আমরা এক অনন্য প্রজাতির প্রাণী এবং বিভিন্ন দিক দিয়ে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীগুলো থেকে বেশ আলাদা। কিন্তু মাঝেমাঝে আমরা ঠিকই নির্বোধের মতো কাজ করে বসি।
ওপরের বক্তব্যটি রেখেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মনোবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক শেষ করা জুলিয়া ওয়াটজেক। কিছুদিন আগেই তিনি একটি গবেষণাপত্রের সহ-রচয়িতা হিসেবে কাজ করেছিলেন। গবেষণাটিতে একদল বানরের বুদ্ধি খাঁটিয়ে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কেমন, তা যাচাই করে দেখা হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এই গবেষণায় একটি বুদ্ধিভিত্তিক কম্পিউটার গেমে বানরের কাছে হেরে যায় মানুষ।
মানুষ নিজেদের বুদ্ধিমত্তা যাচাইয়ের জন্য নানারকম খেলা খেলে থাকে। ইন্টারনেটের বদৌলতে ধাঁধাঁ বা পাজল জাতীয় নানা প্রকার কম্পিউটার ও মোবাইল গেম এখন হাতের নাগালেই পাওয়া যায়। আমাদের মস্তিষ্ক কত প্রখর, তা যাচাইয়ের জন্য গেমগুলো আমরা প্রায়ই খেলে থাকি। এসব গেমে মূলত নানা গাণিতিক ও বাস্তবমুখী সমস্যার সমাধান করতে দেওয়া হয়। বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে কীভাবে দ্রুত আমরা একটি নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান করি তা দিয়েই আমাদের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করা যায়।
রুবিক’স কিউবের কথাই ধরুন। একটি রুবিক’স কিউব যতই উল্টাপাল্টা করে দেওয়া হোক না কেন, নির্দিষ্ট কিছু কৌশল অবলম্বন করে এটি মেলানো সম্ভব। তবে কে, কোন কৌশল ব্যবহার করবে- তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিনির্ভর। অনেকে কেবল একটি কৌশল শিখেই তা দিয়ে এই বস্তুটি মেলাতে পারে। কিউবটি মেলানো যতই সময়সাপেক্ষ হোক না কেন, তারা শেখা কৌশলের বাইরে না গিয়ে একই উপায়ে মেলাতে থাকে। আবার অনেকে আছে, যারা এটি মেলানোর সময় ছোট ছোট কিউবগুলোর অবস্থান বিবেচনা করে এবং মাঝপথেই নিজেদের মতো করে নতুন কৌশল বের করে ফেলে; এতে করে তারা অনেকখানি সময় বাঁচিয়ে কিউবটি মিলিয়ে ফেলতে পারে।
এই যে একটি সমস্যা সমাধানের সময় একেবারে নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবন করার যে ক্ষমতা, তার একটি বৈজ্ঞানিক নাম রয়েছে। একে বলা হয় কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটি। সহজ করে বললে, কোনো সমস্যা সমাধানের সময় প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নতুন বিভিন্ন সহজ পদ্ধতি বা শর্টকাট বের করার ক্ষমতাই হলো কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটি।
বিজ্ঞানীরা মানুষ ও বানরের মাঝে মূলত এই কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটি যাচাইয়ের জন্য একটি গবেষণা করেন। উক্ত গবেষণায় ব্যবহৃত হয় একটি বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত কম্পিউটার গেম। মানুষ ও বানর উভয়কেই গেমের যাবতীয় নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
গেমটি খেলার সময় দেখা যায় যে, নানা নতুন শর্ত জুড়ে দিলে বানর নিজের মতো করে শেখানো নিয়মের রদবদল করছে। অপরদিকে নতুন কোনো শর্তের সম্মুখীন হলেও মানুষ কোনোভাবেই আগের শেখানো নিয়মের বাইরে যাচ্ছে না। যতই নতুন পরিস্থিতি তৈরি করে দেওয়া হোক না কেন, তারা সহজ উপায় অবলম্বন না করে আগে শেখানো পুরনো নিয়ম কাজে লাগিয়েই গেমটি খেলতে থাকে। মূলত এখানেই বানরের কাছে হেরে যায় মানুষ। চলুন আগে এই কম্পিউটার গেমটি সম্পর্কে আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাক।
যে কম্পিউটার গেমটি ব্যবহার করা এক্ষেত্রে, তা নিতান্ত সহজ। গেমে কম্পিউটার পর্দায় চারটি বর্গাকার বাক্স থাকে। তাদের মধ্যে একটি লাল ডোরাকাটা এবং একটি লাল ছোপ ছোপ দাগযুক্ত; অপর দুটি বাক্স সাদা রংয়ের।
খেলার নিয়ম হলো- প্রথমে ডোরাকাটা বর্গে একবার ক্লিক করতে হবে। এরপর ছোপ ছোপ গোলাকার দাগযুক্ত বর্গে ক্লিক করতে হবে। এতে সাদা রংয়ের দুটি বর্গের মধ্যে একটির জায়গায় নীল রংয়ের একটি ত্রিভুজ চলে আসবে। এই নীল ত্রিভুজে ক্লিক করলেই মানুষের জন্য ‘হুপ’ (whoop) জাতীয় একটি শব্দ তৈরি হবে। অর্থাৎ সে জিতে গেছে। আর বানর ত্রিভুজে ক্লিক করলে তাকে উপহারস্বরূপ কলা দিয়ে তৈরি এক বিশেষ খাবার খেতে দেওয়া হবে।
এই গবেষণায় ৬০ জন মানুষ, ৭টি রিসাস ও ২২টি কাপুচিন জাতের বানর অংশগ্রহণ করে। এই একই গেম তাদের বারংবার খেলতে দেওয়া হয়। আর কিছুক্ষণ পরপর গেমের দৃশ্যপটে সামান্য পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। দেখা যায় যে, আগে দুটি বর্গ ক্লিক করার পর যেই ত্রিভূজটি সামনে আসতো, এখন সেটি শুরু থেকেই পর্দায় দৃশ্যমান।
এই নতুন শর্ত আসার পরই আসলে যত গোলমালের সৃষ্টি হয়। প্রথমেই পর্দায় ত্রিভূজটি দেখে বানরগুলো আর আগের শেখানো নিয়ম অনুসরণ করে না। এরা সরাসরি ত্রিভূজে ক্লিক করে গেম জিতে যায়।
অপরদিকে সামনে আগে থেকে ত্রিভূজ দেখেও মানুষ এই শর্টকাটটা বুঝতে পারেনি। তারা প্রত্যেকবারই আগের নিয়ম অনুসরণ করে। অর্থাৎ প্রথমে ডোরাকাটা ও পরে ছোপ যুক্ত বর্গ ক্লিক করার পর ত্রিভূজে ক্লিক করে; অথচ তাদের সামনে ত্রিভূজটি কিন্তু ছিলই।
এটিই ছিল মানুষ ও বানরের মাঝে চলমান কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটির পরীক্ষা। ৬০ জন মানুষের মধ্যে মাত্র একজন এই চালাকি ধরতে পারে। আর প্রায় ৯০ শতাংশ বানর সরাসরি ত্রিভুজে ক্লিক করে। এভাবেই বানরের কাছে মানুষ হেরে যায়।
আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছে এই সামান্য একটা গেমের ফলাফল অনেক তুচ্ছ লাগতে পারে। তবে বিষয়টির গুরুত্ব নিয়ে গবেষণাপত্রে বিস্তারিত ব্যাখা করা হয়েছে।
আমরা কেন কোনো সমস্যা সমাধানের সময় প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করছি না, নতুন কৌশল প্রয়োগ করছি না, এজন্য গবেষকরা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। পাশ্চাত্যের অভ্যাসগত শিক্ষাব্যবস্থাকেই পুরো বিশ্ব অনুসরণ করে। এই শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের শেখানো নিয়মের পাশাপাশি নিজের মতো করে সহজ নিয়ম তৈরি করার রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে।
একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান শিক্ষক যে পদ্ধতিতে করে দিচ্ছেন, সবাই তা-ই অনুসরণ করছে। সমস্যাটি সমাধান করার যে আরো অনেক সহজ ও কার্যকরী পদ্ধতি বের করা যায়, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা স্বেচ্ছায় নতুন কিছু করার পরিশ্রমও করতে চায় না। এটিই ছিল এই গবেষণালব্ধ ফলাফলের মুখ্য কারণ।
২০১৮ সালে মানুষের বুদ্ধিমত্তার উপর ঠিক একই রকম একটি গবেষণা করা হয়েছিল। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের এটিও বলে দেওয়া হয় যে, তারা নিয়ম ভঙ্গ করে নতুন কিছু করার চেষ্টাও করতে পারবে। এই অনুমতি দেওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৩০ শতাংশ প্রতিযোগী প্রচলিত পদ্ধতিই অনুসরণ করে।
একই গবেষণার অংশ হিসেবে আফ্রিকা মহাদেশের নামিবিয়া দেশের হিমবা উপজাতিদের উপর পরীক্ষা চালানো হয়। যেহেতু তারা পাশ্চাত্যের শিক্ষায় পারদর্শী নয়, সেহেতু তাদের কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটি কেমন সেটিই দেখার মূল বিষয় ছিল। এই পরীক্ষায় দেখা যায় যে, ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ ঠিকই সোজা পদ্ধতি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়। কাজেই পাশ্চাত্য শিক্ষা ও কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটির মধ্যকার যোগসূত্র নিয়ে আরো বিস্তর গবেষণা করতে হবে।
আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি যে আমাদের মাঝে সৃজনশীলতার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই তর্ক-বিতর্ক চলছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে শেখানো নিয়ম বহির্ভূত, বাক্সের বাইরে চিন্তা করার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল হিসেবে আমাদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতাও লোপ পাচ্ছে।
বানর জাতীয় প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা অন্যান্য প্রাণীদের থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি। যে গবেষণার ব্যাপারে এখানে আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে বানরের কাছে হেরে যাওয়া মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো আমাদের বহুমুখী চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পাওয়ার বিষয়টি।
কম্পিউটার গেমটির বিষয়াদি বুঝতে মানুষ প্রতিযোগীর দল ঠিকই বানরদের থেকে কম সময় নেয়। তবে সমস্যা সমাধান বা প্রবলেম সল্ভিং স্কিলে যে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান নিয়মভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব ছাড়াও আরো অনেক বিষয় এর জন্য দায়ী হতে পারে। আর এই কারণগুলো উদঘাটনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন গবেষকরা।
বিজ্ঞানের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/