেয়েছি৷ আরও ভালোভাবে দেখার জন্য বাইরে বেরিয়ে এলাম। চাঁদপুর থেকে ছেড়ে রকেট পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া তিন নদীর মিলনস্থল অতিক্রম করবে। তিন নদীর মিলনস্থল দিনের বেলায় দেখার মতো জায়গাই বটে। এখানে পানির রঙ একদম খালি চোখে আলাদা করা যায়। পদ্মার পানি একটু কালচে ধরণের, মেঘনার পানি ঘোলাটে সাদা, আর ডাকাতিয়ার পানি একদম নির্মল। প্রত্যেকটা নদী যে রয়েছে আলাদা রূপ নিয়ে ছুটে চলে, এখানে এলে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। তিন নদীর সঙ্গমস্থলে একটি প্রবল ঘূর্ণি অবিরাম পাঁক খায়৷ এই ঘূর্ণির কবলে পড়েই বহুবার লঞ্চডুবি হয়েছে এখানে। এই সময়ে দিগন্তজোড়া অথৈ জলরাশি ছাড়া কিছুই দেখা যাবে না।
আমাদের কেবিনের ঠিক পাশেই ডেকে বসার জন্য তিনটি আসন আছে। সেখান থেকেও আয়েশ করে বসে নদী ও নদীর পাড়ের জীবন দেখা যায়। রাত বাড়ার সাথে সাথেই মানুষের আনাগোনা কমতে শুরু করেছে। কেবিনের মানুষগুলো শুয়ে পড়েছে কেবিনের বিছানায়, ডেকের মানুষগুলো বিছিয়েছে সঙ্গে করে নিয়ে আসা চাদর। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে দিয়েছে নব্বই বছর পুরনো ডেকে। শুধু জেগে আছে, আমাদের মতো প্রাচীনতার মায়া খুঁজে বেড়ানো সফরকারীরা।
রাতেই দেখতে পেলাম, দু’জন বিদেশীকে। শুনেছি, বিদেশি পর্যটকদের কাছে এই রকেট সার্ভিসটি বেশ জনপ্রিয়, অনেক ভ্রমণকারী কেবল এই রকেট স্টিমারে ভ্রমণ করতেই বাংলাদেশে আসেন।
মোটামুটি সব লঞ্চের ছাদেই সাধারণ যাত্রীদের যাওয়ার সুবিধা থাকলেও, রকেট স্টিমারের ছাদে বসে রাতের নদী উপভোগ করার উপায় নেই৷ কারণ রকেটের ছাদ মানুষজন চলাচলের উপযোগী ছাদ নয়। ছোট একটা ঘর, তাতে বসে রকেট স্টিমারের কাপ্তান চালনা করেন। তার পাশে এক চিলতে দাঁড়ানোর জায়গা।
ভোরের আলো ফুটে উঠছে, এমন সময়ে সেই এক চিলতে ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম ভোর দেখবো বলে। তখন রকেট বরিশালে খুঁটি গেড়েছে। বরিশাল লঞ্চঘাটে রকেট পৌঁছেছে রাত তিনটায়, তখন থেকেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে পুরনো এই স্টিমার রকেটটি। তাই এই সময়টিই ছাদে ওঠার জন্য উৎকৃষ্ট মনে হলো।
রাত থেকে বৃষ্টি হয়েছে। শত বছরের ব্যবহারে লোহার সিঁড়িগুলো ক্ষয়ে গেছে। বৃষ্টি-ভেজা লোহার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় আমার রীতিমতো বুকে কাঁপন ধরেছিল। সাহস করে উঠেই পড়লাম, আর ঠিক তখনই রকেট বিকট হুইসেল বাজিয়ে বরিশাল ছাড়ল।
অসাধারণ এক অনুভূতি নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কীর্তনখোলা নদী। নদীর বুকে ছুটে চলা প্যাডেল স্টিমারের উপরের একচিলতে ছাদ, আর আলতো শীতের ভোর এক অদ্ভুত তৃপ্তি নিয়ে ধরা দিয়েছিল আমার কাছে।
ভোর দেখা শেষ করে নিচের ডেকে চলে গেলাম৷ ডেকের চেয়ারগুলো খালি পড়ে আছে। ওখানে বসেই দেখতে পেলাম বরিশালের ত্রিশ গোডাউনের রাস্তাটি, বদ্ধভূমি, কাশবন। খানিক পরেই এলো গাবখান চ্যানেল, গাবখান ব্রিজ। বছর খানেক আগে এই জায়গাগুলোতে আমি ঘুরে গিয়েছিলাম। স্টিমারে বসে চেনা এই জায়গাগুলো দেখতে পেয়ে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছিলো।
এই রকেট নিয়ে একটি মজার ঘটনা লোকমুখে শোনা যায়। সেসময় ইংল্যান্ডের “রিভার আর স্টিম ন্যাভিগেশন” কোম্পানির বিশাল বিশাল সব স্টিমার চলাচল করত এদেশে। একশ বছর আগে এদেশের লোকেরা এই রকেট স্টিমারে করেই কলকাতা যাওয়া আসা করতো। আমরা সবাই জানি, নদীবেষ্টিত এলাকা বলে বরিশালে কোনো রেলপথ নেই। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সেই আমলে বরিশালে রেলপথ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন এই আর এস এন কোম্পানির লোকেরা ইংল্যান্ড থেকে কলকাঠি নেড়েছিল, যাতে বরিশালে রেলপথ না আসতে পারে। কারণ বরিশালে রেলপথ এলেই তাদের ব্যবসা পড়ে যাবে। সেই থেকে আজ পর্যন্তও সারাদেশের সাথে বরিশালে রেল যোগাযোগ নেই।
কেবিনে ফিরে যাবার সময়, আমাদের কেবিনের পাশেই মার্তা আর জোজে নামের দুই বিদেশিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তারা দুজন পর্যটক পর্তুগালের অধিবাসী৷ তাদের সাথে কথা বলতেই তারা জানালো, বাংলাদেশ তাদের কাছে চমৎকার লেগেছে। এখানকার মানুষ নাকি খুবই আন্তরিক। লম্বা পরিকল্পনা নিয়ে এশিয়ায় এসেছেন এই দুজন পর্তুগিজ। শ্রীলঙ্কা, নেপাল ঘুরে বাংলাদেশ এসেছেন। এখান থেকে যশোর হয়ে ভারতে যাবেন৷ কথা বলে জানতে পারলাম, তারাও আমাদের মতোই হুলারহাট নেমে বাগেরহাট যাবেন।
দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে রকেটে ব্যস্ততা বাড়ে। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্টপেজ আসবে। বরিশালের পরে এলো ঝালকাঠি, তারপর কাউখালি। সকাল সাড়ে ১০ টায় পৌঁছে গেলো পিরোজপুরের হুলারহাট। হুলারহাটে নামার পর মার্তা আর জোজেকেও দেখতে পেলাম৷ ভাবলাম, যেহেতু একই রাস্তায় যাচ্ছি, তারা আমাদের সাথেই যেতে পারবে। তারা সানন্দেই আমাদের সাথে বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা করলো। হুলারহাট থেকে বাসে করে চলে গেলাম বাগেরহাট। বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদসহ আরো কিছু জায়গা ঘুরে বেড়ালাম এই দুজন পরবাসী নিয়ে। বিদায়ের সময় মার্তার হাতে তুলে দিলাম বাংলাদেশের পতাকা আঁকা একটি স্যুভেনির।
আর এইভাবেই আমাদের রকেট স্টিমারের ভ্রমণ শেষ হলো। এই রকেট স্টিমারগুলো পুরাতন হলেও অত্যন্ত নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য। গত ৯০ বছরে এই স্টিমারগুলো বড় ধরণের কোনো দুর্ঘটনায় পড়েনি। একদিন হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে ইতিহাস সমৃদ্ধ এই প্রাচীন বাহনগুলো। তখন আর চাইলেও এই ঐতিহ্যের স্বাদ নেওয়া যাবে না। তাই সময় থাকতেই বেরিয়ে পড়ুন একটা দিন হাতে নিয়ে, ঐতিহ্য ও ইতিহাস সমৃদ্ধ এই প্যাডেল স্টিমার ভ্রমণে।