আগের দিনই ঘটা করে বিসিবির মিডিয়া বিভাগ জানিয়েছিল, ১১ সেপ্টেম্বর (বুধবার) বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের সংবাদ সম্মেলন। বোর্ড সভাপতির সংবাদ সম্মেলন বলে কথা, সকাল থেকেই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বিসিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ভীড়।
এদিন বোর্ড প্রধানের সঙ্গে বিসিবিতে হাজির হয়েছিলেন কয়েকজন পরিচালকও। দুপুর ২টার আগে পরিচালকদের নিয়ে বিসিবি সভাপতি চলে যান জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে। মিনিট বিশেক ক্রিকেটারদের সঙ্গে আলাপচারিতার পর ফিরে আসেন তারা। তারপর বোর্ড রুমে কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করার পর গণমাধ্যমের সামনে হাজির হন বিসিবি সভাপতি।
প্রায় ৪০ মিনিটব্যাপী সংবাদ সম্মেলনে উঠে এসেছিল অনেক বিষয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামে একমাত্র টেস্টে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের অনাকাঙ্ক্ষিত হারের প্রসঙ্গ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) কাঠামোতে বড় পরিবর্তন সংক্রান্ত ঘোষণা এবং সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে অনীহার প্রসঙ্গই ছিল মূল আলোচ্য।
বিসিবির নিজস্ব অর্থায়নে ‘বঙ্গবন্ধু বিপিএল’
বিপিএলের ষষ্ঠ আসর শেষ হয়েছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে পিছিয়েছিল ষষ্ঠ আসর। বিসিবি ঘোষণা দিয়েছিল, সপ্তম আসর অনুষ্ঠিত হবে একই বছরের ডিসেম্বরে। ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে চুক্তির কথাও বলেছিল বিসিবি। কিন্তু একই বছরে দু’টি বিপিএল খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি। তাই বিপিএল আয়োজন নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি হয়েছিল।
এদিন বিসিবি সভাপতি সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে। ডিসেম্বরেই বিপিএল আয়োজন করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। নতুন আঙ্গিকে হবে এবারের বিপিএল, থাকবে না ফ্র্যাঞ্চাইজিদের অংশগ্রহণ। আগামী বছরই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী। তার আগেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিপিএল আয়োজন করছে বিসিবি। এবারের বিপিএলের নাম হবে ‘বঙ্গবন্ধু বিপিএল’, যার পুরো অর্থায়ন করবে বিসিবি।
নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন,
‘এবারের বিপিএল বিসিবি নিজেরাই চালাবে। আমরা কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিতে যাচ্ছি না। আগামী বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। তার নামে আমরা ‘বঙ্গবন্ধু বিপিএল’ চালাব। এবার আমরা কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিতে যাচ্ছি না। বিপিএলের ম্যানেজমেন্ট বিসিবি। ক্রিকেটারদের খাওয়া-দাওয়া, টাকা-পয়সা, সব আমরা দেখব। এতে সবাই খুশি হবেন। যারা খেলতে চাননি, বা যারা বলেছেন, আর্থিক ক্ষতি হবে, এবার তারা খুশি হবেন। আমরা ঠিক করেছি, আমরাই চালাব। দলগুলোর মালিকানা সব বিসিবির থাকবে।’
ফ্র্যাঞ্চাইজিরা থাকলেও দলগুলোর জন্য স্পন্সর নিবে বিসিবি। বোর্ড সভাপতি বলেছেন,
‘যদি কোনো স্পন্সর আসে, তার নামে যাবে। প্লেয়ারদের পেমেন্ট সব কিছু বিসিবি করবে। সব আমরা দেব। তবে যদি টিম স্পন্সর নেই, তাহলে তারা কিছু কিছু করতে পারবে। যদি তারা ডিরেক্ট সাইন করে বিদেশি কিছু খেলোয়াড় আনতে চায়, তারা আনতে পারবে। নিতে চাইলে নিতে পারবে। কোনো দল যদি আরও দামী কোচ আনতে চায়, আনতে পারবে। এই সুযোগ তাদের দেওয়া হবে।’
প্লেয়ার্স ড্রাফট হলেও দলগুলো বিসিবিই গঠন করে দেবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় এবারই শুধু বিপিএল করবে বিসিবি। সবকিছু ঠিক থাকলে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সঙ্গে আগামী বছর নতুন করে চুক্তি করবে বিসিবি।
রেভিনিউ শেয়ার করবে না বিসিবি
সপ্তম আসরের আলোচনা শুরু হতেই বিপিএলের কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের দাবি জানিয়ে আসছিল বিসিবির কাছে, যেমনটা আইপিএলের দলগুলো পেয়ে থাকে। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি সভাপতি রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের দাবি পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন।
নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন,
‘রেভিনিউ শেয়ারিং করা সম্ভব নয়। আমাদের ৮০ কোটি টাকা দিক, আমরা ৪০ কোটি দিয়ে দেব। ৮ কোটি টাকা করে নিত। আমরা সাত কোটি ছেড়েই দিয়েছি, মাত্র এক কোটি নিচ্ছি। আবার কী চায়! একটা জিনিস মনে রাখবেন, আমরা কী চাই। আমরা চাই, যারা বিপিএলে আসবে, তারা বিপিএলে খেলার উন্নয়ন, খেলোয়াড়ের উন্নয়নের জন্য আসবে, ব্যবসা করার জন্য নয়। এখানে সেই সুযোগ নেই।’
তখনই পাল্টা প্রশ্ন ছিল, এমন করে চিন্তা করলে বিপিএলের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার! যদিও বিসিবি সভাপতি এই কথার সঙ্গে একমত নন। পাপন বলেছেন,
‘অন্ধকার কেন? আমরা চালাব। বিসিবি চালাতে পারবে না? শুনেন, লস যদি হয়, তাহলে ৮০ লাখ টাকার খেলোয়াড়কে ৪ কোটি টাকা দিয়ে কেউ নিত না। এই যেগুলো করছে, বেআইনিভাবে কত দাম দিয়ে নিচ্ছে, তা আপনারা জানেনও না। খোঁজ নিয়ে দেইখেন। লস হলে তো কেউ এত টাকা নেয় না। নিশ্চিত অনেক লাভ করে, আরও লাভ করতে চায়।’
নেতৃত্বে ও টেস্টে আগ্রহ নেই সাকিবের
২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টেস্ট সিরিজ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। এর আগেও কয়েকবার বিসিবি সভাপতির মুখ থেকেও বের হয়েছিল টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি সাকিবের অনাগ্রহের বিষয়টি।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি নেই তার। নেতৃত্ব দিতেও চান না তিনি। এছাড়া আফগানিস্তানের কাছে টেস্টে হারের পরও সংবাদ সম্মেলনে সাকিব বলেছেন, অধিনায়কত্ব না করতে হলেই তার জন্য ভালো।
বারবারই বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেয়ার প্রতি নিজের অনীহার কথা বলেছেন বিশ্বসেরা এই বাঁহাতি অলরাউন্ডার। তারপরও টনক নড়ছে না বিসিবির।
সংবাদ সম্মেলনে এই প্রসঙ্গ উঠতেই বিসিবি সভাপতি বলেছেন, সংবাদমাধ্যমে সাকিবের এ ধরনের বক্তব্য দেখেছেন তারা। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে বিসিবিকে এমন কিছু বলেননি তিনি। তাই সাকিবের বক্তব্যের অপেক্ষায় আছে বিসিবি। এবং টেস্টের প্রতি এই বাঁহাতি অলরাউন্ডারের অনীহা নাকি আগে থেকেই।
সাকিবের অধিনায়কত্বের অনাগ্রহ নিয়ে পাপন বলেছেন,
‘এটি ঠিক যে, আমরা দেখছি টেস্টের ব্যাপারে বেশ কিছুদিন থেকে ওর আগ্রহ তেমন নেই। বিশেষ করে আমাদের বাইরে যখন দলগুলো যাচ্ছিল, তখন টেস্টের সময় সে একটু বিরতি চায়। স্বাভাবিকভাবেই ওর হয়তো আগ্রহটা কম, তবে অধিনায়কত্ব নিয়ে কখনো শুনিনি, আমরা কখনো শুনিনি যে অধিনায়কত্ব নিয়ে ওর আগ্রহ কম আছে।’
বিসিবি সভাপতি আরও বলেছেন,
‘ও অনেক সার্ভিস দিয়েছে, আমরা মনে করি, সে হলো সেরা অধিনায়ক। আমাদের হাতে যে অপশন আছে, তাদের মধ্যে থেকে সে-ই সেরা। এখন পর্যন্ত সে আমাদের কিছু বলেনি, মিডিয়াতে বলেছে যে, যদি থাকি কিংবা বোর্ডের সঙ্গে কথা বলতে হবে, এই ধরনের একটি কথা। আমি গতকাল ওর সঙ্গে বসেছিলাম, কিন্তু সেখানে এমন কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। যেহেতু এখন একটি সিরিজ চলছে, আমার মনে হয়, এখনই এটি নিয়ে কথা বলা উচিত। ও যদি প্রসঙ্গ উঠাত, তাহলে অবশ্যই আলোচনা করতাম।’
সাকিব আবেগী হয়েও এমন কথা বলতে পারেন মনে করেন বিসিবি সভাপতি। পাপন বলেছেন,
‘ও (সাকিব) আমাদের সঙ্গে যখন বলবে, তখন ফরমালি বলব। হয় কি, মন খারাপ থাকে তো। ও তো আগে কয়টা টেস্টে যায়ও নাই। এসে হঠাৎ করে আফগানিস্তানের সঙ্গে হারল, আর আমাদের ছেলেরা তো একটু আবেগী। ঠান্ডা মাথায় যা বলার বলব, যদি সে বলে।’
আফগানদের কাছে টেস্টে হারে হতাশ নন পাপন
চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলেছে ১১৫তম টেস্ট, যেটি ছিল আফগানদের তৃতীয় টেস্ট। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে নবীন আফগানরাই চট্টগ্রামে নাস্তানাবুদ করেছে সাকিব আল হাসানের দলকে। হোম কন্ডিশনে বাংলাদেশকে ২২৪ রানে হারের লজ্জায় ডুবিয়েছে রশিদ খানের দল। ম্যাচজুড়ে আধিপত্য ছিল আফগানদের। ব্যাটে-বলে পাত্তাই পায়নি স্বাগতিকরা।
ক্রিকেটমোদীরা এই হারকে দেখছেন দেশের ক্রিকেটের কালো অধ্যায় হিসেবে। ব্যথিত, পীড়িত সমর্থকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
যদিও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন মনে করেন, দুঃখজনক হলেও আফগানদের কাছে এই হারে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটিই সবচেয়ে কষ্টের ঘটনা নয়।
টেস্টে আফগানদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দলের অনাকাঙ্ক্ষিত হার প্রসঙ্গে বিসিবি সভাপতি বলেছেন,
‘এই টেস্ট ম্যাচটি হেরেছি, এটি আসলেই দুঃখজনক। এমন কষ্ট এর আগেও আমরা পেয়েছি। তবে এটাই কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে কষ্টকর নয়। এই ক্রিকেটে আমরা যেমন অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি, খুশি হয়েছি, তেমন অনেকবার কষ্ট পেয়েছি। এটি কিন্তু সব থেকে কষ্টের নয়।’
তবে এখনই হতাশ হতে চান না বিসিবি সভাপতি। তিনি বলেছেন,
‘অনেক বেশি কষ্ট লেগেছে, অত্যন্ত খারাপ লেগেছে। কিন্তু তাই বলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’
ব্যাটসম্যানরা রান না করতে পারলে কোনো দেশের সঙ্গেই জেতা সম্ভব নয় উল্লেখ করে বোর্ড সভাপতি বলেছেন,
‘কোনো দেশের সঙ্গেই আমরা যদি ২০০ রানও করতে না পারি এক ইনিংসে, তাহলে জিততে পারব না, এটি ধরে নিতে হবে। ১৭০ আর ২০০ রান করে টেস্ট ম্যাচ জেতা সম্ভব নয়। পারিনি, যদি করতে না পারি, তাহলে এমনই হবে।’
বিসিবি সভাপতি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, চট্টগ্রাম টেস্টের ম্রিয়মান পারফরম্যান্সই বাংলাদেশ দলের আসল ছবি নয়। নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন,
‘আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের এই অবস্থা না। এটি আমাদের আসল চিত্র না।’
টেস্টে বড় রান পাননি মুশফিক। ব্যাট হাতে ব্যর্থ ছিলেন মাহমুদউল্লাহরা। অথচ তারাই ছিলেন দলের ব্যাটিংয়ের মূল ভরসা। বিসিবি সভাপতি মনে করেন না, মাহমুদউল্লাহ’রা শেষ হয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন,
‘হয়তো অনেকেই ভাবছেন যে, তারা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু না, আমি এখনো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে, তামিম, সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ এরা যেকোনো দলের বিরুদ্ধে, যেকোনো বোলারের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করতে পারে।’
গত কয়েক বছরে দেশের মাটিতে বাংলাদেশ টেস্টে হারিয়েছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে। আফগানদের কাছে সাকিবদের হারকেও এভাবেই দেখতে চান বিসিবি সভাপতি। তিনি বলেছেন,
‘আমরা যখন ইংল্যান্ডকে টেস্টে হারিয়েছি, অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারিয়েছি, ঐ সময়ে আমরা ছিলাম টেস্টের তলানিতে। এরপর ওপর সারির দলগুলো যখন আমাদের কাছে হেরে গেছে, ওরা শেষ হয়ে যায়নি। ইংল্যান্ড এবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এত হতাশ হওয়ার কিছু দেখছি না আমি। পারফর্ম করতে হবে, এবং আমি বিশ্বাস করি, আমাদের ছেলেদের সেই প্রতিভা আছে।’
অধিনায়কের পছন্দেই টেস্টে পেসারহীন একাদশ
চট্টগ্রামে স্পিন-নির্ভর বোলিং আক্রমণ নিয়ে টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। দলে তিনজন পেসার রাখা হলেও কারোরই একাদশে সুযোগ হয়নি, এবং এই সিদ্ধান্তটা শুধুই অধিনায়ক সাকিবের। বিসিবি সভাপতি বলেছেন,
‘এইগুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির মানে নেই। যখনই খেলা হয়, মাশরাফি বলে, আমি চারজন পেসার নিয়ে খেলব। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাকে তিনজন পেসার দেওয়া হয়। ও বলবে, পেসাররাই আমাদের সব ম্যাচ জেতায়। সাকিবকে জিজ্ঞেস করেন, সাকিব বলবে, সব স্পিনার নিয়ে খেলব, স্পিনাররাই তো জেতায়। কেউ ভুল বলে না। এমনটা হতেই পারে। পেসার-স্পিনার এসব কোনো কথা না। আমাদের দলে বিশ্বের সেরা স্পিনাররা আছে। অনেকগুলো ভালো ভালো পেসার আছে। বিশ্বের নামীদামী র্যাঙ্কিং-সেরা কিছু দল হারিয়েছি আমরা।’